পাকিস্তান-গণমাধ্যমের জন্য ভয়ংকরতম রাষ্ট্র by হামিদ মির
দিনে দিনে পাকিস্তান গণমাধ্যমের জন্য বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর দেশ হয়ে উঠছে। পাকিস্তানি সাংবাদিকেরা এখন শুধু তালেবানেরই লক্ষ্যবস্তু নন, তাঁরা একই সঙ্গে বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী থেকে শুরু করে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তানের উদারপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোও গণমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতায় খুব একটা খুশি নয়। সব রাজনৈতিক দল একজোট হয়ে সম্প্রতি পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাবও পাস করে।
পাকিস্তানে এবারের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যমগুলো যে ভূমিকা পালন করেছে, তাতে খুশি হতে পারছেন না অনেক রাজনীতিক, এমনকি বেসরকারি সাহায্য সংস্থাও। তাদের অভিযোগ, এবারের বন্যার বিভিন্ন ত্রাণ ও পুনর্বাসনসংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনের সময় গণমাধ্যম সেনাবাহিনীকে অযথাই বেশি করে ওপরে তুলে ধরেছে। গণমাধ্যমে সেনাবাহিনীকে ‘হিরো’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিছু দিন আগে বেশ কয়েকজন টেলিভিশন উপস্থাপকের কাছে অভিযোগ করেছেন, মুত্তাহিদা কাওমি মুভমেন্টের (এমকিউএম) নেতা আলতাফ হোসেন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদের সামরিক শাসনামলের মতো করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। এটা করতে পেরেছেন, কারণ বন্যার ত্রাণ ও পুনর্বাসন নিয়ে সেনাবাহিনীকে গণমাধ্যমের অতিরিক্ত তোষণ। আর এই টিভি উপস্থাপকেরা একটি সেনা গোয়েন্দা সংস্থার হাতে অপহূত সাংবাদিক উমর চিমার প্রসঙ্গ তুললে ওই মন্ত্রী তা সুকৌশলে এড়িয়ে যান। আলোচনার সময় সেই মন্ত্রী উমর চিমার সমর্থনে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
পাকিস্তানে গণমাধ্যম স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে সাধারণ্যে একটি ধারণা প্রচলিত থাকলেও আসল কাহিনি সম্পূর্ণ আলাদা। বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানি সাংবাদিক ও গণমাধ্যম মালিকেরা স্বাধীনতা ভোগ করার নামে বিভিন্ন সময়ে চড়া মূল্য দিয়ে চলেছেন। অনেক সাংবাদিকই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিনিময়ে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেদের সবকিছু, এমনকি জীবনও।
২০১০ সালের প্রথম নয় মাসে পাকিস্তানে বোমা বিস্ফোরণ ও গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন সাতজন সাংবাদিক। এর পাশাপাশি প্রায় ৭০ জনেরও বেশি সাংবাদিককে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। আরও ১০ জনের মতো সাংবাদিক দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অপহূত হয়েছেন, অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৩০ জন সাংবাদিককে গত ছয় বছরে সংবাদ পরিবেশনের জের ধরে বিভিন্ন উপজাতীয় গোত্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। গত দুই বছরে প্রায় ১০ জন সাংবাদিককে সোয়াত উপত্যকা ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে তালেবানদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য। বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করার জন্য ২০ জনকে কোয়েটা শহর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। অনেককে শুধু সাংবাদিকতা করার জন্য পেশোয়ার ছেড়ে ইসলামবাদ চলে আসতে হয়েছে। অনেকের কাজ খুঁজতে হচ্ছে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বাইরে। কেবল তালেবান ও বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্যই নয়, অনেক সময় রাজনৈতিক কারণেও অনেক সাংবাদিককে নির্যাতিত হতে হয়েছে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তো সব সময়ই সাংবাদিকদের ব্যাপারে খড়্গহস্ত। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাতে নির্যাতিত হওয়া সাংবাদিকের সংখ্যাও পাকিস্তানে যথেষ্ট রয়েছে।
অনেক সময় রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে একজোট হয়। তবে অধিকাংশ সময় আলাদা করেও আক্রমণ শাণায়। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের তিনটি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য তারা শত শত কোটি রুপি ক্ষতি হয়েছে। ফ্রান্সভিত্তিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বডার্সের জরিপে ২০০৯ সালে বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতাসূচকে পাকিস্তানের অবস্থান বিশ্বের ১৭৫টি দেশের মধ্যে ১৫৯তম। এ সূচক অনুযায়ী পাকিস্তান তার প্রতিবেশী, অন্যান্য উন্নয়নশীল, এমনকি অনেক স্বল্পোন্নত দেশের চেয়েও অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসংক্রান্ত এ সূচকে প্রতিবেশী যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। এ তালিকায় আফগানিস্তানের অবস্থান ১৪৯তম। ইরাক রয়েছে ১৪৫তম স্থানে। আর প্রতিবেশী ভারত এ তালিকায় ১০৫তম স্থানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের অবস্থান ১২১-এ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ২০০৮ সালে একই সূচকে পাকিস্তানের যে অবস্থান ছিল ২০০৯ সালে এসে পাকিস্তান সেই সূচকে আরও সাত ধাপ পিছিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ১৩৬তম অবস্থান থেকে এগিয়ে ১২১-এ স্থান করে নিয়েছে। ভারত ১১৮ থেকে হয়েছে ১০৫তম। ২০১০ সালে পাকিস্তানে সাংবাদিক নির্যাতনের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা খুবই আশঙ্কার। ২০১০ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে দুজন, ইরাকে চারজন এবং পাকিস্তানে সাতজন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। অর্থাৎ গত নয় মাসে পাকিস্তানের গণমাধ্যমের অবস্থা আফগানিস্তান ও ইরাকের চেয়েও খারাপ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পাকিস্তানে গণমাধ্যমের পরিস্থিতি ২০১০ সালে আরও খারাপ হবে।
যখনই পাকিস্তানি গণমাধ্যম বিভিন্ন সরকারি সংস্থার অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছে, প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, এমনকি বিভিন্ন বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যকর করার তাগিদ দিয়েছে, তখনই ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টির অনেক নেতা অভিযোগ করেছেন, গণমাধ্যম গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। যখন আলতাফ হোসেন ‘দেশপ্রেমিক’ জেনারেলদের বন্যার কারণে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডে গতি আনার জন্য ‘সেনাশাসনসুলভ’ পদক্ষেপের নেওয়ার দাবি জানালেন, তখন কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য মুখে ফেনা তুলে ফেলা পিপিপি নেতারাই মুখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। আলতাফের সেই মন্তব্যের সমালোচনা করে গণমাধ্যমের একটা বড় অংশ সে সময় মন্তব্য করেছিল, ‘খুব ভালো মানের একনায়কতন্ত্রের চেয়ে নিকৃষ্ট গণতান্ত্রিক শাসন সব সময়ই ভালো।’
ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, পাকিস্তানের গণমাধ্যম সব সময়ই গণতন্ত্রের কথা বলেছে, গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু সেই গণমাধ্যমই পিপিপির গণতান্ত্রিক শাসনামলে সব দিক দিয়ে আক্রমণের শিকার হচ্ছে। অথচ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা কিন্তু গণতন্ত্রেরই দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, গণতন্ত্র গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় এবং একে অবাধ রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সম্প্রতি সাংবাদিক উমর চিমা অপহূত হওয়ার পর যেসব সাংবাদিক এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরাও নানা দিক থেকে চাপের শিকার হচ্ছেন। তাঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এমনকি মুখোশধারী ব্যক্তিরা তাঁদের সর্বক্ষণ অনুসরণ করছে। অথচ এই সাংবাদিকেরাই জেনারেল পারভেজ মোশাররফের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই করেছেন, অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
একজন সহকর্মীর অপহরণ ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় সাংবাদিকেরা পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, অথচ গণতন্ত্র এ ক্ষেত্রে তাঁদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। নিজেদের অপকর্ম প্রকাশিত হয়ে পড়ার ভয়ে যারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক নির্যাতন, অপহরণ প্রভৃতি অপকর্ম করে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এসব অপরাধী গণতন্ত্রকে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। এত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংবাদিকেরা কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে সোচ্চার। অথচ এই গণতন্ত্রই কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
হামিদ মির: পাকিস্তানের জিয়ো টিভির নির্বাহী সম্পাদক।
hamid.mir@geo.tv
পাকিস্তানে এবারের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যমগুলো যে ভূমিকা পালন করেছে, তাতে খুশি হতে পারছেন না অনেক রাজনীতিক, এমনকি বেসরকারি সাহায্য সংস্থাও। তাদের অভিযোগ, এবারের বন্যার বিভিন্ন ত্রাণ ও পুনর্বাসনসংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনের সময় গণমাধ্যম সেনাবাহিনীকে অযথাই বেশি করে ওপরে তুলে ধরেছে। গণমাধ্যমে সেনাবাহিনীকে ‘হিরো’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিছু দিন আগে বেশ কয়েকজন টেলিভিশন উপস্থাপকের কাছে অভিযোগ করেছেন, মুত্তাহিদা কাওমি মুভমেন্টের (এমকিউএম) নেতা আলতাফ হোসেন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদের সামরিক শাসনামলের মতো করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। এটা করতে পেরেছেন, কারণ বন্যার ত্রাণ ও পুনর্বাসন নিয়ে সেনাবাহিনীকে গণমাধ্যমের অতিরিক্ত তোষণ। আর এই টিভি উপস্থাপকেরা একটি সেনা গোয়েন্দা সংস্থার হাতে অপহূত সাংবাদিক উমর চিমার প্রসঙ্গ তুললে ওই মন্ত্রী তা সুকৌশলে এড়িয়ে যান। আলোচনার সময় সেই মন্ত্রী উমর চিমার সমর্থনে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
পাকিস্তানে গণমাধ্যম স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে সাধারণ্যে একটি ধারণা প্রচলিত থাকলেও আসল কাহিনি সম্পূর্ণ আলাদা। বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানি সাংবাদিক ও গণমাধ্যম মালিকেরা স্বাধীনতা ভোগ করার নামে বিভিন্ন সময়ে চড়া মূল্য দিয়ে চলেছেন। অনেক সাংবাদিকই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিনিময়ে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেদের সবকিছু, এমনকি জীবনও।
২০১০ সালের প্রথম নয় মাসে পাকিস্তানে বোমা বিস্ফোরণ ও গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন সাতজন সাংবাদিক। এর পাশাপাশি প্রায় ৭০ জনেরও বেশি সাংবাদিককে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। আরও ১০ জনের মতো সাংবাদিক দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অপহূত হয়েছেন, অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৩০ জন সাংবাদিককে গত ছয় বছরে সংবাদ পরিবেশনের জের ধরে বিভিন্ন উপজাতীয় গোত্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। গত দুই বছরে প্রায় ১০ জন সাংবাদিককে সোয়াত উপত্যকা ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে তালেবানদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য। বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করার জন্য ২০ জনকে কোয়েটা শহর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। অনেককে শুধু সাংবাদিকতা করার জন্য পেশোয়ার ছেড়ে ইসলামবাদ চলে আসতে হয়েছে। অনেকের কাজ খুঁজতে হচ্ছে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বাইরে। কেবল তালেবান ও বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্যই নয়, অনেক সময় রাজনৈতিক কারণেও অনেক সাংবাদিককে নির্যাতিত হতে হয়েছে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তো সব সময়ই সাংবাদিকদের ব্যাপারে খড়্গহস্ত। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাতে নির্যাতিত হওয়া সাংবাদিকের সংখ্যাও পাকিস্তানে যথেষ্ট রয়েছে।
অনেক সময় রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে একজোট হয়। তবে অধিকাংশ সময় আলাদা করেও আক্রমণ শাণায়। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের তিনটি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য তারা শত শত কোটি রুপি ক্ষতি হয়েছে। ফ্রান্সভিত্তিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বডার্সের জরিপে ২০০৯ সালে বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতাসূচকে পাকিস্তানের অবস্থান বিশ্বের ১৭৫টি দেশের মধ্যে ১৫৯তম। এ সূচক অনুযায়ী পাকিস্তান তার প্রতিবেশী, অন্যান্য উন্নয়নশীল, এমনকি অনেক স্বল্পোন্নত দেশের চেয়েও অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসংক্রান্ত এ সূচকে প্রতিবেশী যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। এ তালিকায় আফগানিস্তানের অবস্থান ১৪৯তম। ইরাক রয়েছে ১৪৫তম স্থানে। আর প্রতিবেশী ভারত এ তালিকায় ১০৫তম স্থানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের অবস্থান ১২১-এ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ২০০৮ সালে একই সূচকে পাকিস্তানের যে অবস্থান ছিল ২০০৯ সালে এসে পাকিস্তান সেই সূচকে আরও সাত ধাপ পিছিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ১৩৬তম অবস্থান থেকে এগিয়ে ১২১-এ স্থান করে নিয়েছে। ভারত ১১৮ থেকে হয়েছে ১০৫তম। ২০১০ সালে পাকিস্তানে সাংবাদিক নির্যাতনের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা খুবই আশঙ্কার। ২০১০ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে দুজন, ইরাকে চারজন এবং পাকিস্তানে সাতজন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। অর্থাৎ গত নয় মাসে পাকিস্তানের গণমাধ্যমের অবস্থা আফগানিস্তান ও ইরাকের চেয়েও খারাপ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পাকিস্তানে গণমাধ্যমের পরিস্থিতি ২০১০ সালে আরও খারাপ হবে।
যখনই পাকিস্তানি গণমাধ্যম বিভিন্ন সরকারি সংস্থার অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছে, প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, এমনকি বিভিন্ন বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যকর করার তাগিদ দিয়েছে, তখনই ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টির অনেক নেতা অভিযোগ করেছেন, গণমাধ্যম গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। যখন আলতাফ হোসেন ‘দেশপ্রেমিক’ জেনারেলদের বন্যার কারণে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডে গতি আনার জন্য ‘সেনাশাসনসুলভ’ পদক্ষেপের নেওয়ার দাবি জানালেন, তখন কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য মুখে ফেনা তুলে ফেলা পিপিপি নেতারাই মুখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। আলতাফের সেই মন্তব্যের সমালোচনা করে গণমাধ্যমের একটা বড় অংশ সে সময় মন্তব্য করেছিল, ‘খুব ভালো মানের একনায়কতন্ত্রের চেয়ে নিকৃষ্ট গণতান্ত্রিক শাসন সব সময়ই ভালো।’
ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, পাকিস্তানের গণমাধ্যম সব সময়ই গণতন্ত্রের কথা বলেছে, গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু সেই গণমাধ্যমই পিপিপির গণতান্ত্রিক শাসনামলে সব দিক দিয়ে আক্রমণের শিকার হচ্ছে। অথচ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা কিন্তু গণতন্ত্রেরই দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, গণতন্ত্র গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় এবং একে অবাধ রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সম্প্রতি সাংবাদিক উমর চিমা অপহূত হওয়ার পর যেসব সাংবাদিক এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরাও নানা দিক থেকে চাপের শিকার হচ্ছেন। তাঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এমনকি মুখোশধারী ব্যক্তিরা তাঁদের সর্বক্ষণ অনুসরণ করছে। অথচ এই সাংবাদিকেরাই জেনারেল পারভেজ মোশাররফের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই করেছেন, অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
একজন সহকর্মীর অপহরণ ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় সাংবাদিকেরা পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, অথচ গণতন্ত্র এ ক্ষেত্রে তাঁদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। নিজেদের অপকর্ম প্রকাশিত হয়ে পড়ার ভয়ে যারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক নির্যাতন, অপহরণ প্রভৃতি অপকর্ম করে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এসব অপরাধী গণতন্ত্রকে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। এত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংবাদিকেরা কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে সোচ্চার। অথচ এই গণতন্ত্রই কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
হামিদ মির: পাকিস্তানের জিয়ো টিভির নির্বাহী সম্পাদক।
hamid.mir@geo.tv
No comments