রোহিঙ্গা সংকট-২-রোহিঙ্গারা সহজেই মিশে যাচ্ছে মূল জনগোষ্ঠীতে by মেহেদী হাসান ও রফিকুল ইসলাম
শারীরিক গঠনে মিল। আছে ভাষাগত মিল। এই সুযোগে মিয়ানমারের অনুপ্রবেশকারীরা মিশে যাচ্ছে কক্সবাজার এলাকার মূল জনস্রোতের সঙ্গে। মিয়ানমারের নাগরিক হওয়ার পরও বাংলাদেশে তাদের কেউ এখন শহরের রিকশাচালক, আবার কেউ নৌযানের দক্ষ নাবিক। তাদের নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ার স্বপ্ন এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে।
সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় করে বসতি নির্মাণের পর এবার তাদের স্রোত উপকূলঘেঁষে কক্সবাজার শহরের দিকে বহমান। রোহিঙ্গা নামে পরিচিত মিয়ানমারের ওই অনুপ্রবেশকারীদের বছরের পর বছর বাংলাদেশে অবস্থান করা নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ কক্সবাজার বিশেষ করে টেকনাফ, উখিয়া উপজেলার জনগণ।
২৮ মে, ২০১২। বিকেলে ইনানি সৈকতের পাশেই দেখা হয় সাত-আট শিশুর সঙ্গে। সাগরের পাশেই উপকূলঘেঁষে তাদের জীর্ণ-শীর্ণ ঘর। নাম জিজ্ঞাসা করতেই অকপটে নাম বলে শিশুরা। মিনা, সোলায়মান, আবদুল আওয়াল- এর মতো পরিচিত কিছু নাম শুনে আর চেহারা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে তারা এ দেশি নয়। পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সী ওই শিশুদের সবারই জন্ম বাংলাদেশে। ওদের বাবা-মা মিয়ানমার থেকে এলেও সে দেশের সরকার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। এ দেশে জন্ম হওয়া মিয়ানমারের অনুপ্রবেশকারীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব কী হবে তা নিয়ে ভবিষ্যৎ বিতর্ক ও চাপ অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য।
অটোরিকশাচালক ইখতিয়ার উদ্দিন বিরক্তির সুরে বলেন, মিয়ানমার থেকে আগতরা বছরের পর বছর টেকনাফ ও উখিয়ার বনভূমি ধ্বংস করে এবার সমুদ্রসৈকতকেও গ্রাস করতে চলেছে। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেন কোনো দুর্ভাবনা নেই। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল জলিল সমুদ্রসৈকতে অনুপ্রবেশকারীদের কয়েকটি ঘর দেখিয়ে বলেন, এই পরিবারের লোকজন মাঝে মাঝেই তাদের বাড়িতে আসে সাহায্যের জন্য। তিনি পাশে নির্মাণাধীন রাস্তার শ্রমিকদের দেখিয়ে বলেন, ওদের দেখতে বাংলাদেশি মনে হলেও আসলে ওরা রোহিঙ্গা।
স্থানীয় শ্রমিকদের চেয়ে কম দামে ওরা শ্রম দেয়। জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে মিয়ানমারের কয়েক লাখ অনিবন্ধিত নাগরিক রয়েছে। তাদের নাম, পরিচয় বা অতীতে কাজের ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্য সরকারি কোনো দপ্তরে নেই। বছরের পর বছর তাদের উপস্থিতি স্থানীয় শ্রমবাজার, মৎস্য খাত, বনজ সম্পদের ওপর প্রভাব সৃষ্টিসহ সার্বিকভাবে ব্যাপক সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করছে। আগামী দিনগুলোতে এ সমস্যা আরো প্রকট হবে বলে আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।
উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের পাশে বখতিয়ার মার্কেট এলাকায় যেন স্থায়ী হতে চলেছে রোহিঙ্গারা। প্রায় দুই দশক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বখতিয়ার মেম্বার। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে কথা হয় কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের বাইরে। তাঁর সামনেই ছিলেন রোহিঙ্গাদের কয়েকজন সর্দার। বখতিয়ার মেম্বার জানান, 'মিয়ানমারে এখনো বলার মতো কোনো পরিবর্তন না আসায় রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চায় না।'
তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময়ই সেখানে উপস্থিত হয় দুই রোহিঙ্গা নারী। অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে সমস্যা হওয়াতেই তাঁরা সেখানে আসেন। ওই নারীরা জানান, এক স্বজনের মৃত্যু সংবাদ শুনে তাঁরা মিয়ানমার গিয়েছিলেন এক সপ্তাহ আগে। সীমান্ত থেকে অটোরিকশা নিয়ে আবার তাঁরা বখতিয়ার বাজার এলাকায় ফিরে এসেছেন। এখানেই শরণার্থী শিবিরের পাশে তাঁদের ঘর রয়েছে।
বখতিয়ার বাজার থেকে তমব্রু সীমান্ত এলাকায় যাওয়ার পথে স্থানীয় এক সাংবাদিক জানান, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল রোহিঙ্গাদের উপস্থিতিতে লাভবান হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বসতি গড়তে তারা যেমন সাহায্য করে, তেমনি তাদের আয়ের ওপরও ভাগ বসায়।
স্বজনের মৃত্যুর খবর শুনে মিয়ানমার গিয়ে আবার দুই নারীর ফিরে আসার ঘটনা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, সেখানে পরিস্থিতি যেমন খারাপের কথা বলা হয় তা যদি সত্যিই হতো তাহলে তাঁরা যেতেন না বা এত সহজে ফিরতে পারতেন না। তিনি বলেন, অনুপ্রবেশের মূল কারণ অর্থনৈতিক। ওখানে কাজের সুযোগ নেই, এখানে আছে। আর এখানে অনেক স্বাধীনভাবে তাঁরা থাকতে পারছেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়লেও ঝামেলা এড়াতে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা অভিযোগ স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, আটক করার পর বিচার ও সাজা ভোগশেষে তাঁদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু মিয়ানমার তাঁদের গ্রহণ না করলে তাঁদের ভার তো বাংলাদেশের ওপরই বর্তাবে।
উখিয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জহিরুল ইসলাম তাঁর উপজেলায় অনিবন্ধিত প্রায় ২৮ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থানের কথা স্বীকার করলেও সঠিক কোনো তথ্য নেই বলে জানান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, সার্বিক পরিবেশ, উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ইউএনও জানান, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক সম্প্রতি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করছে এমন বিদেশি কিছু এনজিও এসিএফ, মুসলিম এইডের যাবতীয় কর্মকাণ্ড কঠোর পর্যবেক্ষণে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ইউএনও স্বীকার করেন, রোহিঙ্গাদের অনেকে এ দেশের ভোটার তালিকায় নাম উঠিয়েছে ও জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সঠিক কোনো তথ্য নেই। এসবের পেছনে স্থানীয় কমিউনিটি, জনপ্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত বলে তিনি জানান।
উখিয়ার ইউএনও আরো বলেন, স্থানীয় মাদকচক্রের সহায়তায় রোহিঙ্গারা নানা অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত। স্থানীয় ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে না ওঠা পর্যন্ত এগুলো রোধ করা সম্ভব নয়। অনুপ্রবেশ রোধ ও অপরাধ দমনে পুলিশ, বিজিবিকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা আছে বলেও তিনি জানান।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপ্পেলা রাজু নাহা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তিনি বলেন, শরণার্থী শিবির ও তৎসংলগ্ন রোহিঙ্গা বস্তিতে অবস্থানকারী বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার অবাধে বিচরণ করায় নানাভাবে নিরাপত্তা বিঘি্নত হচ্ছে। ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকপাচার ও নানা অপরাধের সঙ্গে রোহিঙ্গারা সম্পৃক্ত রয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের মাদকদ্রব্য ও অস্ত্রসহ বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।
উখিয়া বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী কক্সবাজারভিত্তিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, উখিয়া-টেকনাফসহ পুরো কক্সবাজার এবং পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ি, আলী কদম, লামা, বান্দরবান সদর, দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনিবন্ধিত আরো প্রায় চার লাখের মতো রোহিঙ্গা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এবং কোনো কোনো স্থানে সংঘবদ্ধভাবে অবস্থান করছে। তবে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে সঠিক তথ্য না থাকা দুঃখজনক বলে তিনি মন্তব্য করেন।
হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ২০০৭ সালে ও এরও আগে ভোটার তালিকায় অসংখ্য রোহিঙ্গা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে তাঁরা বিদেশেও যাচ্ছেন। অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের এ দেশে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী তাঁদের নিয়ে নানাভাবে ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে এমন বেশ কিছু এনজিওর কর্মকাণ্ড বিতর্কিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা এনজিওদের প্ররোচনা এবং সরকারি বিভিন্ন দায়িত্বশীলদের অবহেলার সুযোগ নিচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির এই নেতা অভিযোগ করেন, নিবন্ধিতদের মতো অনিবন্ধিত রোহিঙ্গারাও ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক, মানবপাচার, চুরি, ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, বনাঞ্চল উজাড়, সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ উজাড়, সস্তায় শ্রমবাজার দখল, বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ, হোটেলে যৌন ব্যবসাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই করছে না। তাঁর দাবি, শরণার্থীদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করলেও তাদের আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার অভাব রয়েছে। বের করে না দেওয়া হলে এত আরাম-আয়েশ, সুযোগ-সুবিধা ফেলে অনুপ্রবেশকারীরা দেশে ফিরে যাবে বলেও তিনি মনে করেন।
উখিয়ার ৪নং রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী ও ৯নং ওয়ার্ড সদস্য কুতুপালং এলাকার বাসিন্দা আবদুল হকসহ অনেকে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়কের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তাঁরা মনে করেন, মিয়ানমার থেকে বেশির ভাগই আসছে অর্থনৈতিক কারণে। তাঁরা বলেন, বিজিবির পাশাপাশি পুলিশ, স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীলরা যতক্ষণ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসবে না, ততক্ষণ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
২৮ মে, ২০১২। বিকেলে ইনানি সৈকতের পাশেই দেখা হয় সাত-আট শিশুর সঙ্গে। সাগরের পাশেই উপকূলঘেঁষে তাদের জীর্ণ-শীর্ণ ঘর। নাম জিজ্ঞাসা করতেই অকপটে নাম বলে শিশুরা। মিনা, সোলায়মান, আবদুল আওয়াল- এর মতো পরিচিত কিছু নাম শুনে আর চেহারা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে তারা এ দেশি নয়। পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সী ওই শিশুদের সবারই জন্ম বাংলাদেশে। ওদের বাবা-মা মিয়ানমার থেকে এলেও সে দেশের সরকার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। এ দেশে জন্ম হওয়া মিয়ানমারের অনুপ্রবেশকারীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব কী হবে তা নিয়ে ভবিষ্যৎ বিতর্ক ও চাপ অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য।
অটোরিকশাচালক ইখতিয়ার উদ্দিন বিরক্তির সুরে বলেন, মিয়ানমার থেকে আগতরা বছরের পর বছর টেকনাফ ও উখিয়ার বনভূমি ধ্বংস করে এবার সমুদ্রসৈকতকেও গ্রাস করতে চলেছে। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেন কোনো দুর্ভাবনা নেই। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল জলিল সমুদ্রসৈকতে অনুপ্রবেশকারীদের কয়েকটি ঘর দেখিয়ে বলেন, এই পরিবারের লোকজন মাঝে মাঝেই তাদের বাড়িতে আসে সাহায্যের জন্য। তিনি পাশে নির্মাণাধীন রাস্তার শ্রমিকদের দেখিয়ে বলেন, ওদের দেখতে বাংলাদেশি মনে হলেও আসলে ওরা রোহিঙ্গা।
স্থানীয় শ্রমিকদের চেয়ে কম দামে ওরা শ্রম দেয়। জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে মিয়ানমারের কয়েক লাখ অনিবন্ধিত নাগরিক রয়েছে। তাদের নাম, পরিচয় বা অতীতে কাজের ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্য সরকারি কোনো দপ্তরে নেই। বছরের পর বছর তাদের উপস্থিতি স্থানীয় শ্রমবাজার, মৎস্য খাত, বনজ সম্পদের ওপর প্রভাব সৃষ্টিসহ সার্বিকভাবে ব্যাপক সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করছে। আগামী দিনগুলোতে এ সমস্যা আরো প্রকট হবে বলে আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।
উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের পাশে বখতিয়ার মার্কেট এলাকায় যেন স্থায়ী হতে চলেছে রোহিঙ্গারা। প্রায় দুই দশক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বখতিয়ার মেম্বার। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে কথা হয় কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের বাইরে। তাঁর সামনেই ছিলেন রোহিঙ্গাদের কয়েকজন সর্দার। বখতিয়ার মেম্বার জানান, 'মিয়ানমারে এখনো বলার মতো কোনো পরিবর্তন না আসায় রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চায় না।'
তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময়ই সেখানে উপস্থিত হয় দুই রোহিঙ্গা নারী। অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে সমস্যা হওয়াতেই তাঁরা সেখানে আসেন। ওই নারীরা জানান, এক স্বজনের মৃত্যু সংবাদ শুনে তাঁরা মিয়ানমার গিয়েছিলেন এক সপ্তাহ আগে। সীমান্ত থেকে অটোরিকশা নিয়ে আবার তাঁরা বখতিয়ার বাজার এলাকায় ফিরে এসেছেন। এখানেই শরণার্থী শিবিরের পাশে তাঁদের ঘর রয়েছে।
বখতিয়ার বাজার থেকে তমব্রু সীমান্ত এলাকায় যাওয়ার পথে স্থানীয় এক সাংবাদিক জানান, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল রোহিঙ্গাদের উপস্থিতিতে লাভবান হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বসতি গড়তে তারা যেমন সাহায্য করে, তেমনি তাদের আয়ের ওপরও ভাগ বসায়।
স্বজনের মৃত্যুর খবর শুনে মিয়ানমার গিয়ে আবার দুই নারীর ফিরে আসার ঘটনা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, সেখানে পরিস্থিতি যেমন খারাপের কথা বলা হয় তা যদি সত্যিই হতো তাহলে তাঁরা যেতেন না বা এত সহজে ফিরতে পারতেন না। তিনি বলেন, অনুপ্রবেশের মূল কারণ অর্থনৈতিক। ওখানে কাজের সুযোগ নেই, এখানে আছে। আর এখানে অনেক স্বাধীনভাবে তাঁরা থাকতে পারছেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়লেও ঝামেলা এড়াতে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা অভিযোগ স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, আটক করার পর বিচার ও সাজা ভোগশেষে তাঁদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু মিয়ানমার তাঁদের গ্রহণ না করলে তাঁদের ভার তো বাংলাদেশের ওপরই বর্তাবে।
উখিয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জহিরুল ইসলাম তাঁর উপজেলায় অনিবন্ধিত প্রায় ২৮ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থানের কথা স্বীকার করলেও সঠিক কোনো তথ্য নেই বলে জানান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, সার্বিক পরিবেশ, উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ইউএনও জানান, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক সম্প্রতি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করছে এমন বিদেশি কিছু এনজিও এসিএফ, মুসলিম এইডের যাবতীয় কর্মকাণ্ড কঠোর পর্যবেক্ষণে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ইউএনও স্বীকার করেন, রোহিঙ্গাদের অনেকে এ দেশের ভোটার তালিকায় নাম উঠিয়েছে ও জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সঠিক কোনো তথ্য নেই। এসবের পেছনে স্থানীয় কমিউনিটি, জনপ্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত বলে তিনি জানান।
উখিয়ার ইউএনও আরো বলেন, স্থানীয় মাদকচক্রের সহায়তায় রোহিঙ্গারা নানা অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত। স্থানীয় ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে না ওঠা পর্যন্ত এগুলো রোধ করা সম্ভব নয়। অনুপ্রবেশ রোধ ও অপরাধ দমনে পুলিশ, বিজিবিকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা আছে বলেও তিনি জানান।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপ্পেলা রাজু নাহা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তিনি বলেন, শরণার্থী শিবির ও তৎসংলগ্ন রোহিঙ্গা বস্তিতে অবস্থানকারী বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার অবাধে বিচরণ করায় নানাভাবে নিরাপত্তা বিঘি্নত হচ্ছে। ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকপাচার ও নানা অপরাধের সঙ্গে রোহিঙ্গারা সম্পৃক্ত রয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের মাদকদ্রব্য ও অস্ত্রসহ বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।
উখিয়া বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী কক্সবাজারভিত্তিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, উখিয়া-টেকনাফসহ পুরো কক্সবাজার এবং পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ি, আলী কদম, লামা, বান্দরবান সদর, দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনিবন্ধিত আরো প্রায় চার লাখের মতো রোহিঙ্গা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এবং কোনো কোনো স্থানে সংঘবদ্ধভাবে অবস্থান করছে। তবে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে সঠিক তথ্য না থাকা দুঃখজনক বলে তিনি মন্তব্য করেন।
হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ২০০৭ সালে ও এরও আগে ভোটার তালিকায় অসংখ্য রোহিঙ্গা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে তাঁরা বিদেশেও যাচ্ছেন। অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের এ দেশে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী তাঁদের নিয়ে নানাভাবে ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে এমন বেশ কিছু এনজিওর কর্মকাণ্ড বিতর্কিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা এনজিওদের প্ররোচনা এবং সরকারি বিভিন্ন দায়িত্বশীলদের অবহেলার সুযোগ নিচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির এই নেতা অভিযোগ করেন, নিবন্ধিতদের মতো অনিবন্ধিত রোহিঙ্গারাও ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক, মানবপাচার, চুরি, ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, বনাঞ্চল উজাড়, সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ উজাড়, সস্তায় শ্রমবাজার দখল, বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ, হোটেলে যৌন ব্যবসাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই করছে না। তাঁর দাবি, শরণার্থীদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করলেও তাদের আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার অভাব রয়েছে। বের করে না দেওয়া হলে এত আরাম-আয়েশ, সুযোগ-সুবিধা ফেলে অনুপ্রবেশকারীরা দেশে ফিরে যাবে বলেও তিনি মনে করেন।
উখিয়ার ৪নং রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী ও ৯নং ওয়ার্ড সদস্য কুতুপালং এলাকার বাসিন্দা আবদুল হকসহ অনেকে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়কের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তাঁরা মনে করেন, মিয়ানমার থেকে বেশির ভাগই আসছে অর্থনৈতিক কারণে। তাঁরা বলেন, বিজিবির পাশাপাশি পুলিশ, স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীলরা যতক্ষণ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসবে না, ততক্ষণ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
No comments