প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ রচনার প্রকৃত সমস্যা ও কিছু সুপারিশ by ড. শিশির ভট্টাচার্য্য

রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবী বাংলা ভাষার প্রকৃত বা নিজস্ব কোনো ব্যাকরণ নেই বলে দুঃখ করেছেন। 'বাংলা ভাষা' মানে কী? সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় 'বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ' গ্রন্থে 'বাংলা' শব্দটির দুটি অর্থ নির্দেশ করেছেন_১. ভারতের বিহার, আসাম থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বার্মার


আরাকান অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে প্রচলিত বিশেষ কিছু ইন্দো-আর্য (যেমন_সিলেটি, চট্টগ্রামী ইত্যাদি) উপভাষার সমষ্টিকে 'বাংলা ভাষা' বলা যায়; আবার ২. এই একই অঞ্চলে সর্বজনবোধ্য যে মানের চলিত উপভাষাটি প্রচলিত আছে, সেটাকেও 'বাংলা ভাষা' বলা যেতে পারে। বাংলা ব্যাকরণ লেখার আগে ভবিষ্যৎ বৈয়াকরণদের ঠিক করতে হবে 'ঠিক কোন' বাংলার ব্যাকরণ লিখবেন তাঁরা : ১. বাংলা ভাষার সব আঞ্চলিক রূপের, ২. প্রমিত বাংলার, নাকি ৩. বাংলার অন্য কোনো একটি উপভাষার।
'ব্যাকরণ' মানে কী? পাণিনী থেকে শুরু করে চমস্কি পর্যস্ত পৃথিবীর তাবৎ ভাষা বিজ্ঞানীর কাছে ব্যাকরণ মানে হচ্ছে 'ভাষার নিয়ম'। ব্যাকরণের তিনটি প্রধান অংশ হচ্ছে : ১. ধ্বনিতত্ত্ব, ২. রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্ব। ধ্বনিতত্ত্ব আমাদের বলবে, বাংলাভাষীরা কেমন করে বাংলা শব্দ ও বাংলা বাক্য উচ্চারণ করে উঠতে পারে; রূপতত্ত্ব বলবে, বাংলাভাষীরা কেমন করে বাংলা শব্দ তৈরি করে বা অন্যের তৈরি করা শব্দ বুঝে উঠতে পারে; বাক্যতত্ত্ব বলবে, বাংলাভাষীরা কেমন করে বাংলা বাক্য তৈরি করে বা অন্যের তৈরি করা বাক্যের গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণ করতে পারে। যে ভাষা বা উপভাষার ব্যাকরণই আপনি রচনা করুন না কেন, আপনাকে অবশ্যই সেই বিশেষ ভাষা বা উপভাষার ব্যাকরণের এই তিনটি দিকের বর্ণনা দিতে হবে।
বাংলা ব্যাকরণের পাঠ্যপুস্তক কেমন করে লেখা হবে, তা আমার বোধগম্য নয়। এ ছাড়া প্রশ্ন হতে পারে, শুধু প্রমিত উপভাষার বর্ণনা করেই কি সব উপভাষার সমষ্টি যে বাংলাভাষা, তার বর্ণনা সেরে ফেলা যাবে? মনে রাখতে হবে, অন্য সব উপভাষার মতো তথাকথিত প্রমিত ভাষাটিও একটি উপভাষা মাত্র। বহু ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণে বাংলা অঞ্চলে প্রচলিত বিশেষ একটি উপভাষা প্রমিত ভাষার মর্যাদা পাচ্ছে। ইতিহাস অন্য খাতে বইলে সিলেট, চট্টগ্রাম বা নোয়াখালীর উপভাষাও প্রমিত ভাষা হতে পারত। এতে কোনো সন্দেহ নেই, প্রমিত ও আঞ্চলিক ভাষাসমূহের আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানসম্মত ব্যাকরণ রচনা খুবই জরুরি। আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণ ও ব্যাকরণের সঙ্গে প্রমিত ভাষার উচ্চারণ ও ব্যাকরণের পার্থক্য নির্দেশ করতে হলে প্রমিত ভাষা ও সব আঞ্চলিক ভাষার ব্যাকরণের বিশদ বর্ণনা হাতে থাকা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে যতটুকু কাজ উভয় বাংলায় হয়েছে, তা দিয়ে আর যাই হোক তথাকথিত আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানসম্মত বাংলা ব্যাকরণ রচনা করা সম্ভবপর বলে আমি অন্তত মনে করি না। 'আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান সম্মত' কথাটিও ব্যাখ্যার দাবি রাখে। বিজ্ঞান হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের বিশেষ একটি উপায়, যাতে প্রচলিত তত্ত্ব ক্রমাগত সংশোধন করা হয় এবং সংশোধন করা সম্ভব না হলে প্রচলিত তত্ত্ব বাতিল করা হয় ও নতুন বাতিলযোগ্য তত্ত্বের প্রস্তাব করা হয়। ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্ব ভাষাবিজ্ঞানের এই তিনটি ক্ষেত্রের প্রতিটিতে বহু তত্ত্ব রয়েছে। ঠিক কোন কোন তত্ত্বকে সংশ্লিষ্ট ব্যাকরণ রচয়িতা বা রচয়িতারা 'আধুনিক' মনে করেন, ব্যাকরণ রচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার আগে তা ঠিক করে নেওয়া প্রয়োজন।
শুনেছি, বাংলা একাডেমী দুই বাংলার গবেষক-ভাষাবিদদের নিয়ে একটি বাংলা ব্যাকরণ তৈরিতে হাত দিয়েছে। বাংলা একাডেমীকে সাধুবাদ জানাতে হবে, দেরিতে হলেও বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে ভাবার জন্য। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন বা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ আমাদের পূর্বসূরি বৈয়াকরণবিদরা যা লিখে গেছেন, তার পুনরাবৃত্তিকে আমরা নিশ্চয়ই আধুনিক বাংলা ব্যাকরণ বলব না। এদের ব্যাকরণের কতটা সংস্কৃত ব্যাকরণ আর কতটাই বা প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ, তা নির্ধারণ করার জন্য কোনো গবেষণা আজ পর্যন্ত হয়েছে কি? রবীন্দ্রনাথ এই বলেছেন, সেই বলেছেন বলে নিরন্তর 'ওষ্ঠসেবা' (লিপ সার্ভিস) চলছে গত এক শ বছর ধরে, কাজের কাজ তো কিছু হয়নি। গবেষণা করার মতো যোগ্য বৈয়াকরণই তৈরি হয়নি উভয় বাংলায়।
প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ রচনার আগে বাংলা একাডেমী বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রকৃতই যা করতে পারে_১. সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণাকেন্দ্রগুলোতে বাংলা ব্যাকরণের ওপরে যত প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গবেষণাসন্দর্ভ আছে এবং গত কয়েক শ বছরে যে কয়েক শ বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয়েছে, সেগুলো সংগ্রহ করতে পারে এবং উপযুক্ত মনে হলে তার মধ্যে কোনো কোনোটি সম্পাদনা করে মুদ্রণ বা পুনর্মুদ্রণের উদ্যোগ নিতে পারে; ২. বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গবেষণা পত্রিকায় বাংলা ব্যাকরণের ওপরে যত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো সম্পাদনার ব্যবস্থা করতে পারে; ৩. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার ব্যাকরণের নিয়ম আবিষ্কার করার কাজ শুরু করতে পারে। কারণ প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণের নিয়মগুলো এসব ভাষা থেকে এসেছে কি-না তা স্থির করা প্রয়োজন, ৪. বিভিন্ন আঞ্চলিক বাংলার ব্যাকরণের নিয়ম আবিষ্কার করার কাজ শুরু করতে পারে, যাতে প্রমিত বাংলার ব্যাকরণের সঙ্গে এ নিয়মগুলোর তুলনামূলক আলোচনা করা যায়; ৫. ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় লেখা ভাষাবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকগুলো বাংলা ভাষায় অনুবাদ করাতে পারে। সবচেয়ে আগে যা দরকার এবং যা না করলেই নয়; ৬. ভাষাবিজ্ঞান গবেষণার জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অন্যান্য দেশের ভাষা একাডেমীগুলো এসব কাজ করছে এবং সে কারণে সেসব দেশে বৈয়াকরণ তৈরি হচ্ছে ও ব্যাকরণ চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। উভয় বাংলায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও আগ্রহী বৈয়াকরণদের একটি প্রজন্ম তৈরি হয়ে গেলে বাংলা ভাষার প্রকৃত ব্যাকরণ রচিত হতে দেরি হবে না। ঘটা করে প্রদীপ জ্বালানোর আগে এই সলতে পাকানোর কাজগুলো উপযুক্ত গবেষক-বুদ্ধিজীবী দিয়ে সেরে রাখলে ভালো হয়।


লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
shishir.bhattacharja@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.