শ্রদ্ধাঞ্জলি-‘রঙের দুনিয়া’ ছেড়ে গেলেও তিনি আছেন by সুমনকুমার দাশ
পশ্চিমে বরাম হাওর। দক্ষিণজুড়ে কালনী নদী। এ রকম হাওর-নদীর জলপ্রকৃতির গ্রাম উজানধল। হিজল-করচ-বরুণ বৃক্ষরাজি যেন অতন্দ্রপ্রহরীর মতো। সামান্য বৃষ্টি হলেই কাদামাটির সোঁদা গন্ধ বের হয়। হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত অতি দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলো পূজায়, ঈদে উৎসবের আনন্দে জেগে ওঠে।
প্রকৃতির প্রতিবেশী সহজ-সরল মানুষগুলোর অন্তর হাওরের লিলুয়া বাতাসে বাউল হতে চায়। সারা দিন মাঠে কৃষিকাজ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে উঠোনে মাদুর পেতে ওরা মনের আনন্দে খোশগল্পে মেতে ওঠে। আড্ডা একসময় রূপ নেয় গানের আসরে। এ আসরের নিয়মিত সদস্য উজানধল গ্রামেরই ১০ বছরের এক ংরাখাল বালক। হাতে একতারা নিয়ে সুরেলা কণ্ঠে সুর তোলেন—‘ভাবিয়া দেখো মনে, মাটির সারিন্দারে বাজায় কোন জনে...’। এভাবেই রাখাল বালকের গানের ভুবনে অভিষেক। এরপর বাকিটা ইতিহাস। তিনি এখন বাঙালির লোকগানের কিংবদন্তি পুরুষ বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম। ১২ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালের এই দিনে তিনি তাঁর গানের কথার মতো ‘রঙের দুনিয়া’ থেকে চিরবিদায় নেন।
১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধলআশ্রম গ্রামে শাহ আবদুল করিমের জন্ম। বাবা ইব্রাহিম আলী ছিলেন নিতান্তই দরিদ্র কৃষক, মা নাইওরজান বিবি গৃহিণী। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। আর্থিক দৈন্যের কারণে বালক আবদুল করিম ১০ বছর বয়সেই গ্রামের এক গৃহস্থের বাড়িতে রাখালের চাকরি নেন। মাঠে গরু চরানোর ফাঁকে আর সন্ধ্যায় নিজ গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির উঠোনে মনের আনন্দে গান গাইতেন। মানুষজন করিমের আপন খেয়ালে গাওয়া গান বেশ উপভোগ করতেন। আস্তে আস্তে করিমও জড়িয়ে পড়েন বাউল গানের সঙ্গে। এভাবেই বেড়ে উঠতে থাকেন। একসময় নিজ গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকায় করিমের ডাক পড়ে। তিনিও নিজের সুরের পরশে জড়িয়ে নেন অগণিত মানুষকে। ফলে যুবক বয়সেই তিনি হয়ে ওঠেন হাওরবাসীর প্রিয় ‘করিম বাউল’।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীর সমর্থনে গণসংগীত পরিবেশন, ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে অংশ নিয়ে কবিয়াল রমেশ শীলের সঙ্গে এক মঞ্চে সংগীত পরিবেশন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জাগরণের গান গেয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিল তাঁর অন্তরঙ্গতা। গণসংগীতের পাশাপাশি বাউল ও বিচ্ছেদ গান লিখে এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের কাছে হয়েছেন সমাদৃত। ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার লোকসংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে একুশে পদক দেয়। তাঁর লেখা গানের সংকলনগুলোর মধ্যে আফতাব সংগীত, গণসংগীত, কালনীর ঢেউ, ভাটির চিঠি, ধলমেলা ও কালনীর কূলে উল্লেখযোগ্য। ২০০৯ সালের ২২ মে বাউলসম্রাটের সমগ্র রচনা নিয়ে কবি শুভেন্দু ইমামের সংকলন ও গ্রন্থনায় বের হয়েছে শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র।
শাহ আবদুল করিম জীবনভর গণমানুষের পক্ষে কথা বলেছেন এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামে গান গেয়ে উজ্জীবিত করেছেন দেশের মানুষকে। নির্লোভ ও মানবপ্রেমী এই মানুষটি ছিলেন হাওর ও ভাটির রূপকার। কিন্তু আজ হাওরে গান আছে, সুর আছে, লিলুয়া বাতাস আছে। তবুও এক বেদনাবোধ কুরে কুরে খায় সবাইকে। যে মানুষটি দীর্ঘ আট দশক ভাটি অঞ্চল তথা বাংলা ভাষাভাষীকে সুরসুধায় মুগ্ধ করেছিলেন সেই মানুষটি আর নেই। এখনো হাওরের প্রতিটি বাড়িতে যাত্রা, পালা, কীর্তন, ধামাইল, জারি, সারি, কেচ্ছাপাঠ ও বাউল গানের আসর, ষাঁড়ের লড়াই, ভাইয়াপি কুস্তি ও নৌকাবাইচ হয়। সেসব জায়গায় কথা প্রসঙ্গে ঘুরেফিরে আসে একটি নাম—বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম। বাউলের প্রতি হাওরবাসীর ভালোবাসা আর মমতার পাশাপাশি বাংলা ভাষাভাষী মানুষজন চিরকাল তাঁকে স্মরণ রাখবে। অনাদিকাল পর্যন্ত সুর, কথা আর গানের জাদুকর হিসেবে কিংবদন্তি এই বাউল বেঁচে থাকবেন। বাউলসম্রাটের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধলআশ্রম গ্রামে শাহ আবদুল করিমের জন্ম। বাবা ইব্রাহিম আলী ছিলেন নিতান্তই দরিদ্র কৃষক, মা নাইওরজান বিবি গৃহিণী। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। আর্থিক দৈন্যের কারণে বালক আবদুল করিম ১০ বছর বয়সেই গ্রামের এক গৃহস্থের বাড়িতে রাখালের চাকরি নেন। মাঠে গরু চরানোর ফাঁকে আর সন্ধ্যায় নিজ গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির উঠোনে মনের আনন্দে গান গাইতেন। মানুষজন করিমের আপন খেয়ালে গাওয়া গান বেশ উপভোগ করতেন। আস্তে আস্তে করিমও জড়িয়ে পড়েন বাউল গানের সঙ্গে। এভাবেই বেড়ে উঠতে থাকেন। একসময় নিজ গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকায় করিমের ডাক পড়ে। তিনিও নিজের সুরের পরশে জড়িয়ে নেন অগণিত মানুষকে। ফলে যুবক বয়সেই তিনি হয়ে ওঠেন হাওরবাসীর প্রিয় ‘করিম বাউল’।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীর সমর্থনে গণসংগীত পরিবেশন, ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে অংশ নিয়ে কবিয়াল রমেশ শীলের সঙ্গে এক মঞ্চে সংগীত পরিবেশন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জাগরণের গান গেয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিল তাঁর অন্তরঙ্গতা। গণসংগীতের পাশাপাশি বাউল ও বিচ্ছেদ গান লিখে এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের কাছে হয়েছেন সমাদৃত। ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার লোকসংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে একুশে পদক দেয়। তাঁর লেখা গানের সংকলনগুলোর মধ্যে আফতাব সংগীত, গণসংগীত, কালনীর ঢেউ, ভাটির চিঠি, ধলমেলা ও কালনীর কূলে উল্লেখযোগ্য। ২০০৯ সালের ২২ মে বাউলসম্রাটের সমগ্র রচনা নিয়ে কবি শুভেন্দু ইমামের সংকলন ও গ্রন্থনায় বের হয়েছে শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র।
শাহ আবদুল করিম জীবনভর গণমানুষের পক্ষে কথা বলেছেন এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামে গান গেয়ে উজ্জীবিত করেছেন দেশের মানুষকে। নির্লোভ ও মানবপ্রেমী এই মানুষটি ছিলেন হাওর ও ভাটির রূপকার। কিন্তু আজ হাওরে গান আছে, সুর আছে, লিলুয়া বাতাস আছে। তবুও এক বেদনাবোধ কুরে কুরে খায় সবাইকে। যে মানুষটি দীর্ঘ আট দশক ভাটি অঞ্চল তথা বাংলা ভাষাভাষীকে সুরসুধায় মুগ্ধ করেছিলেন সেই মানুষটি আর নেই। এখনো হাওরের প্রতিটি বাড়িতে যাত্রা, পালা, কীর্তন, ধামাইল, জারি, সারি, কেচ্ছাপাঠ ও বাউল গানের আসর, ষাঁড়ের লড়াই, ভাইয়াপি কুস্তি ও নৌকাবাইচ হয়। সেসব জায়গায় কথা প্রসঙ্গে ঘুরেফিরে আসে একটি নাম—বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম। বাউলের প্রতি হাওরবাসীর ভালোবাসা আর মমতার পাশাপাশি বাংলা ভাষাভাষী মানুষজন চিরকাল তাঁকে স্মরণ রাখবে। অনাদিকাল পর্যন্ত সুর, কথা আর গানের জাদুকর হিসেবে কিংবদন্তি এই বাউল বেঁচে থাকবেন। বাউলসম্রাটের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
No comments