যুগের বানী-কেন যুদ্ধ? by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
ধ১৯৩৯ সালে ছয় বছর স্থায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ওই যুদ্ধের ছায়ায় আমার বাল্যকাল কেটেছে। ১৯৪২ সাল। তখন বাবার কর্মস্থল পশ্চিম বাংলার হুগলি শহরে। আমরা একটা দোতলা বাড়িতে বাস করতাম। কয়েক দিনের মধ্যে জাপানি বোমারু উড়োজাহাজ আসছে সংকেত দিয়ে মাঝরাতে চারদিক কাঁপিয়ে সাইরেন বেজে উঠল।
আতঙ্কে আমরা জেগে উঠলাম। আমরা দ্রুত এক তলার একটি অন্ধকার ঘরে আশ্রয় নিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বোমারু উড়োজাহাজের আওয়াজ, যেন এক ঝাঁক মৌমাছির আওয়াজ শোনা গেল। তারপর বোমার আওয়াজ। অনেকক্ষণ পর অল ক্লিয়ার সাইরেন বাজলে আমরা দোতলায় ফিরে গেলাম। পরদিন বিকেলে পাশের বাড়িতে জোর কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। জানা গেল, ওই বাড়ির এক মেয়ের স্বামী নদীর অপর পারে একটি কারখানায় কাজ করতেন। গত রাতের বোমা হামলায় তিনি মারা পড়েছেন। হুগলি নদীর এপারে হুগলি এবং ওপারে অনেক কলকারখানা ছিল।
কয়েক দিন পরই আমরা গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রেলগাড়িতে চড়লাম। তখন রেলগাড়ির প্রতিটি কামরায় যাত্রীদের সঙ্গে অস্ত্রহাতে সেনারাও যাচ্ছিলেন। তাঁদের হাসিখুশি চেহারা। তাঁরা যুদ্ধ করেন আর মানুষ খুন করেন, সেটা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। এক সেনা বাবার পাশে বসেছিলেন। কোথা থেকে যেন এসে তাঁর হাতের তালুতে একটা লাল পিঁপড়া ঘুরছিল। বাবাকে দেখিয়ে তিনি সেটার বাংলা নাম জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও 'পিঁপড়া' শব্দটির সঠিক উচ্চারণ করতে না পেরে সেটিকে আস্তে রেলগাড়ির মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে জোরে হাসতে লাগলেন। আশপাশের সবাই সেই হাসিতে যোগ দিলাম। বহুকাল পর ঘটনাটি মনে পড়লে আমি অবাক হই অস্ত্রহাতে ওই সেনার একটা তুচ্ছ লাল পিঁপড়ার প্রতি দয়ালু আচরণে, যদিও তখন তিনি যাচ্ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে অথবা নিজে জীবন দিতে। অর্থাৎ পিঁপড়াটির প্রতি ওই সেনার আচরণই ছিল একজন মানুষের স্বাভাবিক আচরণ। তবে কেন যুদ্ধ!
১৯৯৫ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন শহরে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নেওয়া সেনাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কৃষ্ণবর্ণ গ্রানাইট পাথরে তৈরি একটি দেয়াল সমতল থেকে ক্রমাগত অতি ধীরে উঁচু হয়ে কেন্দ্রবিন্দুতে ১০ ফুট উচ্চতায় শেষ হওয়ার পর ১২৫ ডিগ্রি কৌণিক বাঁক নিয়ে ক্রমাগত নিচু হয়ে সমতলে শেষ হয়েছে। যুদ্ধে নিহত ৫৮ হাজার সেনার নামের তালিকা ৫০০ ফুট দীর্ঘ এই দেয়ালে মৃত্যুকাল ক্রমানুসারে খোদাই করা আছে। দেয়ালের এক পাশ ঘেঁষে সমান্তরাল সবুজ তৃণাবৃত মসৃণ জমি। তারপর বৃক্ষসারি এবং অন্য পাশে কংক্রিট করা পায়ে-চলা পথ। সেই পথ দিয়ে ১৯৫৯ সালে প্রথম নিহত সৈনিকের নাম খোদিত প্রস্তরখণ্ডটি পার হয়ে ১৯৭৫ সালে শেষ নিহত সৈনিকের নাম খোদিত প্রস্তরখণ্ডটির সামনে যখন দর্শকরা পেঁৗছায়, তখন যুদ্ধে নিহত সেনাদের ভয়ংকর সংখ্যা আর যুদ্ধের ভয়াবহ দীর্ঘ মেয়াদ তাদের মন আচ্ছন্ন করে দেয়। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকায় সর্বপ্রথম বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করেছিল। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী মায়া ওয়াইং লিন ওই স্মৃতিসৌধের নকশা তৈরি করেছিলেন। নিজ নকশা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য নকশাটিতে আমি এই ভাবনা মূর্ত করতে চেয়েছি যে মৃত্যু ও ধ্বংসের যাতনার তীব্রতা যদিও সময়ের সঙ্গে হ্রাস পায়, কিন্তু কখনো পূর্ণ নিরাময় হয় না, ক্ষতচিহ্ন থাকে।'
তবু কেন যুদ্ধ? ওই সময়ই সেখানে থাকতে সংবাদপত্রে একটি প্রতিবেদন পড়েছিলাম। প্রতিবেদক-সাংবাদিক মাইকেল রিগ্যান সেটা লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর পদাতিক সেনা সিস্টেমস সেন্টার থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল 'সুপার ট্রুপারস' এবং এর বিষয়বস্তু ছিল ভবিষ্যতের একজন মার্কিন সুপার ট্রুপারের বর্ণনা। প্রতিবেদনটি থেকে সংক্ষিপ্ত অনূদিত উদ্ধৃতি দিচ্ছি : 'তার হেলমেট বা শিরস্ত্রাণে থাকবে একটি খুদে ক্যামেরা, যার সাহায্যে সে অন্ধকারে কিংবা ঝোপের আড়ালে থাকা সেনাদের দেখতে পাবে এবং হেলমেটের যে স্বচ্ছ অংশটি চোখ ঢেকে রাখবে তা দিয়ে শত্রু ট্যাংক ও সেনা এবং মিত্র ট্যাংক ও সেনাদের যথাক্রমে লাল ও সবুজ রঙে দেখতে পাবে। নাক, চোয়াল ও চিবুকের সঙ্গে আটকে থাকা একটি অংশ তাকে রাসায়নিক কিংবা জীবাণু অস্ত্র থেকে রক্ষা করবে। তার ডান বাহুতে পোশাকের নিচে একটি সংবেদনশীল ব্যবস্থা থাকবে, যা তার রক্তচাপ ও হৃৎপিণ্ডের গতি নির্দিষ্ট বেতার তরঙ্গে জানাতে থাকবে এবং গুরুতর আহত কিংবা অসুস্থ হলে অবিলম্বে তাকে শনাক্ত করে উদ্ধার করা যাবে। তার বাম পায়ের হাঁটুর পেছনে পোশাকের নিচে একটি বহুরূপী-সদৃশ যন্ত্র থাকবে, ফলে তার পোশাকের রং বদলে পরিবেশের সঙ্গে মিলে যাবে। তার হাতে যে অস্ত্রটি থাকবে তা থেকে নিক্ষিপ্ত গুলির ঝাঁক সক্রিয়ভাবে শত্রু সেনাদের মাথায় আঘাত হানতে থাকবে। বর্তমানে একজন সেনাকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসের যে ব্যাগটি পিঠে বহন করতে হয় তার ওজন ৬০ কেজি। আর একজন সুপার ট্রুপারের ব্যাগের ওজন হবে ২৫ কেজি।'
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাত বছর আগে আইনস্টাইন একটি চিঠি লেখেন ফ্রয়েডকে। দুজনই তখন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব। পত্রলেখক অনন্য পদার্থবিদ এবং পত্রপ্রাপক অনন্য মনস্বত্ববিদ। আইনস্টাইন তাঁর লেখা চিঠিতে ফ্রয়েডের কাছে যে দুটি প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলেন তাদের সংক্ষেপিত অনূদিত উদ্ধৃতি দিচ্ছি : 'আজকে সভ্যতাকে যত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের মধ্যে বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় এটা সবচেয়ে জরুরি বিষয়। সমস্যাটা হলো এই : মানবসমাজকে যুদ্ধের আতঙ্কময় সম্ভাবনা থেকে মুক্তি দেওয়ার কি কোনো উপায় আছে?...মানুষের বিবর্তনকে কি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যাতে সে বিদ্বেষ ও ধ্বংসকামী আবেগের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে?'
১০ সপ্তাহ পরই ফ্রয়েড উত্তরে একটি দীর্ঘ চিঠি দেন। এখন চিঠিটি থেকে সংক্ষিপ্ত অনূদিত উদ্ধৃতি দিচ্ছি : 'একটা পথ দেখা দিয়েছে, যা হিংসা থেকে বিধিব্যবস্থা বা আইনের শাসনের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু কী এই পথ, অবশ্যই এটার উত্তর এই সত্যের উপলব্ধি থেকে যে একজন শক্তিশালী মানুষের আধিপত্যকে পরাভূত করা যায় অনেক দুর্বল মানুষের জোটবদ্ধতা দিয়ে যে, একতাই বল। পশুশক্তিকে জয় করা যায় সংঘশক্তি দিয়ে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা একক গুলির সংযুক্ত শক্তি বিচ্ছিন্ন দৈত্যের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার অর্থাৎ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এভাবে আমরা একটা জনগোষ্ঠীর শক্তিকে ন্যায়সংগত অধিকার অর্থাৎ নিয়ম বা বিধি_এই সংজ্ঞা দিতে পারি, তবু এটা হিংসা ছাড়া কিছুই নয়। শুধু একটাই তফাত_এখানে যা জয়ী হয় তা ব্যক্তিগত হিংসা নয়, সমষ্টিগত হিংসা।'
ফ্রয়েড চিঠিটা শেষ করেছেন এভাবে : 'সব মানুষ কবে শান্তিকামীতে পরিণত হবে সেদিনের জন্য আমাদের কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? বলা অসম্ভব। তবু আমাদের আশা যে এই দুই শক্তি-মানুষের সাংস্কৃতিক প্রবণতা এবং ভবিষ্যতের যুদ্ধ কী রূপ নেবে সে বিষয়ে যথেষ্ট যুক্তিসম্মত আতঙ্ক_এরা মিলে অদূর-ভবিষ্যতে হয়তো যুদ্ধের বিবর্তন ঘটাবে। কিন্তু কোন রাজপথ কিংবা গলিপথ দিয়ে সে ভাবীকাল আসবে তা আমরা অনুমান করতে পারি না। শুধু এটুকুই ভরসা রাখতে পারি, যা কিছু সাংস্কৃতিক বিকাশের অনুকূল তা-ই যুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করছে।'
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
কয়েক দিন পরই আমরা গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রেলগাড়িতে চড়লাম। তখন রেলগাড়ির প্রতিটি কামরায় যাত্রীদের সঙ্গে অস্ত্রহাতে সেনারাও যাচ্ছিলেন। তাঁদের হাসিখুশি চেহারা। তাঁরা যুদ্ধ করেন আর মানুষ খুন করেন, সেটা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। এক সেনা বাবার পাশে বসেছিলেন। কোথা থেকে যেন এসে তাঁর হাতের তালুতে একটা লাল পিঁপড়া ঘুরছিল। বাবাকে দেখিয়ে তিনি সেটার বাংলা নাম জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও 'পিঁপড়া' শব্দটির সঠিক উচ্চারণ করতে না পেরে সেটিকে আস্তে রেলগাড়ির মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে জোরে হাসতে লাগলেন। আশপাশের সবাই সেই হাসিতে যোগ দিলাম। বহুকাল পর ঘটনাটি মনে পড়লে আমি অবাক হই অস্ত্রহাতে ওই সেনার একটা তুচ্ছ লাল পিঁপড়ার প্রতি দয়ালু আচরণে, যদিও তখন তিনি যাচ্ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে অথবা নিজে জীবন দিতে। অর্থাৎ পিঁপড়াটির প্রতি ওই সেনার আচরণই ছিল একজন মানুষের স্বাভাবিক আচরণ। তবে কেন যুদ্ধ!
১৯৯৫ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন শহরে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নেওয়া সেনাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কৃষ্ণবর্ণ গ্রানাইট পাথরে তৈরি একটি দেয়াল সমতল থেকে ক্রমাগত অতি ধীরে উঁচু হয়ে কেন্দ্রবিন্দুতে ১০ ফুট উচ্চতায় শেষ হওয়ার পর ১২৫ ডিগ্রি কৌণিক বাঁক নিয়ে ক্রমাগত নিচু হয়ে সমতলে শেষ হয়েছে। যুদ্ধে নিহত ৫৮ হাজার সেনার নামের তালিকা ৫০০ ফুট দীর্ঘ এই দেয়ালে মৃত্যুকাল ক্রমানুসারে খোদাই করা আছে। দেয়ালের এক পাশ ঘেঁষে সমান্তরাল সবুজ তৃণাবৃত মসৃণ জমি। তারপর বৃক্ষসারি এবং অন্য পাশে কংক্রিট করা পায়ে-চলা পথ। সেই পথ দিয়ে ১৯৫৯ সালে প্রথম নিহত সৈনিকের নাম খোদিত প্রস্তরখণ্ডটি পার হয়ে ১৯৭৫ সালে শেষ নিহত সৈনিকের নাম খোদিত প্রস্তরখণ্ডটির সামনে যখন দর্শকরা পেঁৗছায়, তখন যুদ্ধে নিহত সেনাদের ভয়ংকর সংখ্যা আর যুদ্ধের ভয়াবহ দীর্ঘ মেয়াদ তাদের মন আচ্ছন্ন করে দেয়। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকায় সর্বপ্রথম বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করেছিল। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী মায়া ওয়াইং লিন ওই স্মৃতিসৌধের নকশা তৈরি করেছিলেন। নিজ নকশা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য নকশাটিতে আমি এই ভাবনা মূর্ত করতে চেয়েছি যে মৃত্যু ও ধ্বংসের যাতনার তীব্রতা যদিও সময়ের সঙ্গে হ্রাস পায়, কিন্তু কখনো পূর্ণ নিরাময় হয় না, ক্ষতচিহ্ন থাকে।'
তবু কেন যুদ্ধ? ওই সময়ই সেখানে থাকতে সংবাদপত্রে একটি প্রতিবেদন পড়েছিলাম। প্রতিবেদক-সাংবাদিক মাইকেল রিগ্যান সেটা লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর পদাতিক সেনা সিস্টেমস সেন্টার থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল 'সুপার ট্রুপারস' এবং এর বিষয়বস্তু ছিল ভবিষ্যতের একজন মার্কিন সুপার ট্রুপারের বর্ণনা। প্রতিবেদনটি থেকে সংক্ষিপ্ত অনূদিত উদ্ধৃতি দিচ্ছি : 'তার হেলমেট বা শিরস্ত্রাণে থাকবে একটি খুদে ক্যামেরা, যার সাহায্যে সে অন্ধকারে কিংবা ঝোপের আড়ালে থাকা সেনাদের দেখতে পাবে এবং হেলমেটের যে স্বচ্ছ অংশটি চোখ ঢেকে রাখবে তা দিয়ে শত্রু ট্যাংক ও সেনা এবং মিত্র ট্যাংক ও সেনাদের যথাক্রমে লাল ও সবুজ রঙে দেখতে পাবে। নাক, চোয়াল ও চিবুকের সঙ্গে আটকে থাকা একটি অংশ তাকে রাসায়নিক কিংবা জীবাণু অস্ত্র থেকে রক্ষা করবে। তার ডান বাহুতে পোশাকের নিচে একটি সংবেদনশীল ব্যবস্থা থাকবে, যা তার রক্তচাপ ও হৃৎপিণ্ডের গতি নির্দিষ্ট বেতার তরঙ্গে জানাতে থাকবে এবং গুরুতর আহত কিংবা অসুস্থ হলে অবিলম্বে তাকে শনাক্ত করে উদ্ধার করা যাবে। তার বাম পায়ের হাঁটুর পেছনে পোশাকের নিচে একটি বহুরূপী-সদৃশ যন্ত্র থাকবে, ফলে তার পোশাকের রং বদলে পরিবেশের সঙ্গে মিলে যাবে। তার হাতে যে অস্ত্রটি থাকবে তা থেকে নিক্ষিপ্ত গুলির ঝাঁক সক্রিয়ভাবে শত্রু সেনাদের মাথায় আঘাত হানতে থাকবে। বর্তমানে একজন সেনাকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসের যে ব্যাগটি পিঠে বহন করতে হয় তার ওজন ৬০ কেজি। আর একজন সুপার ট্রুপারের ব্যাগের ওজন হবে ২৫ কেজি।'
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাত বছর আগে আইনস্টাইন একটি চিঠি লেখেন ফ্রয়েডকে। দুজনই তখন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব। পত্রলেখক অনন্য পদার্থবিদ এবং পত্রপ্রাপক অনন্য মনস্বত্ববিদ। আইনস্টাইন তাঁর লেখা চিঠিতে ফ্রয়েডের কাছে যে দুটি প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলেন তাদের সংক্ষেপিত অনূদিত উদ্ধৃতি দিচ্ছি : 'আজকে সভ্যতাকে যত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের মধ্যে বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় এটা সবচেয়ে জরুরি বিষয়। সমস্যাটা হলো এই : মানবসমাজকে যুদ্ধের আতঙ্কময় সম্ভাবনা থেকে মুক্তি দেওয়ার কি কোনো উপায় আছে?...মানুষের বিবর্তনকে কি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যাতে সে বিদ্বেষ ও ধ্বংসকামী আবেগের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে?'
১০ সপ্তাহ পরই ফ্রয়েড উত্তরে একটি দীর্ঘ চিঠি দেন। এখন চিঠিটি থেকে সংক্ষিপ্ত অনূদিত উদ্ধৃতি দিচ্ছি : 'একটা পথ দেখা দিয়েছে, যা হিংসা থেকে বিধিব্যবস্থা বা আইনের শাসনের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু কী এই পথ, অবশ্যই এটার উত্তর এই সত্যের উপলব্ধি থেকে যে একজন শক্তিশালী মানুষের আধিপত্যকে পরাভূত করা যায় অনেক দুর্বল মানুষের জোটবদ্ধতা দিয়ে যে, একতাই বল। পশুশক্তিকে জয় করা যায় সংঘশক্তি দিয়ে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা একক গুলির সংযুক্ত শক্তি বিচ্ছিন্ন দৈত্যের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার অর্থাৎ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এভাবে আমরা একটা জনগোষ্ঠীর শক্তিকে ন্যায়সংগত অধিকার অর্থাৎ নিয়ম বা বিধি_এই সংজ্ঞা দিতে পারি, তবু এটা হিংসা ছাড়া কিছুই নয়। শুধু একটাই তফাত_এখানে যা জয়ী হয় তা ব্যক্তিগত হিংসা নয়, সমষ্টিগত হিংসা।'
ফ্রয়েড চিঠিটা শেষ করেছেন এভাবে : 'সব মানুষ কবে শান্তিকামীতে পরিণত হবে সেদিনের জন্য আমাদের কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? বলা অসম্ভব। তবু আমাদের আশা যে এই দুই শক্তি-মানুষের সাংস্কৃতিক প্রবণতা এবং ভবিষ্যতের যুদ্ধ কী রূপ নেবে সে বিষয়ে যথেষ্ট যুক্তিসম্মত আতঙ্ক_এরা মিলে অদূর-ভবিষ্যতে হয়তো যুদ্ধের বিবর্তন ঘটাবে। কিন্তু কোন রাজপথ কিংবা গলিপথ দিয়ে সে ভাবীকাল আসবে তা আমরা অনুমান করতে পারি না। শুধু এটুকুই ভরসা রাখতে পারি, যা কিছু সাংস্কৃতিক বিকাশের অনুকূল তা-ই যুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করছে।'
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
No comments