ধর্ম-ঈদুল ফিতর অনাবিল আনন্দের উৎসব by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
ঈদ মানেই আনন্দ ও খুশির উৎসব। ‘ঈদ’ শব্দটি আরবি, শব্দমূল ‘আউদ’, এর অর্থ এমন উৎসব, যা ফিরে ফিরে আসে, পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়, রীতি হিসেবে গণ্য হয় প্রভৃতি। এর অন্য অর্থ খুশি-আনন্দ। প্রতিবছর চান্দ্র বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট রীতিতে এক অনন্য আনন্দ-বৈভব বিলাতে ফিরে আসে ঈদ।
গোটা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে বছরে দুবার ঈদ হাজির হয়। একটি ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতর পালিত হয় ১ শাওয়াল আর ঈদুল আজহা পালিত হয় ১০ জিলহজ্ব। এক মাস কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নানা নিয়মকানুন পালনের পর ঈদুল ফিতর; অন্য কথায় রোজার ঈদ। ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া। আরেক অর্থে বিজয়। বিজয় শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। গোটা রমজান মাস রোজা রেখে আল্লাহভীরু মানুষ তার ভেতরের সব রকমের বাজে অভ্যাস, খেয়ালখুশিকে দমন করার মাধ্যমে এক রকমের বিজয় অর্জন করেন।
ঈদুল ফিতরের সঙ্গে বিজয়ের এক মহান যোগসূত্র রয়েছে। পবিত্র ঈদুল ফিতর হিজরি দ্বিতীয় সালে আরম্ভ হয়। ইসলামের ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ বিশেষভাবে স্মরণীয়। ওই যুদ্ধে মুসলমানদের ‘চূড়ান্ত মীমাংসা’ হয়েছিল। প্রথম মাহে রমজানে যে বছর সিয়াম পালিত হয়, সেই দ্বিতীয় হিজরি সনের ১৭ রমজান মোতাবেক ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ ইসলামের ইতিহাসের প্রথম আত্মরক্ষামূলক সশস্ত্র যুদ্ধ গায্ওয়ায়ে বদরে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়েছিল। এই বিজয়ের স্মৃতিকে আরও সম্প্রসারিত করার জন্যই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ওই বছর মাহে রমজান শেষে ঈদ উৎসব পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তদানুযায়ী আরবে প্রথম ঈদুল ফিতর মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরি ২ সনের ১ শাওয়াল শুক্রবার মোতাবেক ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ পালিত হয়। প্রথম ঈদুল ফিতরে সেই বিজয় আনন্দ রোজা ভাঙার আনন্দ-উৎসবে স্বাভাবিকভাবেই যুক্ত হয়েছিল। অন্যদিকে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে রমজান মাসে মক্কা বিজয়ের ৮/৯ দিন পরে মক্কা মুকাররামায় সর্বপ্রথম ঈদুল ফিতর উদ্যাপিত হয়েছিল।
মদিনার অধিবাসীরা ঈদ উৎসব প্রবর্তনের আগে বছরে যে দুটো আনন্দ-উৎসব পালন করত তা ছিল পারস্যের দুটো দিনের অনুকরণে, যার একটির নাম ‘নওরোজ’, যাকে তারা বলত ‘নায়মূক’, অন্যটির নাম ‘মেহেরজান’। অন্ধকার যুগে এ দুই উৎসবকে কেন্দ্র করে অনেক অশ্লীল, অশোভন আচার-অনুষ্ঠান করা হতো। পরিবর্তে হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে ঈদ উৎসবের প্রবর্তন করা হয়। ঈদ উৎসব কল্যাণের ও মানবিক সৌন্দর্যে মণ্ডিত। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে দেখতে পেলেন যে এখানকার অধিবাসীরা বছরে দুটো দিন ক্রীড়া-কৌতুক ও আনন্দ-উৎসব করে। তিনি তাদের কাছে জানতে চাইলেন: এই দুটো দিন কিসের জন্য? তারা বলল: অন্ধকার যুগে (আইয়্যামে জাহিলিয়াতে) আমরা খেলাধুলা ও আনন্দ-উৎসব পালন করতাম। তাদের এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন: আল্লাহ তাআলা তোমাদের এই দুই দিনের বিনিময়ে অন্য দুটো উত্তম দিবস দান করেছেন আর তা হচ্ছে ঈদুল আজহা এবং ঈদুল ফিতর।’ (তিরমিজি, নাসাঈ ও আবু দাউদ)
ঐতিহাসিক পটভূমিতে ঈদ উৎসব পালনের আরও একটি ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। সে সময় আরব দেশে মুসলিম সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য গোষ্ঠীভুক্তদের মধ্যে নানা রকম উৎসবের প্রচলন ছিল। উকাজের মেলা ছিল তার মধ্যে অন্যতম। বলা হয়, এসব উৎসব মূলত নানা অশ্লীল আর রুচিহীন আনুষ্ঠানিকতায় ভরপুর করে রাখা হতো। অপর দিকে ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের জন্য তখন পর্যন্ত তেমন কোনো উৎসবেরই প্রচলন ছিল না। এমতাবস্থায় মুসলমানদের মধ্যে একটা পবিত্র বিনোদনের বিষয় ইসলামের নবী হজরত মুহম্মদ (সা.) গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করেন। আর সেই সুচিন্তার ফলেই তিনি ঈদ উৎসবের সূচনা করেন; যাতে নির্মল বিনোদন অথচ পবিত্র এক আবহে সবাই অবগাহন করে। নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেন, ‘লিকুল্লি কাওমিন ঈদ, হাজা ঈদুনা’ অর্থাৎ ‘প্রতিটি জাতিরই নিজস্ব আনন্দ-উৎসব রয়েছে, আমাদের আনন্দ-উৎসব হচ্ছে এই ঈদ।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ঈদুল ফিতরের অর্থ যেমন রোজা ভাঙার আনন্দ-উৎসব, তেমনি এর অর্থ ফিতরা প্রদানের আনন্দ-উৎসব। সমাজের অভাবী, নিঃস্ব, গরিব-দুঃখীদের মধ্যে শরিয়ত নির্ধারিত হারে ফিতরা প্রদানের মাধ্যমে ঈদুল ফিতরের দিবসের সূচনা হয়। এ জন্য মুসলমানদের ঈদকে বলা হয় ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য খুশির দিন। ঈদুল ফিতরে হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক আদায়ের পাশাপাশি হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক আদায়ের বিধান সমানভাবে বাস্তবায়িত হয়। ইসলাম সব ধনাঢ্য ও সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য ঈদুল ফিতরে ‘সাদাকাতুল ফিতর’ বা ‘ফিতরা’ আদায়ের বিধান অত্যাবশ্যকীয় করেছে। ঈদে শুধু সামর্থ্যবানেরাই আনন্দ করবে, গরিব অসহায়রা নয়, এমন রীতি ইসলাম সমর্থন করে না। জাকাত আদায়ের জন্যও সাধারণত ঈদুল ফিতরের সময়টাকেই বেছে নেওয়া হয়। সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যই আল্লাহ তাআলা জাকাতের বিধান দিয়েছেন। এই প্রতীকী সাম্য ও ঐক্য বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ। আত্মশুদ্ধি তথা কলুষমুক্ত নতুন জীবনের উপলব্ধির মধ্যে ঈদুল ফিতরের মূল তাৎপর্য নিহিত।
ঈদকে ঘিরে যে চালচিত্র সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে দেখা যায়, তা কিন্তু আমাদের মতো দরিদ্র দেশে ঈদ সবার জন্যই সমান আনন্দ উপভোগের হয়ে ওঠে না। নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থায় হতদরিদ্র মানুষের ঈদ আনন্দ উপভোগ করা কঠিন। ঈদের দিনটি তখন আর ধনী-গরিবের একাত্মতার দিন নয়, বরং ক্রমবর্ধমান সামাজিক বৈষম্যের দিকটাই প্রকট হয়ে ওঠে অনেকের অনুভবে। যারা অর্থনৈতিক জীবনে নিত্যদিনই পর্যুদস্ত, তাদের জীবনে ঈদে আনন্দের বন্যা নিশ্চয়ই বইতে পারে না বা তাদের জীবনে ঈদ নিশ্চয়ই কোনো আনন্দের ঝংকার তোলে না। এসব হতদরিদ্র মানুষদের অন্তরের বেদনাকে নিজের বুকে গভীরভাবে ধারণ করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ‘হররোজ রোজার’ অবসান না ঘটা পর্যন্ত ঈদের সকার্থকতা যে আসবে না সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। ‘ঈদ মোবারক’ কবিতায় নজরুল সেই ধর্মীয় বিধানের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন: ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’
বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত হলেও যুগ যুগ ধরে এখানে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই নিকটতম প্রতিবেশী। নিজ নিজ ধর্মীয় বিধি-বিধান এবং আচার-অনুষ্ঠান পালন করেও তারা সমপ্র্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। মুসলমানের ঈদে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও আনন্দের ভাগ নেয়, খ্রিষ্টানদের বড়দিন বা বৌদ্ধদের পূর্ণিমা অথবা হিন্দুদের পূজার উৎসবেও মুসলমানরা যোগ দেয় নানাভাবে, এটাই ধর্মপ্রাণ বাঙালির গৌরবময় ঐতিহ্য।
ঈদের দিনে ‘ঈদ মোবারক আস-সালাম’ অভিবাদনে মশগুল হয় সবাই। কিন্তু এ সাদর অভিবাদন যাতে গতানুগতিক ও নিছক নিষ্প্রাণ অভিবাদনে পর্যবসিত না হয়, অন্তরের বক্রতাকে জিইয়ে রেখে পরস্পরের ভেদাভেদ ভুলে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রকাশের ঈদের মর্মবাণী যাতে হারিয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়। ঈদের দিনের দাবি অপর মুসলমানকে ক্ষমা করে দেওয়া এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পরস্পরকে ভাই-বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়: ‘পথে পথে আজি হাঁকিব, বন্ধু/ঈদ মোবারক! আস্সালাম!’
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
ঈদুল ফিতরের সঙ্গে বিজয়ের এক মহান যোগসূত্র রয়েছে। পবিত্র ঈদুল ফিতর হিজরি দ্বিতীয় সালে আরম্ভ হয়। ইসলামের ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ বিশেষভাবে স্মরণীয়। ওই যুদ্ধে মুসলমানদের ‘চূড়ান্ত মীমাংসা’ হয়েছিল। প্রথম মাহে রমজানে যে বছর সিয়াম পালিত হয়, সেই দ্বিতীয় হিজরি সনের ১৭ রমজান মোতাবেক ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ ইসলামের ইতিহাসের প্রথম আত্মরক্ষামূলক সশস্ত্র যুদ্ধ গায্ওয়ায়ে বদরে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়েছিল। এই বিজয়ের স্মৃতিকে আরও সম্প্রসারিত করার জন্যই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ওই বছর মাহে রমজান শেষে ঈদ উৎসব পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তদানুযায়ী আরবে প্রথম ঈদুল ফিতর মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরি ২ সনের ১ শাওয়াল শুক্রবার মোতাবেক ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ পালিত হয়। প্রথম ঈদুল ফিতরে সেই বিজয় আনন্দ রোজা ভাঙার আনন্দ-উৎসবে স্বাভাবিকভাবেই যুক্ত হয়েছিল। অন্যদিকে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে রমজান মাসে মক্কা বিজয়ের ৮/৯ দিন পরে মক্কা মুকাররামায় সর্বপ্রথম ঈদুল ফিতর উদ্যাপিত হয়েছিল।
মদিনার অধিবাসীরা ঈদ উৎসব প্রবর্তনের আগে বছরে যে দুটো আনন্দ-উৎসব পালন করত তা ছিল পারস্যের দুটো দিনের অনুকরণে, যার একটির নাম ‘নওরোজ’, যাকে তারা বলত ‘নায়মূক’, অন্যটির নাম ‘মেহেরজান’। অন্ধকার যুগে এ দুই উৎসবকে কেন্দ্র করে অনেক অশ্লীল, অশোভন আচার-অনুষ্ঠান করা হতো। পরিবর্তে হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে ঈদ উৎসবের প্রবর্তন করা হয়। ঈদ উৎসব কল্যাণের ও মানবিক সৌন্দর্যে মণ্ডিত। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে দেখতে পেলেন যে এখানকার অধিবাসীরা বছরে দুটো দিন ক্রীড়া-কৌতুক ও আনন্দ-উৎসব করে। তিনি তাদের কাছে জানতে চাইলেন: এই দুটো দিন কিসের জন্য? তারা বলল: অন্ধকার যুগে (আইয়্যামে জাহিলিয়াতে) আমরা খেলাধুলা ও আনন্দ-উৎসব পালন করতাম। তাদের এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন: আল্লাহ তাআলা তোমাদের এই দুই দিনের বিনিময়ে অন্য দুটো উত্তম দিবস দান করেছেন আর তা হচ্ছে ঈদুল আজহা এবং ঈদুল ফিতর।’ (তিরমিজি, নাসাঈ ও আবু দাউদ)
ঐতিহাসিক পটভূমিতে ঈদ উৎসব পালনের আরও একটি ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। সে সময় আরব দেশে মুসলিম সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য গোষ্ঠীভুক্তদের মধ্যে নানা রকম উৎসবের প্রচলন ছিল। উকাজের মেলা ছিল তার মধ্যে অন্যতম। বলা হয়, এসব উৎসব মূলত নানা অশ্লীল আর রুচিহীন আনুষ্ঠানিকতায় ভরপুর করে রাখা হতো। অপর দিকে ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের জন্য তখন পর্যন্ত তেমন কোনো উৎসবেরই প্রচলন ছিল না। এমতাবস্থায় মুসলমানদের মধ্যে একটা পবিত্র বিনোদনের বিষয় ইসলামের নবী হজরত মুহম্মদ (সা.) গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করেন। আর সেই সুচিন্তার ফলেই তিনি ঈদ উৎসবের সূচনা করেন; যাতে নির্মল বিনোদন অথচ পবিত্র এক আবহে সবাই অবগাহন করে। নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেন, ‘লিকুল্লি কাওমিন ঈদ, হাজা ঈদুনা’ অর্থাৎ ‘প্রতিটি জাতিরই নিজস্ব আনন্দ-উৎসব রয়েছে, আমাদের আনন্দ-উৎসব হচ্ছে এই ঈদ।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ঈদুল ফিতরের অর্থ যেমন রোজা ভাঙার আনন্দ-উৎসব, তেমনি এর অর্থ ফিতরা প্রদানের আনন্দ-উৎসব। সমাজের অভাবী, নিঃস্ব, গরিব-দুঃখীদের মধ্যে শরিয়ত নির্ধারিত হারে ফিতরা প্রদানের মাধ্যমে ঈদুল ফিতরের দিবসের সূচনা হয়। এ জন্য মুসলমানদের ঈদকে বলা হয় ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য খুশির দিন। ঈদুল ফিতরে হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক আদায়ের পাশাপাশি হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক আদায়ের বিধান সমানভাবে বাস্তবায়িত হয়। ইসলাম সব ধনাঢ্য ও সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য ঈদুল ফিতরে ‘সাদাকাতুল ফিতর’ বা ‘ফিতরা’ আদায়ের বিধান অত্যাবশ্যকীয় করেছে। ঈদে শুধু সামর্থ্যবানেরাই আনন্দ করবে, গরিব অসহায়রা নয়, এমন রীতি ইসলাম সমর্থন করে না। জাকাত আদায়ের জন্যও সাধারণত ঈদুল ফিতরের সময়টাকেই বেছে নেওয়া হয়। সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যই আল্লাহ তাআলা জাকাতের বিধান দিয়েছেন। এই প্রতীকী সাম্য ও ঐক্য বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ। আত্মশুদ্ধি তথা কলুষমুক্ত নতুন জীবনের উপলব্ধির মধ্যে ঈদুল ফিতরের মূল তাৎপর্য নিহিত।
ঈদকে ঘিরে যে চালচিত্র সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে দেখা যায়, তা কিন্তু আমাদের মতো দরিদ্র দেশে ঈদ সবার জন্যই সমান আনন্দ উপভোগের হয়ে ওঠে না। নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থায় হতদরিদ্র মানুষের ঈদ আনন্দ উপভোগ করা কঠিন। ঈদের দিনটি তখন আর ধনী-গরিবের একাত্মতার দিন নয়, বরং ক্রমবর্ধমান সামাজিক বৈষম্যের দিকটাই প্রকট হয়ে ওঠে অনেকের অনুভবে। যারা অর্থনৈতিক জীবনে নিত্যদিনই পর্যুদস্ত, তাদের জীবনে ঈদে আনন্দের বন্যা নিশ্চয়ই বইতে পারে না বা তাদের জীবনে ঈদ নিশ্চয়ই কোনো আনন্দের ঝংকার তোলে না। এসব হতদরিদ্র মানুষদের অন্তরের বেদনাকে নিজের বুকে গভীরভাবে ধারণ করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ‘হররোজ রোজার’ অবসান না ঘটা পর্যন্ত ঈদের সকার্থকতা যে আসবে না সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। ‘ঈদ মোবারক’ কবিতায় নজরুল সেই ধর্মীয় বিধানের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন: ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’
বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত হলেও যুগ যুগ ধরে এখানে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই নিকটতম প্রতিবেশী। নিজ নিজ ধর্মীয় বিধি-বিধান এবং আচার-অনুষ্ঠান পালন করেও তারা সমপ্র্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। মুসলমানের ঈদে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও আনন্দের ভাগ নেয়, খ্রিষ্টানদের বড়দিন বা বৌদ্ধদের পূর্ণিমা অথবা হিন্দুদের পূজার উৎসবেও মুসলমানরা যোগ দেয় নানাভাবে, এটাই ধর্মপ্রাণ বাঙালির গৌরবময় ঐতিহ্য।
ঈদের দিনে ‘ঈদ মোবারক আস-সালাম’ অভিবাদনে মশগুল হয় সবাই। কিন্তু এ সাদর অভিবাদন যাতে গতানুগতিক ও নিছক নিষ্প্রাণ অভিবাদনে পর্যবসিত না হয়, অন্তরের বক্রতাকে জিইয়ে রেখে পরস্পরের ভেদাভেদ ভুলে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রকাশের ঈদের মর্মবাণী যাতে হারিয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়। ঈদের দিনের দাবি অপর মুসলমানকে ক্ষমা করে দেওয়া এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পরস্পরকে ভাই-বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়: ‘পথে পথে আজি হাঁকিব, বন্ধু/ঈদ মোবারক! আস্সালাম!’
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
No comments