চার দিক-মাটিমনা মানুষের শিল্প by আজাদুর রহমান
সব মাটি দিয়ে টালি হয় না। বেলে-দোআঁশ হলেই হবে না, এরও ভাগ আছে। বংশপরম্পরায় যাঁরা টালিকর, তাঁরা মাটিতে হাত দিয়েই ভাগটা বলে দিতে পারেন, চলবে কি না! গোষ্ঠ চন্দ্র মাটি চেনেন। দুধের সরের মতো উপরিতলের ফুট খানেক মাটি সরিয়ে পরের ১০-১২ ইঞ্চি পরতই উপযুক্ত স্তর। নিচে গেলে হবে না।
মাটি দিয়ে প্রতিমা গড়াতে গড়াতেই একসময় টালি এসে ধরা দিয়েছিল ভাগ্যলক্ষ্মীর দরজায়। তারপর টালি ফেলে অন্যদিকে মনোযোগ ফেরানোর সুযোগ হয়নি তাঁদের। গোষ্ঠের মতো স্বপন, পরিমল, নগেনরাও এসে শামিল হয়েছেন টালির কাজে। টালিই এখন তাঁদের ধন-ধ্যান।
স্বাধীনতার পর চড়া দামের টিন ছেড়ে কিছু মানুষ টালির দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। টিনের দাম চড়ে, টালির কদরও বাড়ে। এমনিতে সস্তা, তার ওপর টেকে বেশি। ওজনদার টালি আটকাতে কাঠের কাঠামো বানাতে যা ব্যয়, এই যা। বনেদি কুমোরদের দেখাদেখি অন্য লোকেরাও জনবল নিয়ে কারখানা খুলে বসতে লাগল। কিন্তু ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে হঠাৎ দপ করে টিনের দাম পড়ে গেল। ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বান মেলানো গেলে টালি দিয়ে ঘর বানানো কেন? গ্রাহক ঠেকাতে অগত্যা দাম কমাতে হলো। কত আর কমানো যায়! মাটি, মজুরি মিলিয়ে যা খরচ পড়ে, তাতে পেটেভাতে হয় না দেখে অনেকেই কারখানার ঝাঁপ নামিয়ে দিলেন। তেল ফুরিয়ে গেলে সলতের আগুন যেমন ধিকধিক করে জ্বলতে থাকে, তেমনি করে চার-পাঁচটি কারখানা তখনো লেংচে লেংচে চলতে থাকল। হাল ছাড়েননি গোষ্ঠরা। সেসব দিনের কথা মনে করতে গিয়ে গোষ্ঠের চাতালে জড়ো হওয়া কারিগরেরা হইহই করে ওঠেন, ‘দ্যাকেন, তখন আগো বড্ড কষ্ট হয়িল।’ মালের গুণাগুণ থাকলে একদিন কদর হবেই—বুকে বিশ্বাস আঁকড়ে প্রায় দেড় যুগ পড়ে ছিলেন বনেদিরা। হলোই তাই। ২০০৩ সালের ঘটনা। রাফায়েল আলদো নামের বয়োজ্যেষ্ঠ ইতালিয়ান হঠাৎ টালিপাড়ায় উপস্থিত হলেন। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন টালি বানানোর কলাকৌশল। আলদোর যেন বিস্ময় কাটে না, কীভাবে এঁরা এত ভালো টালি বানালেন? যেমন ফিনিশিং, তেমন কারুকাজ। নারায়ণগঞ্জে নিজেই টালি উৎপাদন শুরু করে দিলেন আলদো। কিন্তু টালিগুলো ঠিক টেকসই হলো না, ভেঙে গেল। তা ছাড়া ফিনিশিং যা পাওয়া গেল, তাতে মন ভরল না। ভাঙা মন নিয়ে আবার কলারোয়ায় এলেন আলদো এবং স্যাম্পল নিয়ে ইতালিতে চলে গেলেন। কিছুদিন পর ফিরে এসে উদ্বোধন করলেন—নতুনযাত্রা। টালির যাত্রা শুরু হলো ইতালিতে।
আলদোর গল্প শেষ হলে কারিগরেরা অন্য গল্প তোলেন। মাটিজীবনের বিবিধ গল্প। মজমা জমে গেলে গোষ্ঠ পিরিচ হাতে এগিয়ে আসেন, ‘ন্যান ভাই, খেয়ি ন্যান।’ গোষ্ঠকে ধন্যবাদ দিই না, বরং ইতস্তত মুখে চক করা আপেল আর নোনতা বিস্কুট খেয়ে কারিগর মঞ্জিলকে সঙ্গে করে বেরিয়ে আসি। একটু পরপর কারখানা বসানো হয়েছে। সাদা রঙের বিল্ডিংগুলো দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। কারখানার কালো ধোঁয়া লেগে নীলচে চুনকাম অনেকখানি কালচে হয়ে গেছে। সম্ভাবনার শিল্পকে বাঁচাতে গিয়ে পরিবেশ সম্পদও কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এখানে। ধানিজমিতেও টালিখানা। আইল ধরে হেঁটে গিয়ে আয়েশা ও সুলতানকে পেলাম। দুজনই গতর খাটে। আয়েশা কোদাল দিয়ে মাটি টেনে ঠায় জড়ো করেন। তারপর জড়ো করা মাটি গোল করে খাবরি করেন। এবার খাবরির মাঝখানে পানি ঢেলে পা দিয়ে ময়দা চটকানোর মতো করে পেস্ট বানান। অন্যদিকে পুরো শরীরে রোদের ধকল নিয়ে সুলতান ফর্মা থেকে কাঁচা টালি নামিয়ে বালু বিছানো চাতালে পর পর জায়গামতো বসিয়ে দেন। তারপর আঁচ বুঝে হাতা দিয়ে আধা শুকনো টালিগুলোকে পিটিয়ে পিটিয়ে মনমতো সাইজ করেন। এক চাতালে কম করে হলেও ১০-১২ জন জোগাল লাগে। সংসারে যাঁদের খানেওয়ালা বেশি, তাঁরা একযোগে লেগেভেগে জোগালি টানেন। গুণাগুণ ঠিক রাখতে আগুনই বড় কথা। অভিজ্ঞ পোলন্দার ছাড়া আগুনের কাজটা ভালোভাবে করা যায় না। পোলন্দার মানে মিস্ত্রি, যিনি ফায়ারম্যানও বটে। যাঁর পোলন্দার যত ভালো, তাঁর টালির ফিনিশিং তত ভালো। আড়াই শর নিচে ভালো পোলন্দার মেলে না। ইতালিয়ানরা টালির ওপর আরও কিছু কাজ করে। শিরিষ কাগজ ঘষে টালির ওপর ইজিয়াম, মোম, থিনার ইত্যাদি কেমিক্যাল দিয়ে কাজ করে। টালিটা তখন ওয়াটারপ্রুফ হয়ে যায়। কলারোয়ার টালি নাকি হিমের জন্য ভালো। প্রসেস করা টালির ওপর বরফ বসতে পারে না, বরং পিছলে যায়। টালিকথা শেষ হলে পোলন্দার আবুল সরদারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পিচ পথ ছেড়ে পাথারি পথ ধরি। মঞ্জিল হাত উঁচিয়ে বিল্ডিংটা দেখান। দোতলা, নকশাকাটা মনোহরা প্রাসাদ। শহরের ছিটেফোঁটা নেই, অথচ এত নান্দানিক বাড়ি কে বানালেন? বাড়িটার ভেতর ঢুকে গিয়ে আমরা দেয়ালে হাত রাখি। কারুকাজ ছুঁয়ে বিস্মিত হই। স্রেফ টালি দিয়ে এমন নকশাবাড়ি বানানো যেতে পারে, ভাবাই যায় না।
ঘুরে ঘুরে টালিবাড়ি দেখা হলে আমরা ফের গোষ্ঠের চাতালে ফিরে আসি। গোধূলির হলুদ আলোতে পুনরায় ভিড় বাড়ে। টালির সঙ্গে যোগ হয় আয়েশা, সুলতান, আমজাদ, মতিন, নরেনদের জীবনের গল্প। রাফায়েল আলদো আর টালিনির্ভর এখানকার দুই হাজার পরিবারের ছবিগুলো একসময় সশরীরেই যেন উঠে আসতে থাকে আমাদের সামনে। গ্রামীণ গল্পগুলো শেষ হয় না, বরং কল্পনায় অপূর্ব এক বাড়ির দেখা মেলে। কলারোয়ার টালিতে বানানো ইতালিয়ান বাড়িটাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে আমাদের।
স্বাধীনতার পর চড়া দামের টিন ছেড়ে কিছু মানুষ টালির দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। টিনের দাম চড়ে, টালির কদরও বাড়ে। এমনিতে সস্তা, তার ওপর টেকে বেশি। ওজনদার টালি আটকাতে কাঠের কাঠামো বানাতে যা ব্যয়, এই যা। বনেদি কুমোরদের দেখাদেখি অন্য লোকেরাও জনবল নিয়ে কারখানা খুলে বসতে লাগল। কিন্তু ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে হঠাৎ দপ করে টিনের দাম পড়ে গেল। ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বান মেলানো গেলে টালি দিয়ে ঘর বানানো কেন? গ্রাহক ঠেকাতে অগত্যা দাম কমাতে হলো। কত আর কমানো যায়! মাটি, মজুরি মিলিয়ে যা খরচ পড়ে, তাতে পেটেভাতে হয় না দেখে অনেকেই কারখানার ঝাঁপ নামিয়ে দিলেন। তেল ফুরিয়ে গেলে সলতের আগুন যেমন ধিকধিক করে জ্বলতে থাকে, তেমনি করে চার-পাঁচটি কারখানা তখনো লেংচে লেংচে চলতে থাকল। হাল ছাড়েননি গোষ্ঠরা। সেসব দিনের কথা মনে করতে গিয়ে গোষ্ঠের চাতালে জড়ো হওয়া কারিগরেরা হইহই করে ওঠেন, ‘দ্যাকেন, তখন আগো বড্ড কষ্ট হয়িল।’ মালের গুণাগুণ থাকলে একদিন কদর হবেই—বুকে বিশ্বাস আঁকড়ে প্রায় দেড় যুগ পড়ে ছিলেন বনেদিরা। হলোই তাই। ২০০৩ সালের ঘটনা। রাফায়েল আলদো নামের বয়োজ্যেষ্ঠ ইতালিয়ান হঠাৎ টালিপাড়ায় উপস্থিত হলেন। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন টালি বানানোর কলাকৌশল। আলদোর যেন বিস্ময় কাটে না, কীভাবে এঁরা এত ভালো টালি বানালেন? যেমন ফিনিশিং, তেমন কারুকাজ। নারায়ণগঞ্জে নিজেই টালি উৎপাদন শুরু করে দিলেন আলদো। কিন্তু টালিগুলো ঠিক টেকসই হলো না, ভেঙে গেল। তা ছাড়া ফিনিশিং যা পাওয়া গেল, তাতে মন ভরল না। ভাঙা মন নিয়ে আবার কলারোয়ায় এলেন আলদো এবং স্যাম্পল নিয়ে ইতালিতে চলে গেলেন। কিছুদিন পর ফিরে এসে উদ্বোধন করলেন—নতুনযাত্রা। টালির যাত্রা শুরু হলো ইতালিতে।
আলদোর গল্প শেষ হলে কারিগরেরা অন্য গল্প তোলেন। মাটিজীবনের বিবিধ গল্প। মজমা জমে গেলে গোষ্ঠ পিরিচ হাতে এগিয়ে আসেন, ‘ন্যান ভাই, খেয়ি ন্যান।’ গোষ্ঠকে ধন্যবাদ দিই না, বরং ইতস্তত মুখে চক করা আপেল আর নোনতা বিস্কুট খেয়ে কারিগর মঞ্জিলকে সঙ্গে করে বেরিয়ে আসি। একটু পরপর কারখানা বসানো হয়েছে। সাদা রঙের বিল্ডিংগুলো দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। কারখানার কালো ধোঁয়া লেগে নীলচে চুনকাম অনেকখানি কালচে হয়ে গেছে। সম্ভাবনার শিল্পকে বাঁচাতে গিয়ে পরিবেশ সম্পদও কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এখানে। ধানিজমিতেও টালিখানা। আইল ধরে হেঁটে গিয়ে আয়েশা ও সুলতানকে পেলাম। দুজনই গতর খাটে। আয়েশা কোদাল দিয়ে মাটি টেনে ঠায় জড়ো করেন। তারপর জড়ো করা মাটি গোল করে খাবরি করেন। এবার খাবরির মাঝখানে পানি ঢেলে পা দিয়ে ময়দা চটকানোর মতো করে পেস্ট বানান। অন্যদিকে পুরো শরীরে রোদের ধকল নিয়ে সুলতান ফর্মা থেকে কাঁচা টালি নামিয়ে বালু বিছানো চাতালে পর পর জায়গামতো বসিয়ে দেন। তারপর আঁচ বুঝে হাতা দিয়ে আধা শুকনো টালিগুলোকে পিটিয়ে পিটিয়ে মনমতো সাইজ করেন। এক চাতালে কম করে হলেও ১০-১২ জন জোগাল লাগে। সংসারে যাঁদের খানেওয়ালা বেশি, তাঁরা একযোগে লেগেভেগে জোগালি টানেন। গুণাগুণ ঠিক রাখতে আগুনই বড় কথা। অভিজ্ঞ পোলন্দার ছাড়া আগুনের কাজটা ভালোভাবে করা যায় না। পোলন্দার মানে মিস্ত্রি, যিনি ফায়ারম্যানও বটে। যাঁর পোলন্দার যত ভালো, তাঁর টালির ফিনিশিং তত ভালো। আড়াই শর নিচে ভালো পোলন্দার মেলে না। ইতালিয়ানরা টালির ওপর আরও কিছু কাজ করে। শিরিষ কাগজ ঘষে টালির ওপর ইজিয়াম, মোম, থিনার ইত্যাদি কেমিক্যাল দিয়ে কাজ করে। টালিটা তখন ওয়াটারপ্রুফ হয়ে যায়। কলারোয়ার টালি নাকি হিমের জন্য ভালো। প্রসেস করা টালির ওপর বরফ বসতে পারে না, বরং পিছলে যায়। টালিকথা শেষ হলে পোলন্দার আবুল সরদারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পিচ পথ ছেড়ে পাথারি পথ ধরি। মঞ্জিল হাত উঁচিয়ে বিল্ডিংটা দেখান। দোতলা, নকশাকাটা মনোহরা প্রাসাদ। শহরের ছিটেফোঁটা নেই, অথচ এত নান্দানিক বাড়ি কে বানালেন? বাড়িটার ভেতর ঢুকে গিয়ে আমরা দেয়ালে হাত রাখি। কারুকাজ ছুঁয়ে বিস্মিত হই। স্রেফ টালি দিয়ে এমন নকশাবাড়ি বানানো যেতে পারে, ভাবাই যায় না।
ঘুরে ঘুরে টালিবাড়ি দেখা হলে আমরা ফের গোষ্ঠের চাতালে ফিরে আসি। গোধূলির হলুদ আলোতে পুনরায় ভিড় বাড়ে। টালির সঙ্গে যোগ হয় আয়েশা, সুলতান, আমজাদ, মতিন, নরেনদের জীবনের গল্প। রাফায়েল আলদো আর টালিনির্ভর এখানকার দুই হাজার পরিবারের ছবিগুলো একসময় সশরীরেই যেন উঠে আসতে থাকে আমাদের সামনে। গ্রামীণ গল্পগুলো শেষ হয় না, বরং কল্পনায় অপূর্ব এক বাড়ির দেখা মেলে। কলারোয়ার টালিতে বানানো ইতালিয়ান বাড়িটাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে আমাদের।
No comments