বাংলাদেশের রাজনীতিতে পঞ্চমবাহিনী কারা? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে ইংরেজী ভাষার অভিধানে একটি নতুন কথা যুক্ত হয়েছিল ঋরভঃয পড়ষঁসহ। বাংলায় এর তর্জমা করা হয়েছিল পঞ্চমবাহিনী। বাংলাদেশ তখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত একটি প্রদেশ। স্কুলের একেবারে নিচের দিকে ক্লাসে পড়ি।
তখন জাপানী সৈন্যরা বাংলাদেশের পূর্বপ্রান্তে এসে গেছে। গোটা বার্মা (বর্তমানের মিয়ানমার) দখল করে নিয়েছে। এই জাপানী অভিযান রোখার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাদের প্রোপাগান্ডা অত্যন্ত জোরদার করেছিল। বাংলাদেশের শহর, বন্দর, গ্রামের বাড়িঘর, দোকান এবং রাস্তায় দেয়াল পর্যন্ত পোস্টারে ছেয়ে ফেলা হয়েছিল, তাতে লেখা থাকত ‘পঞ্চমবাহিনী হইতে সাবধান।’
তখন পঞ্চমবাহিনী কথাটার অর্থ বুঝতাম না। একটু বড় হয়ে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ফিফ্থ কলাম বা পঞ্চমবাহিনী কথাটার অর্থ মিত্রবেশে দলের মধ্যে বা দেশের মধ্যে থেকে যারা শত্রুতা করে। তারা বাইরের শত্রু ও প্রকাশ্য শত্রুর চাইতেও ভয়ঙ্কর। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিসেস মার্গারেট থ্যাচার বলেছেন, ‘আমি বাইরের শত্রুকে ভয় করি না। ভেতরের শত্রুকে (বহবসু রিঃযরহ) ভয় করি।’ আমার ধারণা, বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে হাসিনা সরকারের উচিত, বাইরের শত্রুর চাইতে ভেতরের শত্রু সম্পর্কে বেশি সতর্ক হওয়া। এই ভেতরের শত্রু বা পঞ্চমবাহিনীর প্রচার ও কার্যকলাপকে এখনই প্রতিহত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিত।
বর্তমান বাংলাদেশের এই পঞ্চমবাহিনী কারা? আমার ধারণা, বিশ্বব্যাংক, মার্কিন এস্টাবলিসমেন্টের নিউকন কোটারি, পাকিস্তানের আইএসআই, পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জী, দিল্লীর আমলাদের বাংলাদেশবিরোধী অংশ এবং এই জাতীয় বাইরের মহলে আমাদের প্রধান শত্রুর অনুসন্ধান না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচিত, তার দৃষ্টি দেশের ভেতরের দিকে ঘুরিয়ে আনা। তিনি দেখতে পাবেন, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই তার চারপাশে পঞ্চমবাহিনীর একটি শক্ত দেয়াল গড়ে উঠেছে। এদের হঠাতে না পারলে বাইরের শত্রুদের চক্রান্ত থেকেও দেশকে মুক্ত করা যাবে না।
সম্প্রতি ঢাকা থেকে আশা ইংরেজী, বাংলা দৈনিকগুলোর ওপর চোখ বুলাচ্ছিলাম। হঠাৎ ‘দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ দৈনিকটির প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবরে চোখ পড়ল। দেখি তিন কলাম হেডিংয়ে একটি খবর ‘অষ ধিহঃং ঃড় পৎবধঃব ঢ়ড়ষষভঁহফ রহ ঃযব হধসব ড়ভ ঢ়ধফসধ নৎরফমব’Ñইঘচ (পদ্মা ব্রিজের নাম করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের তহবিলে টাকা জমাচ্ছে, অভিযোগ বিএনপির)। কৌতূহল হলো, বিএনপির অধিকাংশ নেতানেত্রীই বাচাল। কিন্তু এত বড় বাচালতাটা কে করলেন?
কথাটি যিনি বলেছেন, খবরের সঙ্গে তার ছবিও ছাপা হয়েছে। তিনি ’৭১-এর স্বনামধন্য পুরুষ চখামিয়ার ছেলে মির্জা ফখরুল আলমগীর। বর্তমানে বিএনপির ভারবাহী সম্পাদক (বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের বেলায় ভারপ্রাপ্ত কথাটা এখন আর খাটে না)।
যোগ্য পিতার যোগ্য পুত্র। বাপের একাত্তরের ক্রেডেনসিয়াল দেখেই যে তাকে বিএনপির ভারবাহী মহাসচিব করা হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিএনপির আটক নেতাদের মুক্তিদাবিতে কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত এক সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে চখামিয়াতনয় বলেছেন, ‘সরকার নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার নামে জনগণকে প্রতারণা করে অর্থ সংগ্রহ শুরু করেছে, যে অর্থ তারা নির্বাচন তহবিল গঠনের কাজে লাগাবে।’
এটি একটি গুরুতর অভিযোগ পদ্মা সেতু প্রকল্প একটি দলীয় ইস্যু নয়, একটি জাতীয় ইস্যু। এর সঙ্গে সারাদেশের অর্থনৈতিক বাঁচামরার প্রশ্ন জড়িত। এই প্রকল্পে অর্থদানের অঙ্গীকার করে মাঝপথে দুর্নীতির অপ্রমাণিত অভিযোগ তুলে সেই অঙ্গীকার থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নয়, গোটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। কোন দেশ বহির্শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সে দেশের সরকার ও বিরোধী দল একাট্টা হয়ে যায়। জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদা রক্ষায় আপাতত অভ্যন্তরীণ মতবিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়।
এটা আমরা দেখেছি ব্রিটেনে গত গালফ যুদ্ধের সময়েও। এই যুদ্ধে ব্রিটেনের জড়ানো অন্যায় জেনেও টনি ব্লেয়ারের হঠকারিতায় যখন দেশটি যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তখন বিরোধী কনজারভেটিভ দল তাকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখে এবং যুদ্ধবিরোধী দলগুলোও নমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে।
একমাত্র বাংলাদেশের বেলাতেই দেখা যায়, এখানে বিএনপি, নিজেরা ক্ষমতায় না থাকলে দেশের স্বার্থ ও অস্তিত্ববিরোধী যে কোন চক্রান্তে জড়িত হতে দ্বিধা করে না। এই ভূমিকাকে বিনা দ্বিধায় পঞ্চমবাহিনীর ভূমিকা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু সে কথা সাহস করে কেউ বলছেন না এবং বিএনপির নেতাকর্মীদের মুখোশ খুলে দিচ্ছেন না। ফলে দিন দিন তাদের সাহস ও ধৃষ্টতা বেড়ে যাবে। এরা কখনও সংবিধানের মর্যাদা ক্ষুণœ করে কথা বলছেন। কখনও রাষ্ট্রের মৌলিক স্বার্থের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার বিরুদ্ধে ভূমিকা গ্রহণ করছেন। কখনও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করছেন এবং এসবই করছেন আওয়ামী লীগের বিরোধিতার নামে। এটাই হচ্ছে ফিফ্থ কলামিস্ট বা পঞ্চমবাহিনীর চরিত্র লক্ষণ। এরা মিত্রের বেশে দেশ ও রাষ্ট্রের শত্রুতা করে।
এটা আজ স্পষ্ট, মিসরে নাসেরের শাসনামলে অসওয়ান বাঁধে প্রতিশ্রুত অর্থায়ন থেকে আমেরিকাসহ পশ্চিমা প্রধান দাতা সংস্থাটি যেমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সরে গিয়েছিল, বর্তমানে বাংলাদেশে হাসিনা-সরকারের আমলে একই ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে গেছে। বিশ্বব্যাংক এই ব্যাপারে যে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে, তা ধোপে টেকেনি। দেখা গেছে, দুর্নীতির অভিযোগ বরং বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেই তোলা যায়। নিরপেক্ষ মহল দ্বারাও বিষয়টি স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও চখামিয়াপুত্র অভিযোগ তুলেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির নির্দিষ্ট অভিযোগ (ংঢ়বপরভরপ পড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ ধষষবমধঃরড়হ) তুলেছে। এই নির্দিষ্ট দুর্নীতিটি কি তা যদি বিএনপির মহাসচিব প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে সরকারের উচিত দেশের স্বার্থহানিকর নির্দিষ্ট অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার পেছনে বাংলাদেশের ভেতরেরই গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের এক বরপুত্রের ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির যে বিরাট নেপথ্য চাপ রয়েছে, সে অভিযোগ এখন প্রকাশ্যেই উঠেছে। এই অভিযোগের পেছনে কিছু সত্য না থাকলে হিলারি ক্লিনটন কেন ঢাকা পর্যন্ত ছুটে আসেন সেই বরপুত্রের ব্যক্তিগত স্বার্থের তদ্বির তদারক করার জন্য? মজেনা সাহেব আমেরিকার রাষ্ট্রদূত। তিনি কেন অহেতুক গলা উঁচিয়ে বলতে যাবেন, ‘না না, বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের পেছনে অমুক সাহেবের চাপ নেই।’ অনেকটা ‘ঠাকুর ঘরে কে আমি কলা খাই না’Ñ গোছের জবাবের মতো।
বিশ্বব্যাংকের ওপর ব্যক্তি বিশেষের এই চাপটি এতই ওপেনসিক্রেট হয়ে গেছে যে, তা নিয়ে ঢাকার বাজারে নানা গল্প তৈরি হয়েছে। এসব গল্পের ঢেউ লন্ডনেও এসে পৌঁছেছে। এসব গল্পের পেছনে সত্যতা না থাকারই কথা। তবু একটি বহুল প্রচলিত গল্প এখানে উল্লেখ না করে পারলাম না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সম্প্রতি ঢাকা সফরে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের সময় বলেছেন, ‘আই হোপ টু সী ইউ এবং নেক্সট প্রাইম মিনিস্টার এজ ইউর গ্লোরিয়াস ম্যান এজ নেক্সট প্রেসিডেন্ট অব বাংলাদেশ।’ এই গ্লোরিয়াস ম্যানটি কে তার উল্লেখ নিস্প্রয়োজন। এই কাহিনী সত্য বলে আমি মনে করি না। কিন্তু দেশের বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতি পাবলিক ইমাজিনেশন বা জনগণের কল্পনাশক্তিকে কোথায় নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই গুজবটি। পদ্মা সেতু সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের পেছনে যে রাজনৈতিক চক্রান্তও আছে, তাতে সন্দেহ নেই।
পদ্মা প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক যে আচরণ করেছে, তা একটি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। দেশের মানুষ এটা বুঝতে পেরেছে। নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি তৈরি করার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মনোবল তৈরি হয়েছিল। শেখ হাসিনাও সঙ্কটে একজন জাতীয় নেতার মতো সাহস ও মনোবল দেখিয়ে বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের পরোয়া করি না। তারা টাকা না দিলে আমাদের ষোলো কোটি মানুষের জনশক্তি নিয়েই সেতু গড়ে তুলব’Ñ সেই ঘোষণা অনুযায়ী দুটি ব্যাংক এ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছে। জনগণও তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিচ্ছে। তাতে বিএনপির ভারবাহী সম্পাদক, চখামিয়াপুত্র দেখেছেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচন তহবিল গঠনের প্রয়াস। কথায় বলে, জন্ডিস রোগীর চোখ হলদে হয়ে যায় বলে সে সারা পৃথিবীকে হলুদ দেখে। বিএনপির নেতানেত্রীরাও নিজেরা যা করেছেন এবং এখনও করছেন, অন্যেও তা করছে বলে একই হলুদ রং দেখছেন। যে দলের নেত্রীর বিরুদ্ধে তার স্বামীর জিয়া ট্রাস্ট ফান্ডের তহবিল নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তার মহাসচিবের মুখে বড় বড় কথা মানায় কি?
জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের যে অবস্থান গ্রহণ, তাতে দলীয় স্বার্থে উল্লসিত না হয়ে বিএনপির যেখানে উচিত ছিল অটুট জাতীয় ঐক্যে যোগ দেয়া এবং বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে পদ্মা প্রকল্প সফল করতে সাহায্য যোগানো, সেখানে ওরা আওয়ামী লীগ-বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে যে ভূমিকাটি নিয়েছেন, তা যে পঞ্চমবাহিনীর ভূমিকা গ্রহণ সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।
বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন অবশ্যই করবেন। দেশ শাসনে আওয়ামী সরকার বহু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। সেগুলো তারা জনসাধারণের সামনে তুলে ধরুন। দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুত, গ্যাস, যানজট, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া, সাগর-রুনীর হত্যাকা-, এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতেও তারা আন্দোলন চালাতে পারেন। তাতে ব্যর্থ হয়ে তারা জাতীয় ইস্যু ও জাতীয় সঙ্কট নিয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী ও ঐক্য নষ্টকারী ভূমিকা নেবেন তা তো হতে পারে না।
বিএনপি জন্মাবধি প্রত্যেকটি জাতীয় ইস্যুর জাতীয় স্বার্থবিরোধী বিভীষণের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। জাতীর পিতার হত্যাকারীদের তারা প্রশ্রয় দিয়েছে। এমনকি তাদের বিচার পর্যন্ত বানচাল করার চেষ্টা করেছে। ’৭১-এর স্বাধীনতার শত্রুদের শুধু রাজনৈতিকভাবে বড় ভূমিকা হচ্ছে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা। এখন পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের যে ভূমিকা, তা দেশের স্বার্থ-বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির ভূমিকা বিশ্বব্যাংকে সমর্থনদানের। তাতে পদ্মা সেতু প্রকল্প বানচাল হয় হোক, দেশের স্বার্থ ও সম্মান গোল্লায় যাক, তাতে তাদের কিছু আসে যায় না।
এই পঞ্চমবাহিনীর মনোভাব ও ভূমিকাটি নিয়ে কি বিএনপি আশা করে, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগিতায় আগামী সাধারণ নির্বাচনে তারা ক্ষমতায় যাবে?
লন্ডন, ৩১ জুলাই মঙ্গলবার, ২০১২ ॥
তখন পঞ্চমবাহিনী কথাটার অর্থ বুঝতাম না। একটু বড় হয়ে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ফিফ্থ কলাম বা পঞ্চমবাহিনী কথাটার অর্থ মিত্রবেশে দলের মধ্যে বা দেশের মধ্যে থেকে যারা শত্রুতা করে। তারা বাইরের শত্রু ও প্রকাশ্য শত্রুর চাইতেও ভয়ঙ্কর। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিসেস মার্গারেট থ্যাচার বলেছেন, ‘আমি বাইরের শত্রুকে ভয় করি না। ভেতরের শত্রুকে (বহবসু রিঃযরহ) ভয় করি।’ আমার ধারণা, বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে হাসিনা সরকারের উচিত, বাইরের শত্রুর চাইতে ভেতরের শত্রু সম্পর্কে বেশি সতর্ক হওয়া। এই ভেতরের শত্রু বা পঞ্চমবাহিনীর প্রচার ও কার্যকলাপকে এখনই প্রতিহত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিত।
বর্তমান বাংলাদেশের এই পঞ্চমবাহিনী কারা? আমার ধারণা, বিশ্বব্যাংক, মার্কিন এস্টাবলিসমেন্টের নিউকন কোটারি, পাকিস্তানের আইএসআই, পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জী, দিল্লীর আমলাদের বাংলাদেশবিরোধী অংশ এবং এই জাতীয় বাইরের মহলে আমাদের প্রধান শত্রুর অনুসন্ধান না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচিত, তার দৃষ্টি দেশের ভেতরের দিকে ঘুরিয়ে আনা। তিনি দেখতে পাবেন, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই তার চারপাশে পঞ্চমবাহিনীর একটি শক্ত দেয়াল গড়ে উঠেছে। এদের হঠাতে না পারলে বাইরের শত্রুদের চক্রান্ত থেকেও দেশকে মুক্ত করা যাবে না।
সম্প্রতি ঢাকা থেকে আশা ইংরেজী, বাংলা দৈনিকগুলোর ওপর চোখ বুলাচ্ছিলাম। হঠাৎ ‘দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ দৈনিকটির প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবরে চোখ পড়ল। দেখি তিন কলাম হেডিংয়ে একটি খবর ‘অষ ধিহঃং ঃড় পৎবধঃব ঢ়ড়ষষভঁহফ রহ ঃযব হধসব ড়ভ ঢ়ধফসধ নৎরফমব’Ñইঘচ (পদ্মা ব্রিজের নাম করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের তহবিলে টাকা জমাচ্ছে, অভিযোগ বিএনপির)। কৌতূহল হলো, বিএনপির অধিকাংশ নেতানেত্রীই বাচাল। কিন্তু এত বড় বাচালতাটা কে করলেন?
কথাটি যিনি বলেছেন, খবরের সঙ্গে তার ছবিও ছাপা হয়েছে। তিনি ’৭১-এর স্বনামধন্য পুরুষ চখামিয়ার ছেলে মির্জা ফখরুল আলমগীর। বর্তমানে বিএনপির ভারবাহী সম্পাদক (বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের বেলায় ভারপ্রাপ্ত কথাটা এখন আর খাটে না)।
যোগ্য পিতার যোগ্য পুত্র। বাপের একাত্তরের ক্রেডেনসিয়াল দেখেই যে তাকে বিএনপির ভারবাহী মহাসচিব করা হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিএনপির আটক নেতাদের মুক্তিদাবিতে কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত এক সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে চখামিয়াতনয় বলেছেন, ‘সরকার নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার নামে জনগণকে প্রতারণা করে অর্থ সংগ্রহ শুরু করেছে, যে অর্থ তারা নির্বাচন তহবিল গঠনের কাজে লাগাবে।’
এটি একটি গুরুতর অভিযোগ পদ্মা সেতু প্রকল্প একটি দলীয় ইস্যু নয়, একটি জাতীয় ইস্যু। এর সঙ্গে সারাদেশের অর্থনৈতিক বাঁচামরার প্রশ্ন জড়িত। এই প্রকল্পে অর্থদানের অঙ্গীকার করে মাঝপথে দুর্নীতির অপ্রমাণিত অভিযোগ তুলে সেই অঙ্গীকার থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নয়, গোটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। কোন দেশ বহির্শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সে দেশের সরকার ও বিরোধী দল একাট্টা হয়ে যায়। জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদা রক্ষায় আপাতত অভ্যন্তরীণ মতবিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়।
এটা আমরা দেখেছি ব্রিটেনে গত গালফ যুদ্ধের সময়েও। এই যুদ্ধে ব্রিটেনের জড়ানো অন্যায় জেনেও টনি ব্লেয়ারের হঠকারিতায় যখন দেশটি যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তখন বিরোধী কনজারভেটিভ দল তাকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখে এবং যুদ্ধবিরোধী দলগুলোও নমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে।
একমাত্র বাংলাদেশের বেলাতেই দেখা যায়, এখানে বিএনপি, নিজেরা ক্ষমতায় না থাকলে দেশের স্বার্থ ও অস্তিত্ববিরোধী যে কোন চক্রান্তে জড়িত হতে দ্বিধা করে না। এই ভূমিকাকে বিনা দ্বিধায় পঞ্চমবাহিনীর ভূমিকা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু সে কথা সাহস করে কেউ বলছেন না এবং বিএনপির নেতাকর্মীদের মুখোশ খুলে দিচ্ছেন না। ফলে দিন দিন তাদের সাহস ও ধৃষ্টতা বেড়ে যাবে। এরা কখনও সংবিধানের মর্যাদা ক্ষুণœ করে কথা বলছেন। কখনও রাষ্ট্রের মৌলিক স্বার্থের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার বিরুদ্ধে ভূমিকা গ্রহণ করছেন। কখনও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করছেন এবং এসবই করছেন আওয়ামী লীগের বিরোধিতার নামে। এটাই হচ্ছে ফিফ্থ কলামিস্ট বা পঞ্চমবাহিনীর চরিত্র লক্ষণ। এরা মিত্রের বেশে দেশ ও রাষ্ট্রের শত্রুতা করে।
এটা আজ স্পষ্ট, মিসরে নাসেরের শাসনামলে অসওয়ান বাঁধে প্রতিশ্রুত অর্থায়ন থেকে আমেরিকাসহ পশ্চিমা প্রধান দাতা সংস্থাটি যেমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সরে গিয়েছিল, বর্তমানে বাংলাদেশে হাসিনা-সরকারের আমলে একই ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে গেছে। বিশ্বব্যাংক এই ব্যাপারে যে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে, তা ধোপে টেকেনি। দেখা গেছে, দুর্নীতির অভিযোগ বরং বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেই তোলা যায়। নিরপেক্ষ মহল দ্বারাও বিষয়টি স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও চখামিয়াপুত্র অভিযোগ তুলেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির নির্দিষ্ট অভিযোগ (ংঢ়বপরভরপ পড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ ধষষবমধঃরড়হ) তুলেছে। এই নির্দিষ্ট দুর্নীতিটি কি তা যদি বিএনপির মহাসচিব প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে সরকারের উচিত দেশের স্বার্থহানিকর নির্দিষ্ট অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার পেছনে বাংলাদেশের ভেতরেরই গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের এক বরপুত্রের ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির যে বিরাট নেপথ্য চাপ রয়েছে, সে অভিযোগ এখন প্রকাশ্যেই উঠেছে। এই অভিযোগের পেছনে কিছু সত্য না থাকলে হিলারি ক্লিনটন কেন ঢাকা পর্যন্ত ছুটে আসেন সেই বরপুত্রের ব্যক্তিগত স্বার্থের তদ্বির তদারক করার জন্য? মজেনা সাহেব আমেরিকার রাষ্ট্রদূত। তিনি কেন অহেতুক গলা উঁচিয়ে বলতে যাবেন, ‘না না, বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের পেছনে অমুক সাহেবের চাপ নেই।’ অনেকটা ‘ঠাকুর ঘরে কে আমি কলা খাই না’Ñ গোছের জবাবের মতো।
বিশ্বব্যাংকের ওপর ব্যক্তি বিশেষের এই চাপটি এতই ওপেনসিক্রেট হয়ে গেছে যে, তা নিয়ে ঢাকার বাজারে নানা গল্প তৈরি হয়েছে। এসব গল্পের ঢেউ লন্ডনেও এসে পৌঁছেছে। এসব গল্পের পেছনে সত্যতা না থাকারই কথা। তবু একটি বহুল প্রচলিত গল্প এখানে উল্লেখ না করে পারলাম না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সম্প্রতি ঢাকা সফরে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের সময় বলেছেন, ‘আই হোপ টু সী ইউ এবং নেক্সট প্রাইম মিনিস্টার এজ ইউর গ্লোরিয়াস ম্যান এজ নেক্সট প্রেসিডেন্ট অব বাংলাদেশ।’ এই গ্লোরিয়াস ম্যানটি কে তার উল্লেখ নিস্প্রয়োজন। এই কাহিনী সত্য বলে আমি মনে করি না। কিন্তু দেশের বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতি পাবলিক ইমাজিনেশন বা জনগণের কল্পনাশক্তিকে কোথায় নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই গুজবটি। পদ্মা সেতু সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের পেছনে যে রাজনৈতিক চক্রান্তও আছে, তাতে সন্দেহ নেই।
পদ্মা প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক যে আচরণ করেছে, তা একটি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। দেশের মানুষ এটা বুঝতে পেরেছে। নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি তৈরি করার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মনোবল তৈরি হয়েছিল। শেখ হাসিনাও সঙ্কটে একজন জাতীয় নেতার মতো সাহস ও মনোবল দেখিয়ে বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের পরোয়া করি না। তারা টাকা না দিলে আমাদের ষোলো কোটি মানুষের জনশক্তি নিয়েই সেতু গড়ে তুলব’Ñ সেই ঘোষণা অনুযায়ী দুটি ব্যাংক এ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছে। জনগণও তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিচ্ছে। তাতে বিএনপির ভারবাহী সম্পাদক, চখামিয়াপুত্র দেখেছেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচন তহবিল গঠনের প্রয়াস। কথায় বলে, জন্ডিস রোগীর চোখ হলদে হয়ে যায় বলে সে সারা পৃথিবীকে হলুদ দেখে। বিএনপির নেতানেত্রীরাও নিজেরা যা করেছেন এবং এখনও করছেন, অন্যেও তা করছে বলে একই হলুদ রং দেখছেন। যে দলের নেত্রীর বিরুদ্ধে তার স্বামীর জিয়া ট্রাস্ট ফান্ডের তহবিল নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তার মহাসচিবের মুখে বড় বড় কথা মানায় কি?
জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের যে অবস্থান গ্রহণ, তাতে দলীয় স্বার্থে উল্লসিত না হয়ে বিএনপির যেখানে উচিত ছিল অটুট জাতীয় ঐক্যে যোগ দেয়া এবং বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে পদ্মা প্রকল্প সফল করতে সাহায্য যোগানো, সেখানে ওরা আওয়ামী লীগ-বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে যে ভূমিকাটি নিয়েছেন, তা যে পঞ্চমবাহিনীর ভূমিকা গ্রহণ সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।
বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন অবশ্যই করবেন। দেশ শাসনে আওয়ামী সরকার বহু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। সেগুলো তারা জনসাধারণের সামনে তুলে ধরুন। দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুত, গ্যাস, যানজট, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া, সাগর-রুনীর হত্যাকা-, এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতেও তারা আন্দোলন চালাতে পারেন। তাতে ব্যর্থ হয়ে তারা জাতীয় ইস্যু ও জাতীয় সঙ্কট নিয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী ও ঐক্য নষ্টকারী ভূমিকা নেবেন তা তো হতে পারে না।
বিএনপি জন্মাবধি প্রত্যেকটি জাতীয় ইস্যুর জাতীয় স্বার্থবিরোধী বিভীষণের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। জাতীর পিতার হত্যাকারীদের তারা প্রশ্রয় দিয়েছে। এমনকি তাদের বিচার পর্যন্ত বানচাল করার চেষ্টা করেছে। ’৭১-এর স্বাধীনতার শত্রুদের শুধু রাজনৈতিকভাবে বড় ভূমিকা হচ্ছে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা। এখন পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের যে ভূমিকা, তা দেশের স্বার্থ-বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির ভূমিকা বিশ্বব্যাংকে সমর্থনদানের। তাতে পদ্মা সেতু প্রকল্প বানচাল হয় হোক, দেশের স্বার্থ ও সম্মান গোল্লায় যাক, তাতে তাদের কিছু আসে যায় না।
এই পঞ্চমবাহিনীর মনোভাব ও ভূমিকাটি নিয়ে কি বিএনপি আশা করে, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগিতায় আগামী সাধারণ নির্বাচনে তারা ক্ষমতায় যাবে?
লন্ডন, ৩১ জুলাই মঙ্গলবার, ২০১২ ॥
No comments