চার দিক-লোগাংগাথা by মৃত্যুঞ্জয় রায়
লোগাং একটা নদীর নাম। একটা ঐতিহাসিক জায়গার নামও। চাকমা ভাষায় ‘লোগাং’ মানে রক্তের নদী। নদীর জলটা লালচে, মাটির রঙে লালচে। এ কারণেই হয়তো নামটা হয়েছে। তবে লোগাংয়ের কিছু রক্তাক্ত অধ্যায়ও আছে। আছে চাকমা-বাঙালি সংঘর্ষের লোগাং হত্যাকাণ্ডের রক্তাক্ত ইতিহাস।
ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা থেকে নদীটা লোগাং সীমান্ত দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। লোগাং বিওপির পাশ দিয়ে বয়ে আসা নদীটা দুদুকছড়ায় এসে দুদুকছড়া খালের সঙ্গে মিশেছে। কিছুদূর গিয়ে মিশেছে পূজগাংয়ের সঙ্গে। পূজগাংয়ের জল আবার সাদাটে। পূজগাং আর লোগাংয়ের মিলনে ওখানেই নদী দুটোর সমাপ্তি। ওখান থেকে দুটো নদীর মিলিত ধারা বয়ে চলেছে চেঙ্গী নামে। চেঙ্গী বয়ে চলেছে খাগড়াছড়ি শহরের মধ্য দিয়ে। সেটা গিয়ে মিলেছে কর্ণফুলীর সঙ্গে।
মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু খাগড়াছড়ি থেকে পানছড়ি স্ট্যান্ডে পৌঁছে মনে হলো ওখানে বসন্তকাল চলছে। স্ট্যান্ডের কৃষ্ণচূড়া গাছটা থোকা থোকা লাল ফুলে ভরা। আসার পথেও রাস্তার দুই ধারে বনঝোপের মধ্যে কিছু ফুল ফোটা কুরচিগাছ চোখে পড়ল। এসব ফুল বসন্তে বা গ্রীষ্মের প্রথমে ফোটে। বর্ষা পেরিয়েও এসব ফুল যেন জলবায়ু পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত দিল। কিন্তু বন্ধু পবন চাকমা ও শুভাশীষ চাকমার ইঙ্গিতপূর্ণ আমন্ত্রণে পানছড়ি থেকে আর লোগাং না গিয়ে পারলাম না। ওদের কাছে লোগাং এক ঐতিহাসিক জায়গা। সীমান্তবর্তী ওই জায়গায়ই শান্তি বাহিনীর শেষ দলটি আত্মসমর্পণ করেছিল। সন্তু লারমাও ছিলেন সে দলে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি হওয়ার পরও পারস্পরিক সন্দেহ আর অবিশ্বাসে কেটে যায় আরও কিছুটা সময়। অবশেষে সে বছরই ১৩ ডিসেম্বর ঘটে সর্বশেষ আত্মসমর্পণ। শুরু হয় পার্বত্য শান্তিচুক্তির বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া। দুদুকছড়ার জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী ৬৭ বছর বয়সী আপন চন্দ্র চাকমা বলেন, এর আগে পানছড়ি ছিল এক চরম অশান্তিপূর্ণ এলাকা। কাছেই রিজার্ভ ফরেস্ট। দক্ষিণ ত্রিপুরা আর মিজোরামের কোল ঘেঁষে সেই গহিন জঙ্গলেই হয়তো আস্তানা ছিল তথাকথিত শান্তি বাহিনীর। সে সময় কেউ বাজারে এক বস্তা চাল কিনতে গেলেও ওদের নজর পড়ত তার ওপর। চাঁদা, অপহরণ এসব ছিল নিত্যকার বিষয়। তাঁর মতে, এখন অনেক শান্তিতে আছে দুদুকছড়ার প্রায় ২০০ ঘর চাকমা পরিবার।
পানছড়ি বাজার থেকে লোগাং বিওপির দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। পাকা পিচের পথ। না সমতল, না পাহাড়ি পথ। পবনের মোটরবাইকে করে ওখানে গিয়েছিলাম। তবে ওখানে নিয়মিত চান্দের গাড়ি চলে, ভাড়া জনপ্রতি মাত্র ১৫ টাকা। লোগাং বিওপির সামনে আপন চন্দ্র চাকমার একটা দোকান আছে। তিনি বলেন, লোগাং বিওপিতেই শান্তি বাহিনীর সঙ্গে ডায়ালগ হতো। লোগাং নদীর পাশে একটা আখখেতের মাঠ দেখিয়ে বললেন, ওই মাঠেই সেদিন শান্তি বাহিনীর ২৫২ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। ওখান থেকেই হেলিকপ্টারে করে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়।
আপন চন্দ্র চাকমার পাশে বসেছিলেন বরুণ চাকমা। তিনি বললেন, খাগড়াছড়ির দিঘীনালা আর পানছড়ি যেন অভিশপ্ত এলাকা। এ দুটি জনপদ যেমন সবদিক দিয়ে পিছিয়ে, তেমনি অশান্ত ও গোলযোগপূর্ণ। এ কথা তিনি জানলেন কেমন করে? জবাবে বললেন, তাঁর বাড়িই তো দিঘীনালায়। এখানে বড় বোনের বাড়ি। পানছড়ির দুদুকছড়ায় তিনি এনগেজ করেছেন। তাই দুটো এলাকাই তাঁর খুব জানা। তিনি স্বীকার করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আসলে অশান্তির শুরু ১৯৭৯ থেকে। বাঙালি পুনর্বাসনকে আদিবাসীরা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ফলে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের সূচনা ঘটে, শুরু হয় এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের। ১৯৮৬ সালে লোগাংয়ে আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে। আপন চন্দ্র চাকমা বলেন, ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা কেউ দেশ ছাড়িনি। কিন্তু ওই সময় আমরা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক ভারতের ত্রিপুরায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানেই শেষ নয়। ১৯৯৩ সালের ১০ এপ্রিল লোগাং গুচ্ছগ্রামে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। সরকারি তথ্যমতে, ১১ জন আদিবাসী মারা যাওয়ার কথা বলা হলেও আসলে ৪০ জন ত্রিপুরা ও চাকমা আদিবাসী সে হত্যাকাণ্ডে মারা যায়। এসবই আমাদের নিয়তির পরিহাস আর পাহাড়িদের অলিখিত ইতিহাস।’ তাঁর কথা শুনে মনে হলো, যদি এসব সত্যি হয়, তবে লোগাং নদীর নামটা যথার্থ।
ব্যথাতুর মন নিয়ে ফিরে আসার সময় লোগাং সেতু পেরোতেই মন কিছুটা হালকা হয়ে গেল। চোখ জুড়িয়ে গেল লোগাংয়ের মনকাড়া রূপ দেখে। শরতের কাশফুল ফুটেছে। লোগাংয়ের তীর ধরে বিস্তীর্ণ উপত্যকায় আমন ধানের গালিচা পাতা, দূরে ত্রিপুরার পাহাড়। জানি না, লোগাং না লোগাংতীরের কোনো সুন্দরীকে দেখে সাবেক মন্ত্রী মণি স্বপন দেওয়ান একটা গান লিখেছিলেন, ‘লোগাংছড়ার হুলে হুলে/ হোল গাবুরী এজেদটে/ হরদ তার ইককুয়া হুম/ এককা এককা আজেদটে’। অর্থটা পবনই করে দিল, ‘লোগাং ছড়ার কূলে কূলে/ কোন যুবতী আসিতেছে/ কোলে তার একটা কলস/ একটু একটু হাসিতেছে’।
মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু খাগড়াছড়ি থেকে পানছড়ি স্ট্যান্ডে পৌঁছে মনে হলো ওখানে বসন্তকাল চলছে। স্ট্যান্ডের কৃষ্ণচূড়া গাছটা থোকা থোকা লাল ফুলে ভরা। আসার পথেও রাস্তার দুই ধারে বনঝোপের মধ্যে কিছু ফুল ফোটা কুরচিগাছ চোখে পড়ল। এসব ফুল বসন্তে বা গ্রীষ্মের প্রথমে ফোটে। বর্ষা পেরিয়েও এসব ফুল যেন জলবায়ু পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত দিল। কিন্তু বন্ধু পবন চাকমা ও শুভাশীষ চাকমার ইঙ্গিতপূর্ণ আমন্ত্রণে পানছড়ি থেকে আর লোগাং না গিয়ে পারলাম না। ওদের কাছে লোগাং এক ঐতিহাসিক জায়গা। সীমান্তবর্তী ওই জায়গায়ই শান্তি বাহিনীর শেষ দলটি আত্মসমর্পণ করেছিল। সন্তু লারমাও ছিলেন সে দলে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি হওয়ার পরও পারস্পরিক সন্দেহ আর অবিশ্বাসে কেটে যায় আরও কিছুটা সময়। অবশেষে সে বছরই ১৩ ডিসেম্বর ঘটে সর্বশেষ আত্মসমর্পণ। শুরু হয় পার্বত্য শান্তিচুক্তির বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া। দুদুকছড়ার জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী ৬৭ বছর বয়সী আপন চন্দ্র চাকমা বলেন, এর আগে পানছড়ি ছিল এক চরম অশান্তিপূর্ণ এলাকা। কাছেই রিজার্ভ ফরেস্ট। দক্ষিণ ত্রিপুরা আর মিজোরামের কোল ঘেঁষে সেই গহিন জঙ্গলেই হয়তো আস্তানা ছিল তথাকথিত শান্তি বাহিনীর। সে সময় কেউ বাজারে এক বস্তা চাল কিনতে গেলেও ওদের নজর পড়ত তার ওপর। চাঁদা, অপহরণ এসব ছিল নিত্যকার বিষয়। তাঁর মতে, এখন অনেক শান্তিতে আছে দুদুকছড়ার প্রায় ২০০ ঘর চাকমা পরিবার।
পানছড়ি বাজার থেকে লোগাং বিওপির দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। পাকা পিচের পথ। না সমতল, না পাহাড়ি পথ। পবনের মোটরবাইকে করে ওখানে গিয়েছিলাম। তবে ওখানে নিয়মিত চান্দের গাড়ি চলে, ভাড়া জনপ্রতি মাত্র ১৫ টাকা। লোগাং বিওপির সামনে আপন চন্দ্র চাকমার একটা দোকান আছে। তিনি বলেন, লোগাং বিওপিতেই শান্তি বাহিনীর সঙ্গে ডায়ালগ হতো। লোগাং নদীর পাশে একটা আখখেতের মাঠ দেখিয়ে বললেন, ওই মাঠেই সেদিন শান্তি বাহিনীর ২৫২ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। ওখান থেকেই হেলিকপ্টারে করে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়।
আপন চন্দ্র চাকমার পাশে বসেছিলেন বরুণ চাকমা। তিনি বললেন, খাগড়াছড়ির দিঘীনালা আর পানছড়ি যেন অভিশপ্ত এলাকা। এ দুটি জনপদ যেমন সবদিক দিয়ে পিছিয়ে, তেমনি অশান্ত ও গোলযোগপূর্ণ। এ কথা তিনি জানলেন কেমন করে? জবাবে বললেন, তাঁর বাড়িই তো দিঘীনালায়। এখানে বড় বোনের বাড়ি। পানছড়ির দুদুকছড়ায় তিনি এনগেজ করেছেন। তাই দুটো এলাকাই তাঁর খুব জানা। তিনি স্বীকার করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আসলে অশান্তির শুরু ১৯৭৯ থেকে। বাঙালি পুনর্বাসনকে আদিবাসীরা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ফলে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের সূচনা ঘটে, শুরু হয় এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের। ১৯৮৬ সালে লোগাংয়ে আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে। আপন চন্দ্র চাকমা বলেন, ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা কেউ দেশ ছাড়িনি। কিন্তু ওই সময় আমরা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক ভারতের ত্রিপুরায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানেই শেষ নয়। ১৯৯৩ সালের ১০ এপ্রিল লোগাং গুচ্ছগ্রামে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। সরকারি তথ্যমতে, ১১ জন আদিবাসী মারা যাওয়ার কথা বলা হলেও আসলে ৪০ জন ত্রিপুরা ও চাকমা আদিবাসী সে হত্যাকাণ্ডে মারা যায়। এসবই আমাদের নিয়তির পরিহাস আর পাহাড়িদের অলিখিত ইতিহাস।’ তাঁর কথা শুনে মনে হলো, যদি এসব সত্যি হয়, তবে লোগাং নদীর নামটা যথার্থ।
ব্যথাতুর মন নিয়ে ফিরে আসার সময় লোগাং সেতু পেরোতেই মন কিছুটা হালকা হয়ে গেল। চোখ জুড়িয়ে গেল লোগাংয়ের মনকাড়া রূপ দেখে। শরতের কাশফুল ফুটেছে। লোগাংয়ের তীর ধরে বিস্তীর্ণ উপত্যকায় আমন ধানের গালিচা পাতা, দূরে ত্রিপুরার পাহাড়। জানি না, লোগাং না লোগাংতীরের কোনো সুন্দরীকে দেখে সাবেক মন্ত্রী মণি স্বপন দেওয়ান একটা গান লিখেছিলেন, ‘লোগাংছড়ার হুলে হুলে/ হোল গাবুরী এজেদটে/ হরদ তার ইককুয়া হুম/ এককা এককা আজেদটে’। অর্থটা পবনই করে দিল, ‘লোগাং ছড়ার কূলে কূলে/ কোন যুবতী আসিতেছে/ কোলে তার একটা কলস/ একটু একটু হাসিতেছে’।
No comments