আবুল হোসেনের খোলা চিঠি, পদত্যাগ এবং রাজনীতি ও পদ্মা সেতু by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
গত ২৩ জুলাই সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। ঐ সময় তিনি অবশ্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ২৩ তারিখ সকাল বেলাতেই কোন কোন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে তাঁর একটি খোলা চিঠি প্রকাশিত হতে দেখা গেছে।
কেন তিনি এই খোলা চিঠিটি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করলেন বোঝা গেল না। তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করে কিংবা সকল মিডিয়াতেই আগের দিন তা প্রচারের জন্য প্রেরণ করতে পারতেন। তাতে পত্রিকাগুলো গুরুত্ব দিয়ে চিঠিটি প্রকাশ করলে ব্যাপক পাঠক তা পড়ার সুযোগ পেত। তাতে এতদিন তাঁর সম্পর্কে গণমাধ্যমগুলো এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে যেসব বক্তব্য একতরফাভাবে প্রচারিত হচ্ছিল সেগুলো সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ও অবস্থান আরও অনেক বেশি মানুষের কাছে স্পষ্ট হওয়ার বা উপস্থাপিত হওয়ার সুযোগ হতো। সেটি হয়নি। পত্র-পত্রিকায় তাঁর দেয়া একটি খোলা চিঠির সংবাদের কথা শুধু বলা হয়েছে। তাতে কি লেখা হয়েছে তা জানা, খুঁজে পাওয়া, খুঁজে নেয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। অথচ যে অবস্থানে থেকে তিনি এমন একটি খোলা চিঠি দেশবাসীর জানার জন্য দিয়েছিলেন তা প্রচারের জন্য তখন গণমাধ্যমগুলো উন্মুখই ছিল। তিনি সেই সুযোগ কাজে লাগাননি। কেন লাগাননি, এর ব্যাখ্যা তিনিই ভাল দিতে পারবেন।
আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের দেয়া চিঠির একটি কপি পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছি। সেটি বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। এতদিন একতরফা নানা কথা শুনেছি, অনেকে হয়ত সেগুলোকেই বিশ্বাস করেছেন, তিলকে তাল বানিয়েও হয়ত কেউ কেউ বেচাকেনা করেছেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বক্তব্য, ভেতরের নানা ঘটনা, তথ্য-উপাত্ত, চিঠিপত্র-এগুলোর অনেক কিছুই আমাদের দেখা হয়নি, জানা হয়নি, এই প্রথম যাকে নিয়ে এত অভিযোগ, পদ্মাসেতু হবে কি হবে না, সেদিকে অনেকেরই দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার তাগিদ বোঝা যায়নি। মন্ত্রী ও সচিব দুর্নীতি করেছেন, বিশ্বব্যাংক নাকি তেমন অভিযোগ, তথ্য-প্রমাণ পাঠিয়েছেÑসেভাবেই প্রচার- প্রচারণা, রাজনীতির মাঠ উত্তপ্তকরণ, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, টিভি চ্যানেলের সংবাদ, টকশো, চায়ের দোকানের আলাপচারিতা ইত্যাদি শুনেছি। জানি না, এসব শুনতে গিয়ে কেউ কখনও ক্লান্তি অনুভব করেছেন কিনা। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বক্তব্য শোনার কোন দাবি কোন মহল থেকেই উত্থাপিত হয়নি, তার পদত্যাগের দাবিই কেবল চারদিক থেকে করা হচ্ছিল। গণতন্ত্রে নাকি কারও বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়। তারপর দেখা যাবে সত্য কি মিথ্যা, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় তার বক্তব্য শোনার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই তেমন কোন নিয়মও বাংলাদেশে দেখি না, শুনি না, দাবিও করা হয় না। বেচারা সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোন জবাবই এ পর্যন্ত আমাদেরকে জানানো হলো না। এই প্রথম তিনি একটি লিখিত জবাব দিলেন। তাঁর বক্তব্য আমার বিশ্বাস করা না করা প্রসঙ্গে এখানে কিছু বলছি না। সেটি অনেক পরের বিষয়। বলছি সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর লিখিত চিঠিতে যে সব বক্তব্য দিয়েছেন তা তো গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত ছিল। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেনÑএটিকে ভীষণভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিত। তদন্তে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে তাঁর দাবি সঠিক। তিনি সেই দায়িত্ব নিয়েই নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন নিশ্চয়ই। তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে দেশ এবং জাতিগতভাবে আমরা কলঙ্কের বোঝা থেকে মুক্ত হতে পারি। তিনি তা না হতে পারলে নিজেও ডুববেন, আমাদেরকে ও জাতিগতভাবে ডোবাবেন। কেননা, বিষয়টি দেশের অভ্যন্তরীণ কোন প্রকল্পের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নয়, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়। সে কারণেই তিনি যখন এতটাই আস্থার সঙ্গে বার বার নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন, দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছেন তখন বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাববার যথেষ্ট অবকাশ হয়ত আছে। আমরা সেটিই দেখতে চাই। কিন্তু আমাদের দেশে গণমাধ্যম এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে এমন একটি ভাব আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে শুধু এককভাবে সৈয়দ আবুল হোসেনই অভিযুক্ত হবেনÑআমরা দেশ ও জাতিগতভাবে কিছু হব নাÑবিষয়টি মোটেও তা নয়। আমাদের সমালোচকদের একপেশে চিন্তাভাবনা দেখে আমি দারুণভাবে হতাশ হচ্ছি। কেননা, এই দায়টা গোটা দেশের ওপরও পড়বে। সেদিক থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পুরো ঘটনা সম্পর্কে কি বলেছেন, তিনি দুর্নীতি না হওয়া সম্পর্কে আমাদেরকে কোন আশার আলো উক্ত খোলা চিঠিতে দেখিয়েছেন কিনা সেটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশার কথা হচ্ছে তাঁর চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির আশঙ্কা, পদ্মাসেতুর ঋণচুক্তি বাতিল ইত্যাদি বিষয় একদিন ভুল প্রমাণিত হবে।’ আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করব তাঁর এই দাবি শতভাগ সত্যে পরিণত হোক, জাতি হিসেবে আমরা দুর্নীতির কলঙ্ক থেকে মুক্ত হই। তাঁর এই চিঠি একটি মস্তবড় দলিলÑযেটি ঘরে ঘরে যতœ করে রাখা প্রয়োজন। সৈয়দ আবুল হোসেন পারতেন কোন বক্তব্য না দিয়েই বিদায় নিতে, তাতে তিনি দোষী প্রমাণিত হলেও কেউ এ সবের জন্য কৈফিয়ৎ চাইতে পারত না। কিন্তু পদত্যাগের আগে তিনি যে খোলা চিঠি দিয়েছেন তাতে তাঁর দায়িত্ব কিন্তু বেড়ে গেছে। তাঁর এই অবস্থান নেয়ার ভিত্তি তিনিই ভাল বলতে পারবেন। তবে আমরা এটিকে সাধুবাদ দিতে চাই, এর প্রতিটি বাক্য যেন সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়; সেই প্রতীক্ষায় থাকব।
সৈয়দ আবুল হোসেনের দাবি যদি সত্য বলে প্রমাণিত হয় তাহলে গত দশ মাস ধরে যে সব কথাবার্তা মিডিয়ায় এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বলা হয়েছিল, যে সব লেখালেখি হয়েছিল, পদ্মাসেতু নিয়ে যা কিছু এরই মধ্যে দেশে-বিদেশে ঘটে গেছে সে সবের দায়দায়িত্ব কে নেবেন, কারা সেই সবের জন্য দায়ী হবেনÑএ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে কাউকে কি তখন খুঁজে পাওয়া যাবে? আমার বিশ্বাস, না, কাউকেই পাওয়া যাবে না। এমন কি পদ্মাসেতু নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার জন্য কেউ তখন অনুশোচনাও করবেন বলে মনে হয় না। তবে যদি আনীত অভিযোগের সামান্যতমও প্রমাণ পাওয়া যায় তা হলে শুধু আবুল হোসেন এককভাবেই নন, শেখ হাসিনার গোটা সরকারই ভীষণভাবে নিন্দিত হবে (তখন সরকারে না থাকলেও), রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা এখন আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারছি না। সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগেই দেশ গত দশ মাস কেঁপেছে, রাজনীতিতে সুনামি বয়ে গেছে, দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে আওয়ামী লীগের কপালে কতবড় দুঃখ আছে তা কেবল তখনই দেখা যাবে।
যেটি আমার পর্যবেক্ষণ এবং বলার বিষয় তা হচ্ছে, সৈয়দ আবুল হোসেন দোষী বা নির্দোশ, এর কোনটিই বলার সময় এখন হয়নি। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার প্রবণতা আমাদের রাজনীতি, গণমাধ্যম, একাডেমিক মহল সর্বত্র বিরাজ করছে। গত দশ মাস সেটিই প্রবলভাবে ছিল, এখনও বিদ্যমান । চারদিকে তাকালে বা কান পেতে শোনার চেষ্টা করলে যেটি শোনা যায়, তা হচ্ছেÑ গেল গেল সব গেল। বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করার পর কেউ একজন লেখার শিরোনাম করলেন, ‘পদ্মাসেতু চাই না...’। এখনও আমরা জানি না, কে সত্য কথা বলছে; বিশ্বব্যাংক, নাকি আবুল হোসেন। অথচ কার অভিযোগকে আমরা এখনই সত্য বলে ধরে নিচ্ছি, কার কথা শোনার প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করছি নাÑ এটি বেশ অবাক করার বিষয়। আমাদের উচ্চ পর্যায়ের চিন্তা-ভাবনাতেও আবেগ, নেতিবাচক প্রবণতা, ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার অভ্যাস কতটা প্রবল তা এ থেকে বোঝা যায়। অথচ দেশের অভ্যন্তরে যেটি প্রয়োজন ছিল তা হচ্ছে পদ্মাসেতু নিয়ে যে সব অভিযোগ বিশ্বব্যাংক থেকে গত বছর করা হয়েছিল তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত আগে শোনা উচিত ছিল, বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত নেয়া অপরিহার্য ছিল। তা না করে শুরুতেই দুর্নীতি দুর্নীতি বলে গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দেয়া হলো, সংশ্লিষ্টদের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল এবং হেয় করে দিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলো তার ফলে দেশী-বিদেশী নানা অপশক্তি এর মধ্যে কলকাঠি নাড়াবার সুযোগ হয়ত পেয়ে বসেছে। এক কথায় দশ কথা, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ইত্যাদিতে সব কিছু উত্তপ্ত হয়ে গেল, পদ্মাসেতু কাজ শুরুর আগেই ভেঙ্গেচুরে নদীর পানিতে ডুবে গেল। যার এ বিষয়ে কোন বিশেষ জ্ঞান নেই ,তিনিও এসে মিডিয়ার উচ্চতর বিশেষায়িত প্রযুক্তিজ্ঞানগত প্রকল্পের বিষয়ে কোন অভিযোগ বিশ্বব্যাংক থেকে হওয়ার পর পদ্ধতিগতভাবেই সকলের অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেই শিক্ষা ও ধৈর্য কারও মধ্যেই নেই। সবাই ক্রেডিট নেয়ার প্রতিযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে, নিজের দেশ, জাতি, পদ্মাসেতু ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের চাইতেও কাউকে না কাউকে অভিযোগের সঙ্গে সঙ্গেই দুর্নীতিবাজ হিসেবে সাব্যস্ত করার নজির রাখতে নেমে পড়ল। এ ক্ষেত্রে পদ্ধতিগতভাবে অগ্রসর না হয়ে সব কিছু অচল করে দেয়ার একটি ব্যবস্থা সর্বত্র লক্ষ্য করা গেছে। এটি গণমাধ্যম এবং রাজনীতিতে পাল্লা দিয়ে সমানভাবে চলেছে। এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের সমাজ জীবনে; যেখানে কানকথা, শোনা কথার অবস্থান প্রবল, তথ্য-প্রমাণ দিয়ে যাচাই-বাছাই করে কোন মন্তব্য করা, বিশ্লেষণ করে দেখা ও বোঝার শিক্ষা বলতে গেলে নেই। এ ধরনের সমাজে পদ্মাসেতুর বিশালতা বোঝার ক্ষমতা আমাদের ক’জনের আছেÑবোঝা মুশকিল। পদ্মা সেতুকে অনেকে বাঁশের শাঁকো, বড়জোর একটি পাকা ব্রিজের আদলে চিন্তা করার বেশি খুব একটা ভাবতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে উচ্চতর প্রযুক্তিজ্ঞানের এত বড় পদ্মসেতুর প্রকল্প বাস্তবায়ন মোটেও সহজ কোন কাজ নয়।
মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের আগে ও পরে নানা ব্যঙ্গ, বিদ্রƒপ, প্রচার-প্রচারণা হয়েছে। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তো দাবিই করেছেন যে, এই পদত্যাগই প্রমাণ করে যে, পদ্মাসেতু নিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রী দুর্নীতি করেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা এও দাবি করেছেন যে গোটা সরকারই নাকি পদ্মাসেতু নিয়ে টাকাপয়সা লুটেপুটে খেয়েছে, দুর্নীতি করেছে। তবে তাদের হাতে কোন তথ্য-প্রমাণ আছে কিনা, যদিও শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ বলছেন যে তাদের হাতে এ সংক্রান্ত যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে; ক্ষমতায় গেলে সেগুলো প্রকাশ করা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এত তথ্যপ্রমাণ থাকলে এখনই প্রকাশ করছে না কেন? এখনই তো তাদের জন্য উপযুক্ত সময়। সরকার পতনের জন্য তেমন বিশ্বাসযোগ্য কয়েকটি দলিলই তো যথেষ্ট। হাতে সে রকম তথ্য-প্রমাণ রেখে দিয়ে আগামীতে ক্ষমতায় গিয়ে বর্তমান সরকারের বিচার করবেনÑ এমন হাস্যকর বক্তব্য কোা বোকা লোকেও দেবে বলে মনে করি না। আসলে বিএনপির নেতৃবৃন্দের হাতে তেমন কোন তথ্যপ্রমাণ নেই, তারা তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই প্রতিদিন এখানে সেখানে মিডিয়ার সম্মুখে চেঁচামেচি করছেন, গলা ফাটাচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ এসবকে এখনও রাজনৈতিক গলাবাজিই মনে করে। তাই রাস্তায় নেমে সরকার উৎখাতে জনগণ ভূমিকা রাখার কথা ভাবছে না।
আমাদের জন্য পদ্মাসেতুর কোন বিকল্প নেই। সৈয়দ আবুল হোসেন বিদায় নিয়েছেন। আমরা চাইব তাঁর খোলা চিঠির প্রতিটি বক্তব্য সত্য হোক, পদ্মাসেতু তৈরির কাজ শুরু হোক। এর জন্য ধৈর্য, সংযম, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা এবং পরিকল্পনামতো উদ্যোগ চাই। কথাবার্তা না বলে পদ্মাসেতুর যাবতীয় আয়োজন নিয়ে সরকার ঝাঁপিয়ে পড়ুক সেটিই আসল কাজ।
লেখক : অধ্যাপক ইতিহাস বিভাগ, বাউবি, রাজনীতির বিশ্লেষক
আমি সৈয়দ আবুল হোসেনের দেয়া চিঠির একটি কপি পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছি। সেটি বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। এতদিন একতরফা নানা কথা শুনেছি, অনেকে হয়ত সেগুলোকেই বিশ্বাস করেছেন, তিলকে তাল বানিয়েও হয়ত কেউ কেউ বেচাকেনা করেছেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বক্তব্য, ভেতরের নানা ঘটনা, তথ্য-উপাত্ত, চিঠিপত্র-এগুলোর অনেক কিছুই আমাদের দেখা হয়নি, জানা হয়নি, এই প্রথম যাকে নিয়ে এত অভিযোগ, পদ্মাসেতু হবে কি হবে না, সেদিকে অনেকেরই দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার তাগিদ বোঝা যায়নি। মন্ত্রী ও সচিব দুর্নীতি করেছেন, বিশ্বব্যাংক নাকি তেমন অভিযোগ, তথ্য-প্রমাণ পাঠিয়েছেÑসেভাবেই প্রচার- প্রচারণা, রাজনীতির মাঠ উত্তপ্তকরণ, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, টিভি চ্যানেলের সংবাদ, টকশো, চায়ের দোকানের আলাপচারিতা ইত্যাদি শুনেছি। জানি না, এসব শুনতে গিয়ে কেউ কখনও ক্লান্তি অনুভব করেছেন কিনা। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বক্তব্য শোনার কোন দাবি কোন মহল থেকেই উত্থাপিত হয়নি, তার পদত্যাগের দাবিই কেবল চারদিক থেকে করা হচ্ছিল। গণতন্ত্রে নাকি কারও বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়। তারপর দেখা যাবে সত্য কি মিথ্যা, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় তার বক্তব্য শোনার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই তেমন কোন নিয়মও বাংলাদেশে দেখি না, শুনি না, দাবিও করা হয় না। বেচারা সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোন জবাবই এ পর্যন্ত আমাদেরকে জানানো হলো না। এই প্রথম তিনি একটি লিখিত জবাব দিলেন। তাঁর বক্তব্য আমার বিশ্বাস করা না করা প্রসঙ্গে এখানে কিছু বলছি না। সেটি অনেক পরের বিষয়। বলছি সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর লিখিত চিঠিতে যে সব বক্তব্য দিয়েছেন তা তো গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত ছিল। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেনÑএটিকে ভীষণভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিত। তদন্তে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে তাঁর দাবি সঠিক। তিনি সেই দায়িত্ব নিয়েই নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন নিশ্চয়ই। তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে দেশ এবং জাতিগতভাবে আমরা কলঙ্কের বোঝা থেকে মুক্ত হতে পারি। তিনি তা না হতে পারলে নিজেও ডুববেন, আমাদেরকে ও জাতিগতভাবে ডোবাবেন। কেননা, বিষয়টি দেশের অভ্যন্তরীণ কোন প্রকল্পের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নয়, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়। সে কারণেই তিনি যখন এতটাই আস্থার সঙ্গে বার বার নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন, দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছেন তখন বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাববার যথেষ্ট অবকাশ হয়ত আছে। আমরা সেটিই দেখতে চাই। কিন্তু আমাদের দেশে গণমাধ্যম এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে এমন একটি ভাব আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে শুধু এককভাবে সৈয়দ আবুল হোসেনই অভিযুক্ত হবেনÑআমরা দেশ ও জাতিগতভাবে কিছু হব নাÑবিষয়টি মোটেও তা নয়। আমাদের সমালোচকদের একপেশে চিন্তাভাবনা দেখে আমি দারুণভাবে হতাশ হচ্ছি। কেননা, এই দায়টা গোটা দেশের ওপরও পড়বে। সেদিক থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পুরো ঘটনা সম্পর্কে কি বলেছেন, তিনি দুর্নীতি না হওয়া সম্পর্কে আমাদেরকে কোন আশার আলো উক্ত খোলা চিঠিতে দেখিয়েছেন কিনা সেটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশার কথা হচ্ছে তাঁর চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির আশঙ্কা, পদ্মাসেতুর ঋণচুক্তি বাতিল ইত্যাদি বিষয় একদিন ভুল প্রমাণিত হবে।’ আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করব তাঁর এই দাবি শতভাগ সত্যে পরিণত হোক, জাতি হিসেবে আমরা দুর্নীতির কলঙ্ক থেকে মুক্ত হই। তাঁর এই চিঠি একটি মস্তবড় দলিলÑযেটি ঘরে ঘরে যতœ করে রাখা প্রয়োজন। সৈয়দ আবুল হোসেন পারতেন কোন বক্তব্য না দিয়েই বিদায় নিতে, তাতে তিনি দোষী প্রমাণিত হলেও কেউ এ সবের জন্য কৈফিয়ৎ চাইতে পারত না। কিন্তু পদত্যাগের আগে তিনি যে খোলা চিঠি দিয়েছেন তাতে তাঁর দায়িত্ব কিন্তু বেড়ে গেছে। তাঁর এই অবস্থান নেয়ার ভিত্তি তিনিই ভাল বলতে পারবেন। তবে আমরা এটিকে সাধুবাদ দিতে চাই, এর প্রতিটি বাক্য যেন সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়; সেই প্রতীক্ষায় থাকব।
সৈয়দ আবুল হোসেনের দাবি যদি সত্য বলে প্রমাণিত হয় তাহলে গত দশ মাস ধরে যে সব কথাবার্তা মিডিয়ায় এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বলা হয়েছিল, যে সব লেখালেখি হয়েছিল, পদ্মাসেতু নিয়ে যা কিছু এরই মধ্যে দেশে-বিদেশে ঘটে গেছে সে সবের দায়দায়িত্ব কে নেবেন, কারা সেই সবের জন্য দায়ী হবেনÑএ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে কাউকে কি তখন খুঁজে পাওয়া যাবে? আমার বিশ্বাস, না, কাউকেই পাওয়া যাবে না। এমন কি পদ্মাসেতু নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার জন্য কেউ তখন অনুশোচনাও করবেন বলে মনে হয় না। তবে যদি আনীত অভিযোগের সামান্যতমও প্রমাণ পাওয়া যায় তা হলে শুধু আবুল হোসেন এককভাবেই নন, শেখ হাসিনার গোটা সরকারই ভীষণভাবে নিন্দিত হবে (তখন সরকারে না থাকলেও), রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা এখন আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারছি না। সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগেই দেশ গত দশ মাস কেঁপেছে, রাজনীতিতে সুনামি বয়ে গেছে, দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে আওয়ামী লীগের কপালে কতবড় দুঃখ আছে তা কেবল তখনই দেখা যাবে।
যেটি আমার পর্যবেক্ষণ এবং বলার বিষয় তা হচ্ছে, সৈয়দ আবুল হোসেন দোষী বা নির্দোশ, এর কোনটিই বলার সময় এখন হয়নি। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার প্রবণতা আমাদের রাজনীতি, গণমাধ্যম, একাডেমিক মহল সর্বত্র বিরাজ করছে। গত দশ মাস সেটিই প্রবলভাবে ছিল, এখনও বিদ্যমান । চারদিকে তাকালে বা কান পেতে শোনার চেষ্টা করলে যেটি শোনা যায়, তা হচ্ছেÑ গেল গেল সব গেল। বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করার পর কেউ একজন লেখার শিরোনাম করলেন, ‘পদ্মাসেতু চাই না...’। এখনও আমরা জানি না, কে সত্য কথা বলছে; বিশ্বব্যাংক, নাকি আবুল হোসেন। অথচ কার অভিযোগকে আমরা এখনই সত্য বলে ধরে নিচ্ছি, কার কথা শোনার প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করছি নাÑ এটি বেশ অবাক করার বিষয়। আমাদের উচ্চ পর্যায়ের চিন্তা-ভাবনাতেও আবেগ, নেতিবাচক প্রবণতা, ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার অভ্যাস কতটা প্রবল তা এ থেকে বোঝা যায়। অথচ দেশের অভ্যন্তরে যেটি প্রয়োজন ছিল তা হচ্ছে পদ্মাসেতু নিয়ে যে সব অভিযোগ বিশ্বব্যাংক থেকে গত বছর করা হয়েছিল তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত আগে শোনা উচিত ছিল, বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত নেয়া অপরিহার্য ছিল। তা না করে শুরুতেই দুর্নীতি দুর্নীতি বলে গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দেয়া হলো, সংশ্লিষ্টদের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল এবং হেয় করে দিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলো তার ফলে দেশী-বিদেশী নানা অপশক্তি এর মধ্যে কলকাঠি নাড়াবার সুযোগ হয়ত পেয়ে বসেছে। এক কথায় দশ কথা, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ইত্যাদিতে সব কিছু উত্তপ্ত হয়ে গেল, পদ্মাসেতু কাজ শুরুর আগেই ভেঙ্গেচুরে নদীর পানিতে ডুবে গেল। যার এ বিষয়ে কোন বিশেষ জ্ঞান নেই ,তিনিও এসে মিডিয়ার উচ্চতর বিশেষায়িত প্রযুক্তিজ্ঞানগত প্রকল্পের বিষয়ে কোন অভিযোগ বিশ্বব্যাংক থেকে হওয়ার পর পদ্ধতিগতভাবেই সকলের অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেই শিক্ষা ও ধৈর্য কারও মধ্যেই নেই। সবাই ক্রেডিট নেয়ার প্রতিযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে, নিজের দেশ, জাতি, পদ্মাসেতু ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের চাইতেও কাউকে না কাউকে অভিযোগের সঙ্গে সঙ্গেই দুর্নীতিবাজ হিসেবে সাব্যস্ত করার নজির রাখতে নেমে পড়ল। এ ক্ষেত্রে পদ্ধতিগতভাবে অগ্রসর না হয়ে সব কিছু অচল করে দেয়ার একটি ব্যবস্থা সর্বত্র লক্ষ্য করা গেছে। এটি গণমাধ্যম এবং রাজনীতিতে পাল্লা দিয়ে সমানভাবে চলেছে। এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের সমাজ জীবনে; যেখানে কানকথা, শোনা কথার অবস্থান প্রবল, তথ্য-প্রমাণ দিয়ে যাচাই-বাছাই করে কোন মন্তব্য করা, বিশ্লেষণ করে দেখা ও বোঝার শিক্ষা বলতে গেলে নেই। এ ধরনের সমাজে পদ্মাসেতুর বিশালতা বোঝার ক্ষমতা আমাদের ক’জনের আছেÑবোঝা মুশকিল। পদ্মা সেতুকে অনেকে বাঁশের শাঁকো, বড়জোর একটি পাকা ব্রিজের আদলে চিন্তা করার বেশি খুব একটা ভাবতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে উচ্চতর প্রযুক্তিজ্ঞানের এত বড় পদ্মসেতুর প্রকল্প বাস্তবায়ন মোটেও সহজ কোন কাজ নয়।
মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের আগে ও পরে নানা ব্যঙ্গ, বিদ্রƒপ, প্রচার-প্রচারণা হয়েছে। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তো দাবিই করেছেন যে, এই পদত্যাগই প্রমাণ করে যে, পদ্মাসেতু নিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রী দুর্নীতি করেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা এও দাবি করেছেন যে গোটা সরকারই নাকি পদ্মাসেতু নিয়ে টাকাপয়সা লুটেপুটে খেয়েছে, দুর্নীতি করেছে। তবে তাদের হাতে কোন তথ্য-প্রমাণ আছে কিনা, যদিও শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ বলছেন যে তাদের হাতে এ সংক্রান্ত যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে; ক্ষমতায় গেলে সেগুলো প্রকাশ করা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এত তথ্যপ্রমাণ থাকলে এখনই প্রকাশ করছে না কেন? এখনই তো তাদের জন্য উপযুক্ত সময়। সরকার পতনের জন্য তেমন বিশ্বাসযোগ্য কয়েকটি দলিলই তো যথেষ্ট। হাতে সে রকম তথ্য-প্রমাণ রেখে দিয়ে আগামীতে ক্ষমতায় গিয়ে বর্তমান সরকারের বিচার করবেনÑ এমন হাস্যকর বক্তব্য কোা বোকা লোকেও দেবে বলে মনে করি না। আসলে বিএনপির নেতৃবৃন্দের হাতে তেমন কোন তথ্যপ্রমাণ নেই, তারা তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই প্রতিদিন এখানে সেখানে মিডিয়ার সম্মুখে চেঁচামেচি করছেন, গলা ফাটাচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ এসবকে এখনও রাজনৈতিক গলাবাজিই মনে করে। তাই রাস্তায় নেমে সরকার উৎখাতে জনগণ ভূমিকা রাখার কথা ভাবছে না।
আমাদের জন্য পদ্মাসেতুর কোন বিকল্প নেই। সৈয়দ আবুল হোসেন বিদায় নিয়েছেন। আমরা চাইব তাঁর খোলা চিঠির প্রতিটি বক্তব্য সত্য হোক, পদ্মাসেতু তৈরির কাজ শুরু হোক। এর জন্য ধৈর্য, সংযম, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা এবং পরিকল্পনামতো উদ্যোগ চাই। কথাবার্তা না বলে পদ্মাসেতুর যাবতীয় আয়োজন নিয়ে সরকার ঝাঁপিয়ে পড়ুক সেটিই আসল কাজ।
লেখক : অধ্যাপক ইতিহাস বিভাগ, বাউবি, রাজনীতির বিশ্লেষক
No comments