চরাচর-হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
আমাদের দেশের খালবিল, নদীনালা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ। প্রাকৃতিক উৎসে জন্মানো কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, চাপিলা, টাকি, রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, রিঠা, পাঙ্গাশ, বোয়াল প্রভৃতি সুস্বাদু দেশি মাছ_এখন দেখা পাওয়া যায় খুবই কম।
বাজারে আজকাল যেসব মাছ পাওয়া যাচ্ছে, তার বেশির ভাগই খামারে উৎপাদিত হাইব্রিড মাছ। দেশে প্রাকৃতিক উৎসের মাছ কমে গেলেও বিদেশি হাইব্রিড মাছের উৎপাদন বেড়ে গেছে বহুলাংশে। দেশে উৎপাদিত রুই, কাতলা, নলা বা পাঙ্গাশ মাছ যা পাওয়া যায়, তা-ও প্রাকৃতিক উৎসের নয়_কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়ায় পোনা উৎপাদন করে খামারে চাষ করা। পুকুর-জলাশয়ে উৎপাদিত। এসব মাছ ফরমালিনের পানিতে চুবিয়ে সংরক্ষণ করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রাকৃতিক উৎসে জন্মানো দেশি জাতের সুস্বাদু মৎস্যসম্পদ বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ_দেশি মৎস্যসম্পদের স্থায়ী অভয়ারণ্যের সমস্যা। দেশি প্রজাতির মাছের বংশ বৃদ্ধি এবং তাদের বাড়তে দেওয়ার জন্য যে অবারিত নদী-জলাশয়, খালবিল, বাঁওড়ের প্রয়োজন, তা আর অবশিষ্ট নেই। অতীতে এ দেশের খালবিল, নদীনালায় কোনো রকম যত্ন ছাড়াই জন্ম নিত, বেড়ে উঠত অজস্র দেশি প্রজাতির মাছ। ছোট-বড় মিলে দেশে তেরো শতাধিক নদী ছিল। বিলঝিলের সংখ্যা ছিল অগণিত। এখনো দেশের ১৯টি জেলায় পাঁচ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে রয়েছে হাওর-বাঁওড়। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, আমাদের নদী-জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো মৎস্যকুলের বেঁচে থাকার মতো অনুকূল পরিবেশ আর অবশিষ্ট নেই। অধিক মুনাফালোভীরা হাইব্রিড মাছের চাষ করতে গিয়ে এখানকার জলাশয়গুলো থেকে দেশি জাতের মাছ বিলুপ্ত করে ফেলছে। বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার, বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও শেরপুর জেলায় রয়েছে সুবিস্তৃত হাওর। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে অনেক হাওর-বিল। পাবনা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল চলনবিল। দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলায়ই রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য বিলঝিল। এসব নদী-বিল-হাওর এবং খালেই একসময় জন্ম নিত অজস্র দেশি প্রজাতির মাছ। এসব মূল্যবান জলাধার এবং নদী আজ নিঃশেষ হওয়ার পথে। তেরো শতাধিক নদীর মধ্যে এক হাজার ১০০টিই শেষ হয়ে গেছে। এখনো যে দুই শতাধিক নদী কোনোমতে বেঁচে আছে, এর বেশির ভাগেরই বর্ষার দুই-তিন মাস ছাড়া নাব্যতা থাকে না। শুষ্ক মৌসুমে অনেক নদীই শুকিয়ে যায়। অনেক নদীর বুকের ওপর এখন ধানি জমি হয়েছে। তার পরও রয়েছে শহরাঞ্চলের এবং শিল্প এলাকাগুলোর আশপাশের নদীনালায় পানিদূষণের প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে অবৈধ দখলদার। বছরের পর বছর নদী-হাওরগুলো সংস্কার না হওয়ায় হাওরের অনেক স্থানে তলা ভরাট হয়ে গেছে। হাওর-বাঁওড়ের পানিও মাছের বেঁচে থাকার অনুকূল নয় অনেক ক্ষেত্রে। দেশি মাছের প্রজনন ও বংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জলাশয়গুলো স্থায়ী মৎস্য অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশি মৎস্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে নদী, খালবিল, হাওর-বাঁওড়ের খনন-সংস্কার কার্যক্রমের কোনো বিকল্প নেই। এসব উন্মুক্ত জলাশয়ে পানির সংস্থান হলে প্রাকৃতিক উৎসের মাছের বংশ বিস্তার ও বৃদ্ধি সহজ হবে। এভাবেই বিলুপ্তির হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে দেশীয় মৎস্যসম্পদ।
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
No comments