ফরমালিন-হাত বাড়ালেই মেলে, আমদানিও সহজ by ফারজানা লাবনী
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কোনো খাবার মুখে তোলার আগে প্রায় সবাই অন্তত একবার ভ্রু কুঁচকে ভাবি- ফরমালিন মেশানো নেই তো? কিন্তু হাজার ভেবেও লাভ নেই। ফরমালিন মেশানো থাক বা না থাক, খাবারটা গিলে নিতে হয় অবলীলায়, অসহায়ের মতো। কিচ্ছু করার নেই! ফরমালিন দেখাও যায় না, গন্ধও পাওয়া যায় না।
শুধু জানা যায়, এটা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। 'জেনে-শুনে বিষ করেছি পান'-এর মতো করে সবাই খেয়ে যাচ্ছি ফরমালিন নামের এই বিষ।
এভাবে আজ এক আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে ফরমালিন। অসাধু ব্যবসায়ীদের দ্বারা নানা খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে এই রাসায়নিক অদৃশ্য ঘাতকের মতো ঢুকে পড়ছে আমাদের ঘরে। এরপর রান্নাঘর, ডাইনিং টেবিল হয়ে ঢুকছে আমাদের দেহে। বাধাচ্ছে কঠিন সব রোগ-ব্যাধি। কখনো কখনো এসব রোগ মৃত্যুর কারণও হচ্ছে।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফরমালিন নামের এই ঘাতক রাসায়নিকটি এত সহজে আমাদের শরীরে ঢোকার অন্যতম প্রধান কারণ- এর আমদানিতে কঠোর বিধিনিষেধ নেই। আমদানির অনুমোদন দেওয়ার জন্য উল্টো রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। ফলে সহজেই মেলে ফরমালিন। এরপর সেটা পচন রোধের জন্য ফলমূল, মাছ থেকে শুরু করে দুধে পর্যন্ত মেশানো হচ্ছে। বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের (বিসিএসআইআর) প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার নাসিমা খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ফরমালডিহাইডের ৩৭ শতাংশ জলীয় দ্রবণকে আমরা ফরমালিন বলি। এ রাসায়নিক দ্রব্য মূলত মৃত প্রাণী বা মর্গে লাশ সংরক্ষণ, কাঠ ও নির্মাণ শিল্প, বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি, থার্মোপ্লাস্টিক রেজিন তৈরি, পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পে রাসায়নিক দ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।'
নাসিমা খান বলেন, কিছু ব্যবসায়ী খাবারের স্থায়িত্বকাল বাড়াতে ফরমালিন ব্যবহার করছেন। এর ফলে খাবারের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ফরমালিন প্রবেশ করছে। এতে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়, চোখের মারাত্মক ক্ষতি হয়, স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা কমে যায়; ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ও ফুসফুসের জটিল ক্যান্সার এবং অ্যালাজি, অ্যাজমাসহ নানা রকম জটিল রোগ তৈরি হয়।
উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ফরমালিন ব্যবহার ও ফরমালিন মেশানো দ্রব্যাদি আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফরমালিনের ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে।
মারাত্মক ক্ষতিকর এই রাসায়নিক দ্রব্যটি বাংলাদেশে আমদানির ক্ষেত্রে শর্তযুক্ত পণ্যের তালিকায় আছে। কিন্তু সামান্য কিছু কাগজপত্র জমা দিতে পারলেই মেলে আমদানির অনুমোদন। এসব নথি জোগাড় করে দেওয়ার জন্য গড়ে উঠেছে দালাল শ্রেণী।
অফিস চলাকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের আশপাশে পান-সিগারেট ও ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে শুরু করে হোটেল বা ছোট-বড় দোকানে দালালদের আনাগোনা। অফিসের সামনে রাস্তার পাশেও দেখা মেলে তাদের। এসব দালাল সাত থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে ফরমালিন আমদানির লাইসেন্স সরবরাহ করে থাকে।
আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের সহকারী নিয়ন্ত্রক রবিউল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ফরমালিন আমদানির অনুমোদনে যেসব কাগজপত্র জমা দিতে হয় তার মধ্যে রয়েছে ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন নম্বর, ব্যবসায়িক সংগঠনের সদস্য পদ, ব্যাংকের সার্টিফিকেট (যে ব্যাংক থেকে এলসি খোলা হবে), ভোটার আইডি কার্ড।
তবে দপ্তরের কর্মকর্তারা দালালদের মাধ্যমে ফরমালিন আমদানির লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন না। আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক দপ্তর সূত্র জানায়, ফরমালিন আমদানির লাইসেন্স পেতে সরকারি তহবিলে জমা দেওয়া ফির পরিমাণ এক লাখ টাকা পর্যন্ত আমদানিতে দুই হাজার ১০০ টাকা, এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ পর্যন্ত আমদানিতে তিন হাজার ৩০০ টাকা, পাঁচ লাখ থেকে ১৫ লাখ পর্যন্ত আমদানিতে পাঁচ হাজার ১০০ টাকা, ১৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত আমদানিতে ৯ হাজার ৮০০ টাকা, ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকার আমদানিতে ১৭ হাজার ৮০০ টাকা, এক কোটি টাকা থেকে এর ওপরে আমদানির ক্ষেত্রে ২৩ হাজার ৩০০ টাকা।
বাংলাদেশ ডায়িং, পেইন্ট এবং কেমিক্যাল মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুস সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণেই ফরমালিন আমদানি একেবারে নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়। তবে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে আমদানি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ফরমালিন কী কাজে ব্যবহার করা হবে, তা আমদানির আগেই সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের জানাতে হয়। কিন্তু আমদানির পর প্রকৃতপক্ষে ওই কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সরকারি নজরদারি নেই। অন্যদিকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে দীর্ঘদিন ধরেই সীমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাই পথে ফরমালিন আসছে। তবে প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য সরকারি পদক্ষেপ দেখা যায় না। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার ভেজালের পরিমাণও বাড়ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাসায়নিক দ্রব্য আমদানিকারক একজন ব্যবসায়ী কালের কণ্ঠকে বলেন, শিল্প কারখানার এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীও বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে বিভিন্ন আড়তদারের কাছে আমদানি করা ফরমালিন বিক্রি করে থাকে। বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ জানতেও পারে না। আবার গবেষণাগার ও হাসপাতাল থেকেও ফরমালিন সরবরাহ হচ্ছে বাজারে; তবে তা সীমিত আকারে। এ ছাড়া চোরাই পথে সীমান্ত এলাকা দিয়ে বড় আকারের ফরমালিন আসে। এ কাজে অনেক বড় সিন্ডিকেট জড়িত। শুধু দেশের আড়তে নয়, অনেক সময় সীমান্ত এলাকা থেকেও এ রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয়। এদিকে বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীরা ফরমালিনের ব্যবহার দিনে দিনে বাড়িয়ে চলেছে। তাই এ পণ্যের চাহিদাও আগের চেয়ে বেশি। এতে ফরমালিন চোরাচালান সিন্ডিকেট আরো সক্রিয় ও শক্তিশালী হচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের বিস্তারও আগের চেয়ে বেশি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে পাওয়া হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম মাসের চেয়ে শেষ মাসে ফরমালিন আমদানির পরিমাণ বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে ফরমালিন আমদানি হয়েছে ৮৭ লাখ ৮২ হাজার ৬০০ টাকার।
আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের নিয়ন্ত্রক শামসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ফরমালিন আমদানির অনুমোদন সরকারি এই প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ফরমালিন আমদানির পর তা কী কাজে ব্যবহার করছে, সেই বিষয়ে কোনো নজরদারি করা হয় না এখান থেকে। এ কাজে মূলত ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনায় নিয়োজিত সরকারি মোবাইল টিম আছে, তারাই দায়বদ্ধ।
এ বিষয়ে দীর্ঘদিন বিএসটিআইয়ের ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তা ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ম্যাজিস্ট্রেট আল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ফরমালিনসহ নানা রকম রাসায়নিক দ্রব্য খাবারে মেশানো হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব মোবাইল কোর্টের। তবে শিল্প কারখানা বা গবেষণাগার থেকে তা চুরি হচ্ছে কি না বা চোরাই পথে ফরমালিন আসছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনাকারীদের নয়। সরকারের প্রতিষ্ঠান আছে। আমদানির অনুমোদন তারাই দিয়ে থাকে। তিনি মনে করেন, রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে অতি সহজে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। তাই ভেজাল কার্যক্রমও কমে যাবে।
শিল্প কারখানায় ফরমালিনের যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কি না, এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম খোরশেদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ফরমালিন আমদানির অনুমতি যারা দেয় তাদেরই উচিত নিয়ন্ত্রণ করা। শিল্প মন্ত্রণালয় ফরমালিন আমদানির সঙ্গে জড়িত নয়। তাই নজরদারিতেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দায়ী নয়। তবে বিএসটিআই ফরমালিনের অপব্যবহার রোধে অভিযান পরিচালনা করে থাকে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখেই আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আমদানির পর কী করে, তা শত শত গুদাম বা কারখানায় গিয়ে সরেজমিনে যাচাই করা সম্ভব নয়।
No comments