স্নাতকোত্তরে ভর্তি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতি বৈষম্য
বিশ্বায়নের এ যুগে যখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো মেধাবী শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর কোর্সে পড়ার সুযোগ পান, যখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো পিএইচডি এবং উচ্চপর্যায়ের কোর্সগুলোতে যোগ্যতাসম্পন্ন যেকোনো শিক্ষার্থীকে ভর্তির সুযোগ
দেয়, ঠিক তখনই বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষায় স্বাগত জানাতে কুণ্ঠা বোধ করছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীই কি তবে অযোগ্য ও মেধাহীন?
এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই লেখার অবতারণা। সাম্প্রতিক মাস্টার্স কোর্সে বেসরকারি এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ দেখা গেছে বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পৃথিবীর অধিকাংশ মানসম্পন্ন এবং শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন সব শিক্ষার্থীকে তাদের স্নাতকোত্তর কোর্সগুলোতে পড়ার সুযোগ দেয়। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়া কেবল আইইএলটিএস বা টোফেল এবং জিআরইর মতো ভাষাগত দক্ষতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার মাপকাঠি কিংবা অতীতের পরীক্ষার ফলাফলকেই বিবেচনা করা হয়। ওই শিক্ষার্থী বেসরকারি নাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছেন বা কোন দেশ থেকে পড়াশোনা করেছেন, তা কখনো মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয় না। অথচ বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার অপরাধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হচ্ছে। যদি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যোগ্যতাসম্পন্ন ও মেধাবী হন তবে তাঁকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দিতে অসুবিধা কোথায়?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এই শিক্ষার্থীরা যে মানসম্পন্ন তা নিশ্চিত করা যাবে কীভাবে? খুব সহজ। একটি উন্মুক্ত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হোক এবং একটি মানদণ্ড নির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক যে শতকরা ৭০ কিংবা ৮০ ভাগ নম্বর পেলেই কেবল ওই ছাত্র ভর্তির সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ শিক্ষার্থী যদি পরীক্ষায় নিজেকে প্রমাণ করতে পারেন তাহলেই তিনি ভর্তির সুযোগ পাবেন। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ স্নাতকোত্তর কোর্সে শীর্ষস্থানীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষারই আয়োজন করে না এবং শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হন। এভাবে দ্বার বন্ধ রেখে দেশের আদৌ কোনো উপকার হচ্ছে কি?
আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে যেসব শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক কিংবা এ লেভেল পরীক্ষার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান না, অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, স্নাতক পর্যায়ে একটি ছাত্র চার বছর পড়াশোনা করছেন। এই চার বছরে অনেক ভালো শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়ে ছাত্রটি যদি নিজেকে উন্নত করতে পারেন, একটি নির্দিষ্ট মানে উন্নীত করতে পারেন, যদি নিজেকে অন্য যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সমমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে তাঁকে মাস্টার্সে সুযোগ দিতে সমস্যা কোথায়? সেই শিক্ষার্থীর যদি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র বা জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধ থাকে, ভালো জিআরই কিংবা আইইএলটিএস স্কোর থাকে, স্নাতক পর্যায়ে অসাধারণ ফলাফল থাকে, ভালো ব্যবহারিক জ্ঞান থাকে, তাহলে কেন তাঁকে সুযোগ দেওয়া হবে না?
আমরা বলছি না সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ই মানসম্পন্ন। অনেক ভুঁইফোঁড়, মানহীন সার্টিফিকেটসর্বস্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন আছে, তেমনি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, দক্ষ শিক্ষকসমৃদ্ধ ও চমৎকার পরিবেশসমৃদ্ধ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে। সেখান থেকে নিশ্চয়ই বেশ কিছু অসাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থী বের হন। তাঁদের জন্য সুযোগ উন্মুক্ত থাকবে না কেন?
যদি এমন মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকত তাহলে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড, আরবানা শাম্পেন এবং মর্যাদাপূর্ণ আইভি লিগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডিতে ভর্তি হন এসব শিক্ষার্থী? যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়, ইম্পেরিয়াল কলেজ, কিংস কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব হাল, সুইডেনের কেটিএইচ, জার্মানির হাইডেলবার্গ, উলম ও ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্তত ১০০ জন বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্কলারশিপ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী মেধার স্বীকৃতি পাচ্ছেন, সেখানে বাংলাদেশে তাঁদের জন্য দুয়ার বন্ধ করে রাখার পেছনে আমরা কোনো কারণ খুঁজে পাই না। করপোরেট প্রতিষ্ঠান, টেলিকম প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান, সফটওয়্যার ফার্ম, শিক্ষকতা—প্রতিটি ক্ষেত্রে বেশ সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।
এই শিক্ষার্থীরাই কিন্তু যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, মালয়েশিয়ার মতো জায়গায় বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ করে পড়তে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কিছু আসন মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকত, তাহলে অন্তত দেশের কিছু অর্থ সাশ্রয় হতো।
আবার প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে নিজেদের ছাত্রদেরই গবেষণার সুযোগ, ল্যাবরেটরি ব্যবহারের সুযোগ কিংবা ইন্টারনেট-সুবিধা দিতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে কীভাবে তারা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অতিরিক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে সুযোগ দেবে? এখানেই আসে অর্থের প্রশ্ন। এই শিক্ষার্থীরাই তো স্নাতক পর্যায়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ করেছেন, তাঁরাই হয়তো বা মাস্টার্সে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে লন্ডনে বা কানাডায় পড়তে যাবেন। এখন এই শিক্ষার্থী যদি মেধাবী হন এবং মাস্টার্সে অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে রাজি থাকেন, তাহলে সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ নিতে অসুবিধা কোথায়? এটি শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করা নয় বরং প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সীমাবদ্ধতা উত্তরণের জন্য অতিরিক্ত ফি আদায় করা হচ্ছে। এটি কোনো নতুন ধারণা নয়। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদ এবং আইবিএর (ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট) এমবিএতে উন্মুক্ত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ সেখানে ভর্তি হওয়া ছাত্ররা প্রদান করেন। এ কোর্সগুলোর মান নিয়ে তো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। এসব কোর্সে ভর্তি হওয়া অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মান নিয়েও কখনো প্রশ্ন ওঠেনি। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ যদি সফল হয় তাহলে অন্য বিষয়গুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ার কেন বন্ধ করে রাখা হবে?
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়ার উচ্চশিক্ষা অধ্যায়ের ১০ নং অনুচ্ছেদও এই প্রস্তাব সমর্থন করে। শিক্ষানীতির ১০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে হবে। সরকারি অনুদান ছাড়া ও উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যয় নির্বাহের জন্য শিক্ষার্থীদের বেতন ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যক্তিগত অনুদান সংগ্রহের চেষ্টা চালাতে হবে।’
যেখানে শিক্ষানীতিতে শিক্ষাকে উন্মুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে, সবার সঙ্গে জ্ঞান সঞ্চারণের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে কেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আলাদা একটি শ্রেণী হিসেবে চিহ্নিত করে রাখা হবে? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়া কি কোনো অপরাধ?
লেখকেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই লেখার অবতারণা। সাম্প্রতিক মাস্টার্স কোর্সে বেসরকারি এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ দেখা গেছে বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পৃথিবীর অধিকাংশ মানসম্পন্ন এবং শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন সব শিক্ষার্থীকে তাদের স্নাতকোত্তর কোর্সগুলোতে পড়ার সুযোগ দেয়। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়া কেবল আইইএলটিএস বা টোফেল এবং জিআরইর মতো ভাষাগত দক্ষতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার মাপকাঠি কিংবা অতীতের পরীক্ষার ফলাফলকেই বিবেচনা করা হয়। ওই শিক্ষার্থী বেসরকারি নাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছেন বা কোন দেশ থেকে পড়াশোনা করেছেন, তা কখনো মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয় না। অথচ বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার অপরাধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হচ্ছে। যদি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যোগ্যতাসম্পন্ন ও মেধাবী হন তবে তাঁকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দিতে অসুবিধা কোথায়?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এই শিক্ষার্থীরা যে মানসম্পন্ন তা নিশ্চিত করা যাবে কীভাবে? খুব সহজ। একটি উন্মুক্ত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হোক এবং একটি মানদণ্ড নির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক যে শতকরা ৭০ কিংবা ৮০ ভাগ নম্বর পেলেই কেবল ওই ছাত্র ভর্তির সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ শিক্ষার্থী যদি পরীক্ষায় নিজেকে প্রমাণ করতে পারেন তাহলেই তিনি ভর্তির সুযোগ পাবেন। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ স্নাতকোত্তর কোর্সে শীর্ষস্থানীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষারই আয়োজন করে না এবং শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হন। এভাবে দ্বার বন্ধ রেখে দেশের আদৌ কোনো উপকার হচ্ছে কি?
আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে যেসব শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক কিংবা এ লেভেল পরীক্ষার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান না, অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, স্নাতক পর্যায়ে একটি ছাত্র চার বছর পড়াশোনা করছেন। এই চার বছরে অনেক ভালো শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়ে ছাত্রটি যদি নিজেকে উন্নত করতে পারেন, একটি নির্দিষ্ট মানে উন্নীত করতে পারেন, যদি নিজেকে অন্য যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সমমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে তাঁকে মাস্টার্সে সুযোগ দিতে সমস্যা কোথায়? সেই শিক্ষার্থীর যদি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র বা জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধ থাকে, ভালো জিআরই কিংবা আইইএলটিএস স্কোর থাকে, স্নাতক পর্যায়ে অসাধারণ ফলাফল থাকে, ভালো ব্যবহারিক জ্ঞান থাকে, তাহলে কেন তাঁকে সুযোগ দেওয়া হবে না?
আমরা বলছি না সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ই মানসম্পন্ন। অনেক ভুঁইফোঁড়, মানহীন সার্টিফিকেটসর্বস্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন আছে, তেমনি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, দক্ষ শিক্ষকসমৃদ্ধ ও চমৎকার পরিবেশসমৃদ্ধ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে। সেখান থেকে নিশ্চয়ই বেশ কিছু অসাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থী বের হন। তাঁদের জন্য সুযোগ উন্মুক্ত থাকবে না কেন?
যদি এমন মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকত তাহলে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড, আরবানা শাম্পেন এবং মর্যাদাপূর্ণ আইভি লিগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডিতে ভর্তি হন এসব শিক্ষার্থী? যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়, ইম্পেরিয়াল কলেজ, কিংস কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব হাল, সুইডেনের কেটিএইচ, জার্মানির হাইডেলবার্গ, উলম ও ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্তত ১০০ জন বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্কলারশিপ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী মেধার স্বীকৃতি পাচ্ছেন, সেখানে বাংলাদেশে তাঁদের জন্য দুয়ার বন্ধ করে রাখার পেছনে আমরা কোনো কারণ খুঁজে পাই না। করপোরেট প্রতিষ্ঠান, টেলিকম প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান, সফটওয়্যার ফার্ম, শিক্ষকতা—প্রতিটি ক্ষেত্রে বেশ সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।
এই শিক্ষার্থীরাই কিন্তু যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, মালয়েশিয়ার মতো জায়গায় বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ করে পড়তে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কিছু আসন মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকত, তাহলে অন্তত দেশের কিছু অর্থ সাশ্রয় হতো।
আবার প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে নিজেদের ছাত্রদেরই গবেষণার সুযোগ, ল্যাবরেটরি ব্যবহারের সুযোগ কিংবা ইন্টারনেট-সুবিধা দিতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে কীভাবে তারা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অতিরিক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে সুযোগ দেবে? এখানেই আসে অর্থের প্রশ্ন। এই শিক্ষার্থীরাই তো স্নাতক পর্যায়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ করেছেন, তাঁরাই হয়তো বা মাস্টার্সে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে লন্ডনে বা কানাডায় পড়তে যাবেন। এখন এই শিক্ষার্থী যদি মেধাবী হন এবং মাস্টার্সে অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে রাজি থাকেন, তাহলে সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ নিতে অসুবিধা কোথায়? এটি শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করা নয় বরং প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সীমাবদ্ধতা উত্তরণের জন্য অতিরিক্ত ফি আদায় করা হচ্ছে। এটি কোনো নতুন ধারণা নয়। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদ এবং আইবিএর (ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট) এমবিএতে উন্মুক্ত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ সেখানে ভর্তি হওয়া ছাত্ররা প্রদান করেন। এ কোর্সগুলোর মান নিয়ে তো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। এসব কোর্সে ভর্তি হওয়া অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মান নিয়েও কখনো প্রশ্ন ওঠেনি। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ যদি সফল হয় তাহলে অন্য বিষয়গুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ার কেন বন্ধ করে রাখা হবে?
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়ার উচ্চশিক্ষা অধ্যায়ের ১০ নং অনুচ্ছেদও এই প্রস্তাব সমর্থন করে। শিক্ষানীতির ১০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে হবে। সরকারি অনুদান ছাড়া ও উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যয় নির্বাহের জন্য শিক্ষার্থীদের বেতন ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যক্তিগত অনুদান সংগ্রহের চেষ্টা চালাতে হবে।’
যেখানে শিক্ষানীতিতে শিক্ষাকে উন্মুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে, সবার সঙ্গে জ্ঞান সঞ্চারণের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে কেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আলাদা একটি শ্রেণী হিসেবে চিহ্নিত করে রাখা হবে? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়া কি কোনো অপরাধ?
লেখকেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
No comments