অলিম্পিক বিস্ময় by ফারজানা আক্তার সাথী

রেকর্ড দিয়েই শুরু। বিশ্বে একমাত্র শহর লন্ডন, যারা তিনটি অলিম্পিক আসরের আয়োজকের ইতিহাস গড়েছে। ক’দিন আগেই হয়ে গেল নয়নাভিরাম উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, যা বিশ্বকে মাত করে দিয়েছে। অনেকের মতে, বেজিংয়ের মতো জমকালো না হলেও লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হৃদয় ছুঁয়ে গেছে সবার।


ড্যানি বয়েলের পরিচালনায় মনোমুগ্ধকর ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা লন্ডন অলিম্পিককে দিয়েছে আলাদা বিশেষেত্ব। চার বছর আগে যেটি ছিল না সর্বকালের সেরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানখ্যাত বেজিং অলিম্পিকেও। খুব বেশি বাহারি নয়, তবে বাস্তবসম্মত ভিন্ন ধাচের অনুষ্ঠান আসলেই মাতিয়েছে পুরো বিশ্বকে। লন্ডন অলিম্পিক পার্কের স্টেডিয়ামে এই অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছেন প্রায় ৮০ হাজার দর্শক। আর টিভি পর্দায় প্রায় ১০০ কোটি।
তবে বাজিমাত করেছেন ড্যানি বয়েল। সøামডগ মিলিনিয়রের অস্কার জয়ী এই পরিচালক প্রত্যাশার চেয়েও বেশি মুগ্ধতা তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন পুরো বিশ্বে। কি ছিল না উদ্বোধনীতে, জেমস বন্ডখ্যাত ড্যানিয়েল ক্রেইগের সঙ্গে ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথের এক কল্পচিত্র, হাসির ফোয়ারা ছুটিয়েছেন মিস্টার বিনখ্যাত রোয়ান এ্যাটকিনসন, জেকে রাওলিংয়ের সৃষ্টি হ্যারি পটার আর তাঁর শুত্রু লর্ড ভলডারমটের লড়াই থেকে শুরু করে ব্রিটেনের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য। অদ্ভুত আকারে সজ্জিত স্টেডিয়ামের মাঝে হঠাৎ উপস্থিত বিখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। সঙ্গে ছিল তাঁর কালজয়ী নাটক ‘দ্য টেমপেস্ট’-এর ছোট্ট একটি অংশ। এছাড়া জেরুজালেম, ড্যানি বয়, ফ্লাওয়ার অব স্কটল্যান্ড ও ব্রেড অব হেভেনÑ এই মন মাতাল করা চারটি গানের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয় গ্রেট ব্রিটেনের চার দেশ ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের প্রাচীন ঐতিহ্যকে। এছাড়া মার্চপাস্টসহ আরও কত কি?
লন্ডন অলিম্পিক পার্কে স্থানীয় সময় রাত আটটায় শুরু হয় কাক্সিক্ষত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘণ্টাটি বাজানোর পরই শুরু হয় সব কার্যক্রম। ঘণ্টাটি বাজালেন খ্যাতিমান সাইক্লিস্ট ব্রাডলি উইগিন্স। কি ছিল না উদ্বোধনীতে। তবে বেশি বিস্ময় ছড়িয়েছে ড্যানি বয়েলের পরিচলানায় যুক্তরাজ্যের হাজার বছরের পটভূমিতে নির্মিত ‘বিস্ময়ের দ্বীপ’। যেখানে দেখা যায় গ্রামীণ চিত্র। এতে ব্যবহৃত হয় খামারের সত্যিকারের গবাদিপশু। চিত্রিত হয় একটি গ্রামীণ ক্রিকেট ম্যাচও। দেখানো হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের শিল্প-বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায়। পেছনে পড়ে থাকেননি জেমস বন্ডও। এতে দেখানো হয় জেমস বন্ড বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে রানী এলিজাবেথকে নিয়ে হেলিকপ্টারে চড়ে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে প্রবেশ করছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কাহিনীচিত্রে রানী এলিজাবেথ জেমস বন্ডকে পেছনে ফেলে আগেই প্যারাসুটে করে স্টেডিয়ামে লাফিয়ে পড়েন, যা বাড়তি আনন্দ দেয় দর্শকদের। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কোরিওগ্রাফার আকরাম খানের নেতৃত্বাধীন একটি দল তুলে ধরে মানুষের জীবন-সংগ্রামকে। এরপরেই শুরু হয় অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর এ্যাথলেটদের বর্ণাঢ্য মার্চপাস্ট। নিয়ম অনুযায়ী সবার আগ আসে গ্রীস। তারপর এ থেকে জেড পর্যন্ত বর্ণানুক্রমে আসে ২০৪টি দেশ। অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মার্চপাস্টে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বহন করেন সাতারু মাহফুজুর রহমান। গ্যালারি থেকে বাংলাদেশ দলকে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। মার্চপাস্টের পর দেখানো হয় ১৮৯৬ সালে প্রথম অলিম্পিকের মশাল প্রজ্বলনের দৃশ্য। এবারই অতীতের নিয়ম ভেঙ্গে এবারের অলিম্পিক মশাল প্রজ্বলন করেন ব্রিটেনের সাতজন তরুণ ক্রীড়াবিদ। আগে নিয়ম ছিল, সেই মশাল প্রজ্বলন করবেন, যিনি অতীতে অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতেছেন। এবার তার ভিন্নতা দেখা গেল লন্ডনে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রায় ১৫ বিলিয়ন পাউন্ড খরচ করতে হয়েছে আয়োজক ব্রিটেনকে। এটি লন্ডনের রেকর্ড তৃতীয় অলিম্পিক আয়োজন। এর আগে ১৯০৮ ও ১৯৪৮ সালে অলিম্পিক আয়োজন করেছিল লন্ডন।
শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন লন্ডন গেমস আয়োজক কমিটির চেয়ারম্যান সেবাস্তিয়ান কো। পরে আইওসির প্রেসিডেন্ট জ্যাক রগ তার বক্তব্যে বলেন, ‘অলিম্পিক আয়োজনে লন্ডনের শত বছরেরও বেশি সময়ের ঐতিহ্য আছে।’ প্রাচীন এই নগরবাসীদের ধন্যবাদ জানান আইওসি প্রেসিডেন্ট। তিনি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে, ‘হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবীর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তারা এ সময়ের সেরা, মেধাবী এবং জ্ঞানী।’ প্রথমবারের মতো অলিম্পিক সদস্যভুক্ত সকল দেশ থেকে নারী ক্রীড়াবিদ অংশগ্রহণ করায় তিনি আনন্দ প্রকাশ করেন। অলিম্পিক পতাকা বহন করেন ডরিন লরেন, হাইলে জেব্রেসেলেসি, সেলি বাকের, সমি চক্রবর্তী, ড্যানিয়েল ড্যারেন বোয়িন এবং ব্রাজিলিয়ান পরিবেশবিদ মারিনা সিলভা। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ছিলেন এই দলে। পরে আসেন কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলী। ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ অলিম্পিকের ৩০তম আসরের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
শুক্রবারের নয়নাভিরাম উদ্বোধনের পর তাই বিশ্ব মিডিয়া লন্ডনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অস্ট্রেলিয়ান সংবাদ মাধ্যম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে একবাক্যে উল্লেখ করেছে, ‘আবেগী, ফাটাফাটি, ব্রিটিশ ছন্দ।’ সিডনি মর্নিং হেরাল্ড লিখেছে, ‘বয়েলের সাবলীল আর হৃদয় কাঁপানো অভিনয়শিল্প উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করেছে পুরোদমে, যা কিছুটা আতঙ্কও ছড়াল আগামী ২০১৬ রিও ডি জেনিরো অলিম্পিককেও। লন্ডন থেকে তাদের শিক্ষা নিতে হবে।’ বয়েলের প্রশংসা করে তারা আরও লিখেছে, ‘তার নয়ন জুড়ানো প্রদর্শনী ছিল দেখার মতো, যা ছিল না গতানুগতিক। খুব সাধারণভাবে দারুণ কিছু উপহার দিয়েছেন তিনি। এটা ছিল একধরনের চালাকি, তবে অতি স্মার্টনেস নয়।’ শুধু সিডনি মর্নিং হেরাল্ড নয়, পুরো অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়াতে দেখা গেছে লন্ডনের প্রশংসা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমেও প্রশংসার ঢেউ লেগেছে লন্ডন নিয়ে। দি নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ‘কল্পনাপ্রসূত জিনিস বাস্তবে যেন জ্বলজ্বল করছিল। সত্যিই অসাধারণ। কোলাহলপূর্ণ, ব্যস্ত, বিদগ্ধ আর হতবিহ্বল করার মতো প্রডাকশন ছিল এটি।’ দি জার্নাল লিখেছে, ‘চার ঘণ্টার দীর্ঘ প্রদর্শনীতে ব্রিটিশরা দেখিয়েছে তাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্য।’ নিজেদের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত ব্রিটিশ মিডিয়াও। ডেইলি টেলিগ্রাফ লিখেছে, ব্রিলিয়ান্ট, রুদ্ধশ্বাস, হৃদয় কাঁপানো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।’ ডেইলি মেইল এককথায় লিখেছে ‘ব্লাস্ট অফ’। ইতালির গাজেত্তা দেল্লো স্পোর্ত লিখেছে, ‘ব্যয়বহুল আর দর্শনীয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রত্যাশা পূরণ করে সম্ভবত প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে।’ ফ্রান্সের লেকিপ লিখেছে, ‘আড়ম্বরের সঙ্গে রসবোধ মিশিয়ে ড্যানি বয়েল এ্যাথলেটদের চিরাচরিত ঐতিহ্যবাদী মাঠ প্রদক্ষিণকে আধুনিক করে তুলেছেন।’ জার্মানির বিল্ড লিখেছে, ‘বিশাল জাঁকাল এক অনুষ্ঠান।’ দুর্দান্ত। যুক্তরাষ্ট্রের স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড লিখেছে, এই অনুষ্ঠান ছিল, ‘লাউড এ্যান্ড প্রাউড।’ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস লিখেছে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো আ ফ্লাইং স্টার্ট।’ অনুষ্ঠানটির নাম ‘আইলস অব ওয়ান্ডার’ অনুকরণে দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে ‘নাইট অব ওয়ান্ডার’। সান একটু ঘুরিয়ে লিখেছে ‘গোল্ডেন ওয়ান্ডার’। জেমস বন্ডের সঙ্গে রানীর অভিনয় প্রসঙ্গে সবচেয়ে ভাল শিরোনাম অবশ্য দিয়েছে জার্মানির ডাই ওয়েল্ট, ‘নতুন বন্ডকন্যার বয়স এখন ৮৬ বছর।’
বর্ণাঢ্য আয়োজন, প্রশংসার ফুলঝুড়ি। এজন্য লন্ডনকে কম কষ্ট করতে হয়নি। অনুষ্ঠানকে মনোমুগ্ধকর করতে আয়োজকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছিল। প্রতিটি ইভেন্ট প্রাণবন্ত করতে কত না ঝামেলাই তৈরি হয়েছিল তাদের। আয়োজনের ফিরিস্তি একনজরে দেখলেই বুঝতে পারবেন তা। যে মঞ্চে উদ্বোধন হয়েছিল, তার আকার ছিল ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার, যা ১২টি অলিম্পিক সাঁতার পুলের সমান। উদ্বোধনীতে মোট স্বেচ্ছাসেবী ছিল ৭ হাজার ৫০০। এঁদের মহড়া হয়েছে ২৮৪ বার। শিশুশিল্পী নেয়া হয়েছে ২৫টি স্কুল থেকে। ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের আনা হয়েছে ৬টি কলেজ থেকে, এরা ৫০টিরও বেশি ভাষায় কথা বলতে পারে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখতে পেয়েছেন নানা প্রজাতির পশুপাখি। এর মধ্যে ছিল ৪০টি ভেড়া, ১২টি ঘোড়া, ৩টি গরু, ২টি ছাগল, ১০টি মুরগি, ১০টি হাঁস, ৯টি রাজহাঁস, ৩টি ভেড়া খেদানো কুকুর। এসব পশুপাখির দেখাশোনার জন্য ছিল ৩৪ জন। সাউন্ডের জন্য স্পিকার ব্যবহার করা হয়েছে মোট ৫০০টি। প্রতিটা দর্শক আসনের পাশে লাগানো ‘অডিয়েন্স পিক্সেল’ ছিল প্রযুক্তি ব্যবহারের অভিনব ধারণা। ৭০ হাজার ৭৯৯টি প্যানেল ছিল গ্যালারিজুড়ে। প্রতিটা প্যানেলে ছিল নয়টি এলইডি লাইট। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ এলইডি লাইট ছিল। কেন্দ্রীয় একটি কম্পিউটার দিয়ে এই লাইটগুলোর আলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। স্টেডিয়ামের মাঝখানে যে চারণভূমি ছিল তার আয়তন ছিল ৭ হাজার ২৪৬ বর্গমিটার। সত্যিকারের উপকরণ দিয়েই বানানো হয়েছিল এটি। ব্রিটেনের শিশু সাহিত্য ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখা দুই প্রতিষ্ঠানকে সম্মানিত করতে বিশেষ একটি অংশ ছিল অনুষ্ঠানে। এই পর্বে ব্যবহার করা হয়েছে ৩২০টি বেড। এই পর্বের নাচে অংশ নেয়া ৬০০ শিল্পীর প্রত্যেকেই ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের কর্মী। উদ্বোধন শুরু হয়েছিল যে বিশাল ঘণ্টা বাজানোর মধ্য দিয়ে, তার ওজন ছিল ২৩ টন। একটি বিশেষ পর্ব ছিল যেখানে পরোক্ষভাবে পৃথিবীর সব মানুষই ছিল অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। একটি হেলিকপ্টারে করে স্টেডিয়ামে ফেলা হয়েছিল কাগজের ৭০০ কোটি টুকরো। প্রত্যেকটি টুকরো বিশ্বের একেকটি মানুষের প্রতিনিধি! এর আগে ১৯০৮ ও ১৯৪৮ সালে অলিম্পিক আয়োজন করেছিল লন্ডন। আধুনিক সময় এই প্রথম, যা লন্ডনকে নতুন করে চেনাল বিশ্বময়।
উদ্বোধনীতে নানা চমক। আগামী ১২ আগস্ট সমাপনীতে কী চমক দেবে লন্ডন। তার অপেক্ষায় এখন সবাই।

No comments

Powered by Blogger.