দুই রাতে কয়েক হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ!

সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির সতর্কতা সত্ত্বেও গত শুক্র ও শনিবার রাতে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল রবিবার গুলিবিদ্ধ দুই অনুপ্রবেশকারীকে পুলিশ আটক করেছে। জানা গেছে, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে রাতের আঁধারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে।


বিজিবি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের খবর অস্বীকার করলেও গত দুই দিনে আহত বহু রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে বলে সীমান্তের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। সীমান্তে আরো কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা না নিলে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে আরাকানের মংডু থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গতকাল সকালেও প্রাণহানি হয়েছে। মংডুর আশপাশে কারফিউ চলছে।
জানা গেছে, মংডুতে গত শুক্রবার সহিংসতা শুরুর পর থেকেই টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও সাবরাং সীমান্ত দিয়ে নৌকাযোগে এসে তারা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে আগে থেকে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের কাছে। এরপর শনিবার রাতে অনুপ্রবেশ করে আরো কমপক্ষে দুই হাজার রোহিঙ্গা। টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে জানান, শনিবার রাতের আঁধারে অনেক কষ্ট করে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা এপারে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। তিনি আরো জানান, ওই রাতেই রোহিঙ্গাদের বহনকারী ছয়টি নৌকা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও সাবরাং সীমান্তে এসে পৌঁছে। সকাল হয়ে যাওয়ায় আরো দুটি নৌকা ভিড়তে পারেনি।
এদিকে আরাকানের মংডু থেকে গতকাল পাওয়া খবরে জানা গেছে, টেকনাফে আসার জন্য বেশ কয়েকটি নৌকা ভাড়া করে রাখা হয়েছে। অনুকূল পরিবেশ পেলেই তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করবে।
কক্সবাজারে বিজিবি-১৭ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল খালেকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে জানান, 'আমরা বরাবরই সজাগ রয়েছি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে। আমাদের জানা মতে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেনি।' টেকনাফে বিজিবি-৪২ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারাও বলেছেন, তাঁরা নাফ নদীর তীরে অবিরাম টহল অব্যাহত রেখেছেন। কোনোভাবেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে তাঁরা জানিয়েছেন।
এদিকে মিয়ানমারের অনুপ্রবেশকারী গুলিবিদ্ধ একজন রোহিঙ্গাকে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গতকাল সকালে পুলিশ আটক করেছে। আটক ব্যক্তির নাম তৈয়ব (২৫)। তিনি মংডুর বাসিন্দা। অন্যদিকে গতকাল সকালে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা কালা হোসেন (৫০) নামের আরো একজন গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গাকে পুলিশ আটক করেছে। জানা গেছে, পুলিশের হাতে আটক হওয়া থেকে বাঁচতে গুলিবিদ্ধ আরো অনেক রোহিঙ্গা গোপনে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা (আরআরসি) ও সরকারের যুগ্ম সচিব ফিরোজ সালাহ উদ্দিন গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, মিয়ানমার থেকে নতুন করে কোনো অনুপ্রবেশকারী যাতে টেকনাফ ও উখিয়ার দুটি রোহিঙ্গা শিবিরে ঢুকতে না পারে, সেজন্য শিবিরের পুলিশ ও আনসারদের সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে।
ফিরোজ সালাহ উদ্দিন বলেন, ইতিমধ্যে শিবির দুটি থেকে শরণার্থীদের বাইরে যাওয়া-আসায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
ফিরেছে ৩৯ বাংলাদেশি : মিয়ানমারের আরকানে সংঘাতের পর আটকে পড়া ৫৫ বাংলাদেশির মধ্যে ৩৯ জন গতকাল রবিবার দুপুর ২টার দিকে টেকনাফ স্থল বন্দর ইমিগ্রেশন দিয়ে ফিরে এসেছে। অভিবাসন কর্মকর্তা আবদুল কাদের সিদ্দিকী জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় মিয়ানমারের ১০ নাগরিক দেশে ফিরে গেছেন।
ফিরে আসা বাংলাদেশিরা জানিয়েছে, মিয়ানমারের পুলিশের গুলিতে গতকাল সকালেও সীমান্তের ওপারে এক মুসলিম কিশোরী নিহত হয়েছে। শুক্রবার থেকেই তারা মুহুর্মুহু গুলির শব্দে আতঙ্কে সময় কাটিয়েছে।
বান্দরবান সীমান্তেও বিজিবি সতর্কাবস্থায়, নাইক্ষ্যংছড়িতে বিশেষ টহল চৌকি : অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বেতবুনিয়া বাজার এলাকায় একটি বিশেষ টহল চৌকি বসানো হচ্ছে। গতকাল রবিবার বান্দরবান জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় টহল চৌকি বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। জেলা প্রশাসক কে এম তারিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান বীর বাহাদুর এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ সুপার কামরুল আহসান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইশরাত জামান, সেনাবাহিনী ও বিজিবি প্রতিনিধি, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, উপজেলাগুলোর চেয়ারম্যান ও নির্বাহী অফিসারসহ জেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্যরা এতে উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সীমান্তের ওপারের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এপারে বিজিবি এবং পুলিশ বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার কামরুল আহসান সভায় জানান, বর্তমানে বান্দরবান জেলার বিভিন্ন এলাকায় রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। গত ১০ দিনে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ১০৪ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে বিদেশি নাগরিক আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে।
সভায় অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাসহ অননুমোদিতভাবে অবস্থানকারী সব বিদেশিকে গ্রেপ্তার করার জন্য চলমান নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি বিশেষ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকার সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্তের এপারে বিজিবিকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.