মত দ্বিমত-যৌথ বিদ্যুৎ প্রকল্পে আমরা লাভবানই হব by কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
খুলনায় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। প্রস্তাবিত যৌথ বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটা রক্ষিত হবে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ ব্যাপারে দুটি অভিমত এখানে তুলে ধরা হলো।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, সেটি দেখতে হবে সামগ্রিক আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রেক্ষাপটে। আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছে, কিন্তু এই বর্ধিত চাহিদা মেটানোর জন্য যে জ্বালানি প্রয়োজন, তা দেশে নেই। এ কারণে আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সমস্যা সমাধানে আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রয়োজন। কোনো একক দেশের পক্ষে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। শুধু ভারত নয়, নেপাল ও ভুটানকেও যুক্ত করতে হবে যৌথ উদ্যোগে। ওই দুটি দেশে অঢেল পানিসম্পদ আছে, যা কাজে লাগিয়ে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। তাতে এ অঞ্চলের সব দেশই লাভবান হবে।
উন্নয়নের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্পর্কটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেই আলোকে যদি আমরা চিন্তা করি, তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সংযোগ বাড়ানোর উদ্যোগকে ইতিবাচক বলতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলো দ্রুত উন্নতি করেছে। এ অঞ্চলের দেশগুলো এত দিন বিচ্ছিন্ন থেকে বা বৈরিতা জিইয়ে রেখে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেউ লাভবান হয়নি।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সাম্প্রতিক চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকগুলো সেই আলোকেই পর্যালোচনা করতে হবে। গত জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে বাংলাদেশের সড়ক, নৌ ও রেলপথ উন্নয়নে ভারত সহায়তা দিতে রাজি হয়। সম্প্রতি ঢাকায় ভারতীয় সহায়তা ঋণ নিয়ে একটি চুক্তিও সই হয়। এই সহায়তার লক্ষ্য যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন। অনেকে অভিযোগ করে, এর মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে সহায়ক হবে। আসলে দুটি দেশের মধ্যে যেকোনো চুক্তি বা সমঝোতার পূর্বশর্ত হলো উভয়ের স্বার্থ নিশ্চিত করা। আমরা মনে করি, যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলে উভয় দেশই লাভবান হবে। ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দিলে আমরাও ভারতের ওপর দিয়ে নেপাল ও ভুটানে একই সুবিধা পাব। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত পণ্য পরিবহন করলে তার বিনিময়ে তাদের সার্ভিস চার্জও দেবে। সেটি নিশ্চয়ই আমাদের আয় বাড়াবে। দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির জন্য রেলওয়ে ও সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। আলাদা মন্ত্রণালয় স্থাপনের কথাও বলা হচ্ছে। রেলওয়ের প্রচুর সম্পদ আছে। সেটি কাজে লাগাতে পারলে রেলওয়েকে স্বাবলম্বী করা সম্ভব। রেলওয়ে যেমন সাশ্রয়ী পরিবহন, তেমনি পরিবেশবান্ধবও।
সড়ক, নৌ ও অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ ভারত থেকে যে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তাতে ভারতই লাভবান হবে এ কথা ঠিক নয়। এই ঋণের সুদের হার বেশি বলেও দাবি করছে কেউ কেউ। একসময় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে এ ধরনের ঋণ নিলে ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ দিতে হতো। এর চেয়ে বেশি সুদে আমরা চীন থেকেও ঋণ নিয়েছি। তবে এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টির প্রতি জোর দিতে হবে, তা হলো প্রাপ্ত ঋণের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার। যথাসময়ে প্রকল্প শেষ করতে পারলে ব্যয় অনেক কম হবে, অন্যথায় খরচ বেশি পড়বে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, তাতেও আপত্তির কিছু দেখি না। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে পরিবেশের কিছু ক্ষতি হয়, স্বীকার করি। কিন্তু এর বিকল্প কী আছে? আমাদের গ্যাসসম্পদ ফুরিয়ে যাচ্ছে। ভারতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, তার প্রায় অর্ধেকই আসছে কয়লা থেকে। সৌরবিদ্যুৎ ও অন্যান্য সূত্র থেকে বড়জোর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চাহিদা মেটাতে পারে। ফলে এখন আমাদেরও কয়লা উত্তোলনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কয়লা উত্তোলনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে পরিবেশদূষণ কম হবে। উন্মুক্ত না ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন বিতর্ক চলছে। আমরা মনে করি, যেটি জাতীয় স্বার্থের ও উন্নয়নের সহায়ক হবে, সেটিই গ্রহণ করতে হবে।
এখানে বাস্তবতার বিষয়টিও আমলে নেওয়া প্রয়োজন। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করলে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি পাওয়া যাবে না, যেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ ব্যবহার সম্ভব। এ ছাড়া ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে দুর্ঘটনার হারও বেড়ে চলেছে। জার্মানি, ব্রাজিল ও চিলির মতো দেশ যখন দুর্ঘটনা রোধ করতে পারছে না, তখন আমরা কী করে পারব?
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে পরিবেশের ঝুঁকি রয়েছে, এ কথা সত্য। কিন্তু উন্নয়ন করতে হলে কিছু না কিছু ঝুঁকি তো নিতেই হবে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে কম ঝুঁকিতে বেশি উন্নয়ন করা। বাংলাদেশে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের হার বছরে মাথাপিছু শূন্য দশমিক ৩ টন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ২০ টন, ভারতে দুই টন ও চীনে চার টনের মতো।
সে ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা খুব খারাপ নয়। তবে যেকোনো চুক্তির ক্ষেত্রে জাতীয় সর্বোচ্চ স্বার্থ সমুন্নত রাখাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এখনো কয়লাভিত্তিক যৌথ বিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে মাত্র। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে সরকার পদক্ষেপ নিলে আমরা এ প্রকল্প থেকে লাভবানই হব।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, অর্থনীতিবিদ। চেয়ারম্যান, পিকেএসএফ।
No comments