নিম্নমানের ওষুধ : জীবন নিয়ে জুয়া by ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ
অনেকেরই নিম্নমানের ওষুধ সম্পর্কে খুব স্বচ্ছ ধারণা নেই। তাই নিম্নমানের ওষুধ গ্রহণ করে অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও মৃত্যুবরণ করছে। সে জন্য নিম্নমানের ওষুধ সম্পর্কে আমাদের সাবধান ও সচেতন হতে হবে। কোনো ওষুধের পরিমাণ ও গুণগত মান যা থাকার কথা, তার চেয়ে কম থাকলে তাকে নিম্নমানের ওষুধ বলা হয়।
নকল ও ভেজাল ওষুধের সঙ্গে নিম্নমানের ওষুধের পার্থক্য রয়েছে। নকল ও ভেজাল ওষুধের উৎপাদকরা বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয়। জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত অনুমতিপ্রাপ্ত উৎপাদক ওষুধ উৎপাদনকালে বর্ণিত নির্দেশ বা গুণগত মান বজায় না রাখলে তাকে নিম্নমানের ওষুধ বা 'আউট অব স্পেসিফিকেশন' ড্রাগ বলা হয়ে থাকে। সাধারণত ওষুধ উৎপাদনের শর্ত হিসেবে গুণগত মান বজায় রাখা ও কতগুলো নির্দেশ মেনে চলতে ওষুধ কম্পানিগুলো বাধ্য থাকে। ওষুধ বাজারজাত করার আগে জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এসব নির্দেশ পালন ও ওষুধের গুণগত মান বজায় রাখা হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করে থাকে।
নিম্নমানের ওষুধ গ্রহণ বা সেবন করলে একজন রোগী বহুবিধ ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। গত বছর দূষিত ও নিম্নমানের হেপারিন গ্রহণ করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ৯৫ জন রোগী মারা যায়। এসব দুর্ঘটনা গণসচেতনতা বাড়াতে সক্ষম হলেও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর টনক নড়াতে এ ধরনের ট্র্যাজেডি খুব একটা ভূমিকা রাখে না। এসব সংস্থার কর্মকর্তারা নকল-ভেজাল প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডে লাখো-কোটি টাকা ব্যয় করলেও উন্নয়নশীল দেশের ওষুধ কম্পানিগুলোর ওষুধ প্রস্তুতে নির্দেশাবলি সংক্ষেপ করা বা নিরাপত্তাজনিত গুণগত মানের ক্ষেত্রে অসাবধানতা বা শৈথিল্যের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখান। এ ধরনের মনোভাবের পরিবর্তন প্রয়োজন। ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ওষুধ নকল করা বা দীনহীন বা অপ্রতুলভাবে প্রস্তুত করার অর্থ হলো রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়া। কোনো ট্যাবলেটে ওষুধের পরিবর্তে শুধু চক বা চুনাপাথর দিয়ে প্রস্তুত করা হলে রোগীর কী অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমেয়। সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম পরিমাণের ওষুধ দিয়ে প্রস্তুত করা হলে জীবাণুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং একসময় অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়বে। জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও মৃত্যুবরণ করতে পারে।
এ বছরের ২২ থেকে ২৯ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যকরী পরিষদের একটি সুযোগ ছিল বিশ্বব্যাপী নিম্নমানের ওষুধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং জনমত সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার। নকল ও ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের হাতে নিম্নমানের ওষুধ প্রতিরোধের ক্ষমতা প্রদান করার কথাটিও সংস্থা বিবেচনায় নিতে পারত।
নকল ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। নকল ওষুধ ধ্বংসাত্মক, পেটেন্ট রুলের বিবেচনায়ও বেআইনি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এসব নকল ওষুধের বিক্রয়লব্ধ অর্থ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী, দুষ্কৃৃতকারীদের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়। নকল ওষুধ প্রস্তুত বন্ধে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানো দরকার এবং এ ধরনের চক্রের বিরুদ্ধে তথ্য আদান-প্রদান অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। ইন্টারপোলের মতো আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নকল ওষুধ প্রস্তুতকারী দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে বেশি তৎপর থাকে। কারণ আইনগত বৈধতা ছাড়াই দুষ্কৃৃতকারী ও চোরাকারবারিরা বিশেষ করে পেটেন্টপ্রাপ্ত ওষুধের নকল ভার্সন প্রস্তুতে বেশি তৎপর থাকে। কারণ এসব ওষুধের দাম বেশি থাকে বলে মুনাফাও বেশি। সে জন্যই বিশ্বব্যাপী ব্লকবাস্টার ব্র্যান্ড ওষুধগুলোই বেশি নকল হতে দেখা যায়। অন্যদিকে আইনগত বৈধতার মধ্যে থেকেই কোনো কোনো কম্পানিকে নিম্নমানের 'অফ পেটেন্ট' ওষুধ প্রস্তুতে জড়িত থাকতে দেখা যায়। নকল ওষুধ নিয়ে বড় বড় ওষুধ কম্পানিগুলোর ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারণ তাদের পেটেন্টপ্রাপ্ত বা ব্র্যান্ড ওষুধগুলো ব্যাপকহারে নকল হয় বলে এসব ওষুদের ওপর মানুষের আস্থা কমে যেতে পারে। কাটতি কমে যাওয়ার কারণে মুনাফাও কমে যায়। অন্যদিকে 'অফ-পেটেন্ট' ওষুধ নিম্নমানের হলে কম্পানির তেমন ক্ষতি হয় না, মুনাফাও তেমন হ্রাস পায় না। দুশ্চিন্তার কারণ হলো, দিন দিন নিম্নমানের ওষুধের সংখ্যা ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো একদিকে গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ পেতে চায়, অন্যদিকে তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে যত বেশি সম্ভব মানুষকে সেবা প্রদান করা। এ কারণে অনেক সংস্থা বেশিসংখ্যক মানুষকে সেবা প্রদানের জন্য সস্তায় বেশি ওষুধ কিনতে উদ্বুদ্ধ হয় যদিও এসব ওষুধ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার মানদণ্ড পুরোপুরি পূরণ করে না। জেনেভায় অবস্থিত ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ও এইডস প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার জন্য গঠিত গ্লোবাল ফান্ডের মাধ্যমে ২০০৭ সালে কেনিয়া সরকার এক কোটি ৩০ লাখ ম্যালেরিয়ার ওষুধ কেনার জন্য ভারতের অজান্তা কম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। ২০০৮ সালের জুনের মধ্যে ওষুধগুলো সরবরাহ করার কথা ছিল। কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের বিধান শিথিল করার পরও সরবরাহকারী সংস্থা নির্দিষ্ট সময়ে ওষুধগুলো সরবরাহ করতে পারেনি। সময়মতো ওষুধ সরবরাহ না করতে পারার কারণে ওষুধের মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বহু মানুষ বিপজ্জনক হুমকির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল।
পরে জরুরি ভিত্তিতে নোভারটিস থেকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ কিনে প্রয়োজন মেটানো হয়েছিল। বিলম্বের কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে ২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিদল ওষুধ উৎপাদক ও সরবরাহকারীদের ওষুধ কারখানা পরিদর্শন করে। পরিদর্শনে তারা ওষুধ উৎপাদনে জিএমপিতে (ড়েড়ফ গধহঁভধপঃঁৎরহম চৎধপঃরপব) বড় ধরনের বিচ্যুতি দেখতে পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত অজান্তার কোনো নতুন ওষুধের পূর্বানুমতি প্রদান স্থগিত রাখে।
ওষুধের গুণগত মান নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ল্যাব সুবিধা বা অর্থকড়িও অনেক দেশের থাকে না। উদাহরণস্বরূপ এইডসের ওষুধের সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করা তেমন ব্যয়সাপেক্ষ নয়, আওতার বাইরেও নয়। কিন্তু এসব অত্যাধুনিক ওষুধের জৈবিক প্রাপ্যতা (বায়ো-অ্যাভেইলেবিলিটি) ও জৈবিক সমলভ্যতার (বায়োইকোইভ্যালেন্স) মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো জটিল, সূক্ষ্ম ও ব্যয়সাপেক্ষ। গুণগত মানের জন্য ওষুধের এসব পরীক্ষা সম্পন্ন করা অত্যাবশ্যক। আবশ্যক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে অধিকাংশ ওষুধের ক্ষেত্রে ওপরে উলি্লখিত পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করা হয় না। উন্নত বিশ্বে ওষুধ রপ্তানির জন্য আজ হোক, কাল হোক, এই পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করার বিধান চালু করতে হবে। নতুবা ওষুধের রপ্তানি বাড়ানো দুরূহ হবে।
পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আরো কারণ আছে। অনেক দরিদ্র দেশ সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও অনেক অসাধুকে ওষুধ কম্পানি প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স দিয়ে থাকে। সরকার আশা করে, এতে করে চাকরির সংস্থান বৃদ্ধি ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিবেশ সৃষ্টি হবে। দেশীয় ওষুধ কম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওষুধের সংখ্যা ও পরিমাণ বৃদ্ধি পায়_এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সরকার উৎপাদিত ওষুধের গুণগত মান নির্ণয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে না বলে এসব কম্পানি কর্র্তৃক উৎপাদিত ওষুধের অধিকাংশই নিম্নমানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে দরিদ্র, অসহায়, নিরীহ মানুষ তথা জাতি আর্থিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গত তিন বছর ধরে হু কর্তৃক গঠিত 'মেডিক্যাল প্রোডাক্টস অ্যান্টিকাউন্টার ফিটিং টাস্কফোর্স' (ওষুধ-উৎপন্ন দ্রব্যের নকল প্রতিরোধ টাস্কফোর্স) (যাকে সংক্ষেপে ইমপ্যাক্ট বলা হয়) নকল-ভেজাল ওষুধের বিপজ্জনক প্রভাব সম্পর্কে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ ছাড়াও ভেজাল প্রতিরোধে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে উদ্বুদ্ধ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু সংস্থাটি নিম্নমানের ওষুধের প্রসঙ্গটি এ পর্যন্ত সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে বা যাচ্ছে।
আমরা বরাবরই আশা করে আসছি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের লাখো-কোটি মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে শুধু নকল-ভেজাল নয়, নিম্নমানের ওষুধ প্রতিরোধ ও নির্মূলে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। কারণ নকল ও ভেজাল ওষুধের মতো নিম্নমানের ওষুধও একজন রোগীর জন্য সমান বিপজ্জনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পাশাপাশি প্রতিটি দেশের সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুতকারকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। কয়েক দিন আগে আমাদের অর্থমন্ত্রী নিম্নমানের ওষুধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুতকারী কম্পানির লাইসেন্স বাতিলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন। ওষুধ খাতের এক সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী নিম্নমানের ওষুধের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগ_তারা এ খাতের ওপর যথেষ্ট নজরদারি করছেন না। দরিদ্র ও অসচেতন জনগোষ্ঠী নিম্নমানের ওষুধের টার্গেট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়া জীবনও হারায় তারা বেশি। জীবন নিয়ে এমন জুয়া চলতে পারে না। আমাদের দাবি, অতিদ্রুত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি এলে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাবি এবং প্রোভিসি, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
drmuniruddin@yahoo.com
নিম্নমানের ওষুধ গ্রহণ বা সেবন করলে একজন রোগী বহুবিধ ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। গত বছর দূষিত ও নিম্নমানের হেপারিন গ্রহণ করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ৯৫ জন রোগী মারা যায়। এসব দুর্ঘটনা গণসচেতনতা বাড়াতে সক্ষম হলেও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর টনক নড়াতে এ ধরনের ট্র্যাজেডি খুব একটা ভূমিকা রাখে না। এসব সংস্থার কর্মকর্তারা নকল-ভেজাল প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডে লাখো-কোটি টাকা ব্যয় করলেও উন্নয়নশীল দেশের ওষুধ কম্পানিগুলোর ওষুধ প্রস্তুতে নির্দেশাবলি সংক্ষেপ করা বা নিরাপত্তাজনিত গুণগত মানের ক্ষেত্রে অসাবধানতা বা শৈথিল্যের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখান। এ ধরনের মনোভাবের পরিবর্তন প্রয়োজন। ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ওষুধ নকল করা বা দীনহীন বা অপ্রতুলভাবে প্রস্তুত করার অর্থ হলো রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়া। কোনো ট্যাবলেটে ওষুধের পরিবর্তে শুধু চক বা চুনাপাথর দিয়ে প্রস্তুত করা হলে রোগীর কী অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমেয়। সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম পরিমাণের ওষুধ দিয়ে প্রস্তুত করা হলে জীবাণুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং একসময় অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়বে। জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও মৃত্যুবরণ করতে পারে।
এ বছরের ২২ থেকে ২৯ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যকরী পরিষদের একটি সুযোগ ছিল বিশ্বব্যাপী নিম্নমানের ওষুধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং জনমত সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার। নকল ও ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের হাতে নিম্নমানের ওষুধ প্রতিরোধের ক্ষমতা প্রদান করার কথাটিও সংস্থা বিবেচনায় নিতে পারত।
নকল ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। নকল ওষুধ ধ্বংসাত্মক, পেটেন্ট রুলের বিবেচনায়ও বেআইনি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এসব নকল ওষুধের বিক্রয়লব্ধ অর্থ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী, দুষ্কৃৃতকারীদের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়। নকল ওষুধ প্রস্তুত বন্ধে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানো দরকার এবং এ ধরনের চক্রের বিরুদ্ধে তথ্য আদান-প্রদান অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। ইন্টারপোলের মতো আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নকল ওষুধ প্রস্তুতকারী দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে বেশি তৎপর থাকে। কারণ আইনগত বৈধতা ছাড়াই দুষ্কৃৃতকারী ও চোরাকারবারিরা বিশেষ করে পেটেন্টপ্রাপ্ত ওষুধের নকল ভার্সন প্রস্তুতে বেশি তৎপর থাকে। কারণ এসব ওষুধের দাম বেশি থাকে বলে মুনাফাও বেশি। সে জন্যই বিশ্বব্যাপী ব্লকবাস্টার ব্র্যান্ড ওষুধগুলোই বেশি নকল হতে দেখা যায়। অন্যদিকে আইনগত বৈধতার মধ্যে থেকেই কোনো কোনো কম্পানিকে নিম্নমানের 'অফ পেটেন্ট' ওষুধ প্রস্তুতে জড়িত থাকতে দেখা যায়। নকল ওষুধ নিয়ে বড় বড় ওষুধ কম্পানিগুলোর ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারণ তাদের পেটেন্টপ্রাপ্ত বা ব্র্যান্ড ওষুধগুলো ব্যাপকহারে নকল হয় বলে এসব ওষুদের ওপর মানুষের আস্থা কমে যেতে পারে। কাটতি কমে যাওয়ার কারণে মুনাফাও কমে যায়। অন্যদিকে 'অফ-পেটেন্ট' ওষুধ নিম্নমানের হলে কম্পানির তেমন ক্ষতি হয় না, মুনাফাও তেমন হ্রাস পায় না। দুশ্চিন্তার কারণ হলো, দিন দিন নিম্নমানের ওষুধের সংখ্যা ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো একদিকে গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ পেতে চায়, অন্যদিকে তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে যত বেশি সম্ভব মানুষকে সেবা প্রদান করা। এ কারণে অনেক সংস্থা বেশিসংখ্যক মানুষকে সেবা প্রদানের জন্য সস্তায় বেশি ওষুধ কিনতে উদ্বুদ্ধ হয় যদিও এসব ওষুধ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার মানদণ্ড পুরোপুরি পূরণ করে না। জেনেভায় অবস্থিত ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ও এইডস প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার জন্য গঠিত গ্লোবাল ফান্ডের মাধ্যমে ২০০৭ সালে কেনিয়া সরকার এক কোটি ৩০ লাখ ম্যালেরিয়ার ওষুধ কেনার জন্য ভারতের অজান্তা কম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। ২০০৮ সালের জুনের মধ্যে ওষুধগুলো সরবরাহ করার কথা ছিল। কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের বিধান শিথিল করার পরও সরবরাহকারী সংস্থা নির্দিষ্ট সময়ে ওষুধগুলো সরবরাহ করতে পারেনি। সময়মতো ওষুধ সরবরাহ না করতে পারার কারণে ওষুধের মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বহু মানুষ বিপজ্জনক হুমকির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল।
পরে জরুরি ভিত্তিতে নোভারটিস থেকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ কিনে প্রয়োজন মেটানো হয়েছিল। বিলম্বের কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে ২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিদল ওষুধ উৎপাদক ও সরবরাহকারীদের ওষুধ কারখানা পরিদর্শন করে। পরিদর্শনে তারা ওষুধ উৎপাদনে জিএমপিতে (ড়েড়ফ গধহঁভধপঃঁৎরহম চৎধপঃরপব) বড় ধরনের বিচ্যুতি দেখতে পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত অজান্তার কোনো নতুন ওষুধের পূর্বানুমতি প্রদান স্থগিত রাখে।
ওষুধের গুণগত মান নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ল্যাব সুবিধা বা অর্থকড়িও অনেক দেশের থাকে না। উদাহরণস্বরূপ এইডসের ওষুধের সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করা তেমন ব্যয়সাপেক্ষ নয়, আওতার বাইরেও নয়। কিন্তু এসব অত্যাধুনিক ওষুধের জৈবিক প্রাপ্যতা (বায়ো-অ্যাভেইলেবিলিটি) ও জৈবিক সমলভ্যতার (বায়োইকোইভ্যালেন্স) মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো জটিল, সূক্ষ্ম ও ব্যয়সাপেক্ষ। গুণগত মানের জন্য ওষুধের এসব পরীক্ষা সম্পন্ন করা অত্যাবশ্যক। আবশ্যক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে অধিকাংশ ওষুধের ক্ষেত্রে ওপরে উলি্লখিত পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করা হয় না। উন্নত বিশ্বে ওষুধ রপ্তানির জন্য আজ হোক, কাল হোক, এই পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করার বিধান চালু করতে হবে। নতুবা ওষুধের রপ্তানি বাড়ানো দুরূহ হবে।
পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আরো কারণ আছে। অনেক দরিদ্র দেশ সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও অনেক অসাধুকে ওষুধ কম্পানি প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স দিয়ে থাকে। সরকার আশা করে, এতে করে চাকরির সংস্থান বৃদ্ধি ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিবেশ সৃষ্টি হবে। দেশীয় ওষুধ কম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওষুধের সংখ্যা ও পরিমাণ বৃদ্ধি পায়_এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সরকার উৎপাদিত ওষুধের গুণগত মান নির্ণয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে না বলে এসব কম্পানি কর্র্তৃক উৎপাদিত ওষুধের অধিকাংশই নিম্নমানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে দরিদ্র, অসহায়, নিরীহ মানুষ তথা জাতি আর্থিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গত তিন বছর ধরে হু কর্তৃক গঠিত 'মেডিক্যাল প্রোডাক্টস অ্যান্টিকাউন্টার ফিটিং টাস্কফোর্স' (ওষুধ-উৎপন্ন দ্রব্যের নকল প্রতিরোধ টাস্কফোর্স) (যাকে সংক্ষেপে ইমপ্যাক্ট বলা হয়) নকল-ভেজাল ওষুধের বিপজ্জনক প্রভাব সম্পর্কে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ ছাড়াও ভেজাল প্রতিরোধে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে উদ্বুদ্ধ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু সংস্থাটি নিম্নমানের ওষুধের প্রসঙ্গটি এ পর্যন্ত সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে বা যাচ্ছে।
আমরা বরাবরই আশা করে আসছি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের লাখো-কোটি মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে শুধু নকল-ভেজাল নয়, নিম্নমানের ওষুধ প্রতিরোধ ও নির্মূলে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। কারণ নকল ও ভেজাল ওষুধের মতো নিম্নমানের ওষুধও একজন রোগীর জন্য সমান বিপজ্জনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পাশাপাশি প্রতিটি দেশের সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুতকারকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। কয়েক দিন আগে আমাদের অর্থমন্ত্রী নিম্নমানের ওষুধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুতকারী কম্পানির লাইসেন্স বাতিলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন। ওষুধ খাতের এক সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী নিম্নমানের ওষুধের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগ_তারা এ খাতের ওপর যথেষ্ট নজরদারি করছেন না। দরিদ্র ও অসচেতন জনগোষ্ঠী নিম্নমানের ওষুধের টার্গেট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়া জীবনও হারায় তারা বেশি। জীবন নিয়ে এমন জুয়া চলতে পারে না। আমাদের দাবি, অতিদ্রুত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি এলে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাবি এবং প্রোভিসি, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
drmuniruddin@yahoo.com
No comments