চার দিক-বুড়িগঙ্গা নদীতে ইফতার... by মনিরুল আলম

ইফতারি কিনতে যাব—এরই মধ্যে হঠাৎ করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, বৃষ্টিটা একটু কমলে তারপর ইফতারি কিনতে বের হব। ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। আচ্ছা, এই বৃষ্টির মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর খেয়ানৌকার মাঝিরা তাহলে কীভাবে ইফতার করবে?


ওরা কি নৌকায় ছাতা মাথায় দিয়ে ইফতার করবে, নাকি ঘাটের কোনো এক জায়গায় আশ্রয় নেবে ইফতার করার জন্য? সেদিন তো নৌকায় বসে ইফতার করতে করতেই নানা সুখ-দুঃখের কথা হলো ওদের সঙ্গে।
সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও কেউ কেউ রোজা রাখে। কিন্তু সেটা ওদের জন্য খুব কষ্টের হয়ে ওঠে। ইউনুস মাঝি বলেন, ‘কেউ রোজা রাখুক বা না রাখুক, ইফতারের সময় আজান দিলে এই নদীর ওপরেই ইফতার করি। তখন ঘাটে নৌচলাচল কমে যায়, পারাপারের যাত্রী থাকে না। আমরাও কজন মিলে ছোলা-মুড়ি আর পেঁয়াজু দিয়ে ইফতার করি। কেউ কেউ আবার মসজিদেও যায় ইফতার করতে।’
শ্যালোনৌকা আর লঞ্চ চলাচলের শব্দ। সেই সঙ্গে ভরা বর্ষার পানিতে ছোট ছোট ঢেউয়ে আমাদের নৌকাটি দুলতে থাকে। ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকলেও মনে মনে একটু ভয় হয়। ইউনুস মাঝি হাসতে হাসতে বলেন, ‘ভয় পাইয়েন না। নৌকা শক্ত করে বাঁধা আছে। ডোবার কোনো সম্ভাবনা নাই।’
‘ঠিক আছে।’ আমি বলি, ‘এবার আপনার আয়রোজগার সম্পর্কে কিছু বলেন।’
‘নৌকা ভাড়া আর ঘাটের ভাড়া বাদ দিয়ে প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকা থাকে। নৌকা ভাড়া ৪৫ টাকা দিতে হয় আর রাতে পাহারাদারকে দিতে হয় পাঁচ টাকা, ঘাট ভাড়া ৫০ টাকা। দিন-রাত এই ঘাটে নৌকা চলাচল করে, পরিশ্রম বেশি করলে বেশি টাকা পাওয়া যায়। এই কাজে খাটুনি বেশি, পরিশ্রম করা যায় না। শরীরে কুলায় না।’
পশ্চিম আকাশে তখন সূর্য হেলে পড়েছে। খণ্ড খণ্ড মেঘে রং ছড়াতে শুরু করেছে। বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে তখন অন্য রকম প্রতিফলন দেখা যায়। যাত্রী পারাপার দেখতে দেখতে দূর আকাশের দিকে চোখ চলে যায়। মেঘের দল যাত্রা শুরু করেছে দূরে, বহু দূরে। এসব দেখতে দেখতেই পাশের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। ততক্ষণে ইউসুফ মাঝি ও তাঁর সঙ্গীসাথিরা ইফতারি নিয়ে বসে গেছেন। নৌকার ওপর একটা গামছা বিছিয়ে তাতে কিছু মুড়ি, পেঁয়াজু আর ছোলা একত্রে মাখিয়ে খেতে শুরু করেছেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে ইফতারে শরিক হলাম।
বুড়িগঙ্গা নদীর এপারে ওয়াইজঘাট আর ওপারে কালীগঞ্জ। প্রতিদিন এই ঘাট দিয়ে শত শত যাত্রী পারাপার হয়। ইউসুফ মাঝিকে প্রশ্ন করি, আনুমানিক প্রতিদিন কত লোক পারাপার হয় এই ঘাট দিয়ে?
ইউসুফ মাঝি আমতা আমতা করতে থাকেন।
তাঁর পাশে বসা লতিফ মাঝি বলেন, ‘তা ধরেন বিশ হাজার তো হইবই। আমাগো এই ঘাটে দিন-রাত প্রায় ৩০০ নৌকা চলাচল করে। বড় নৌকাগুলাতে সাত-আটজন করে যাত্রী ওঠে। আর ছোটগুলাতে (রিজার্ভ) এক-দুই জন করে পারাপার হয়।’ লতিফ মাঝির কথায় সায় দেন ইফতার করতে বসা জামাল মাঝি।
চটজলদি ইফতার সেরে নৌকার মাঝিরা নামাজ আদায় শুরু করেন। উপস্থিত মাঝিরা নৌকার ওপর চারজনের একটা ছোট জামাতে দাঁড়িয়ে যান আর ততক্ষণে আমার ক্যামেরায় ক্লিক হতে থাকে সেই মুহূর্তটি ধরে রাখার জন্য। খেয়াঘাটটিতে পারাপারের জন্য যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে—এর মধ্যেই কোনো এক মাঝির কণ্ঠে ডাক শুনতে পাই, ‘ওই রিজাভ! আহেন এই দিকে।’ ঈদের কেনাকাটা। তাই সবার ব্যস্ততা যেন একটু অন্য রকম। লঞ্চ টার্মিনালের ঝলমলে আলো নদীর পানিতে প্রতিফলিত হয়ে এক অদ্ভুত আবহ সৃষ্টি হয়। ইউসুফ মাঝি সেই পানি কেটে আমাদের নিয়ে চলেন ঘাটের দিকে।

No comments

Powered by Blogger.