সময়ের প্রতিধ্বনি-'দেশপ্রেমিক' আবুল হোসেনের পদত্যাগ রহস্য by মোস্তফা কামাল
আবার আবুল হোসেন প্রসঙ্গ। তাঁর আকস্মিক পদত্যাগ এবং তাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশপ্রেমিক সার্টিফিকেট দেওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে তিনি আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন। কিন্তু তাঁর পদত্যাগের বিষয়টি এক ধরনের রহস্যের জন্ম দিয়েছে।
সবার প্রশ্ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন কি সত্যিই পদত্যাগ করেছেন? নাকি পদত্যাগ পদত্যাগ খেলা করছেন! তিনি নিজেই তাঁর পদত্যাগের কথা সাংবাদিকদের জানান এবং পরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিষয়টি নিশ্চিত করেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণ করতেই সরকার সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের ব্যাপারে ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি এও বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত পূরণ করা হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই পদ্মা সেতুতে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি বিশ্বব্যাংক বিবেচনা করবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে আবুল হোসেনের পদত্যাগের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি দেশপ্রেমিক বলেই পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু ঢাকায় তাঁর পদত্যাগ বিষয়ে এখন আর কেউ মুখ খুলছে না। সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। তাঁর পদত্যাগের বিষয়ে কোনো গেজেটও প্রকাশ করা হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ সচিবও এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
মন্ত্রিসভায় আবুল হোসেন এত অপরিহার্য কেন? তাঁকে মন্ত্রিসভায় রাখতে পেরে সরকার ধন্য হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তা না হলে এত কিছুর পরও তাঁকে মন্ত্রিসভায় রাখতে হবে কেন? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? তাঁকে দিয়ে কেউ কি স্বার্থ হাসিল করছেন? তাঁকে সরিয়ে দিলে সেই স্বার্থে আঘাত লাগবে? এখন শোনা যাচ্ছে, আবুল হোসেনকে সরানো হবে যদি বিশ্বব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে 'গ্রিন সিগনাল' পাওয়া যায়। আর বিশ্বব্যাংক যদি আগের সিদ্ধান্তেই অটল থাকে, তাহলে তিনি মন্ত্রিসভায় থেকে যাবেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন এতটাই 'ক্যারিশম্যাটিক ব্যবসায়ী-নেতা' যে আওয়ামী লীগের আগের আমলেও (১৯৯৬-২০০১) তাঁকে মন্ত্রিসভায় রাখতে হয়েছিল। তিনি তখন ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। সরকারি রীতি অনুযায়ী মন্ত্রী-এমপিরা লাল পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে কারো সবুজ পাসপোর্ট থাকলে তা জমা দিতে হয়। আবুল হোসেন প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে দুটি পাসপোর্টই ব্যবহার করতেন। ব্যবসায়িক কাজে বিদেশে যেতে হলে তিনি সবুজ পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন। তখন তিনি একবার নিজের ব্যবসায়িক কাজে সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাওয়ার ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে সরকার। অনৈতিক এই কাজের জন্য তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করা হয়।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার মন্ত্রিসভা গঠনের সময় সেই আবুল হোসেনই আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তাঁকে দেওয়া হয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। শুরুতে পুরো মন্ত্রিসভা নিয়েই জনমনে প্রশ্ন ছিল। আবুল হোসেনসহ আওয়ামী লীগের থানাপর্যায়ের কিছু নেতাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে তুখোড় সমালোচনার মুখে পড়েছিল সরকার। অনেককেই তখন বলতে শোনা যায়, আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতাকে বাদ দিয়ে 'কচিকাঁচা'দের নিয়ে মন্ত্রিসভা করার খেসারত একদিন আওয়ামী লীগকে দিতে হবে। এই অনভিজ্ঞরা পুরোপুরি আমলানির্ভর হয়ে পড়বেন। বাস্তবে তা-ই হয়েছে। মন্ত্রীদের অতি আমলানির্ভরতার কারণে প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রশাসন চাইলে ফাইল নড়াচড়া করে। না চাইলে করে না। অধিকাংশ মন্ত্রীই আমলাদের হাতের পুতুল!
ইতিমধ্যেই প্রশাসনের সঙ্গে মন্ত্রীদের বেশ দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সন্দেহ-অবিশ্বাস বেড়েছে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অনেক যোগ্য কর্মকর্তা। সন্দেহ-অবিশ্বাস থেকেই অনেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অনেককে করা হয়েছে ওএসডি। সংগত কারণেই প্রশাসন গতি হারিয়ে ফেলেছে।
যা হোক, সৈয়দ আবুল হোসেন প্রসঙ্গে আসি। আগেও বলেছি, মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি প্রথম মন্ত্রী আবুল হোসেনের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিষয়টি ফাঁস হয় ২০১১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইউকিলিকস প্রকাশিত মার্কিন গোপন নথি থেকে। মরিয়ার্টি ঢাকা থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে এ-সংক্রান্ত তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন। এর কয়েক দিন পরই ২১ সেপ্টেম্বর মূল সেতু ও তদারকি পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক অর্থমন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে।
এ ঘটনার পর পরই সৈয়দ আবুল হোসেনের যোগাযোগমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি সরে না গিয়ে বরং নিজের পক্ষেই সাফাই গাইতে শুরু করলেন। আমরা ধরে নিচ্ছি, আবুল হোসেন বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রের শিকার। সরকারকে বিপদে ফেলতে বিশ্বব্যাংক তাঁকে 'বলির পাঁঠা' বানিয়েছে। তাই অর্থছাড় না করেই বিশ্বব্যাংক তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। যেহেতু আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা অভিযোগ এনেছে, সেহেতু স্বচ্ছতার স্বার্থেই আবুল হোসেনের উচিত ছিল পদত্যাগ করা। তারপর সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা করা। অথচ তিনি উল্টো বললেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার জন্য বিশ্বব্যাংকই একসময় লজ্জিত হবে। আবার বললেন, তাঁর পদত্যাগের বিষয়টি তাঁর হাতে নেই। তার মানে কী? প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পদত্যাগ করতে বারণ করেছেন?
আমরা দেখলাম, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আবুল হোসেনকে নিয়ে একের পর এক রিপোর্ট বের হলো। সরকারের ভাবমূর্তির ওপর দারুণভাবে আঘাত এলো। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার হিসেবেও অপবাদ দেওয়া হলো। অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা স্থগিত করার পর সরকারের বোধোদয় হলো এবং আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। তিনি এতই গুরুত্বপূর্ণ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মন্ত্রী যে তাঁকে বাদ দেওয়া সম্ভব হলো না। তাঁকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলো। ফলে প্রথম তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার খবরে যাঁরা স্বস্তি বোধ করেছিলেন, তাঁরাই আবার হতাশ হলেন।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি নিয়ে এর আগে আমি বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছি। প্রতিটি লেখায়ই বিশ্বব্যাংকের অতিমাত্রায় খবরদারির কঠোর সমালোচনা করেছি। এখনো আমি মনে করি, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। বিশ্বব্যাংক শর্তযুক্ত ঋণ দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশকেই দেউলিয়া বানিয়েছে। বাংলাদেশকে নিয়েও ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু সরকার কেন বিশ্বব্যাংকের পাতা ফাঁদে পা দেবে? কিন্তু বিশ্বব্যাংক ও সরকারের পাল্টাপাল্টি অবস্থান দেখে মনে হয়, পাড়া-মহল্লার এক ক্লাবের সঙ্গে আরেক ক্লাবের ঝগড়াঝাটি হচ্ছে।
সবারই মনে রাখা দরকার, এখনো বাংলাদেশের এমন অবস্থা হয়নি যে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যুদ্ধ ঘোষণা করবে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়া যে দেশের বাজেট ঘোষণা করা যায় না, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় না, সেই দেশের সরকারের বিপ্লবী ভূমিকা মোটেই সাজে না। তা ছাড়া বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিতে হলে নানা শর্ত মেনে চলতে হয়- এ কথা কে না জানে! সেই শর্ত মেনেই বিভিন্ন দেশ ঋণ নিয়ে থাকে। শর্ত মানতে আপত্তি থাকলে ঋণ না নিলেই হয়!
আজকের মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ বিশ্বব্যাংকের অতি খবরদারির কারণে ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দেন। তারপর নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয় দেশটি। কিন্তু কোনো দিন বিশ্বব্যাংকের কাছে মাথানত করেনি। সততা আর নিষ্ঠা নিয়ে দেশকে তিল তিল করে গড়ে তোলেন ড. মাহাথির। এখন মালয়েশিয়া বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করার বীরোচিত ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণায় সারা দেশের প্রতিটি মানুষ, এমনকি প্রবাসীরাও ব্যাপকভাবে আলোড়িত হন এবং তাঁকে অভিনন্দন জানান। একজন হতদরিদ্র মানুষকেও বলতে শুনেছি, পদ্মা সেতুর জন্য এক টাকা হলেও দেবেন। সত্যিই তো! যুদ্ধজয়ী একটি দেশ কেন একটি পদ্মা সেতু করতে পারবে না! অবশ্যই পারবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর যা ঘটল, সেটাও দেশবাসীর অজানা নয়। সেই প্রসঙ্গের আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।
তবে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, তাতে দেশের ক্ষতি বৈ লাভ হবে না। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাংককেই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান বলেছেন। লন্ডনে গিয়েও তিনি বিশ্বব্যাংককে তুলোধুনো করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কারণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বেশ দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এখন অর্থমন্ত্রী যতই দৌড়ঝাঁপ করুন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাওয়া কঠিন হবে। এটাও তো ঠিক, বিভিন্ন সময় বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকা লুটপাট হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের যোগসাজশে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারাও লুটপাটে অংশ নিয়েছেন।
বলতে দ্বিধা নেই, প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে যা বলেছেন, তার মধ্যে অসত্য কিছু নেই। কিন্তু সব সত্য সব সময় বলা যায় না। এমনিতেই সরকারকে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশ পরিচালনা করতে হচ্ছে। তার ওপর বিশ্বব্যাংকের মতো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চটিয়ে শত্রু বাড়ানোর কী দরকার ছিল! এর আগে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বাদ দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। এ ইস্যুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট হন। এখন বিশ্বব্যাংক যদি অন্য প্রকল্প থেকেও অর্থ তুলে নেয়, কিংবা প্রতিশ্রুত অর্থ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে, তখন কী হবে? দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করার প্রত্যয় ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী যা অর্জন করেছিলেন, তার সবটাই জলাঞ্জলি দিয়েছেন আবুল হোসেনকে দেশপ্রেমিকের সার্টিফিকেট দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী আরো কৌশলী না হলে বারবারই তাঁকে বিব্রত হতে হবে, বিপদে পড়তে হবে। আমরা দেখছি, তাঁর ভালো গুণগুলোও কালচে বর্ণ ধারণ করছে অতিকথনের বিষক্রিয়ায়। আমাদের আশা, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বিষয়টি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে আবুল হোসেনের পদত্যাগের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি দেশপ্রেমিক বলেই পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু ঢাকায় তাঁর পদত্যাগ বিষয়ে এখন আর কেউ মুখ খুলছে না। সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। তাঁর পদত্যাগের বিষয়ে কোনো গেজেটও প্রকাশ করা হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ সচিবও এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
মন্ত্রিসভায় আবুল হোসেন এত অপরিহার্য কেন? তাঁকে মন্ত্রিসভায় রাখতে পেরে সরকার ধন্য হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তা না হলে এত কিছুর পরও তাঁকে মন্ত্রিসভায় রাখতে হবে কেন? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? তাঁকে দিয়ে কেউ কি স্বার্থ হাসিল করছেন? তাঁকে সরিয়ে দিলে সেই স্বার্থে আঘাত লাগবে? এখন শোনা যাচ্ছে, আবুল হোসেনকে সরানো হবে যদি বিশ্বব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে 'গ্রিন সিগনাল' পাওয়া যায়। আর বিশ্বব্যাংক যদি আগের সিদ্ধান্তেই অটল থাকে, তাহলে তিনি মন্ত্রিসভায় থেকে যাবেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন এতটাই 'ক্যারিশম্যাটিক ব্যবসায়ী-নেতা' যে আওয়ামী লীগের আগের আমলেও (১৯৯৬-২০০১) তাঁকে মন্ত্রিসভায় রাখতে হয়েছিল। তিনি তখন ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। সরকারি রীতি অনুযায়ী মন্ত্রী-এমপিরা লাল পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে কারো সবুজ পাসপোর্ট থাকলে তা জমা দিতে হয়। আবুল হোসেন প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে দুটি পাসপোর্টই ব্যবহার করতেন। ব্যবসায়িক কাজে বিদেশে যেতে হলে তিনি সবুজ পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন। তখন তিনি একবার নিজের ব্যবসায়িক কাজে সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাওয়ার ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে সরকার। অনৈতিক এই কাজের জন্য তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করা হয়।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার মন্ত্রিসভা গঠনের সময় সেই আবুল হোসেনই আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তাঁকে দেওয়া হয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। শুরুতে পুরো মন্ত্রিসভা নিয়েই জনমনে প্রশ্ন ছিল। আবুল হোসেনসহ আওয়ামী লীগের থানাপর্যায়ের কিছু নেতাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে তুখোড় সমালোচনার মুখে পড়েছিল সরকার। অনেককেই তখন বলতে শোনা যায়, আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতাকে বাদ দিয়ে 'কচিকাঁচা'দের নিয়ে মন্ত্রিসভা করার খেসারত একদিন আওয়ামী লীগকে দিতে হবে। এই অনভিজ্ঞরা পুরোপুরি আমলানির্ভর হয়ে পড়বেন। বাস্তবে তা-ই হয়েছে। মন্ত্রীদের অতি আমলানির্ভরতার কারণে প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রশাসন চাইলে ফাইল নড়াচড়া করে। না চাইলে করে না। অধিকাংশ মন্ত্রীই আমলাদের হাতের পুতুল!
ইতিমধ্যেই প্রশাসনের সঙ্গে মন্ত্রীদের বেশ দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সন্দেহ-অবিশ্বাস বেড়েছে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অনেক যোগ্য কর্মকর্তা। সন্দেহ-অবিশ্বাস থেকেই অনেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অনেককে করা হয়েছে ওএসডি। সংগত কারণেই প্রশাসন গতি হারিয়ে ফেলেছে।
যা হোক, সৈয়দ আবুল হোসেন প্রসঙ্গে আসি। আগেও বলেছি, মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি প্রথম মন্ত্রী আবুল হোসেনের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিষয়টি ফাঁস হয় ২০১১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইউকিলিকস প্রকাশিত মার্কিন গোপন নথি থেকে। মরিয়ার্টি ঢাকা থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে এ-সংক্রান্ত তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন। এর কয়েক দিন পরই ২১ সেপ্টেম্বর মূল সেতু ও তদারকি পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক অর্থমন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে।
এ ঘটনার পর পরই সৈয়দ আবুল হোসেনের যোগাযোগমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি সরে না গিয়ে বরং নিজের পক্ষেই সাফাই গাইতে শুরু করলেন। আমরা ধরে নিচ্ছি, আবুল হোসেন বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রের শিকার। সরকারকে বিপদে ফেলতে বিশ্বব্যাংক তাঁকে 'বলির পাঁঠা' বানিয়েছে। তাই অর্থছাড় না করেই বিশ্বব্যাংক তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। যেহেতু আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা অভিযোগ এনেছে, সেহেতু স্বচ্ছতার স্বার্থেই আবুল হোসেনের উচিত ছিল পদত্যাগ করা। তারপর সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা করা। অথচ তিনি উল্টো বললেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার জন্য বিশ্বব্যাংকই একসময় লজ্জিত হবে। আবার বললেন, তাঁর পদত্যাগের বিষয়টি তাঁর হাতে নেই। তার মানে কী? প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পদত্যাগ করতে বারণ করেছেন?
আমরা দেখলাম, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আবুল হোসেনকে নিয়ে একের পর এক রিপোর্ট বের হলো। সরকারের ভাবমূর্তির ওপর দারুণভাবে আঘাত এলো। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার হিসেবেও অপবাদ দেওয়া হলো। অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা স্থগিত করার পর সরকারের বোধোদয় হলো এবং আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। তিনি এতই গুরুত্বপূর্ণ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মন্ত্রী যে তাঁকে বাদ দেওয়া সম্ভব হলো না। তাঁকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলো। ফলে প্রথম তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার খবরে যাঁরা স্বস্তি বোধ করেছিলেন, তাঁরাই আবার হতাশ হলেন।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি নিয়ে এর আগে আমি বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছি। প্রতিটি লেখায়ই বিশ্বব্যাংকের অতিমাত্রায় খবরদারির কঠোর সমালোচনা করেছি। এখনো আমি মনে করি, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। বিশ্বব্যাংক শর্তযুক্ত ঋণ দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশকেই দেউলিয়া বানিয়েছে। বাংলাদেশকে নিয়েও ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু সরকার কেন বিশ্বব্যাংকের পাতা ফাঁদে পা দেবে? কিন্তু বিশ্বব্যাংক ও সরকারের পাল্টাপাল্টি অবস্থান দেখে মনে হয়, পাড়া-মহল্লার এক ক্লাবের সঙ্গে আরেক ক্লাবের ঝগড়াঝাটি হচ্ছে।
সবারই মনে রাখা দরকার, এখনো বাংলাদেশের এমন অবস্থা হয়নি যে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যুদ্ধ ঘোষণা করবে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়া যে দেশের বাজেট ঘোষণা করা যায় না, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় না, সেই দেশের সরকারের বিপ্লবী ভূমিকা মোটেই সাজে না। তা ছাড়া বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিতে হলে নানা শর্ত মেনে চলতে হয়- এ কথা কে না জানে! সেই শর্ত মেনেই বিভিন্ন দেশ ঋণ নিয়ে থাকে। শর্ত মানতে আপত্তি থাকলে ঋণ না নিলেই হয়!
আজকের মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ বিশ্বব্যাংকের অতি খবরদারির কারণে ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দেন। তারপর নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয় দেশটি। কিন্তু কোনো দিন বিশ্বব্যাংকের কাছে মাথানত করেনি। সততা আর নিষ্ঠা নিয়ে দেশকে তিল তিল করে গড়ে তোলেন ড. মাহাথির। এখন মালয়েশিয়া বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করার বীরোচিত ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণায় সারা দেশের প্রতিটি মানুষ, এমনকি প্রবাসীরাও ব্যাপকভাবে আলোড়িত হন এবং তাঁকে অভিনন্দন জানান। একজন হতদরিদ্র মানুষকেও বলতে শুনেছি, পদ্মা সেতুর জন্য এক টাকা হলেও দেবেন। সত্যিই তো! যুদ্ধজয়ী একটি দেশ কেন একটি পদ্মা সেতু করতে পারবে না! অবশ্যই পারবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর যা ঘটল, সেটাও দেশবাসীর অজানা নয়। সেই প্রসঙ্গের আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।
তবে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, তাতে দেশের ক্ষতি বৈ লাভ হবে না। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাংককেই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান বলেছেন। লন্ডনে গিয়েও তিনি বিশ্বব্যাংককে তুলোধুনো করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কারণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বেশ দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এখন অর্থমন্ত্রী যতই দৌড়ঝাঁপ করুন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাওয়া কঠিন হবে। এটাও তো ঠিক, বিভিন্ন সময় বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকা লুটপাট হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের যোগসাজশে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারাও লুটপাটে অংশ নিয়েছেন।
বলতে দ্বিধা নেই, প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে যা বলেছেন, তার মধ্যে অসত্য কিছু নেই। কিন্তু সব সত্য সব সময় বলা যায় না। এমনিতেই সরকারকে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশ পরিচালনা করতে হচ্ছে। তার ওপর বিশ্বব্যাংকের মতো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চটিয়ে শত্রু বাড়ানোর কী দরকার ছিল! এর আগে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বাদ দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। এ ইস্যুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট হন। এখন বিশ্বব্যাংক যদি অন্য প্রকল্প থেকেও অর্থ তুলে নেয়, কিংবা প্রতিশ্রুত অর্থ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে, তখন কী হবে? দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করার প্রত্যয় ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী যা অর্জন করেছিলেন, তার সবটাই জলাঞ্জলি দিয়েছেন আবুল হোসেনকে দেশপ্রেমিকের সার্টিফিকেট দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী আরো কৌশলী না হলে বারবারই তাঁকে বিব্রত হতে হবে, বিপদে পড়তে হবে। আমরা দেখছি, তাঁর ভালো গুণগুলোও কালচে বর্ণ ধারণ করছে অতিকথনের বিষক্রিয়ায়। আমাদের আশা, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বিষয়টি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
No comments