সেন্ডাই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি এবং বাংলাদেশের আগাম প্রস্তুতি by ড. আবু এন এম ওয়াহিদ

যেকোনো রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় উপদ্রুত মানুষ দুই ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। একটা জানের, আরেকটা মালের। যারা মারা যায়, তারা তো গেলই; কিন্তু যারা বেঁচে থাকে, তাদেরও অনেক ভোগান্তি এবং যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে হয়।


কেউ কেউ আবার শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে এতই ভেঙে পড়ে যে, কোনো দিনই আর আগের জীবন ফিরে পায় না। এটা হলো মানবিক দিক। টাকা-পয়সা দিয়ে এর কোনো মূল্যায়ন হয় না। এ ছাড়া প্রতিটি দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতির আরেকটা দিক আছে, সেটা হলো আর্থিক এবং জাতীয় জীবনে এর গুরুত্বও কম নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতির ওপর তাৎপর্যপূর্ণ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি খাতকে যৌথভাবে অনেক কষ্টে সামাল দিতে হয়। আর্থিক ক্ষতি আবার দুই ধরনের। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ ক্ষতি হলো, বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মেরামতি মূল্য। পরোক্ষ ক্ষতি হলো ব্যবসা বন্ধ থাকার কারণে হারানো মুনাফা, শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ায় পুঁজির ক্ষয় এবং দুর্যোগের কারণে নাগরিকদের ওপর যদি কোনো ধরনের নতুন কর আরোপ করা হয় তার ধকল সামলানো। জাপানের বেলায় এ তিনটির দুটি ঘটেছে এবং তৃতীয়টির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ব্যক্তি এবং করপোরেট খাতে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় প্রতিদিন জাতীয় আয়ের কোটি কোটি ডলার লোকসান হচ্ছে। ভূমিকম্পের পর প্রথম দুদিনে টোকিওর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা হারিয়েছে ৬২৬ বিলিয়ন ডলারের পুঁজি। এই লোকসান হয়তো একদিন উঠে আসবে। কিন্তু কবে আসবে, তা কেউ জানে না। আর হাতের টাকা হাতে ফিরে না আসা পর্যন্ত, লোকসান তো লোকসানই। তারপর এ দুর্যোগ সামাল দিতে জাপান সরকার যে পরিমাণ আর্থিক চাপের মধ্যে পড়বে, তা থেকে উত্তরণের জন্য অদূর-ভবিষ্যতে যে নাগরিকদের ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে আসবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
জাপানের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কী পরিমাণ হতে পারে, কে কিভাবে এর দায়ভার বহন করবে এবং এ থেকে বাংলাদেশ কোনো আগাম শিক্ষা, প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নিতে পারে কি না_তার একটি বস্তুনিষ্ঠ আলোচনাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। সেন্ডাই ভূমিকম্প, সুনামি ও পারমাণবিক বিস্ফোরণজনিত জরুরি অবস্থা সামলে ওঠার পর পরই শুরু হবে ক্ষয়ক্ষতির চুলচেরা হিসাবনিকাশ। তারপর আসবে ক্লেইম এবং লেনদেনের প্রশ্ন। ক্লেইম হবে দুই ধরনের। একটা সরকারি, আরেকটা বেসরকারি। বেসরকারি খাতে আবার করপোরেট এবং ব্যক্তি-উদ্যোক্তাদের ক্লেইম হবে আলাদা। সরকারি সম্পত্তি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের যে ক্লেইম, তা প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি বীমা কম্পানিকেই শোধ করতে হবে। তবে এই ক্লেইম যদি একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের ঊধর্ে্ব চলে যায়, তবে সেটার দায়ভার গিয়ে পড়বে বড় বড় রিইনস্যুরেন্স কম্পানিগুলোর ওপর। যেমন_সুইস রিইনস্যুরেন্স, মিউনিক রিইনস্যুরেন্স, হ্যানোভার রিইনস্যুরেন্স, লয়েডস্ রিইনস্যুরেন্স ইত্যাদি। বেসরকারি খাত থেকে আসবে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতি এবং কম্পানির কল-কারখানা এবং স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতির ক্লেইম। এখানেও মূল দায়ভার জাপান সরকারের। কারণ জাপানে ব্যক্তিমালিকানাধীন সহায়-সম্পত্তির ৮৫ শতাংশ সরকারি কম্পানির কাছে বীমাকৃত। অবশিষ্ট মাত্র ১৫ শতাংশ প্রাইভেট বীমা কম্পানির অধীন। ব্যক্তি খাতেরও প্রাথমিক এবং বড় অংশের ক্লেইম জাপান সরকার এবং প্রাইভেট বীমা কম্পানিকে পরিশোধ করতে হবে। তার পরের অংশ গিয়ে পড়বে মাল্টিন্যাশনাল রিইনস্যুরারদের ওপর। তাই এই দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যা-ই হোক, প্রাইভেট এবং মাল্টিন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স ও রিইনস্যুরেন্স কম্পানিগুলোর দায়ভার খুব একটা বেশি হবে না বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ক্ষয়ক্ষতির সিংহভাগ দায়িত্ব নিতে হবে জাপান সরকারকেই।
তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক ক্যাটাস্ট্রফি রিস্ক মডেলিং ফার্ম ই কিউ ই ক্যাটের প্রাথমিক জরিপ অনুযায়ী, সেন্ডাই ভূমিকম্পের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হবে ১০০ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রাইভেট বীমা কম্পানিগুলোকে এর পুরোটা বহন করতে হবে না। ই কিউ ই ক্যাটের সহযোগী ফার্ম আরএমএস এবং এআইআর ওয়ার্ল্ডওয়াইডের আন্দাজ, প্রাইভেট বীমা কম্পানিগুলোর ওপর এই ভূমিকম্পের আর্থিক দায়ভার পড়বে বড়জোর ১৫ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের। সুইস রিইনস্যুরেন্স কম্পানি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ভূমিকম্প ও সুনামির কারণে যেসব আবাসিক বাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে, তার বেশির ভাগের দায়দায়িত্ব জাপান সরকারের। তবে ভূমিকম্পের পর আগুন লাগা এবং পারমাণবিক বিস্ফোরণজনিত কারণে যে লোকসান হবে, বীমা কম্পানিগুলোর তার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার কথা। তবে এখানেও একটা কথা আছে, এই দুই কারণে সম্পত্তির যতটা না ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে জনস্বাস্থ্যের, এ বিষয়টি বীমা কম্পানিগুলোর আওতার বাইরে। এ ছাড়া জাপানের সবচেয়ে বড় সম্পত্তি বীমা কম্পানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এআইজির আরেকটা সুবিধা রয়েছে। আর তা হলো, এআইজির প্রতিটি পলিসি পারমাণবিক জাতীয় দুর্ঘটনা থেকে দায়মুক্ত। কারণ জাপানি পার্লামেন্টে ১৯৬১ সালে পাস হওয়া নিউক্লিয়ার অ্যাক্ট অব ১৯৬১, ইনস্যুরেন্স কম্পানিগুলোকে এ জাতীয় দুর্ঘটনার দায় থেকে মুক্ত করে দিয়েছে।
কলিন জেরেমি নামে এক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ তাঁর ইন্পারনেট ব্লগে লিখেছেন, সেন্ডাই ভূমিকম্পের মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে ১৮০ বিলিয়ন ডলার এবং বীমা কম্পানির দায়ভার হবে ৩৫ বিলিয়ন ডলার। জাপানি আইন অনুযায়ী, পারমাণবিক বিস্ফোরণজনিত কারণে ক্ষয়ক্ষতি বাদ যাবে। আমেরিকান ইনস্যুরেন্স ব্রোকার মার্শ ইনকরপোরেটেডের সিনিয়র কর্মকর্তা ডানকান এলিসের মতে, এ ভূমিকম্পে শুধু উত্তর-পূর্ব জাপানই নয়; টোকিও এবং ওসাকায়ও অনেক সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ধরা পড়ছে। এটাই যদি হয়, তবে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে। এআইআর ওয়ার্ল্ডওয়াইড নাসা থেকে স্যাটেলাইট ছবি সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে সেন্ডাই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নতুন করে নিরূপণ করার চেষ্টা করছে। তারা শিগ্গিরই পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির নতুন এস্টিমেট দেবে।
রিইনস্যুরারদের সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সর্বমোট ক্লেইম ৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেলে, ক্ষতিগ্রস্ত সম্পত্তির মালিকদের এবং ইনস্যুরারদের মধ্যে লোকসান ভাগাভাগি করে নিতে হয়। মালিকরা হারানো সম্পত্তির পুরো মূল্যমান ফিরে পায় না। ইনস্যুরেন্স বিশেষজ্ঞদের মতে, সেন্ডাই ভূমিকম্পের ক্লেইম পরিশোধের ব্যাপারে, ইনস্যুরার এবং রিইনস্যুরারদের খুব একটা অসুবিধা হবে না। কারণ ২০০৫ সালের হারিকেন ক্যাটরিনার পর ইনস্যুরেন্স প্রিমিয়াম বাড়ার ফলে, বড় বীমা কম্পানিগুলোর হাতে ৫০ থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলারের ক্যাপিটাল জমা আছে। এ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে বরং সবচেয়ে বড় অসুবিধা হবে জাপান সরকারের, কারণ জাপানি নিয়ম এবং আইন অনুযায়ী, ক্লেইমের সিংহভাগ শোধ করতে হবে জাপান সরকারকে, যে এমনিতেই ঋণভারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। বর্তমানে জাপান সরকারের মোট ঋণ তার জিডিপির তিনগুণ অর্থাৎ ১৫ ট্রিলিয়ন ডলার।
এ তো গেল জাপানের কথা। এখন দেখা যাক, এ ধরনের দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থা কী দাঁড়াবে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অতি কাছে আসাম ফল্টে, রিখটার স্কেলে ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে বলে সিসমোলজিস্টদের ধারণা। আমরা আল্লাহর অনুগ্রহ চাই, যাতে এ ধরনের ঘটনা কোনো দিন না ঘটে। তার সঙ্গে সঙ্গে, চোখ-কান বন্ধ করে রাখলেও তো চলবে না। জাতীয়ভাবে এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সার্বিক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন। উন্নত দেশে, ঝড়, তুফান, আগুন, পানি ও ভূমিকম্পের কবল থেকে বাড়িঘর ও স্থাপনা বাঁচানোর জন্য মানুষ লাখো-কোটি ডলারের বীমা করে রাখে। বাংলাদেশের জনগণ এ ধরনের বীমার সঙ্গে বলতে গেলে একেবারেই অপরিচিত। আমাদের দেশের সরকারকে শিগগিরই এনজিওগুলোর সহযোগিতায় ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কাজের সুষ্ঠু ও বিস্তারিত পরিকল্পনার সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি সামলে ওঠার জন্য, দেশি-বিদেশি ইনস্যুরেন্স এবং রিইনস্যুরেন্স কম্পানিগুলোর সঙ্গে সিরিয়াস আলাপ-আলোচনা শুরু করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি, এডিটর-জার্নাল অব
ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid@tnstate.edu

No comments

Powered by Blogger.