চিরকুট-টেলিভিশন ও মনন by শাহাদুজ্জামান
‘টিভি আমাকে বেশ জ্ঞানী করে তোলে, কারণ যখন এ ঘরে সবাই টিভি দেখতে বসে, আমি তখন বাধ্য হয়ে আমার পড়ার ঘরে একটা বই নিয়ে বসি।’ এমনটা লিখেছিলেন একজন পশ্চিমা লেখক। সাধারণভাবে জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে টিভির সম্পর্ক ক্ষীণ। টিভি মাধ্যমটির সাফল্য প্রধানত বিনোদন এবং তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে।
তবে পৃথিবীর বহু দেশে টেলিভিশন তার এই পরিচিত ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসেছে। ইতিহাস ও বিজ্ঞানের গবেষণাভিত্তিক নানা অনুষ্ঠান মানুষের মনন এবং জ্ঞানার্জনেও নানা ভূমিকা রাখছে। হিস্ট্রি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, বিবিসি ফোর ইত্যাদি চ্যানেলে জ্ঞানপিপাসু দর্শকদের চিন্তা-উদ্দীপক বিস্তর অনুষ্ঠান রয়েছে। পৃথিবীর ব্যাপকসংখ্যক দর্শক টিভির দ্বারস্থ হন মূলত খানিকটা বিনোদন এবং দেশ-বিদেশের সাম্প্রতিক খবরাখবরের জন্য। কিন্তু এমন দর্শকও আছেন, যাঁরা এই মাধ্যমটির কাছে গভীর চিন্তার খোরাকও চান। পৃথিবীর বহু দেশের টিভি তেমন দর্শকদেরও ক্ষুধা মেটায়। ব্রিটেনের কোনো কোনো চ্যানেলে দর্শনের ওপর ধারাবাহিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জোসেফ ক্যাম্পবেল তাঁর মিথবিষয়ক বিখ্যাত ধারণা দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন; হয় সাহিত্যবিষয়ক উঁচুমানের অনুষ্ঠান। নিয়মিত হয় ব্যাপক গবেষণাভিত্তিক সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক ডকুমেন্টারি।
লক্ষ করি, ওপরতলের খবরের উত্তেজনা আর চটুল বিনোদন বিতরণই হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের প্রধান প্রবণতা। জ্ঞানপিপাসু দর্শকের জন্য সেখানে খাদ্য সামান্যই। মনে আছে, সত্তর দশকের শেষে আশির দশকের গোড়ার দিকে বেলাল বেগ প্রমুখ ব্যক্তির উদ্যোগে জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক, জ্ঞান জিজ্ঞাসা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম সেসব অনুষ্ঠান দেখার জন্য। কলেজছাত্র হিসেবে পরবর্তী সময় অংশও নিয়েছি সেসব অনুষ্ঠানে। একজন নাটকের তারকার মতোই খ্যাতি ছিল সেরা বিতার্কিক মাহবুবুল মেকাদ্দেম আকাশের। কিন্তু সেই ধারাটি টেলিভিশনে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। অগণিত চ্যানেল আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেগবান হয়েছে তরল আনন্দের ধারা। এখন টক শো নামে বিস্তর ছদ্ম-চিন্তাশীল অনুষ্ঠান হয়ে থাকে বিভিন্ন চ্যানেলে, কিন্তু সেসব অনুষ্ঠানে বিষয়ের গভীরে যাওয়ার সুযোগ থাকে নেহাতই সামান্য। দু-একটি টিভি চ্যানেলের ভেতর মহলের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, প্রায়ই মেধাহীন রূপসী উপস্থাপিকাদের বসিয়ে দেওয়া হয় এমন কোনো বিষয়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে অথবা এমন কারও সাক্ষাৎকার নিতে, যাঁর সম্পর্কে বা যে বিষয় তাঁর ধারণা সামান্য এবং প্রস্তুতি প্রায় শূন্য।
চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি এবং একসময় চলচ্চিত্র আন্দোলনে সক্রিয়তার সুবাদে একটি টেলিভিশন চ্যানেল আমাকে চলচ্চিত্রবিষয়ক একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতে আমন্ত্রণ জানায়। অনুষ্ঠানের প্রযোজক নিজেও একজন প্রাক্তন চলচ্চিত্র সংসদকর্মী। আমি রাজি হলে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হই। এ ধরনের একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছি দেখে পরিচিত অনেকে বিস্মিত হন। আমি সিরিয়াস বিষয়ে লেখালেখি করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি—আমি সিনেমা নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করছি, এটি তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না মোটেও। তাঁদের ধারণা, সিনেমা কোনো সিরিয়াস বিষয় নয় এবং নায়ক-নায়িকার গালগল্প ছাড়া এ বিষয়ে আর কোনো অনুষ্ঠান হতে পারে না। আমার অনুষ্ঠানটি ছিল মূলত চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব, ধ্রুপদী চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রসাহিত্য ইত্যাকার বিষয়ে। এতে আবার সমস্যা দেখা দেয় চ্যানেলটির মালিকপক্ষ থেকে। তারা মনে করে, অনুষ্ঠানটি যথেষ্ট বিনোদনমূলক নয়। অনুষ্ঠানটিকে তাদের ধারণা অনুযায়ী বিনোদনমূলক করার অব্যাহত চাপ থাকে। অনুষ্ঠানটির প্রযোজক এবং মালিকপক্ষের টানাপোড়েনে একপর্যায়ে অনুষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ করি, বিনোদন বলতে কী বোঝায়, এর গড়পড়তা ধারণাই মূলত টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে শাসন করে। শাসক অবশ্য শেষ পর্যন্ত নানা শক্তিমান করপোরেটের পুঁজি। তাদের দাক্ষিণ্যেই টেলিভিশন অনুষ্ঠানের চরিত্র নির্ধারিত হয়। আমার সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নির্মিত বেশ কটি চমৎকার ও মননশীল ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্রের অংশবিশেষ দেখিয়েছি এবং তাদের নির্মাতাদের সঙ্গে আলাপ করেছি। নির্মাতারা আমাকে জানিয়েছেন, নানা চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো টিভি চ্যানেলকে তাঁরা তাঁদের এই ডকুমেন্টারিগুলো দেখানোর ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে পারেননি। দিনের পর দিন চ্যানেলের পর চ্যানেল ধরে অগণিত তরল, ইয়ার্কিসর্বস্ব নাটক প্রচারিত হলেও দীর্ঘ গবেষণা, পরিশ্রমে নির্মিত এসব ডকুমেন্টারি দেখানোর জন্য ছয় মাসে, এক বছরেও ঘণ্টাখানেক সময় ছাড়তে প্রস্তুত হয়নি কোনো চ্যানেল। বলা বাহুল্য, জ্ঞান কোনো বিনোদনের বিষয় হিসেবে বিবেচ্য নয়। এমনকি যে নাটক গড়পড়তা বিনোদনের স্তর পেরিয়ে মননশীল বিনোদনের আবেদন তৈরি করার চেষ্টা করে, তার পক্ষেও টিভির পর্দায় জায়গা করে নেওয়া হয়ে পড়ে দুরূহ। জেনে বিস্মিত হয়েছি, নির্মাতা নুরুল আলম আতিককে তাঁর বিকল পাখীর গান-এর মতো একটি বিরল মানের টেলিভিশন প্রযোজনাকে পর্দায় আনতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
পৃথিবীর সব দেশের টিভি চ্যানেলেই সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি সোপ অপেরা, রিয়েলিটি শো, ফ্যাশন শো, মিউজিক শো ইত্যাদি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, কিন্তু সমান্তরালে এমন কিছু অনুষ্ঠানও হয়, যার আবেদন থাকে মানুষের গভীরতর জ্ঞান ও মননের কাছে। কিছু ব্যতিক্রমী চেষ্টা থাকলেও বাংলাদেশে এই সমান্তরাল ধারাটি অত্যন্ত ক্ষীণ। বলা বাহুল্য, মননবিমুখতাকে প্রশ্রয় দিলে বাংলাদেশের টেলিভিশন এর সীমাহীন সম্ভাবনাকেই সীমিত করবে মাত্র।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
লক্ষ করি, ওপরতলের খবরের উত্তেজনা আর চটুল বিনোদন বিতরণই হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের প্রধান প্রবণতা। জ্ঞানপিপাসু দর্শকের জন্য সেখানে খাদ্য সামান্যই। মনে আছে, সত্তর দশকের শেষে আশির দশকের গোড়ার দিকে বেলাল বেগ প্রমুখ ব্যক্তির উদ্যোগে জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক, জ্ঞান জিজ্ঞাসা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম সেসব অনুষ্ঠান দেখার জন্য। কলেজছাত্র হিসেবে পরবর্তী সময় অংশও নিয়েছি সেসব অনুষ্ঠানে। একজন নাটকের তারকার মতোই খ্যাতি ছিল সেরা বিতার্কিক মাহবুবুল মেকাদ্দেম আকাশের। কিন্তু সেই ধারাটি টেলিভিশনে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। অগণিত চ্যানেল আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেগবান হয়েছে তরল আনন্দের ধারা। এখন টক শো নামে বিস্তর ছদ্ম-চিন্তাশীল অনুষ্ঠান হয়ে থাকে বিভিন্ন চ্যানেলে, কিন্তু সেসব অনুষ্ঠানে বিষয়ের গভীরে যাওয়ার সুযোগ থাকে নেহাতই সামান্য। দু-একটি টিভি চ্যানেলের ভেতর মহলের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, প্রায়ই মেধাহীন রূপসী উপস্থাপিকাদের বসিয়ে দেওয়া হয় এমন কোনো বিষয়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে অথবা এমন কারও সাক্ষাৎকার নিতে, যাঁর সম্পর্কে বা যে বিষয় তাঁর ধারণা সামান্য এবং প্রস্তুতি প্রায় শূন্য।
চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি এবং একসময় চলচ্চিত্র আন্দোলনে সক্রিয়তার সুবাদে একটি টেলিভিশন চ্যানেল আমাকে চলচ্চিত্রবিষয়ক একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতে আমন্ত্রণ জানায়। অনুষ্ঠানের প্রযোজক নিজেও একজন প্রাক্তন চলচ্চিত্র সংসদকর্মী। আমি রাজি হলে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হই। এ ধরনের একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছি দেখে পরিচিত অনেকে বিস্মিত হন। আমি সিরিয়াস বিষয়ে লেখালেখি করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি—আমি সিনেমা নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করছি, এটি তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না মোটেও। তাঁদের ধারণা, সিনেমা কোনো সিরিয়াস বিষয় নয় এবং নায়ক-নায়িকার গালগল্প ছাড়া এ বিষয়ে আর কোনো অনুষ্ঠান হতে পারে না। আমার অনুষ্ঠানটি ছিল মূলত চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব, ধ্রুপদী চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রসাহিত্য ইত্যাকার বিষয়ে। এতে আবার সমস্যা দেখা দেয় চ্যানেলটির মালিকপক্ষ থেকে। তারা মনে করে, অনুষ্ঠানটি যথেষ্ট বিনোদনমূলক নয়। অনুষ্ঠানটিকে তাদের ধারণা অনুযায়ী বিনোদনমূলক করার অব্যাহত চাপ থাকে। অনুষ্ঠানটির প্রযোজক এবং মালিকপক্ষের টানাপোড়েনে একপর্যায়ে অনুষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ করি, বিনোদন বলতে কী বোঝায়, এর গড়পড়তা ধারণাই মূলত টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে শাসন করে। শাসক অবশ্য শেষ পর্যন্ত নানা শক্তিমান করপোরেটের পুঁজি। তাদের দাক্ষিণ্যেই টেলিভিশন অনুষ্ঠানের চরিত্র নির্ধারিত হয়। আমার সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নির্মিত বেশ কটি চমৎকার ও মননশীল ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্রের অংশবিশেষ দেখিয়েছি এবং তাদের নির্মাতাদের সঙ্গে আলাপ করেছি। নির্মাতারা আমাকে জানিয়েছেন, নানা চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো টিভি চ্যানেলকে তাঁরা তাঁদের এই ডকুমেন্টারিগুলো দেখানোর ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে পারেননি। দিনের পর দিন চ্যানেলের পর চ্যানেল ধরে অগণিত তরল, ইয়ার্কিসর্বস্ব নাটক প্রচারিত হলেও দীর্ঘ গবেষণা, পরিশ্রমে নির্মিত এসব ডকুমেন্টারি দেখানোর জন্য ছয় মাসে, এক বছরেও ঘণ্টাখানেক সময় ছাড়তে প্রস্তুত হয়নি কোনো চ্যানেল। বলা বাহুল্য, জ্ঞান কোনো বিনোদনের বিষয় হিসেবে বিবেচ্য নয়। এমনকি যে নাটক গড়পড়তা বিনোদনের স্তর পেরিয়ে মননশীল বিনোদনের আবেদন তৈরি করার চেষ্টা করে, তার পক্ষেও টিভির পর্দায় জায়গা করে নেওয়া হয়ে পড়ে দুরূহ। জেনে বিস্মিত হয়েছি, নির্মাতা নুরুল আলম আতিককে তাঁর বিকল পাখীর গান-এর মতো একটি বিরল মানের টেলিভিশন প্রযোজনাকে পর্দায় আনতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
পৃথিবীর সব দেশের টিভি চ্যানেলেই সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি সোপ অপেরা, রিয়েলিটি শো, ফ্যাশন শো, মিউজিক শো ইত্যাদি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, কিন্তু সমান্তরালে এমন কিছু অনুষ্ঠানও হয়, যার আবেদন থাকে মানুষের গভীরতর জ্ঞান ও মননের কাছে। কিছু ব্যতিক্রমী চেষ্টা থাকলেও বাংলাদেশে এই সমান্তরাল ধারাটি অত্যন্ত ক্ষীণ। বলা বাহুল্য, মননবিমুখতাকে প্রশ্রয় দিলে বাংলাদেশের টেলিভিশন এর সীমাহীন সম্ভাবনাকেই সীমিত করবে মাত্র।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments