পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে অন্য জাতিগোষ্ঠী? by আবু এন এম ওয়াহিদ
আমার আজকের এ লেখার একটি যোগসূত্র বা ছোট্ট ইতিহাস আছে। শিরোনামের বিষয়টি যেমন পাঠকদের কাছে কৌতূহল সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি আমার দৃঢ়বিশ্বাস নিবন্ধটি কেন লিখছি, সেটাও তাদের কাছে একটি আগ্রহের বিষয় হতে পারে। আর তাই ঘটনাটি সংক্ষেপে খুলে বলছি।
বেশ কিছুদিন আগে, 'হিলারির মমতা-দর্শন' নামে আমার একটি কলাম ঢাকার এক দৈনিক কাগজে ছাপা হয়েছিল। লেখাটি পড়ে একজন বোদ্ধা পাঠক আবেগমাখা মন নিয়ে একটি দীর্ঘ চিঠি টাইপ করে স্ক্যান কপি ই-মেইলে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। চিঠিটি পড়ে আমি যত দূর বুঝেছি, তাঁর মূল বক্তব্য এ রকম- 'বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিকভাবে একটি সরকারকে নির্বাচিত করার পর পরই সরকারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ একেবারে হারিয়ে ফেলে। আবার কিছুদিন যেতে না যেতে একইভাবে সরকারও তার বশংবদ পেয়ারা বান্দাদের কোনো কথাই শোনাতে পারে না। তার ওপর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং জনগণের সমস্যার কথা ভুলে গিয়ে নিতান্তই দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, অর্থাৎ জনগণ সরকারের ওপর শুধু আস্থাই হারায় না, বরং রীতিমতো ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী নির্বাচনে অন্য দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে আবার দেয়ালে মাথা ভাঙার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ না হয় একটি পিছিয়ে পড়া গরিব দেশ, সুতরাং এখানে এটা মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায়ও কেন এমন দেখা যায়? তারা তো উন্নত, ধনী এবং তাদের রয়েছে শত শত বছরে গড়ে ওঠা মজবুত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তারা কেন এমন করে? অর্থাৎ তাদের সরকারগুলো যখন অযৌক্তিক কারণে বিদেশের মাটিতে গিয়ে বছরের বছর ধরে যুদ্ধ করে, মানুষ মারে, ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, সমাজ, সভ্যতা এবং অর্থনীতিকে ক্ষত-বিক্ষত করে, তখন তাদের জনগণের বিবেক কোথায় যায়? তারা কেন প্রতিবাদ করে না? তারা কেন তাদের সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোকে এ ধরনের অনৈতিক ও অমানবিক কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না? সমস্যাটা কোথায়?'
সম্মানিত পাঠকের চিঠি পাওয়ার পর অনেক দিন ধরে আমার মাথায় তাঁর প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি ভাবছি; কিন্তু কোনো জুতসই উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না, আর তাঁর চিঠির জবাবও দেওয়া হচ্ছে না।
এমনি অবস্থায় গতানুগতিক ধারায় ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে গিয়ে হঠাৎ সেদিন একটি বইয়ের কমার্শিয়াল ভেসে উঠল আমার কম্পিউটারের স্ক্রিনে। One Hundred Great Inventions that Changed the World. অর্থাৎ '১০০টি মহা আবিষ্কার যা কিনা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে'। কারসার ঘুরিয়ে বইয়ের কাভারের ওপরে, আশপাশে, ডানে-বাঁয়ে মাউস ক্লিক করলাম অনেকবার, কিন্তু বইখানা খুলতে পারলাম না। তাই জানা হলো না ওই মহা আবিষ্কারগুলো কী কী। অন্ধের মতো আরো কিছু কসরত করার পর ঢুকে পড়লাম একটি ওয়েবসাইটে, যার নাম www.independent.co.uk। এখানে পেলাম ১০১টি মহা আবিষ্কারের একটি দীর্ঘ তালিকা, যেখানে আমাদের আদি পিতা-মাতা আদম-হাওয়া থেকে শুরু করে বিল গেটস পর্যন্ত সবার উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারগুলো যত্নসহকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ তালিকাটি আবিষ্কারের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব এবং তাদের আর্থিক তাৎপর্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়নি। এতে অধিক গুরুত্ব পেয়েছে সেই সব আবিষ্কার, যেগুলো সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে খুবই প্রয়োজনীয় এবং যেগুলো যুগ যুগ ধরে মানুষের জীবনকে করে তুলেছে সহজ, সহনীয় ও আরামদায়ক। এসব আবিষ্কার ছাড়া আজকালকার জীবন একেরাইে অচল। এখানে দেখতে পেলাম অনেক সুন্দর সুন্দর নাম, অবাক করা তথ্য-উপাত্ত, যা পড়লে আমার বিশ্বাস পাঠকরা বিরক্ত হবেন না। যদি কেউ হয়ে থাকেন, তাহলে আগেই তাঁর কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি। এই ১০১টি আবিষ্কারের মধ্যে সাতটি প্রাগৈতিহাসিক যুগের। কবে, কোথায়, কোন দেশে, কে বা কারা এগুলো উদ্ভাবন করেছে তার কোনো হদিস নেই। এই সাতটি হলো- আগুন, তীর-ধনুক, মাছ ধরার বড়শি, ছোটখাটো যন্ত্রপাতি (হাঁড়ি-পাতিল, দা, কুড়াল, ছুরি-কাঁচি ইত্যাদি), চাকা, দাঁড়িপাল্লা, তালা-চাবি। পাঠকরা এখানে ভেবে দেখুন, আধুনিক যুগের বিচারে এর কোনোটিই হয়তো খুব একটা বিশাল, জটিল বা কঠিন কিছু নয়; কিন্তু এগুলো ছাড়া কি এক দিনের জন্যও মানবজীবন চিন্তা করা যায়! আগুন যদিও আবিষ্কার হয়েছে লাখ লাখ বছর আগে; কিন্তু সহজে ও নিরাপদে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন জ্বালানো শুরু হয়েছে মাত্র সেদিন, ১৮২৭ সালে। আবিষ্কার করেছেন একজন ব্রিটিশ ফার্মাসিস্ট। আগুন থেকে দিয়াশলাই আলাদা করে রাখলে চলে গেল সাতটি আবিষ্কার। ১০১-এর মধ্যে বাকি রইল ৯৪টি।
এই ৯৪-এর মধ্যে একেবারে সাধারণ জিনিস, হালের লাঙল, ঢাকঢোল, ছাতা, চায়ের কেটলি, বোতাম, জিপার, ভেলক্রো, পোস্ট ইট নোট, লেড পেনসিল, ইরেজার, রাবার বেন্ড, পেপার ক্লিপ, সেলোটেপ, বলপয়েন্ট কলম, টুথব্রাশ, ফ্লাশিং টয়লেট ইত্যাদি থেকে শুরু করে ক্যামেরা, ক্যামকর্ডার, নিনটেন্ডো গেম, বার কোড, ব্ল্যাকবেরি, মোবাইল ফোন, রিমোট কন্ট্রোল, মাউস, পিসি, ল্যাপটপ- সবই আছে। এর মধ্যে দেখা যাক জাতি হিসেবে কার অবদান কী। কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইরানের আছে একটি করে আবিষ্কার। কানাডার অবদান রিসার্চ ইন মোশন কম্পানির উদ্ভাবন- অত্যাধুনিক ব্ল্যাকবেরি, কোরিয়ানদের গৌরব জেনিথ ইলেকট্রনিকস কম্পানির আবিষ্কার টিভি রিমোট কন্ট্রোল এবং ইরানের অবদান ফ্রিজ। বর্তমানে আমরা যে ফ্রিজ ব্যবহার করি, তার আবিষ্কারের সমান দাবিদার স্কটিশ, জার্মান এবং আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু এর সবচেয়ে মৌলিক উপাদান রেফ্রিজারেটেড কয়েল, যা প্রথম তৈরি করেন পারসীয় বিজ্ঞানী ইবনে সিনা। ইরাকের নিজস্ব আছে দুটি অবদান- হালের লাঙল, ঢাকঢোল এবং তৃতীয়টি অর্থাৎ রোবটে তাদের অবদান আছে মিসর ও ইতালির সঙ্গে শরিক হয়ে এবং চতুর্থটি অর্থাৎ কনডম তাদের অবদান ইতালি ও মিসরের সঙ্গে যৌথভাবে। জাপানিদের গৌরব দুটি- তারা বের করেছে নিনটেন্ডো গেম বয় এবং ক্যামকর্ডার। মিসরীয়দের আছে ছয়টি আবিষ্কার। তার মধ্যে দুটি তাদের একক কৃতিত্ব, যেমন- ক্লক ওয়ার্ক রেডিও ও পকেট ক্যালকুলেটর। বাকি যে চারটিতে আছে, তাদের শরিকি অবদান, সেগুলো হলো- কনডম ও রোবট (ইতালি ও ইরাকের সঙ্গে), সিরিঞ্জ (আইরিশদের সঙ্গে), থার্মোমিটার (ইতালি ও ফরাসিদের সঙ্গে)। চীনের আবিষ্কার ১০টি। তার মধ্যে আটটি তাদের নিজস্ব যেমন- অ্যাবাকাস, কম্পাস, কাগজ, বারুদ, বন্দুক, পর্যান বা স্যাড্ল, টুথব্রাশ ও জিপার। বাকি দুটি শরিকি যেমন- ছাতা (মেসোপটেমিয়া, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সঙ্গে) যান্ত্রিক ঘড়ি (ইউরোপের সঙ্গে)।
এখানে কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইরাক, জাপান, মিসর ও চীন মিলে চলে গেল আরো ২৫টি। ৯৪ থেকে ২৫ গেলে থাকে ৬৯টি। এই ৬৯-এর মধ্যে ২০টি আবিষ্কারের একক দাবিদার আমেরিকা এবং অবশিষ্ট ৪৯টি ইউরোপের। এখানে দেখা যায়, মানব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ১০১টি আবিষ্কারের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই একা ইউরোপ-আমেরিকার অবদান। আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এই ভৌগোলিক এবং রেসিয়াল বায়াস বা ভারসাম্যহীনতা কেন? কেন তা আমার জানা নেই, তবে এটার ফলে ইউরোপ-আমেরিকার মানুষের মন-মগজে স্বাভাবিকভাবে একটি অহংবোধ বা আত্মম্ভরিতা জন্ম নিতে পারে। ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ মনে করতে পারে, তারা পৃথিবীর অন্য সব জাতির তুলনায় বিদ্যা-বুদ্ধিতে, আচার-ব্যবহারে এবং সভ্যতায় শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ববোধের কারণে তাদের পক্ষে অন্যান্য জাতির ব্যাপারে একটু উদাসীন এবং গাফেল হওয়া অসম্ভব নয়। তারা নিজেদের মতো অন্যদের হয়তো বা সমান মর্যাদার সঙ্গে দেখে না বা দেখতে চায় না।
এখানে একটি উদাহরণ দেওয়া যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার হাতে ছিল মাত্র দুটি পারমাণবিক বোমা। আর এ দুটি বোমাই তারা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ফেলে হাজার হাজার জাপানিকে মুহূর্তের মধ্যে মেরে ফেলে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড কোনো এক আমেরিকানকে পাবলিক মিডিয়ায় এই বলে জায়েজ করার চেষ্টা করতে শুনেছি, 'ইট সেভড্ লটস অব লাইভস্'। সব আমেরিকান যে এমন ভাবে, তা ঠিক নয়। তবে কেউ কেউ তো ভাবছেই। এ ধরনের মনস্তত্ত্বের কারণে তৃতীয় বিশ্বে গিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার সরকার যখন মাস্তানি করে, তখন তাদের জনগণ সম্ভবত এ কারণেই নিশ্চুপ থাকে, কোনো প্রকার স্পর্শকাতরতা বা সংবেদনশীলতা দেখায় না। এই ব্যাখ্যা হতে পারে আমার বোদ্ধা পাঠকের প্রশ্নের একটি সাদাসিধে উত্তর। তবে এ ব্যাপারে আরো তাত্তি্বক এবং নিরীক্ষাধর্মী গবেষণার আগে কোনো চূড়ান্ত উপসংহারে আসা উচিত নয়।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
Awahid2569@gmail.com
সম্মানিত পাঠকের চিঠি পাওয়ার পর অনেক দিন ধরে আমার মাথায় তাঁর প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি ভাবছি; কিন্তু কোনো জুতসই উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না, আর তাঁর চিঠির জবাবও দেওয়া হচ্ছে না।
এমনি অবস্থায় গতানুগতিক ধারায় ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে গিয়ে হঠাৎ সেদিন একটি বইয়ের কমার্শিয়াল ভেসে উঠল আমার কম্পিউটারের স্ক্রিনে। One Hundred Great Inventions that Changed the World. অর্থাৎ '১০০টি মহা আবিষ্কার যা কিনা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে'। কারসার ঘুরিয়ে বইয়ের কাভারের ওপরে, আশপাশে, ডানে-বাঁয়ে মাউস ক্লিক করলাম অনেকবার, কিন্তু বইখানা খুলতে পারলাম না। তাই জানা হলো না ওই মহা আবিষ্কারগুলো কী কী। অন্ধের মতো আরো কিছু কসরত করার পর ঢুকে পড়লাম একটি ওয়েবসাইটে, যার নাম www.independent.co.uk। এখানে পেলাম ১০১টি মহা আবিষ্কারের একটি দীর্ঘ তালিকা, যেখানে আমাদের আদি পিতা-মাতা আদম-হাওয়া থেকে শুরু করে বিল গেটস পর্যন্ত সবার উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারগুলো যত্নসহকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ তালিকাটি আবিষ্কারের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব এবং তাদের আর্থিক তাৎপর্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়নি। এতে অধিক গুরুত্ব পেয়েছে সেই সব আবিষ্কার, যেগুলো সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে খুবই প্রয়োজনীয় এবং যেগুলো যুগ যুগ ধরে মানুষের জীবনকে করে তুলেছে সহজ, সহনীয় ও আরামদায়ক। এসব আবিষ্কার ছাড়া আজকালকার জীবন একেরাইে অচল। এখানে দেখতে পেলাম অনেক সুন্দর সুন্দর নাম, অবাক করা তথ্য-উপাত্ত, যা পড়লে আমার বিশ্বাস পাঠকরা বিরক্ত হবেন না। যদি কেউ হয়ে থাকেন, তাহলে আগেই তাঁর কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি। এই ১০১টি আবিষ্কারের মধ্যে সাতটি প্রাগৈতিহাসিক যুগের। কবে, কোথায়, কোন দেশে, কে বা কারা এগুলো উদ্ভাবন করেছে তার কোনো হদিস নেই। এই সাতটি হলো- আগুন, তীর-ধনুক, মাছ ধরার বড়শি, ছোটখাটো যন্ত্রপাতি (হাঁড়ি-পাতিল, দা, কুড়াল, ছুরি-কাঁচি ইত্যাদি), চাকা, দাঁড়িপাল্লা, তালা-চাবি। পাঠকরা এখানে ভেবে দেখুন, আধুনিক যুগের বিচারে এর কোনোটিই হয়তো খুব একটা বিশাল, জটিল বা কঠিন কিছু নয়; কিন্তু এগুলো ছাড়া কি এক দিনের জন্যও মানবজীবন চিন্তা করা যায়! আগুন যদিও আবিষ্কার হয়েছে লাখ লাখ বছর আগে; কিন্তু সহজে ও নিরাপদে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন জ্বালানো শুরু হয়েছে মাত্র সেদিন, ১৮২৭ সালে। আবিষ্কার করেছেন একজন ব্রিটিশ ফার্মাসিস্ট। আগুন থেকে দিয়াশলাই আলাদা করে রাখলে চলে গেল সাতটি আবিষ্কার। ১০১-এর মধ্যে বাকি রইল ৯৪টি।
এই ৯৪-এর মধ্যে একেবারে সাধারণ জিনিস, হালের লাঙল, ঢাকঢোল, ছাতা, চায়ের কেটলি, বোতাম, জিপার, ভেলক্রো, পোস্ট ইট নোট, লেড পেনসিল, ইরেজার, রাবার বেন্ড, পেপার ক্লিপ, সেলোটেপ, বলপয়েন্ট কলম, টুথব্রাশ, ফ্লাশিং টয়লেট ইত্যাদি থেকে শুরু করে ক্যামেরা, ক্যামকর্ডার, নিনটেন্ডো গেম, বার কোড, ব্ল্যাকবেরি, মোবাইল ফোন, রিমোট কন্ট্রোল, মাউস, পিসি, ল্যাপটপ- সবই আছে। এর মধ্যে দেখা যাক জাতি হিসেবে কার অবদান কী। কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইরানের আছে একটি করে আবিষ্কার। কানাডার অবদান রিসার্চ ইন মোশন কম্পানির উদ্ভাবন- অত্যাধুনিক ব্ল্যাকবেরি, কোরিয়ানদের গৌরব জেনিথ ইলেকট্রনিকস কম্পানির আবিষ্কার টিভি রিমোট কন্ট্রোল এবং ইরানের অবদান ফ্রিজ। বর্তমানে আমরা যে ফ্রিজ ব্যবহার করি, তার আবিষ্কারের সমান দাবিদার স্কটিশ, জার্মান এবং আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু এর সবচেয়ে মৌলিক উপাদান রেফ্রিজারেটেড কয়েল, যা প্রথম তৈরি করেন পারসীয় বিজ্ঞানী ইবনে সিনা। ইরাকের নিজস্ব আছে দুটি অবদান- হালের লাঙল, ঢাকঢোল এবং তৃতীয়টি অর্থাৎ রোবটে তাদের অবদান আছে মিসর ও ইতালির সঙ্গে শরিক হয়ে এবং চতুর্থটি অর্থাৎ কনডম তাদের অবদান ইতালি ও মিসরের সঙ্গে যৌথভাবে। জাপানিদের গৌরব দুটি- তারা বের করেছে নিনটেন্ডো গেম বয় এবং ক্যামকর্ডার। মিসরীয়দের আছে ছয়টি আবিষ্কার। তার মধ্যে দুটি তাদের একক কৃতিত্ব, যেমন- ক্লক ওয়ার্ক রেডিও ও পকেট ক্যালকুলেটর। বাকি যে চারটিতে আছে, তাদের শরিকি অবদান, সেগুলো হলো- কনডম ও রোবট (ইতালি ও ইরাকের সঙ্গে), সিরিঞ্জ (আইরিশদের সঙ্গে), থার্মোমিটার (ইতালি ও ফরাসিদের সঙ্গে)। চীনের আবিষ্কার ১০টি। তার মধ্যে আটটি তাদের নিজস্ব যেমন- অ্যাবাকাস, কম্পাস, কাগজ, বারুদ, বন্দুক, পর্যান বা স্যাড্ল, টুথব্রাশ ও জিপার। বাকি দুটি শরিকি যেমন- ছাতা (মেসোপটেমিয়া, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সঙ্গে) যান্ত্রিক ঘড়ি (ইউরোপের সঙ্গে)।
এখানে কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইরাক, জাপান, মিসর ও চীন মিলে চলে গেল আরো ২৫টি। ৯৪ থেকে ২৫ গেলে থাকে ৬৯টি। এই ৬৯-এর মধ্যে ২০টি আবিষ্কারের একক দাবিদার আমেরিকা এবং অবশিষ্ট ৪৯টি ইউরোপের। এখানে দেখা যায়, মানব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ১০১টি আবিষ্কারের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই একা ইউরোপ-আমেরিকার অবদান। আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এই ভৌগোলিক এবং রেসিয়াল বায়াস বা ভারসাম্যহীনতা কেন? কেন তা আমার জানা নেই, তবে এটার ফলে ইউরোপ-আমেরিকার মানুষের মন-মগজে স্বাভাবিকভাবে একটি অহংবোধ বা আত্মম্ভরিতা জন্ম নিতে পারে। ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ মনে করতে পারে, তারা পৃথিবীর অন্য সব জাতির তুলনায় বিদ্যা-বুদ্ধিতে, আচার-ব্যবহারে এবং সভ্যতায় শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ববোধের কারণে তাদের পক্ষে অন্যান্য জাতির ব্যাপারে একটু উদাসীন এবং গাফেল হওয়া অসম্ভব নয়। তারা নিজেদের মতো অন্যদের হয়তো বা সমান মর্যাদার সঙ্গে দেখে না বা দেখতে চায় না।
এখানে একটি উদাহরণ দেওয়া যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার হাতে ছিল মাত্র দুটি পারমাণবিক বোমা। আর এ দুটি বোমাই তারা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ফেলে হাজার হাজার জাপানিকে মুহূর্তের মধ্যে মেরে ফেলে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড কোনো এক আমেরিকানকে পাবলিক মিডিয়ায় এই বলে জায়েজ করার চেষ্টা করতে শুনেছি, 'ইট সেভড্ লটস অব লাইভস্'। সব আমেরিকান যে এমন ভাবে, তা ঠিক নয়। তবে কেউ কেউ তো ভাবছেই। এ ধরনের মনস্তত্ত্বের কারণে তৃতীয় বিশ্বে গিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার সরকার যখন মাস্তানি করে, তখন তাদের জনগণ সম্ভবত এ কারণেই নিশ্চুপ থাকে, কোনো প্রকার স্পর্শকাতরতা বা সংবেদনশীলতা দেখায় না। এই ব্যাখ্যা হতে পারে আমার বোদ্ধা পাঠকের প্রশ্নের একটি সাদাসিধে উত্তর। তবে এ ব্যাপারে আরো তাত্তি্বক এবং নিরীক্ষাধর্মী গবেষণার আগে কোনো চূড়ান্ত উপসংহারে আসা উচিত নয়।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
Awahid2569@gmail.com
No comments