গদ্যকার্টুন-ভূমিকম্প হলে এমপিরা বেঁচে থাকবেন... by আনিসুল হক

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প হয়েছে। ঈদের আগের রাতে আর ঈদের দিন। ভূমিকম্পের সময় অনেক জায়গায় আতঙ্কিত মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। বাংলাদেশে নাকি একটা বড় ভূমিকম্প ঘটতে যাওয়ার সময় হয়েছে।ভূমিকম্প হলে কী হবে, সেটাও আমরা জানি।


পত্রিকান্তরে পড়লাম, কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদে খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ঢাকায় ৭ থেকে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। মধুপুরের নিচে যে ফাটল আছে, তা থেকে ঢাকায় এই মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। আর সেটা যদি রাতে হয়, ৯০ হাজার লোক মারা যাবে। আর দিনে হলে ৭২ হাজার লোক মারা যাবে। এর ফলে যে পরিমাণ ধ্বংসচূর্ণ জমা হবে, তার পরিমাণটা হলো ৩০০ কোটি টন। আর পুনর্নির্মাণের জন্য ঢাকায় দরকার হবে ছয় বিলিয়ন ডলার, যা জাতীয় বাজেটের অর্ধেক।
এখন ভূমিকম্প যদি হঠাৎ এসেই যায়, আর তা যদি ঘটে এখনই, আপনি-আমি কী-ই বা করতে পারি।
আমরা আমাদের নির্মাতাদের বলতে পারি, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন বানান। সরকারকে বলতে পারি, এ বিষয়ে কঠোরতা আর সতর্কতা অবলম্বন করুন। কিন্তু সেসব তো আর এক দিনে হবে না। আপনি এখন যে ভবনে বসে এই লেখাটা পড়ছেন, সেটা আপনার ঐকান্তিক ইচ্ছাবলে এখনই এইমাত্র ভূমিকম্পরোধী হয়ে উঠবে, তা তো আর হবার নয়। কাজেই এই মুহূর্তে এই লেখাটা যতক্ষণ পড়ছেন, ততক্ষণ আমরা যা করতে পারি, তা হলো রসিকতা।
মন্ত্রীর কথা ধরেই এগোই। আচ্ছা, বলুন তো, দিনের বেলা ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার, আর রাতের বেলা হলে যে ৯০ হাজার লোক মারা যাবে—দিন আর রাতের মধ্যে এই পার্থক্যটা কেন?
কারণটা হলো যানজট। দিনের বেলা যানজট থাকে। রাতের বেলা থাকে না। আশা করা হচ্ছে, ১৮ হাজার লোক যানজটে আটকে থাকবে। তারা বেঁচে যাবে।
যানজট জীবনের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ। যানজট ভূমিকম্প থেকে বাঁচার জন্য একান্ত উপকারী।
অতএব যতক্ষণ পারেন, রাস্তায় থাকুন।
৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় মাত্র ৯০ হাজার লোক মারা যাবে শুনে কিন্তু মনে হচ্ছে, আপনি আর আমি মরব না। দেড় কোটির মধ্যে ৭০ হাজার বা ৯০ হাজার মোটেও বেশি না।
আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ১২ জন করে মানুষ মারা যায় গড়ে। বছরে চার হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায় শুধু রাস্তায়। গত ১৫ বছরে দেশে রাস্তায় মারা গেছে ৫৫ হাজার মানুষ। কিন্তু ১৫ বছরে ভূমিকম্পে কেউ মারা গেছে বলে আমার জানা নেই।
এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিন, রাস্তায় থাকবেন, নাকি বাসায় থাকবেন।
তবে ভূমিকম্পের একটা সাম্যবাদী পক্ষপাত আছে। ভূমিকম্পে মরার আশঙ্কা সর্বহারার চেয়ে বুর্জোয়াদের বেশি। সর্বহারা, যারা বস্তিতে থাকে, ভূমিকম্পের প্রথম ধাক্কায় তারা মারা যাবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু যারা দালানে থাকে, তাদের কী হবে, সেটা আল্লাহ্ জানেন।
প্রথম কথা, আমাদের ভবনগুলো যেখানে-সেখানে জলাশয় ভরাট করে তোলা হচ্ছে। এগুলো সামান্য বাতাসে, কখনো কখনো বাতাস ছাড়াই হেলে পড়ে, ঝাঁকুনি লাগলে এগুলোর কী হবে, কেউ বলতে পারে না। ২ নম্বর: এগুলো বেশির ভাগই কোনো রকমের নিয়মকানুন মেনে তৈরি হয়নি, নকশার ঠিকঠিকানা নেই, নকশা ঠিক আছে তো ঠিকাদার সিমেন্ট আর লোহা দিয়েছে কম, মিস্ত্রি ঠিকভাবে পানি দেয়নি, নির্মাণের সময় কারিগরি মান ঠিক রাখার চেষ্টা হয়নি।
কাজেই এ ক্ষেত্রেও আপনার সামনে বাছাই করে নেওয়ার সুযোগ আছে, আপনিই ঠিক করুন, আপনি গাছতলায় থাকবেন, নাকি পাঁচতলায় থাকবেন। গাছতলায় থাকলে ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আমাদের সামনে বেছে নেওয়ার আর একটা সুযোগ আছে। সেটা হলো, আমরা বেছে নিতে পারি, আমরা কি মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়ার ফলে মরব, নাকি ওই সময় বেঁচে থেকে পরবর্তী অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় মারা যাব। ভূমিকম্পে সরাসরি না মরে পরবর্তী দুর্যোগে ঢাকার লোক বেশি মরবে বলে মনে করা হয়।
ভূমিকম্পের যেমন সাম্যবাদী চরিত্র আছে, তেমনি এর আছে গণতান্ত্রিক চরিত্র। সবারই এক ভোট। সবারই একটা করে প্রাণ। মাথার ওপরে ছাদ ভেঙে পড়লে মন্ত্রী, এমপি, সচিব, সৈনিক, ছাত্রনেতা, যুবনেতা, উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, বিচারক, আসামি, কয়েদি—যে কেউই মারা যেতে পারেন।
তবে আমার নিজের ধারণা, আমাদের জাতীয় সংসদটা লুই কান নির্ভুলভাবে নকশা করেছেন এবং এটা নির্মাণের সময় ঠিকাদারেরা ফাঁকি দেননি বা কম দিয়েছেন। কাজেই জাতীয় সংসদ অধিবেশন যদি ওই সময় চলতে থাকে, তাহলে আমাদের গণপ্রতিনিধিরা বেঁচে যাবেন।
এবং তাঁরা যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে আমরা বেঁচে থাকব। কারণ তাঁরা আমাদের প্রতিনিধি।
তাঁরা আমাদের নানাভাবে সম্মানিত করছেন। তাঁরা দামি গাড়ি চড়ছেন, যেহেতু তাঁরা আমাদেরই প্রতিনিধি, কাজেই আমরাই দামি গাড়ি চড়ছি। তাঁরা করমুক্তি পাচ্ছেন বেতনের ওপরে। যেহেতু তাঁরা আমাদেরই প্রতিনিধি, কাজেই আমরাই করমুক্তির সম্মান ও আনন্দ পাচ্ছি। তাঁরা পুলিশের অভিযোগনামা থেকে, খুনের মামলাতেও অব্যাহতি পাচ্ছেন। যেহেতু তাঁরা আমাদেরই প্রতিনিধি, কাজেই আমরাই এতে সম্মানিত হচ্ছি। ভূমিকম্পের সময় যদি তাঁরা জাতীয় সংসদে থাকেন আর বেঁচে যান, যেহেতু তাঁরা আমাদেরই প্রতিনিধি, আমরা সবাই বেঁচে যাব। অন্তত মরে গিয়েও শান্তি পাব যে আমাদের মূল্যবান ভোটে নির্বাচিত আমাদেরই প্রতিনিধিরা বেঁচে আছেন এবং পুরো দেশটাকে ৩৬০ ভাগে ভাগ করে নিয়ে স্বাধীন তালুক প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। শুধু আফসোস, সেই তালুকদারদের সেবা করার জন্য আমরা কেউই বেঁচে থাকব না।
আশা করি, এরপর বিরোধী দল জাতীয় সংসদ অধিবেশনে যোগ দেবেন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.