রমজানে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন, বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগি- রমজানুল মোবারক

রমজান এলেই মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন নেমে আসে। মাসব্যাপী সৃষ্টি হয় ধর্মীয় আবহ। বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগীতে শামিল হয়ে পড়ে সবাই। মসজিদে মসজিদে চলে বিশেষ ধর্মীয় আলোচনা। ঘরে ঘরে শোনা যায় পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের আওয়াজ।


রমজানকে বলা হয় গুনাহ মাফের মাস। এ জন্য সারা বছর মুমিন মুসলমানগণ এই এক মাসের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। এবারও পবিত্র মাহে রমজানের আগমনে আমূল পরিবর্তন হয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষের জীবনযাত্রায়। সর্বত্র বিরাজ করছে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ। রেডিও-টেলিভিশনগুলো রমজান উপলক্ষে প্রতিদিন প্রচার করছে ইসলামী বিশেষ অনুষ্ঠান। প্রায় প্রতি নামাজেই পাড়া-মহল্লার মসজিদগুলোতে দেখা যাচ্ছে উপচে পড়া ভিড়।
রাতে সেহ্রি খাওয়ার মধ্য দিয়ে রোজা শুরু হয়। শেষ হয় সন্ধ্যায় আজানের সময় ইফতারি করার মাধ্যমে। এ সময়ের মধ্যে রোজাদারদের অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে দেখা যায়। বেশিরভাগ সময়ই রোজাদাররা পাপ কাজ থেকে দূরে থাকেন। বিকেল থেকে চলে ইফতারের বিশেষ প্রস্তুতি। মুসল্লিদের এ সময়ে টুপি পরিহিত অবস্থায় চলাচল করতে দেখা যায়। ইফতারির পরেই সবাই ছোটেন নামাজের জন্য মসজিদে। এশার আজানের পর থেকেই শুরু হয় তারাবির নামাজ। রোজার অন্যতম শর্ত তারাবির নামাজ। তারাবি উপলক্ষে প্রায় প্রতিটি মসজিদেই মুসল্লিদের ঢল নামে। কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়ার মসজিদগুলো ঘুরে দেখা গেছে তারাবির নামাজে মুসল্লিদের জামাত মসজিদের গ-ি ছাড়িয়ে রাস্তায় চলে আসে। এ সময় অবশ্য যান চলাচলে অনেকটা বিঘœ ঘটে।
পাড়া-মহল্লার শপিং মলে, গানের দোকানে প্রতিদিন যেখানে হাইভলিউমে চলত বাংলা-হিন্দী-ইংরেজী গান। সেসব এলাকা ঘুরে কোরান তেলাওয়াত আর ইসলামী গান শোনা গেছে। সরকারী-বেসরকারী প্রায় প্রতিটি রেডিও-টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠামালায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ইফতারের আগ মুহূর্তে এসব চ্যানেলে ইসলামের বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান প্রচার করতে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন। এছাড়া সেহ্রির সময়ও সব চ্যানেলেই ইসলামের বিশেষ অনুষ্ঠান হামদ নাত, ইসলামী সঙ্গীত ও ধর্মীয় বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে।
নগরীর খাবার দোকান হোটেল-রেস্তরাঁয় রমজানে বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়। বিশেষ করে রোজাদারদের সম্মানে হোটেল-রেস্তরাঁগুলোতে শামিয়ানা টাঙিয়ে রাখতে দেখা যায়। রমজান ছাড়া হোটেল-রেস্তরাঁয় এভাবে শামিয়ানা টাঙাতে কখনও দেখা যায় না। শামিয়ানার নিচে বড় বড় ডেকচিতে রান্না করা হয়েছে হালিম, ভাজা হয়েছে জিলাপি, পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপসহ শত পদের ইফতার। দুপুরের পর ফুটপাথ থেকে শুরু করে তারকা হোটেল পর্যন্ত সর্বত্র ইফতারে পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। বেলা ৩টার পর থেকে শুরু হয় বেচাকেনা। সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের আগে আগে অনেক দোকানে তৈরি করা পণ্য প্রায় শেষ হয়ে যায়।
ঢাকা শহরের প্রত্যেক পাড়া-মহল্লায় সেহ্রি খাওয়ার আগে কাসিদার মাধ্যমে রোজাদারদের জাগাতে দেখা যায়। বিশেষ করে পুরান ঢাকার পাড়া মহল্লার তরুণদের ঢোল, কাসার ব্যবহৃত জিনিসপত্রের ওপর লাঠির আঘাত করে রোজাদারদের জাগানোর চেষ্টা করতে দেখা যায়। কখনও প্রত্যেক বাসাবাড়িতে গিয়ে দরজায় নক করেও রোজাদারদের জাগাতে দেখা যায়। এ ছাড়া রোজাদার ওঠ, সেহ্রির সময় হয়েছে, ইত্যাদি গানের মাধ্যমে জাগাতে দেখা যায়। রাজধানীর কাজীপাড়ার বিভিন্ন মহল্লায় প্রতিরাতে একদল তরুণকে দেখা যায় সেহ্রির সময় হলেই তারা একত্রে আওয়াজ করছে, সেহ্রি সময় হলো রে, কত যে সময় চলে গেল রে। ওঠ মুমিন মুসলমান, রোজা রাখ নামাজ পড়।
এ ছাড়া রমজান এলেই বেড়ে যায় ইসলামী বই ক্যাসেট, সিডি, টুপি, আতর, তসবিহ্সহ বিভিন্ন ইসলামী ব্যবহার্য জিনিস বিক্রির হিড়িক। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি ফুটপাথে এসব জিনিস ফেরি করে বিক্রি করতে দেখা যায়। বাসের মধ্যে হকারদের ফেরি করে ইসলামী বই, নামাজ শিক্ষার বই বিক্রি করার দৃশ্য প্রতিদিনই চোখে পড়ে। বুধবার খামারবাড়ি রোডে সিগনালে আটকে থাকা বাসের মধ্যে টুপি, আতর, তসবিহ ফেরি করে বিক্রি করছিলেন এক ফেরিওয়ালা। তিনি বলেন, ১০ টাকা থেকে শুরু করে প্রায় ১শ’ টাকার টুপি তিনি বিক্রি করছেন। এ ছাড়া রমজানে আতর, তসবিহ বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে তিনি জানান।
রমজানের প্রথম ১০ দিনকে বলা হয় রহমতের। দ্বিতীয় ১০ দিনকে বলা হয় মাগফিরাতের। তৃতীয় বা শেষ ১০ দিনের রমজানকে বলা হয় গুনাহ মাপের বা জাহান্নাম থেকে মুক্তি। ইতোমধ্যে রহমতের ১০টি রোজা শেষ হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে মাগফিরাতের রোজা। রমজান উপলক্ষে মুসল্লিদের মধ্যে দান খয়রাতের প্রবণতা বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই গরিব ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে দান করতে দেখা যায়। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রথম থেকেই ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন ব্যক্তি গোষ্ঠীর সম্মানে ইফতার পার্টির আয়োজন করতে দেখা গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও রোজায় বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে আয়োজন করে থাকে ইফতার পার্টির। পাপ থেকে মুক্তি ও বিশেষ সওয়াব লাভের আশায় মুসল্লিরা এসবের আয়োজন করে থাকেন।
হাদিস শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী রমজান মুসলমানদের জন্য বিশাল এক আনন্দের মাস। মহাকালের পরিক্রমায় ঘুরে ঘুরে আসে রমজান। আসে এই সম্মানিত মৌসুম। আসে এই মহান মাস। আসে প্রিয় মেহমান হয়ে, সম্মানিত অতিথি হয়ে। এই উম্মতের জন্য মাহে রমজান আল্লাহ্র এক নেয়ামত। কেননা এ মাসের রয়েছে বহু গুণাবলী, বৈশিষ্ট্য। আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত এক হাদিসে বলা হয়েছে যখন রমজান আসে বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। দোজখের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানকে শিকল পড়িয়ে দেয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.