সহজিয়া কড়চা-তাঁর শাসনামল ও তাঁর কাব্যযুগ by সৈয়দ আবুল মকসুদ

সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী হাইকোর্টের রায়ে অবৈধ ঘোষণা এবং তাঁকে অবৈধভাবে ক্ষমতা জবরদখলকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। রায় ঘোষণার পর তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহ ও বিদ্রোহ—দুই অপরাধেই বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির নতুন করে দাবি উঠেছে। আদালতের রায়কে তিনি ‘স্বাগত’ জানান।


এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৪৫ মিনিট একান্ত বৈঠকের আগেই তিনি দেশবাসীকে জানিয়ে দেন, ‘আমার বিচার কেউ করতে পারবে না।’ আমিও তাঁর সঙ্গে একমত।
শের শাহ যত দিন শাসনক্ষমতায় ছিলেন, তিনি তাঁর দ্বিগুণ সময় রাষ্ট্রপরিচালনার সুযোগ পান। একটি জাতির জীবনে একটি দশক অল্প সময় নয়। বাংলাদেশের আশির দশকটি বিধাতা তাঁকে উপহার দিয়েছিল। তাঁর প্রস্তুতিপর্বের শুরু ৩০ মে ১৯৮১। সশরীরে মঞ্চে আবির্ভাব ২৪ মার্চ ১৯৮২। তার পর থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ পর্যন্ত সমস্ত সময় গোটা বাংলাদেশ ছিল তাঁর হাতের মুঠোয়।
গোটা জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যে প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল জানা দরকার, তার সবটাই তাঁর জানা ছিল। তিনি বাঘ ও ছাগকে এক ঘাটে পানি পান করিয়েছেন। সুবিধাবাদীদের জন্য তিনি এমন একটি শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করেন, যাতে থাবার মধ্যে পেয়েও বাঘ ছাগকে কামড় দেয়নি, মুখের কাছে গিয়েও ছাগ বাঘকে বিন্দুমাত্র ভয় পায়নি। ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার নামে তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেন। সেই সংস্কৃতিটিই আজ বাংলাদেশে বিকশিত হয়েছে। ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ব মোরা’ নামে তিনি যে গানটি বেঁধেছিলেন এবং বিটিভির কল্যাণে যার দ্বারা সাতটি বছর আমাদের কান ঝালাপালা হয়েছে, তা যে শুধু প্রাচ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত সংগীত ছিল, তা-ই নয়, তাঁর বাণীর তাৎপর্য ছিল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সর্বশ্রেষ্ঠ গানটির চেয়ে বেশি। তিনি একটি নতুন বাংলাদেশই আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন।
তাঁর ছিল নানা পরিচয়। তিনি প্রেসিডেন্ট, তিনি প্রেমিক, তিনি কবি। সে কবিও মৈমনসিংহ গীতিকার কবিদের মতো কবি নন, আঞ্চলিক লোককবি নন; বায়রন, শেলির মতো আন্তর্জাতিক মানের কবি। যাঁর আমন্ত্রণে ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজ বাংলার মাটিতে কবিতা ও প্রবন্ধ পাঠ করতে আসেন। আমি তাঁকে স্বৈরাচার হিসেবে দেখব না, তাঁর বহুমুখী প্রতিভার কথাই বলব। বিশেষ করে তাঁর কবিসত্তার পরিচয় দেব, কারণ একদিন আমিও তাঁর মতো কবি ছিলাম। আশির দশকে তিনি যখন কবি হিসেবে আবির্ভূত হন, তখন তাঁর কারণেই কবিতা লেখা মুলতবি রেখে আমি কলাম লেখা এস্তেমাল করতে বাধ্য হই। বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে একজন কুশলী অভিনেতা এবং বাংলাকাব্যের এক দিকপাল হিসেবে তাঁর আবির্ভাব না ঘটলে আমি কবিতা, গল্প, উপন্যাস নিয়েই থাকতাম। বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে আমার সমালোচক হিসেবেও সামান্য পরিচিতি আছে, সুতরাং তাঁর কাব্য নিয়ে আলোচনা আমার জন্য অনধিকার চর্চা হবে না।
বাংলাদেশের মানুষ জানে তাঁকে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও একটি বড় দলের নেতা হিসেবে। জলপাইগুড়ি ও কলকাতার আমার ছেলেমেয়ের বয়সী সাংবাদিকেরা তাঁকে ডাকে পেয়ারাদা। চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান তাঁকে কী একটা জুতসই উপাধি দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে স্ব-আরোপিত ‘পল্লিবন্ধু’ উপাধিটিই পছন্দ করেন। আজ জাফর, জয়নাল, আইয়ুব, দীপালি সাহা, কাঞ্চন, ফারুক, রাউফুন বসুনিয়া, নূর হোসেন, ডাক্তার মিলন এবং তাঁদের মতো আরও দুই-আড়াই শ হতভাগ্যের কথা কিছুই বলব না। তাঁদের আত্মার যদি মৃত্যু না হয়ে থাকে, তাহলে তাঁরা দেখছেন, বাংলাদেশে তাঁদের রক্তের বিনিময়ে কী সুন্দর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেই গণতান্ত্রিক সরকারের তিনি একটি স্তম্ভ।
ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে তিনি জনগণমন-অধিনায়ক হয়ে উঠেছিলেন, তবে জনগণ ‘জয় হে, জয় হে’ বলে কোরাস না ধরে বলতে থাকল—‘যাও হে, যাও হে’। তিনি যাওয়ার পাত্র নন। তিনি সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন, যা তাঁর এক বিরল কৃতিত্ব। তাঁর মন্ত্রিসভায় একাত্তরের উত্তম বীর এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী ঘাতক-দালালদের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ঘটান। তিনি পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট ও বাগদাদপন্থী যুদ্ধাপরাধীকে এক আসনে বসান। তিনি ভারতপন্থী জাতীয়তাবাদী ও পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদীকে এককাতারে খাড়া করেন। তিনি সোভিয়েতপন্থী প্রগতিশীল ও মার্কিনপন্থী গণতন্ত্রীকে সমান হিস্যা দেন। তিনি কিম-ইল-সুংপন্থী কমিউনিস্ট ও আনোয়ার হোজ্জাপন্থী মার্ক্সবাদী এবং শান্তিনিকেতনপন্থী রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ ও শর্ষিনার পীরপন্থী তৌহিদীদের একুশে ও স্বাধীনতা পদক সমান ভাগে ভাগ করে দেন।
তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন ছিল মধ্যযুগের বাগদাদ, ইস্পাহান ও ইয়েমেন থেকে আসা মহান সুফিদের চেয়ে এক ধাপ বেশি। রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা খরচ করে তিনি হেলিকপ্টারে ছুটে যেতেন ফরিদপুর আশেকান হিসেবে। ওখানে গিয়ে তিনি রাজনীতি ও কাব্য ভুলে যেতেন। বুঝতে পারতেন এই জগৎ কিছুই না, একেবারে মিছা, আজ আছি কাল নাই, কী হবে রাজ্যপাট ও পাটরানি ও সুয়োরানি দিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার উভয়কেই তিনি গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরায় কিছু কিছু প্লট দিয়ে সন্তুষ্ট করেন। প্রধান প্রগতিশীল কবিকেও তিনি সফরসঙ্গী হিসেবে দিল্লি ও অন্যান্য রাজধানীতে নিয়ে যান। তবে রাজাকারদেরই সঙ্গে রাখেন বেশি সংখ্যায়।
তিনিই পৃথিবীর একমাত্র পিতা যিনি জনসভায় ঘোষণা দেন: এইমাত্র খবর পেলাম, আমার একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। সমাবেশের সব মানুষ তা বিশ্বাস করে এবং শুকরিয়া আদায় করে। তিনি প্রতি শুক্রবার ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন মসজিদে নামাজ আদায় করতেন। দিনের কাজ শেষ করে রাতের বেলা কবিতার খাতা গুটিয়ে যখন ঘুমিয়ে পড়তেন, তখন ধর্ম নিয়ে দেখতেন নানা স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেন দিনের বেলা। টিপু সুলতান রোডের মসজিদে গিয়ে তিনি জাতিকে জানিয়ে দিলেন, তাঁর বড়ই আফসোস, বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্রধর্ম নেই। রাষ্ট্রধর্ম ছাড়া রাষ্ট্র কেমন খালি খালি ঠেকে। তা হয় না। তিনি রাষ্ট্রধর্ম করলেন। এটা বদলানোর শক্তি এখন কারও নেই।
শুধু দেশের মানুষ নয়, বাইরের বন্ধুদের পর্যন্ত তিনি ঘোল খাইয়ে দিলেন। পেন্টাগন মনে করল, তিনি তাদেরই খাস লোক। ক্রেমলিন দেখল, মার্ক্স-লেনিনের অনুসারী না হলেও আমাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। পাকিস্তানের হাইকমিশনার তাঁর ওপর অতি প্রসন্ন। হয়তো তাঁকে তিনি একান্তে বললেন, আমি পাকিস্তানকে ভালোবাসি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলায় আসিনি। এলে নির্ঘাৎ বিপাকে পড়তে হতো বলে পাকেই ছিলাম। আমি নিলো, জেবা, মুসাররাত নাজির ও নায়ার সুলতানার অভিনয় শুধু নয়, তাদের ফিগারও ভালোবাসি। ওস্তাদ সালামত আলি, নাজাকত আলির গজল না শুনলে আমার ঘুম আসে না।
পরের দিনই ‘কল অন’ করেন ভারতীয় কূটনীতিক। তাঁর সঙ্গে আলোচনা রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করেন। তারপর বলেন: পাকিস্তান আমার দুই চোখের দুশমন। ওরা আমাকে একাত্তরে আটকে রেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি বহু চেষ্টা করেও বর্ডার ক্রস করতে পারিনি। কয়েকবার অ্যাটেম্ট নিয়েছে। ওরা আমাকে সারাক্ষণ পাহারায় রাখত। হিন্দি ছবির কথাও পাড়েন। বলেন: আশা পারেখ, বৈজয়ন্তী মালা, হেমা মালিনী আমার প্রিয়। কী চমৎকার স্লিম ফিগার। পাকিস্তানি মোটকা নায়িকাগুলোকে আমি দেখতে পারি না। কূটনীতিক সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যান।
শুধু কূটনীতিকদের কেন? মার্ক টালি উপমহাদেশে খুবই জনপ্রিয় সাংবাদিক। উপজেলা নির্বাচন কভার করতে এলেন। নির্বাচনের দিন তিন রাজনৈতিক জোট হরতাল ডাকে। তিনি সরকারের বিরুদ্ধে কড়া এক প্রতিবেদন বিবিসিতে প্রচার করেন। বিকেলে তিনি তাঁর সচিবালয়ে গিয়ে দেখা করেন। সন্ধ্যায় দিল্লিতে চলে যান। রাতের রিপোর্টটি ছিল তাঁর প্রশংসায় পরিপূর্ণ।
তাঁর কাব্যখ্যাতি দেশের বাইরে বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এম জে আকবর উপমহাদেশের অল্প কয়েকজন শীর্ষ সাংবাদিকের একজন। যেমন তাঁর বক্তব্য, তেমনি তাঁর শিল্পিত ও সংহত ভাষা। তিনি ছাড়েন না কাউকে। আকবর এসেছিলেন তাঁর আমলে ঢাকায়। তাঁর সাক্ষাৎকার যেন। গিয়ে তিনি তাঁর সম্পাদিত দ্য সানডে পত্রিকায় লিখলেন: ‘যে জন কবি তিনি কখনো ম্যাকিয়াভেলি হতে পারেন না। প্রেম ও শান্তির জন্য; ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নির্যাতনযুক্ত এক নতুন জগতের অন্বেষণে তিনি মগ্ন থাকেন।’ আট পৃষ্ঠাব্যাপী এক প্রতিবেদনে আকবর উল্লেখ করেন, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি কবি বলেছেন: ‘আমি সবাইকে ভালোবাসতে চাই, আর এটাই আমার স্বভাব। কারও সঙ্গে শত্রুতা আমার কাম্য নয়।...আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে মূল্যবোধের প্রয়োজন আছে।...আমি কখনো একনায়ক ছিলাম না এবং নইও। আমি খুবই গণতন্ত্রমনা মানুষ। আমার শাসনামলের মতো এত বেশি গণতান্ত্রিক অধিকার রাজনৈতিক দলগুলো কখনো ভোগ করেছে বলে আমি মনে করি না।’ [দৈনিক বাংলা, ১৯ এপ্রিল ১৯৮৫]
আকবরকে দোষ দেব না। তখন তাঁর কবিখ্যাতি উপমহাদেশে মির্জা গালিবের থেকে বেশি। বিচিত্রায় প্রকাশিত হলো তাঁর ‘কনক প্রদীপ জ্বালো’ নামক এক বস্তু। অবিলম্বে তাঁর কাব্যচর্চা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ছুটতে লাগল। বিভিন্ন জনসভায় এবং বিদেশে যাত্রার আগে ‘নিজের লেখা’ কবিতা পাঠ করতে লাগলেন। এরপর তাঁর বাসনা হলো, বাংলাকাব্যকে রবীন্দ্রনাথ কিছুটা বহির্বিশ্বে পরিচিত করেছিলেন—তিনি পুরোপুরি পরিচিত করবেন। গঠন করেন বাংলাদেশ কবিতা কেন্দ্র।
তাঁর কবিবন্ধুরা তাঁকে কবিতা উৎসব করার পরামর্শ দেন। যখন শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দুর্বার গণ-আন্দোলন চলছে, তখন ২১ মে ১৯৮৫ আট সদস্যের একটি কবি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসেন। নেতৃত্ব দেন সৈয়দ আলী আহসান। দৈনিক বাংলার খবরে বলা হয়: ‘আগামী শীতকালে ঢাকায় এশীয় কবিতা উৎসব অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।...প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে এই ধরনের প্রথম একটি উৎসব অনুষ্ঠানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ জানানো হলে তিনি উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হতে সম্মত হন।’ পরে সৈয়দ হক কবিতাকেন্দ্র ছেড়ে দেন।
কবিতাপাঠের মোশায়েরা চলতে থাকল ঘন ঘন। রেডিও-টেলিভিশন তাদেরই। পয়লা বৈশাখ, ঈদের দিন তাঁরা কবিতাপাঠের আয়োজন করতে লাগলেন। যখন ঢাকার রাজপথে মানুষের রক্ত ঝরছে, তখন ১৯৮৮-এর বাংলা নববর্ষ বিটিভিতে কবিতাপাঠের মাধ্যমে উদ্যাপিত হয়। ‘মৃদু যন্ত্রসংগীতের তালে তালে’ সৈয়দ আলী আহসানের উপস্থাপনায় কাঁপা কাঁপা গলায় টেনে টেনে প্রায় সুর করে কবিতা আবৃত্তি করেন আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি।
তাঁরা কবিতায় মেতে উঠলেন। আমি, হুমায়ুন আজাদ ও আরও অনেকে ওসবের বিরুদ্ধে লিখতে লাগলাম। বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটল অনেকের সঙ্গে। কথাবার্তা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৮৮-এর বন্যায় গোটা দেশ নিমজ্জিত। ঢাকা নগরে পানি। বিটিভিতে চলল সে উপলক্ষে কাব্যপাঠ। উপস্থাপনা করতে গিয়ে সৈয়দ আলী আহসান বললেন: ‘অন্ধ কালো পানি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ পানি নিঃশব্দ—নিশ্চিত। এ পানির কোথাও লাল ফুল দেখা যায়নি, কিন্তু একটি দৃঢ় প্রত্যয় দেখা যাচ্ছে। ক্লান্তিহীন পানি। মানুষের অন্তর্ধানকে কবিরা কীভাবে দেখছে—’ ইত্যাদি। কালো পানির লাল ফুল নিয়ে কবিতা পাঠ করলেন সেই গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অনেকে। বন্যার্তদের সাহায্যে প্রেসিডেন্টপন্থী কবিরা আয়োজন করেছিলেন কবিতাপাঠের। আলী আহসানের বক্তৃতার ভাষা ও তাঁদের কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে আমি আর হুমায়ুন আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মলে বা ক্লাবে বসে গবেষণা করতাম। আমাদের অপরাহ্ন ও সন্ধ্যাগুলো আনন্দে ভরে যেত। কোনো কোনো দিন শামসুর রাহমানের বাড়িতে। তখন শামসুর রাহমান ও তাঁর গোত্রের কবিরা রাজকীয় কবিদের প্রতিপক্ষ।
‘এশীয় কবিতা উৎসব’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কবি-রাষ্ট্রপতি বললেন: ‘আমি কবি নই, কবি হওয়ার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করিনি। কিন্তু চারদিকের দারিদ্র্য দেখে স্থির থাকতে পারি না। প্রতিবাদের জন্য হাতে কলম তুলি।...কবিতা লিখি ফেলে আসা দিনগুলিকে ফিরিয়ে আনার জন্য। চাঁদের আলোকে ফিরিয়ে আনার জন্য।...আমরা মানুষের মতো বেঁচে থাকতে চাই—কবি হয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আমাদের কবিদের ফুলের মতো আদর করেন আপনারা।...আমরা কবিরা বেঁচে থাকব আপনাদের মাঝে।’ ওই দিনই সকালে বেতারে ঘোষণা করা হয়: ‘এশিয়ার কাব্যাকাশকে এক নতুন আভায় উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে’ এই কবিতা উৎসবের আয়োজন।
তাঁর কাব্যচর্চা রবিঠাকুর বা কাজীকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। একটি উদাহরণ। ‘সচিত্র বাংলাদেশ’-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ সংখ্যায় তাঁর একুশটি কবিতা প্রকাশিত হয়। মূল শিরোনাম: ‘তোমার বিস্তৃতির অংশ’। মোট পঙিক্তসংখ্যা ৩৭৯। ‘বিস্তৃতি’ জাতীয় শব্দকে বেশি ব্যবহার করতেন, তা অনেকেই জানেন। আমি তখন লিখেছিলাম, এসব কবিতা কম্পিউটার থেকে বেরোচ্ছে। বাংলাদেশের কম্পিউটার কবিতা লিখতে পারে।
আমি তাঁর আন্তর্জাতিক কবিখ্যাতির কথা বলেছি। কেউ মনে করবেন, আমি রসিকতা করছি। তা নয়। ১৯৮৬-এর আগস্টে সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় ‘আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব’ হয়। একটি অনুষ্ঠান হয় মেসিডোনিয়ার স্ট্রগায়। সেখানে তিনি তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় করে পাঠিয়েছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদকে। তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বিরচিত কবিতা, মালদ্বীপ। সরকারি তথ্য বিবরণীর ভাষায়, ‘মালদ্বীপ উচ্চপ্রশংসিত হইয়াছে। কবিতাটি সার্ক মৈত্রী চেতনার বাহক।’ আমি তখন লিখেছিলাম, কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ আলাউদ্দিন আল আজাদের কণ্ঠে শোনার পরও যদি শ্রোতাদের চেতনা থাকত, তাহলে তারা পুনর্বার অচেতন হয়ে যেত। সেখানে আমাদের কবি প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন ‘বিশ্ব কবিতা কেন্দ্র’ স্থাপনের জন্য। তাঁর প্রতিনিধি দেশে এসে মিডিয়াকে বলেন: ‘চলতি বছর ডিসেম্বরে ঢাকায় এশীয় কবিতা উৎসব অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রয়াসের প্রতিও উৎসবে গভীর আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।’
তাঁর কবিতার প্রশংসায় যে মেসিডোনিয়ার আকাশ-বাতাস মুখরিত, সে-কথা আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে না জানালে গোটা ব্যাপারটিই বরবাদ। কবিরা সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই সংবাদ সহাস্যে বলার জন্য তাঁরা বঙ্গভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে মোলাকাত করবেন। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬ রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে যান সৈয়দ আলী আহসান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, আবদুস সাত্তার, জাহানারা আরজু, ইমরান নূর ও সাইফুল বারী।
তাঁর কাব্যযুগ নিয়ে কলাম নয়, এমফিল ও পিএইচডি করা যায়। সেদিন আমাদের একশ্রেণী কবির ভাগ্য খুলে গিয়েছিল। কেউ বখতিয়ারের ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে তার লাগাম টানছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে যাবেন বলে। কেউ প্লেনে উঠে বসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমরা কেউ বিদেশে গেছি, তাঁর থেকে প্লট নিয়েছি, বাড়ি করার টাকা নিয়েছি, পার্বত্য চট্টগ্রামে জমি নিয়েছি, চুক্তিতে চাকরি নিয়েছি। আটটি বছর তাঁকে টিকিয়ে রেখেছি। আমাদের শিরদাঁড়া নেই। প্রাপ্তির জন্য নুয়ে পড়ি। বিচার হলে বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরী থেকে শুরু করে সবারই বিচার হওয়া উচিত।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.