সমকালীন প্রসঙ্গ-জাতীয় সংসদের বেহাল অবস্থা by বদরুদ্দীন উমর
উন্নত ও পশ্চিমা দেশগুলোতে তো নয়ই, এমনকি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল ইত্যাদি দেশেও পার্লামেন্ট, সিনেট, বিধানসভা ইত্যাদিতে কোরাম ফেলের কোনো ব্যাপার নেই। ব্রিটিশ আমলে বাংলার ব্যবস্থা পরিষদ, পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদেও কোরাম ফেলের ব্যাপার ছিল না।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হয়েছিল, সেখানেও অধিবেশনের সময় কোরাম ফেল হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র জাঁকিয়ে বসার আগ পর্যন্ত এখানেও কোরাম ফেল হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি
বাজেট আলোচনায় ১৪ আনা মন্ত্রীর অনুপস্থিতি লক্ষ্য করে জাতীয় সংসদের স্পিকার ক্ষোভ প্রকাশ করেন! (যায়যায়দিন ২২-৬-২০১১)। এ ঘটনায় স্পিকার এমনভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, যাতে মনে হয় এমন ঘটনা এক নতুন ব্যাপার! ১৪ আনা মন্ত্রী বাজেট আলোচনার সময় অনুপস্থিত থাকলেও সংসদে কোরাম ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত এ সংসদে কত দিন সাংসদদের অনুপস্থিতির কারণে কোরাম ফেল হয়েছে, তার একটা হিসাব নিলে এ অনুপস্থিতিতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। শুধু ২০০৮ সালে নির্বাচিত এ সংসদই নয়, ১৯৯১ থেকে জাতীয় সংসদগুলোর প্রতিটিরই এই বেহাল অবস্থা। এটা অকারণে অথবা অজ্ঞাত কোনো কারণে ঘটছে না। এটা ঘটছে নির্দিষ্ট কারণেই।
উন্নত ও পশ্চিমা দেশগুলোতে তো নয়ই, এমনকি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল ইত্যাদি দেশেও পার্লামেন্ট, সিনেট, বিধানসভা ইত্যাদিতে কোরাম ফেলের কোনো ব্যাপার নেই। ব্র্রিটিশ আমলে বাংলার ব্যবস্থা পরিষদ, পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদেও কোরাম ফেলের ব্যাপার ছিল না। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হয়েছিল, সেখানেও অধিবেশনের সময় কোরাম ফেল হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র জাঁকিয়ে বসার আগ পর্যন্ত এখানেও কোরাম ফেল হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
এ থেকে এ সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী যে, আগে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যেভাবে সংসদে উপস্থিত থেকে এর সদস্য হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালনের রাজনৈতিক ও নৈতিক তাগিদ বোধ করতেন, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তা বোধ করেন না। এর কারণকে একটু ঠেলা দিলেই এ সিদ্ধান্ত অপ্রতিরোধ্য যে, বর্তমানে সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক ব্যক্তি নন, তাদের নৈতিক চেতনা নিম্নস্তরের এবং জনগণ জাতীয় সংসদে দেশ ও জনগণের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে উদ্দেশ্যে তাদের নির্বাচিত করে, সে উদ্দেশ্যকে তারা বুড়ো আঙুল দেখান। জাতীয় সাংসদদের এ চরিত্র বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী দল, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, রাজনৈতিক পার্টি নির্বিশেষে বিরোধী দলের সংসদ বয়কট করা এবং সরকারদলীয় সদস্যদের সংসদে অনুপস্থিত থাকা এক এবং অভিন্ন কারণেই ঘটে থাকে।
যে কোনো সমীক্ষা থেকেই এখন দেখা যায়, সাংসদদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হাউসের মালিকসহ নানা ধরনের ব্যবসায় নিযুক্ত সাংসদের সংখ্যা ৮০ শতাংশেরও বেশি! এরা প্রথমত ব্যবসায়ী এবং নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা, সম্প্রসারণ অথবা গড়ে তোলার জন্যই নির্বাচন করেন, জাতীয় সংসদের সদস্য, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উপদেষ্টা ইত্যাদি হন। সময়ের দাম আছে। কাজেই নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থেই এরা নিজেদের সময় ব্যয় করেন। একেবারে বাধ্য না হলে জাতীয় সংসদে যাওয়া লাভের ব্যাপার মনে করেন না। প্রকৃত রাজনৈতিক বিতর্ক, দেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে গুরুতর আলোচনায় এদের কোনো উৎসাহ নেই! অধিকাংশ সদস্যের এ ক্ষেত্রে কোনো যোগ্যতাও নেই। অর্ধশিক্ষিত লোকজনের ভিড়ই জাতীয় সংসদে বেশি। এরা জাতীয় সংসদের অধিবেশন, এমনকি বাজেট অধিবেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়েও সংসদে উপস্থিত থাকার পরিবর্তে নিজেদের ব্যবসায়ী অফিসে অথবা সেক্রেটারিয়েটে কোনো তদবিরের কাজে ব্যস্ত থাকাই নিজেদের স্বার্থে বেশি প্রয়োজনীয় মনে করেন।
আগে আইন পরিষদ, পার্লামেন্ট ইত্যাদিতে যারা নির্বাচিত হতেন, নির্বাচনী এলাকায় তাদের রাজনৈতিক কাজ থাকত, তারা হতেন এলাকার পরিচিত ব্যক্তি। যারা মন্ত্রী হতেন তারা শুধু নিজেদের নির্বাচনী এলাকায়ে নয়, সারাদেশের জনগণের কাছেও অল্প-বিস্তর পরিচিত হতেন। এখন সে জমানা আর নেই। এলাকার পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ডিঙিয়ে এখন প্রধান দুই রাজনৈতিক দলে নতুন ও হঠাৎ আগন্তুকরা নমিনেশন লাভ করে নির্বাচনে কেল্লাফতে করে জাতীয় সংসদের সদস্য হন। দলীয় নমিনেশন দেওয়ার মালিক শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীদের সন্তুষ্ট করে, অর্থাৎ অর্থের জোগান দিয়েই যে তারা নির্বাচনী এলাকার পুরনো ও পরিচিত লোকজনকের হটিয়ে দিয়ে নমিনেশন লাভ করেন, এটা এক পরিচিত ব্যাপার। আজকাল এ কথা নিয়ে কেউ আপত্তি বা বিতর্ক করতে আসেন না। এর কারণ খুব স্পষ্ট। এলাকায় দলের লোক হিসেবে কাজ করে যারা পরিচিত, তাদের পরিবর্তে হুট করে বাইরের একজন ব্যবসায়ীকে নমিনেশন দেওয়ার কারণ যে টাকা-পয়সার লেনদেন ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না, এটা যে কোনো গর্দভের পক্ষেও বোঝা সহজ। বিষয়টি নিয়ে কিছু কিছু মহলে এখন বেশ সমালোচনা শুরু হওয়ায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অন্তত তিন বছর দলীয় সাংগঠনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত না থাকা কোনো ব্যক্তিকে ভবিষ্যতে নমিনেশন দেওয়া যাবে না। এটা বলা হলেও এর মধ্যেও এমন ফাঁকফোকর আছে, যার মধ্য দিয়ে অর্থ লেনদেনকারীরা আগের মতোই নমিনেশন পেয়ে যাবেন। কিন্তু সে কথা এখন থাক। এখানে শুধু এটা বালাই যথেষ্ট যে, এলাকার পরিচিত ও পুরনো কর্মীদের ডিঙিয়ে হঠাৎ আগন্তুককে যে জাতীয় সংসদে নমিনেশন দেওয়া হয়ে আসছে, এ সত্যের স্বীকৃতিই নমিনেশনের জন্য তিন বছর কাজের পূর্বশর্তের কথা এখন বলা হচ্ছে। এই দলীয় ঘোষণার দাম কত, এটা বোঝার সময় এখন নয়। এটা বোঝা যাবে এরপর যখন তাদের সামনে নমিনেশন দেওয়ার মতো নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।
২৬ জুন ২০১১ তারিখে জাতীয় সংসদে আপাতদৃষ্টিতে এক অবাক কাণ্ড ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের মেঝের ওপর দাঁড়িয়েই নিজেদের মহাজোটের এক সাংসদকেই শুধু নয়, অন্য সদস্যদেরও চোর বলেছেন! গাইবান্ধা-৩ আসনের জাতীয় পার্টির সাংসদ ফজলে রাব্বী চৌধুরী প্রত্যেক সাংসদের জন্য এলাকায় অফিসের ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানান। এ দাবি বিস্ময়কর, কারণ এলাকায় কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির জন্য স্বতন্ত্র কোনো অফিস কোথাও থাকে না। থাকে দলীয় অফিস এবং সাংসদও সেখানেই বসেন অথবা সেখানেই তার বসার কথা। কিন্তু যেহেতু সাংসদরা অধিকাংশই এলাকার দলীয় কাজ করা ব্যক্তি নন, এ কারণে দলীয় অফিসকে তারা নিজেদের অফিস মনে করেন না। কাজেই তাদের জন্য দলীয় অফিসের বাইরে নিজস্ব অফিস দরকার! সাংসদ ফজলে রাব্বীর উপরোক্ত দাবি বা আবদারের জবাবে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেন, 'এ ব্যাপারে তাদের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রত্যেক সাংসদকে এলাকায় অফিস পরিচালনার জন্য প্রতি মাসে নয় হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। তারা সে টাকা যদি পকেটে রেখে দেন, তাহলে তো কিছুই করার নেই।' (সকালের খবর ২৭-৬-২০১১)। এরপর শেখ হাসিনা তার নিজের বক্তব্যের সাধারণ ধরন অনুযায়ী ফজলে রাব্বীকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আমার ধারণা, উনি এ খাতে যে বরাদ্দ পেয়েছেন তার এক টাকাও খরচ করেননি। পকেটে রেখে দিয়েছেন।' (ওই) জাতীয় সংসদের মেঝেয় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেদের জোটের এক সাংসদকে সরাসরি এবং নিজের দলের সাংসদদেরও যেভাবে চোর আখ্যায় ভূষিত করেছেন, তা প্রশংসার যোগ্য! নির্দিষ্ট খাতে খরচের জন্য দেওয়া সরকারি টাকা সে উদ্দেশ্যে খরচ না করে পকেটে রাখাকে চুরি ছাড়া আর কী বলা যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার 'দ্বিতীয় ভাগ'-এ চুরির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, কাহারও দ্রব্য না বলিয়া লইলে তাহাকে চুরি করা বলে।
এখানে শেখ হাসিনার উপরোক্ত বক্তব্যের একটি অংশ নিয়ে কিছু কথার পর এ আলোচনা শেষ করা হবে। তিনি বলেছেন, সাংসদরা মাসে অফিস পরিচালনা বাবদ তাদের দেওয়া নয় হাজার টাকা খরচ না করলে এ নিয়ে তাদের করার কিছু নেই। কেন নেই? সরকারি অর্থ কি বেওয়ারিশ মাল যে, সেটা সাংসদরা চুরি করলে তা নিয়ে সরকার, জোট ও দলের করার কিছু থাকার কথা নয়! 'সরকারকা মাল দরিয়ামে ডাল' বলে যে কথা আছে, এটা কি তাহলে তা-ই? অবস্থা যদি এ রকম হয় এবং এটা যদি জানা থাকে যে, সাংসদদের মাসে নিয়মিত নয় হাজার টাকা এলাকায় অফিস পরিচালনার জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ করা সত্ত্বেও তারা সেটা নির্ধারিত কাজে খরচ না করে পকেটে পুরছেন, তাহলে সে বরাদ্দ অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। শুধু তা-ই নয়, এত দিন পর্যন্ত প্রতি মাসে যে নয় হাজার টাকা করে তাদের দেওয়া হয়েছে, সেটা তাদের কাছ থেকে ফেরত নিয়ে সরকারি ট্রেজারিতে জমা দেওয়ার ব্যবস্থাও করা দরকার। এ কাজ যদি সরকার না করে, সরকারের প্রধানমন্ত্রী যদি বলেন, এ ব্যাপারে তার করার কিছু নেই, তাহলে সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কীভাবে এ অপব্যয়ের দায়দায়িত্ব এড়াতে পারেন? আইয়ুব খান তার বেসিক ডেমোক্রেসি ব্যবস্থায় ইউনিয়ন কাউন্সিলের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতেন। তার একটা বড় অংশ চুরি হতো। এ চুরি সরকার কর্তৃক উৎসাহিতও হতো। এ কারণে আইয়ুব খান বেসিক ডেমোক্রেসির জন্য বরাদ্দ অর্থের হিসাব নেওয়ার জন্য কোনো অডিট ব্যবস্থা রাখেননি। প্রধানমন্ত্রীর কথা থেকে মনে হয়, সাংসদদের দেওয়া এ টাকা খরচের জন্যও একই কারণে কোনো অডিট ব্যবস্থা নেই। সে ব্যবস্থা থাকলে তিনি কখনোই বলতে পারতেন না যে, বরাদ্দ অর্থ নির্ধারিত কাজে ব্যয় না হলে তার করার আর কী আছে! এসবের মধ্যে যে শুধু জাতীয় সংসদের বেহাল অবস্থাই দেখা যাচ্ছে তা-ই নয়, সরকার, সরকারি দল, সরকারের জোট এবং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীরও যে বেহাল অবস্থা, এটাই এসবের মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে।
২৭.৬.২০১১
বাজেট আলোচনায় ১৪ আনা মন্ত্রীর অনুপস্থিতি লক্ষ্য করে জাতীয় সংসদের স্পিকার ক্ষোভ প্রকাশ করেন! (যায়যায়দিন ২২-৬-২০১১)। এ ঘটনায় স্পিকার এমনভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, যাতে মনে হয় এমন ঘটনা এক নতুন ব্যাপার! ১৪ আনা মন্ত্রী বাজেট আলোচনার সময় অনুপস্থিত থাকলেও সংসদে কোরাম ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত এ সংসদে কত দিন সাংসদদের অনুপস্থিতির কারণে কোরাম ফেল হয়েছে, তার একটা হিসাব নিলে এ অনুপস্থিতিতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। শুধু ২০০৮ সালে নির্বাচিত এ সংসদই নয়, ১৯৯১ থেকে জাতীয় সংসদগুলোর প্রতিটিরই এই বেহাল অবস্থা। এটা অকারণে অথবা অজ্ঞাত কোনো কারণে ঘটছে না। এটা ঘটছে নির্দিষ্ট কারণেই।
উন্নত ও পশ্চিমা দেশগুলোতে তো নয়ই, এমনকি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল ইত্যাদি দেশেও পার্লামেন্ট, সিনেট, বিধানসভা ইত্যাদিতে কোরাম ফেলের কোনো ব্যাপার নেই। ব্র্রিটিশ আমলে বাংলার ব্যবস্থা পরিষদ, পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদেও কোরাম ফেলের ব্যাপার ছিল না। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হয়েছিল, সেখানেও অধিবেশনের সময় কোরাম ফেল হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র জাঁকিয়ে বসার আগ পর্যন্ত এখানেও কোরাম ফেল হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
এ থেকে এ সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী যে, আগে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যেভাবে সংসদে উপস্থিত থেকে এর সদস্য হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালনের রাজনৈতিক ও নৈতিক তাগিদ বোধ করতেন, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তা বোধ করেন না। এর কারণকে একটু ঠেলা দিলেই এ সিদ্ধান্ত অপ্রতিরোধ্য যে, বর্তমানে সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক ব্যক্তি নন, তাদের নৈতিক চেতনা নিম্নস্তরের এবং জনগণ জাতীয় সংসদে দেশ ও জনগণের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে উদ্দেশ্যে তাদের নির্বাচিত করে, সে উদ্দেশ্যকে তারা বুড়ো আঙুল দেখান। জাতীয় সাংসদদের এ চরিত্র বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী দল, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, রাজনৈতিক পার্টি নির্বিশেষে বিরোধী দলের সংসদ বয়কট করা এবং সরকারদলীয় সদস্যদের সংসদে অনুপস্থিত থাকা এক এবং অভিন্ন কারণেই ঘটে থাকে।
যে কোনো সমীক্ষা থেকেই এখন দেখা যায়, সাংসদদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হাউসের মালিকসহ নানা ধরনের ব্যবসায় নিযুক্ত সাংসদের সংখ্যা ৮০ শতাংশেরও বেশি! এরা প্রথমত ব্যবসায়ী এবং নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা, সম্প্রসারণ অথবা গড়ে তোলার জন্যই নির্বাচন করেন, জাতীয় সংসদের সদস্য, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উপদেষ্টা ইত্যাদি হন। সময়ের দাম আছে। কাজেই নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থেই এরা নিজেদের সময় ব্যয় করেন। একেবারে বাধ্য না হলে জাতীয় সংসদে যাওয়া লাভের ব্যাপার মনে করেন না। প্রকৃত রাজনৈতিক বিতর্ক, দেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে গুরুতর আলোচনায় এদের কোনো উৎসাহ নেই! অধিকাংশ সদস্যের এ ক্ষেত্রে কোনো যোগ্যতাও নেই। অর্ধশিক্ষিত লোকজনের ভিড়ই জাতীয় সংসদে বেশি। এরা জাতীয় সংসদের অধিবেশন, এমনকি বাজেট অধিবেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়েও সংসদে উপস্থিত থাকার পরিবর্তে নিজেদের ব্যবসায়ী অফিসে অথবা সেক্রেটারিয়েটে কোনো তদবিরের কাজে ব্যস্ত থাকাই নিজেদের স্বার্থে বেশি প্রয়োজনীয় মনে করেন।
আগে আইন পরিষদ, পার্লামেন্ট ইত্যাদিতে যারা নির্বাচিত হতেন, নির্বাচনী এলাকায় তাদের রাজনৈতিক কাজ থাকত, তারা হতেন এলাকার পরিচিত ব্যক্তি। যারা মন্ত্রী হতেন তারা শুধু নিজেদের নির্বাচনী এলাকায়ে নয়, সারাদেশের জনগণের কাছেও অল্প-বিস্তর পরিচিত হতেন। এখন সে জমানা আর নেই। এলাকার পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ডিঙিয়ে এখন প্রধান দুই রাজনৈতিক দলে নতুন ও হঠাৎ আগন্তুকরা নমিনেশন লাভ করে নির্বাচনে কেল্লাফতে করে জাতীয় সংসদের সদস্য হন। দলীয় নমিনেশন দেওয়ার মালিক শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীদের সন্তুষ্ট করে, অর্থাৎ অর্থের জোগান দিয়েই যে তারা নির্বাচনী এলাকার পুরনো ও পরিচিত লোকজনকের হটিয়ে দিয়ে নমিনেশন লাভ করেন, এটা এক পরিচিত ব্যাপার। আজকাল এ কথা নিয়ে কেউ আপত্তি বা বিতর্ক করতে আসেন না। এর কারণ খুব স্পষ্ট। এলাকায় দলের লোক হিসেবে কাজ করে যারা পরিচিত, তাদের পরিবর্তে হুট করে বাইরের একজন ব্যবসায়ীকে নমিনেশন দেওয়ার কারণ যে টাকা-পয়সার লেনদেন ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না, এটা যে কোনো গর্দভের পক্ষেও বোঝা সহজ। বিষয়টি নিয়ে কিছু কিছু মহলে এখন বেশ সমালোচনা শুরু হওয়ায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অন্তত তিন বছর দলীয় সাংগঠনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত না থাকা কোনো ব্যক্তিকে ভবিষ্যতে নমিনেশন দেওয়া যাবে না। এটা বলা হলেও এর মধ্যেও এমন ফাঁকফোকর আছে, যার মধ্য দিয়ে অর্থ লেনদেনকারীরা আগের মতোই নমিনেশন পেয়ে যাবেন। কিন্তু সে কথা এখন থাক। এখানে শুধু এটা বালাই যথেষ্ট যে, এলাকার পরিচিত ও পুরনো কর্মীদের ডিঙিয়ে হঠাৎ আগন্তুককে যে জাতীয় সংসদে নমিনেশন দেওয়া হয়ে আসছে, এ সত্যের স্বীকৃতিই নমিনেশনের জন্য তিন বছর কাজের পূর্বশর্তের কথা এখন বলা হচ্ছে। এই দলীয় ঘোষণার দাম কত, এটা বোঝার সময় এখন নয়। এটা বোঝা যাবে এরপর যখন তাদের সামনে নমিনেশন দেওয়ার মতো নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।
২৬ জুন ২০১১ তারিখে জাতীয় সংসদে আপাতদৃষ্টিতে এক অবাক কাণ্ড ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের মেঝের ওপর দাঁড়িয়েই নিজেদের মহাজোটের এক সাংসদকেই শুধু নয়, অন্য সদস্যদেরও চোর বলেছেন! গাইবান্ধা-৩ আসনের জাতীয় পার্টির সাংসদ ফজলে রাব্বী চৌধুরী প্রত্যেক সাংসদের জন্য এলাকায় অফিসের ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানান। এ দাবি বিস্ময়কর, কারণ এলাকায় কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির জন্য স্বতন্ত্র কোনো অফিস কোথাও থাকে না। থাকে দলীয় অফিস এবং সাংসদও সেখানেই বসেন অথবা সেখানেই তার বসার কথা। কিন্তু যেহেতু সাংসদরা অধিকাংশই এলাকার দলীয় কাজ করা ব্যক্তি নন, এ কারণে দলীয় অফিসকে তারা নিজেদের অফিস মনে করেন না। কাজেই তাদের জন্য দলীয় অফিসের বাইরে নিজস্ব অফিস দরকার! সাংসদ ফজলে রাব্বীর উপরোক্ত দাবি বা আবদারের জবাবে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেন, 'এ ব্যাপারে তাদের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রত্যেক সাংসদকে এলাকায় অফিস পরিচালনার জন্য প্রতি মাসে নয় হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। তারা সে টাকা যদি পকেটে রেখে দেন, তাহলে তো কিছুই করার নেই।' (সকালের খবর ২৭-৬-২০১১)। এরপর শেখ হাসিনা তার নিজের বক্তব্যের সাধারণ ধরন অনুযায়ী ফজলে রাব্বীকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আমার ধারণা, উনি এ খাতে যে বরাদ্দ পেয়েছেন তার এক টাকাও খরচ করেননি। পকেটে রেখে দিয়েছেন।' (ওই) জাতীয় সংসদের মেঝেয় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেদের জোটের এক সাংসদকে সরাসরি এবং নিজের দলের সাংসদদেরও যেভাবে চোর আখ্যায় ভূষিত করেছেন, তা প্রশংসার যোগ্য! নির্দিষ্ট খাতে খরচের জন্য দেওয়া সরকারি টাকা সে উদ্দেশ্যে খরচ না করে পকেটে রাখাকে চুরি ছাড়া আর কী বলা যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার 'দ্বিতীয় ভাগ'-এ চুরির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, কাহারও দ্রব্য না বলিয়া লইলে তাহাকে চুরি করা বলে।
এখানে শেখ হাসিনার উপরোক্ত বক্তব্যের একটি অংশ নিয়ে কিছু কথার পর এ আলোচনা শেষ করা হবে। তিনি বলেছেন, সাংসদরা মাসে অফিস পরিচালনা বাবদ তাদের দেওয়া নয় হাজার টাকা খরচ না করলে এ নিয়ে তাদের করার কিছু নেই। কেন নেই? সরকারি অর্থ কি বেওয়ারিশ মাল যে, সেটা সাংসদরা চুরি করলে তা নিয়ে সরকার, জোট ও দলের করার কিছু থাকার কথা নয়! 'সরকারকা মাল দরিয়ামে ডাল' বলে যে কথা আছে, এটা কি তাহলে তা-ই? অবস্থা যদি এ রকম হয় এবং এটা যদি জানা থাকে যে, সাংসদদের মাসে নিয়মিত নয় হাজার টাকা এলাকায় অফিস পরিচালনার জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ করা সত্ত্বেও তারা সেটা নির্ধারিত কাজে খরচ না করে পকেটে পুরছেন, তাহলে সে বরাদ্দ অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। শুধু তা-ই নয়, এত দিন পর্যন্ত প্রতি মাসে যে নয় হাজার টাকা করে তাদের দেওয়া হয়েছে, সেটা তাদের কাছ থেকে ফেরত নিয়ে সরকারি ট্রেজারিতে জমা দেওয়ার ব্যবস্থাও করা দরকার। এ কাজ যদি সরকার না করে, সরকারের প্রধানমন্ত্রী যদি বলেন, এ ব্যাপারে তার করার কিছু নেই, তাহলে সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কীভাবে এ অপব্যয়ের দায়দায়িত্ব এড়াতে পারেন? আইয়ুব খান তার বেসিক ডেমোক্রেসি ব্যবস্থায় ইউনিয়ন কাউন্সিলের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতেন। তার একটা বড় অংশ চুরি হতো। এ চুরি সরকার কর্তৃক উৎসাহিতও হতো। এ কারণে আইয়ুব খান বেসিক ডেমোক্রেসির জন্য বরাদ্দ অর্থের হিসাব নেওয়ার জন্য কোনো অডিট ব্যবস্থা রাখেননি। প্রধানমন্ত্রীর কথা থেকে মনে হয়, সাংসদদের দেওয়া এ টাকা খরচের জন্যও একই কারণে কোনো অডিট ব্যবস্থা নেই। সে ব্যবস্থা থাকলে তিনি কখনোই বলতে পারতেন না যে, বরাদ্দ অর্থ নির্ধারিত কাজে ব্যয় না হলে তার করার আর কী আছে! এসবের মধ্যে যে শুধু জাতীয় সংসদের বেহাল অবস্থাই দেখা যাচ্ছে তা-ই নয়, সরকার, সরকারি দল, সরকারের জোট এবং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীরও যে বেহাল অবস্থা, এটাই এসবের মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে।
২৭.৬.২০১১
No comments