কালের পুরাণ-বিএনপিতে ‘ডিগবাজ’ ও আওয়ামী লীগের ‘বাকশাল-দর্শন’ by সোহরাব হাসান
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন একবার লিখেছিলেন, ‘একবার যে রাজাকার, সব সময়ই সে রাজাকার। কিন্তু একবার যে মুক্তিযোদ্ধা, সব সময় মুক্তিযোদ্ধা না-ও থাকতে পারে।’ তাঁর কথাটি সামান্য অদল-বদল করে বলা যায়, একবার যে সামরিক শাসক, সে সব সময়ই সামরিক শাসক। জিয়া ও এরশাদ সেটাই প্রমাণ করেছেন।
ক্ষমতায় থাকতে তাঁরা গণতন্ত্রের জন্য যতই মায়াকান্না করুন না কেন, নিজেদের গণতন্ত্রী প্রমাণ করতে পারেননি। একজন মৃত্যুর ২৯ বছর এবং অপরজন ক্ষমতাচ্যুতির ২০ বছর পরও অবৈধ শাসক রয়ে গেলেন মাননীয় আদালতের বিচারে; এমনকি ইতিহাসের বিচারেও।
কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক শাসকেরা কীভাবে মূল্যায়িত হবেন? অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশে কোনো শাসকই শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রী থাকতে পারেননি। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। রাজনীতিতে তাঁদের আগমনও হয়েছিল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পটভূমিতে। শেখ হাসিনা যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন দেশে জিয়ার আধা সেনাশাসন। আর খালেদা জিয়া যখন আসেন, তখন এরশাদের পুরো সামরিক শাসন। তাঁদের যূথবদ্ধ আন্দোলনই নব্বইয়ে স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়েছিল। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়, গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে অশুভ শক্তি পিছু হটতে বাধ্য। আবার তাঁদের অনৈক্য ও বৈরিতার সুযোগে স্বৈরাচারী শাসকই শুধু জগদ্দল পাথরের মতো জাতির কাঁধে চেপে বসে না, মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীও শেকড় গেড়ে বসে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জঙ্গিদের উত্থান এবং অব্যাহত বোমা-গ্রেনেড হামলা সেই সাক্ষ্যই দেয়।
পাকিস্তান আমলের পুরো সময়ই আমরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি। স্বাধীনতার পর ৩৯ বছর ধরে দেশে গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলছে, কিন্তু রাজনৈতিক দল থেকে জাতীয় সংসদ, কেন্দ্র থেকে স্থানীয় সরকার—কোথাও গণতন্ত্রের চর্চা নেই। আছে দলতন্ত্র, ব্যক্তিপূজা, গোষ্ঠীপূজা এবং মৃতের আরাধনা। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে ন্যূনতম কর্মসম্পর্ক থাকে, তার ছিটেফোঁটাও নেই এখানে। মনে হচ্ছে, আমাদের রাজনীতিকেরা ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নেননি। এমনকি ২০০৬ সালের ১/১১-এর অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনও তাঁদের বোধোদয় ঘটাতে পারেনি। আমরা গণতন্ত্রের খোলসটি পেয়েছি, মর্ম স্পর্শ করতে পারিনি। উচ্চ আদালতে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সাবেক সামরিক শাসক এরশাদের বিচার করা না-করা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, কিন্তু তিনি বা তাঁর পূর্বসূরি জিয়া যেসব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছেন, রাজনীতিকে কেনাবেচার পণ্য করেছেন, ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন, সেই অপসংস্কৃতি থেকে কি আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি? পারিনি। নেতা-নেত্রীরাও চাননি। জিয়া-এরশাদের অবৈধ শাসনের উপাদানগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে না পারলে গণতন্ত্র হবে কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
২.
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নাজমুল হুদা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদকে ডিগবাজ ও সুবিধাবাদী রাজনীতিক বলে অভিহিত করেছেন। এটি আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বললে নিশ্চয়ই তাঁরা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দিতেন। কিন্তু মওদুদ আহমদকে তো আওয়ামী কাতারে ফেলা যাবে না। তিনি পঁচাত্তরের পর থেকে জিয়া-এরশাদ-খালেদার সেবা করে এসেছেন। নাজমুল হুদার অভিযোগ, ‘মওদুদ অতীতে স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এমনকি উপরাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হয়েছেন। এখন বিএনপিতে ঢুকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতিকে ধ্বংস করতে চাইছেন।’
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতৃত্ব হাতছাড়া হওয়ায় নাজমুল হুদা খেপে গেছেন। তাঁর অভিযোগ সত্য কি না, দলীয় নেত্রী তদন্ত করে দেখবেন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন অন্যখানে। সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিসরত সব আইনজীবীই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য হবেন। এটি একটি পেশাজীবী সংগঠন, এর সঙ্গে বিএনপি, আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দলের সম্পর্ক থাকতে পারে না। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ যেকোনো দল করতে পারেন, সেটি নয়াপল্টন বা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ যেখানেই হোক না কেন, দলীয় পরিচয়কে তাঁরা সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে নিয়ে আসতে পারেন না। আওয়ামী লীগের সমর্থক সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদও একই কাজ করছে। করছেন অন্য পেশাজীবীরাও। বিএনপির আমলে ড্যাব বা ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগের আমলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের রমরমা ব্যবসা চলে। এবং অনিবার্যভাবে বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের সমর্থক চিকিৎসকেরা নাজেহাল হবেন আর আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপির সমর্থক চিকিৎসকেরা বহিষ্কৃত হবেন। সারা দেশে সরকারি অফিস, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও দলীয় ব্যানারে ছেয়ে গেছে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। একশ্রেণীর শিক্ষক তো ছাত্রদের পড়ানো বাদ দিয়ে তারেক-বন্দনায় মেতে উঠেছেন। দলীয় নামে পেশাজীবী সংগঠন চলতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও এ অপরাজনীতি চলতে পারে না।
দ্বিতীয় কথা হলো, নাজমুল হুদা মওদুদকে স্বৈরাচারের সহযোগী বলেছেন। রাজনীতিতে তিনি যাঁর দীক্ষা নিয়েছেন, সেই জিয়াউর রহমানও একজন অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী। এক সামরিক স্বৈরাচারের অনুগ্রহভাজন হয়ে অন্যকে উপদেশ দেওয়ার নৈতিক অধিকার তাঁর নেই। পেশাদার রাজনীতিকেরা যদি অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের সঙ্গে হাত না মেলাতেন, তাহলে তাঁরা এক দিনও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারতেন না। ওপরের দিকে থুথু ফেললে কেবল পরিবেশ দূষিত হয় না, নিজের গায়েও এসে লাগে।
৩.
আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ ব্যাখ্যা করে থাকেন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা কিংবা সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বহু দিন থেকে সেই রেওয়াজই চলে আসছে। তাঁরা কোনো বক্তৃতা-বিবৃতিতে বাকশাল-দর্শনের কথা বলেননি। গত মে মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে যে উদ্দেশ্য, আদর্শ ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতেও বাকশালের কথা নেই। বরং আওয়ামী লীগের নেতারা সভা-সমাবেশে সাফাই গাইতে চেষ্টা করেন, বাকশাল ছিল বঙ্গবন্ধুর সাময়িক পদক্ষেপ; স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ রোববার হঠাৎ করেই বাকশালকে দলের রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করে বিরোধীদের হাতে সমালোচনার মোক্ষম অস্ত্রটি তুলে দিলেন। তাঁর দাবি, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দলীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামেই দল নিবন্ধীকরণের দরখাস্ত করেছিল। হানিফ সাহেব বুঝে-শুনেই কি কথাটি বলেছেন? বাকশালের দুটি দিক ছিল—রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে বাকশাল ছিল চরম স্বৈরাচারী। সেখানে ভিন্ন মতের সুযোগ ছিল না, বিরোধী দল ছিল না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল না। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এখন ভিন্ন মত প্রকাশের সুযোগ আছে। হানিফ সাহেবরা কি তা খর্ব করতেই বাকশাল-দর্শনের কথা বলছেন?
বাকশালের অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে বাধ্যতামূলক সমবায়ের কথা বলা হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বাস্তবায়নের কথা ছিল। সব কৃষিজমি সমবায়ের অধীনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব, তথা হানিফ সাহেবরা তাতে বিশ্বাস করেন না বলেই ব্যক্তি-মালিকানায় সব ছেড়ে দিচ্ছেন। সমাজতন্ত্রের কথা মুখে আনেন না। তারপরও বাকশাল-দর্শনের কথা বলার উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে?
দেশে হাজারটা সমস্যা আছে। বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির অভাবে এবং যানজটের কবলে পড়ে ঢাকার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেসব দিকে নজর না দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা উল্টাপাল্টা বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা কি ইচ্ছে করেই বিরোধী দলকে সুযোগ করে দিচ্ছেন? চাঁদের যেমন নিজস্ব আলো নেই, সূর্যের আলোতে সে আলোকিত হয়; আমাদের মতো দেশে বিরোধী দলের শক্তি হলো সরকারের দুর্বলতা, গোয়ার্তুমি, হঠকারিতা। ক্ষমতাসীন দল কোথায়, কখন, কীভাবে বিপর্যয় ডেকে আনে, আগেভাগে কেউ বলতে পারেন না। এক মাস আগেও কেউ ভাবতে পারেননি, আওয়ামী লীগের একজন সাংসদের পিস্তলের গুলিতে তাঁরই রাজনৈতিক শিষ্য ও যুবলীগের কর্মী বেঘোরে প্রাণ হারাবেন। ঘটনার পর থেকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও পুলিশের কর্মকর্তারা পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলে আসছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, হত্যকাণ্ডের সঙ্গে সাংসদ শাওন জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি গত বিশ মাসে কতজন দলীয় লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা জানা যায়নি। আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, অস্ত্র আইনে সাংসদ শাওনের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। ঢাকার পুলিশ কমিশনার বললেন, মামলা করা যায় না। একেই বলে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়।
ইব্রাহিম হত্যার জন্য কারা দায়ী—সঠিক ও সুষ্ঠু তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু শুরু থেকে যে ঢাক-গুড়গুড় ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে ঘটনার সুষ্ঠু ও সঠিক তদন্ত হবে কি না, সে ব্যাপারে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করছেন। তদন্ত সুষ্ঠু হলে প্রকৃত আসামি চিহ্নিত এবং বিচারের সম্মুখীন হবে। বিএনপির আমলে বহু হত্যাকাণ্ড ও গ্রেনেড-বোমা হামলার মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল। আসল অপরাধীদের রক্ষা করতে জজ মিয়া কাহিনি, জয়নাল আবেদিন ও সরকার কমিশনের নামে রাতকে দিন করার চেষ্টা চলেছে। পাঁচ-সাত বছর আগের ঘটনার তদন্তে এখন প্রকৃত অপরাধীদের নাম বেরিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ সরকারও যদি একই কাজ করে, ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে নতুন তদন্ত হবে। এ রকম তদন্ত তদন্ত খেলা কত দিন চলবে?
হানিফ সাহেবের মনে আছে কি না জানি না, বাকশালের জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর দলটি প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পায়, তাও শেখ হাসিনা ছাড়া সম্ভব হতো না। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার ২০ মাসের মাথায় মানুষকে বাকশালের দর্শন বোঝানোর কী প্রয়োজন পড়ল? আদালতের যে ঐতিহাসিক রায় পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছে, সেই রায়ও কিন্তু বাকশালকে অনুমোদন করেনি; বরং পঞ্চম সংশোধনীর যেসব ফরমানের মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হয়েছে, সেগুলোকে ‘মার্জনা’ করেছে। সংবিধানের পবিত্রতা শুধু সামরিক শাসকেরাই নষ্ট করেননি, গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলেও ব্যক্তি ও গোষ্ঠি স্বার্থে একাধিকবার কাটাছেঁড়া হয়েছে।
এত কিছুর পর হানিফ সাহেবদের মাথায় বাকশাল-দর্শনের যে ভূত চেপেছে তাতে তাদের কতটা লাভ বা ক্ষতি হবে জানি না। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা ও বাচালতার দায় নিতে হবে দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক শাসকেরা কীভাবে মূল্যায়িত হবেন? অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশে কোনো শাসকই শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রী থাকতে পারেননি। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। রাজনীতিতে তাঁদের আগমনও হয়েছিল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পটভূমিতে। শেখ হাসিনা যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন দেশে জিয়ার আধা সেনাশাসন। আর খালেদা জিয়া যখন আসেন, তখন এরশাদের পুরো সামরিক শাসন। তাঁদের যূথবদ্ধ আন্দোলনই নব্বইয়ে স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়েছিল। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়, গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে অশুভ শক্তি পিছু হটতে বাধ্য। আবার তাঁদের অনৈক্য ও বৈরিতার সুযোগে স্বৈরাচারী শাসকই শুধু জগদ্দল পাথরের মতো জাতির কাঁধে চেপে বসে না, মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীও শেকড় গেড়ে বসে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জঙ্গিদের উত্থান এবং অব্যাহত বোমা-গ্রেনেড হামলা সেই সাক্ষ্যই দেয়।
পাকিস্তান আমলের পুরো সময়ই আমরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি। স্বাধীনতার পর ৩৯ বছর ধরে দেশে গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলছে, কিন্তু রাজনৈতিক দল থেকে জাতীয় সংসদ, কেন্দ্র থেকে স্থানীয় সরকার—কোথাও গণতন্ত্রের চর্চা নেই। আছে দলতন্ত্র, ব্যক্তিপূজা, গোষ্ঠীপূজা এবং মৃতের আরাধনা। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে ন্যূনতম কর্মসম্পর্ক থাকে, তার ছিটেফোঁটাও নেই এখানে। মনে হচ্ছে, আমাদের রাজনীতিকেরা ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নেননি। এমনকি ২০০৬ সালের ১/১১-এর অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনও তাঁদের বোধোদয় ঘটাতে পারেনি। আমরা গণতন্ত্রের খোলসটি পেয়েছি, মর্ম স্পর্শ করতে পারিনি। উচ্চ আদালতে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সাবেক সামরিক শাসক এরশাদের বিচার করা না-করা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, কিন্তু তিনি বা তাঁর পূর্বসূরি জিয়া যেসব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছেন, রাজনীতিকে কেনাবেচার পণ্য করেছেন, ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন, সেই অপসংস্কৃতি থেকে কি আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি? পারিনি। নেতা-নেত্রীরাও চাননি। জিয়া-এরশাদের অবৈধ শাসনের উপাদানগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে না পারলে গণতন্ত্র হবে কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
২.
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নাজমুল হুদা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদকে ডিগবাজ ও সুবিধাবাদী রাজনীতিক বলে অভিহিত করেছেন। এটি আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বললে নিশ্চয়ই তাঁরা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দিতেন। কিন্তু মওদুদ আহমদকে তো আওয়ামী কাতারে ফেলা যাবে না। তিনি পঁচাত্তরের পর থেকে জিয়া-এরশাদ-খালেদার সেবা করে এসেছেন। নাজমুল হুদার অভিযোগ, ‘মওদুদ অতীতে স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এমনকি উপরাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হয়েছেন। এখন বিএনপিতে ঢুকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতিকে ধ্বংস করতে চাইছেন।’
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতৃত্ব হাতছাড়া হওয়ায় নাজমুল হুদা খেপে গেছেন। তাঁর অভিযোগ সত্য কি না, দলীয় নেত্রী তদন্ত করে দেখবেন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন অন্যখানে। সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিসরত সব আইনজীবীই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য হবেন। এটি একটি পেশাজীবী সংগঠন, এর সঙ্গে বিএনপি, আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দলের সম্পর্ক থাকতে পারে না। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ যেকোনো দল করতে পারেন, সেটি নয়াপল্টন বা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ যেখানেই হোক না কেন, দলীয় পরিচয়কে তাঁরা সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে নিয়ে আসতে পারেন না। আওয়ামী লীগের সমর্থক সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদও একই কাজ করছে। করছেন অন্য পেশাজীবীরাও। বিএনপির আমলে ড্যাব বা ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগের আমলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের রমরমা ব্যবসা চলে। এবং অনিবার্যভাবে বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের সমর্থক চিকিৎসকেরা নাজেহাল হবেন আর আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপির সমর্থক চিকিৎসকেরা বহিষ্কৃত হবেন। সারা দেশে সরকারি অফিস, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও দলীয় ব্যানারে ছেয়ে গেছে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। একশ্রেণীর শিক্ষক তো ছাত্রদের পড়ানো বাদ দিয়ে তারেক-বন্দনায় মেতে উঠেছেন। দলীয় নামে পেশাজীবী সংগঠন চলতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও এ অপরাজনীতি চলতে পারে না।
দ্বিতীয় কথা হলো, নাজমুল হুদা মওদুদকে স্বৈরাচারের সহযোগী বলেছেন। রাজনীতিতে তিনি যাঁর দীক্ষা নিয়েছেন, সেই জিয়াউর রহমানও একজন অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী। এক সামরিক স্বৈরাচারের অনুগ্রহভাজন হয়ে অন্যকে উপদেশ দেওয়ার নৈতিক অধিকার তাঁর নেই। পেশাদার রাজনীতিকেরা যদি অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের সঙ্গে হাত না মেলাতেন, তাহলে তাঁরা এক দিনও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারতেন না। ওপরের দিকে থুথু ফেললে কেবল পরিবেশ দূষিত হয় না, নিজের গায়েও এসে লাগে।
৩.
আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ ব্যাখ্যা করে থাকেন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা কিংবা সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বহু দিন থেকে সেই রেওয়াজই চলে আসছে। তাঁরা কোনো বক্তৃতা-বিবৃতিতে বাকশাল-দর্শনের কথা বলেননি। গত মে মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে যে উদ্দেশ্য, আদর্শ ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতেও বাকশালের কথা নেই। বরং আওয়ামী লীগের নেতারা সভা-সমাবেশে সাফাই গাইতে চেষ্টা করেন, বাকশাল ছিল বঙ্গবন্ধুর সাময়িক পদক্ষেপ; স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ রোববার হঠাৎ করেই বাকশালকে দলের রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করে বিরোধীদের হাতে সমালোচনার মোক্ষম অস্ত্রটি তুলে দিলেন। তাঁর দাবি, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দলীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামেই দল নিবন্ধীকরণের দরখাস্ত করেছিল। হানিফ সাহেব বুঝে-শুনেই কি কথাটি বলেছেন? বাকশালের দুটি দিক ছিল—রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে বাকশাল ছিল চরম স্বৈরাচারী। সেখানে ভিন্ন মতের সুযোগ ছিল না, বিরোধী দল ছিল না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল না। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এখন ভিন্ন মত প্রকাশের সুযোগ আছে। হানিফ সাহেবরা কি তা খর্ব করতেই বাকশাল-দর্শনের কথা বলছেন?
বাকশালের অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে বাধ্যতামূলক সমবায়ের কথা বলা হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বাস্তবায়নের কথা ছিল। সব কৃষিজমি সমবায়ের অধীনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব, তথা হানিফ সাহেবরা তাতে বিশ্বাস করেন না বলেই ব্যক্তি-মালিকানায় সব ছেড়ে দিচ্ছেন। সমাজতন্ত্রের কথা মুখে আনেন না। তারপরও বাকশাল-দর্শনের কথা বলার উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে?
দেশে হাজারটা সমস্যা আছে। বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির অভাবে এবং যানজটের কবলে পড়ে ঢাকার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেসব দিকে নজর না দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা উল্টাপাল্টা বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা কি ইচ্ছে করেই বিরোধী দলকে সুযোগ করে দিচ্ছেন? চাঁদের যেমন নিজস্ব আলো নেই, সূর্যের আলোতে সে আলোকিত হয়; আমাদের মতো দেশে বিরোধী দলের শক্তি হলো সরকারের দুর্বলতা, গোয়ার্তুমি, হঠকারিতা। ক্ষমতাসীন দল কোথায়, কখন, কীভাবে বিপর্যয় ডেকে আনে, আগেভাগে কেউ বলতে পারেন না। এক মাস আগেও কেউ ভাবতে পারেননি, আওয়ামী লীগের একজন সাংসদের পিস্তলের গুলিতে তাঁরই রাজনৈতিক শিষ্য ও যুবলীগের কর্মী বেঘোরে প্রাণ হারাবেন। ঘটনার পর থেকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও পুলিশের কর্মকর্তারা পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলে আসছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, হত্যকাণ্ডের সঙ্গে সাংসদ শাওন জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি গত বিশ মাসে কতজন দলীয় লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা জানা যায়নি। আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, অস্ত্র আইনে সাংসদ শাওনের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। ঢাকার পুলিশ কমিশনার বললেন, মামলা করা যায় না। একেই বলে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়।
ইব্রাহিম হত্যার জন্য কারা দায়ী—সঠিক ও সুষ্ঠু তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু শুরু থেকে যে ঢাক-গুড়গুড় ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে ঘটনার সুষ্ঠু ও সঠিক তদন্ত হবে কি না, সে ব্যাপারে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করছেন। তদন্ত সুষ্ঠু হলে প্রকৃত আসামি চিহ্নিত এবং বিচারের সম্মুখীন হবে। বিএনপির আমলে বহু হত্যাকাণ্ড ও গ্রেনেড-বোমা হামলার মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল। আসল অপরাধীদের রক্ষা করতে জজ মিয়া কাহিনি, জয়নাল আবেদিন ও সরকার কমিশনের নামে রাতকে দিন করার চেষ্টা চলেছে। পাঁচ-সাত বছর আগের ঘটনার তদন্তে এখন প্রকৃত অপরাধীদের নাম বেরিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ সরকারও যদি একই কাজ করে, ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে নতুন তদন্ত হবে। এ রকম তদন্ত তদন্ত খেলা কত দিন চলবে?
হানিফ সাহেবের মনে আছে কি না জানি না, বাকশালের জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর দলটি প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পায়, তাও শেখ হাসিনা ছাড়া সম্ভব হতো না। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার ২০ মাসের মাথায় মানুষকে বাকশালের দর্শন বোঝানোর কী প্রয়োজন পড়ল? আদালতের যে ঐতিহাসিক রায় পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছে, সেই রায়ও কিন্তু বাকশালকে অনুমোদন করেনি; বরং পঞ্চম সংশোধনীর যেসব ফরমানের মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হয়েছে, সেগুলোকে ‘মার্জনা’ করেছে। সংবিধানের পবিত্রতা শুধু সামরিক শাসকেরাই নষ্ট করেননি, গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলেও ব্যক্তি ও গোষ্ঠি স্বার্থে একাধিকবার কাটাছেঁড়া হয়েছে।
এত কিছুর পর হানিফ সাহেবদের মাথায় বাকশাল-দর্শনের যে ভূত চেপেছে তাতে তাদের কতটা লাভ বা ক্ষতি হবে জানি না। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা ও বাচালতার দায় নিতে হবে দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments