চারদিক-আমার মা by অধ্যাপক মধুশ্রী ভদ্র
সুমধুর ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী ছিলেন আমার মা। আকাশের মতো উদার ছিল তাঁর মন। আমার মা ছিলেন এমন একটা সময়ের প্রতিচ্ছবি, যে যুগে মেয়েদের শিক্ষার সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা, পারিবারিক দায়িত্ব, কর্মজীবনে নিষ্ঠাসহ কতকগুলো মূল্যবোধ জড়িত ছিল।
সাহিত্য ও গবেষণা ক্ষেত্রে মা যেমন সফলতা অর্জন করেছিলেন, তেমনি তিনি সফলতা অর্জন করছিলেন তাঁর শিক্ষকতা জীবনেও। শিক্ষাই জীবন এবং জীবনের জন্য শিক্ষা—এই নীতি তাঁকে আত্মোৎকর্ষের হিরণ্ময় পথে ধাপে ধাপে উত্তীর্ণ করেছে। বাংলাদেশের নারীদের চলার পথে, বিদ্যা অর্জনের পথে কত বাধা, কত বিঘ্ন, কত শত প্রতিকূলতা। এসব বাধা-বিঘ্ন-প্রতিকূলতা পেরিয়ে নির্ভীক ও দৃপ্ত সাহসে এগিয়ে গেছেন এই শিক্ষাব্রতী, বহু গ্রন্থের প্রণেতা এক প্রজ্ঞাসম্পন্ন নারী অধ্যাপক মঞ্জুশ্রী চৌধুরী।
আমার পরমারাধ্য মাতৃদেবী ছিলেন সেই যুগের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসটিংশন গ্র্যাজুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিটি (প্রথম শ্রেণী) এবং এমএ, এমএড (প্রথম শ্রেণী), পিএইচডি। তিনি ছিলেন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান, তাই তো যোগ্যতার প্রকাশ ঘটিয়ে, মেধা ও মননের সমন্বয় ঘটিয়ে, কত যুগ আগে পুরুষশাসিত সমাজে নিজ প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে দক্ষতার সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে ও প্রশাসনে স্থান করে নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে একটি সুপরিচিত নাম ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরী। আমার মমতাময়ী মা, কল্যাণময়ী মা, যিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও সর্বোপরি একজন সুশিক্ষক। জ্ঞান হওয়া অবধি একটি পবিত্র দৃশ্য দেখে আমি বড় হয়েছি। দৃশ্যটি দেখে আমি কেবলই মুগ্ধ হতাম। সেই দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যটি এ রকম—মায়ের বিবাহকালীন সাবেকি নকশা করা উঁচু বার্মাটিকের বিরাট পালঙ্কজুড়ে শুধু বই আর বই। ইট দিয়ে যেমন করে মানুষ দালান গাঁথে, তেমনি মায়ের বিছানাজুড়ে তিন পাশে শুধু বইয়ের সারি, আর এই বইয়ের দেয়ালের মাঝখানে বসে মা সাহিত্যচর্চা ও লেখালেখিতে গভীরভাবে মগ্ন থাকতেন, এমনকি বিয়ের পরও কলেজ ছুটি হলে স্বামী-সন্তানসহ যখনই এসেছি তাঁর কাছে, নয়নলোভন এই দৃশ্যটি দেখে অভিভূত হয়েছি।
আধুনিক চিন্তাচেতনায় ঋদ্ধ তাঁর রচিত গ্রন্থ সুশিক্ষক, বাংলা শিক্ষণ পদ্ধতি, শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের কথা, শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞান, শিশুর জীবন বিকাশ, রবীন্দ্র ভাবন, রবীন্দ্রনাথের রূপক সাংকেতিক নাটক ইত্যাদি শিক্ষাক্ষেত্রে অতুলনীয় অবদানের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এ ছাড়া অজস্র প্রবন্ধ ও ছোটগল্প তিনি লিখেছেন।
এত উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও মায়ের মধ্যে দেখেছি শাশ্বত বাংলার কল্যাণময়ী রূপ। শুনেছি, আমরা যখন খুব ছোট, তখন মা নিজ যোগ্যতাবলে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন বৈরুত ও কলেরেডো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। আমরা তিন ভাইবোন (শুভাগত, মধুশ্রী ও অরূপ) তখন নাবালক, মাতৃসান্নিধ্য বঞ্চিত হলে আমাদের মনে আঘাত লাগবে, এই চিন্তা করে বিদেশে শিক্ষালাভ করার লোভনীয় প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। সংসারের যাবতীয় কাজ, সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নানাবিধ দায়িত্ব পালন, শ্রেণীকক্ষে পাঠদান, গবেষণাকর্ম—এত সব কাজ করেও আমার দায়িত্ব-সচেতন মা নিয়মিত গ্রন্থ রচনা ও লেখালেখি করে গেছেন। আমার মা রন্ধনশিল্প ও সূচিশিল্পেও স্বর্ণপদক লাভ করেছেন। তাঁর গানের গলাও ছিল চমৎকার। সুরেলা কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, যা ছিল অসাধারণ। আমাদের সংগীতের হাতেখড়িও মায়ের কাছে।
আমার আনন্দময়ী জননী তাঁর প্রত্যেক সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত করে প্রমাণ করেছেন যে কর্মজীবী নারীরাও সফল ও সার্থক মা হতে পারেন, সুগৃহিণীও বটে!
মায়ের জীবনে ধ্রুবতারা ছিলেন আমার বাবা সিলেটের জমিদার শৈলেন্দ্র কুমার চৌধুরী। জমিদার বাড়ির বউ হয়েও বিত্ত-বৈভব, অর্থসম্পত্তির প্রতি মায়ের কোনো আকর্ষণ ছিল না। শিক্ষানুরাগী স্বামীর উৎসাহে মা সারা জীবন সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চা করে গেছেন।
আমার শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে। সেখানে একটানা ১৫ বছর অধ্যাপনা করছি বোটানি বিভাগে। মা-বাবা ঢাকায় থাকতেন, তখন মুঠোফোনের চল ছিল না। প্রতি সপ্তাহে মা-বাবা আমাদের দুটো করে চিঠি লিখতেন। চিঠিতে মা শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের প্রস্তুতি, কলাকৌশল, বাকৈশলী, পাঠদানে দক্ষতা সম্পর্কে পরামর্শ দিতেন, সেই সঙ্গে প্রতিটি চিঠিতে থাকত একটা করে কোটেশন; যেমন— ‘একজন উত্তম অধ্যাপক একজন উত্তম ছাত্র’ বা ‘যেখানে অধ্যাপকগণ জ্ঞানের চর্চায় স্বয়ং প্রবৃত্ত, সেখানেই ছাত্রগণ বিদ্যাকে প্রত্যক্ষ দেখিতে পায়’—যা পড়ে আমি উজ্জীবিত হতাম।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী মা সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চা এবং বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের জন্য লেখিকা সংঘ পদক, শেরে বাংলা পদক, অনন্যা সম্মাননা পদক, নন্দিনী সাহিত্য পুরস্কার, সাজিদুন্নেসা চৌধুরানী পদকসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হলেও প্রকৃত অর্থে যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি এই মহীয়সী নারীর। মা তাঁর তিন কৃতী সন্তানের জন্য গ্র্যান্ড আজাদ রত্নগর্ভা মা-২০০৫ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন কিন্তু আমার কাছে সব সময় মনে হয়—‘মা নিজেই একজন অমূল্য রত্ন।’
আজ ১১ জুন। আজ থেকে ছয় বছর আগে মা অমর্ত্যলোকে যাত্রা করেছেন। এখন আর আমি আমার মায়ের শান্ত-স্নিগ্ধ হিরণ্ময় মুখটি দেখতে পাই না, কোনো সংকটে পড়লে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারি না, ‘মাগো, পথ দেখাও।’ তবে আমি অনুভব করি, আমার সব কাজের উৎস হয়ে আছেন আমার পুণ্যবতী, গুণবতী, প্রেরণাদাত্রী মা জননী।
অধ্যাপক মধুশ্রী ভদ্র
madhusree01@yahoo.com
No comments