গাবতলীতে মাসে তিন, বছরে ৩৫ কোটি টাকা লেনদেন by এস এম আজাদ

টার্মিনাল থেকে বের হতেই একটু দূরে রাস্তায় হাতের ইশারায় বাসগুলোকে দাঁড় করাচ্ছেন কয়েকজন। তাঁদের হাতে রসিদ, খুচরা টাকা। বাসগুলো গতি কমিয়ে ওই লোকগুলোর হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে রসিদ নিয়ে চলে যাচ্ছে। সম্প্রতি এক দুপুরে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া খালেক পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো ব ১৪-৪২২৬) চালক আবদুল মালেকের


কাছে জানতে চাওয়া হয়, কী জন্য টাকা দিচ্ছেন? তিনি বলেন, 'ট্রিপ নিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের ১০০ টাকা দিতে হয়। একেক রুটে একেক রেট।' মালেকের মতো আরো কয়েকজন বাসচালক জানান, তাঁরা এভাবে টার্মিনালে পার্কিংয়ের জন্য টাকা দিচ্ছেন। বাসপ্রতি আদায় করা টাকার পরিমাণ ৭০ থেকে ২০০ টাকা। তবে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ফি মাত্র ৪০ টাকা। আয়তন ও বাস চলাচলের সংখ্যার দিক থেকে রাজধানীর ব্যস্ততম টার্মিনালগুলোর একটি গাবতলীতে গিয়ে এমন তথ্য মিলেছে। এখানে বিভিন্ন শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের আলাদা ব্যানারে পার্কিং ফি, রাজস্ব আদায় ও সংগঠনের নামে প্রতিদিন প্রকাশ্যেই চলছে চাঁদাবাজি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিমাসে আদায় করা চাঁদার পরিমাণ প্রায় তিন কোটি টাকা। চাঁদা দেওয়াটাকেই নিয়ম বলে মেনে নিয়েছেন মালিক ও চালকরা।
বাস মালিক ও চালকরা অভিযোগ করেছেন, টার্মিনালে শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের নামে যে টাকা তোলা হয়, তার বেশির ভাগই তহবিলে জমা পড়ে না। টার্মিনাল ও ফুটপাতে অতিরিক্ত দোকান বসিয়ে রমরমা বাণিজ্য চালানো হলেও দেখার কেউ নেই। জায়গার অভাবে আন্তজেলা ও সিটি সার্ভিসের বেশির ভাগ বাসই টার্মিনালের বাইরে সড়কের ওপর রাখা হয়। অথচ পার্কিংয়ের নামে অতিরিক্ত ফি দিতে হয় ওই সব বাসকেও। পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের দাবি, যে টাকা তোলা হয়, তা সার্ভিস চার্জ ও শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু পার্কিংয়ের নামে দিনে অন্তত এক লাখ টাকার বেশি আদায় করা হচ্ছে গাবতলী টার্মিনাল থেকে। মাসে এর পরিমাণ ৩০ লাখ টাকা। অবৈধ দোকান থেকে প্রতিদিন ৬০ হাজার, অর্থাৎ মাসে ১৮ লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়। কাউন্টার থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে প্রতিদিন ৬৪ হাজার টাকা। মাসে দাঁড়ায় ১৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। টাউন সার্ভিসের বাস থেকে দিনে চাঁদা আদায় হয় তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা। মাসে এই পরিমাণ দাঁড়ায় এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা। পুলিশের নামে প্রতিমাসে তোলা হয় অন্তত তিন লাখ ২১ হাজার টাকা। টার্মিনাল থেকে ছাড়তে প্রতিটি বাস বিভিন্ন সংগঠন ও খরচের নামে দিনে ২০০ টাকা করে চাঁদা দেয়। এতে টার্মিনাল থেকে আদায় করা টাকার পরিমাণ চার লাখ। মাসের হিসাবে এক কোটি ২০ লাখ টাকা।
জানা গেছে, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা জেলা বাস-ট্রাক ওনার্স গ্রুপ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের নামেই বেশি চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। কয়েকজন মালিক ও চালক জানান, প্রতি সংগঠনের কমিটিকে আলাদাভাবে ৩০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। মালিক সমিতির ৩০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ২০ টাকা, ফেডারেশন ১০ টাকা ও কমিউনিটি পুলিশের জন্য ১০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও এ নিয়ম মানে না কেউ।
পার্কিং ফির নামে চাঁদাবাজি : গাবতলী টার্মিনালে একটি বাস পার্কিংয়ের জন্য সিটি করপোরেশন ৪০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে এই হারের কয়েক গুণ বেশি টাকা আদায় করছে রাজস্ব আদায়কারী ও বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন। সরেজমিন দেখা গেছে, টার্মিনালের সামনে পুলিশ ফাঁড়ির কোনায় এবং ঢাকা উদ্যানের রাস্তার পাশে কয়েকজন দাঁড়িয়ে পার্কিং ফির নামে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছে। প্রতিটি বাস থেকে নূ্যনতম ৭০ টাকা আদায় করছে তারা। টার্মিনালে অবস্থানকালে কয়েকটি দূরপাল্লার বাস থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত ফি আদায় করতে দেখা যায়। তবে রসিদ দেওয়া হচ্ছে ৪০ টাকারই। গোপালগঞ্জ বিশ্ব রোডের সুবর্ণ পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো ব ১১-০০৮১) চালক আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'বাড়তি টাকা নেওয়ার সময় আমাদেরকে খরচের কথা বইলা নেয়। রসিদ তো ৪০ টাকারই দেয়।'
রাস্তায় পার্কিং, টার্মিনালের চাঁদা : ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) তথ্যানুযায়ী, প্রায় ২২ একর জমির ওপর গাবতলী টার্মিনালটি নির্মিত। এখানে কাউন্টার ২১৪টি। টোকেন দোকান ১৫৪টি। অস্থায়ী বরাদ্দের দোকান ১৫টি, স্থায়ী বরাদ্দের দোকান ২১টি। এর বাইরে বসানো হয়েছে আরো ৩৬টি দোকান। সরেজমিন দেখা গেছে, বাস্তবের সঙ্গে ডিসিসির এই হিসাবের কোনো মিল নেই। টার্মিনালজুড়েই দোকানপাট। প্লাটফরম ও ফুটপাতে একটুও ফাঁকা জায়গা নেই। অবৈধভাবে ছোট-বড় অন্তত ২০০ দোকান বসানো হয়েছে। বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল, ওপরে কাপড় টানিয়ে রেস্টুরেন্ট, টং দোকান, চায়ের দোকান ও ফলের দোকান করা হয়েছে অর্ধশতাধিক। প্লাটফরমের বেশির ভাগ জায়গাই হকারদের দখলে। হকাররা জানায়, দোকানপ্রতি দিনে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আকতার, সোহরাবসহ কয়েকজন লাইনম্যান সন্ধ্যার পরে এ টাকা ওঠায়। ২০০ দোকান থেকে দিনে গড়ে ৩০০ টাকা করে মোট প্রায় ৬০ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে।
কাউন্টারে দিনে ৩০০ টাকা ভাড়া : অনুসন্ধানে জানা গেছে, টার্মিনালের দূরপাল্লার বাস কাউন্টারগুলো থেকে প্রতিদিন মালিক-শ্রমিক সমিতির নামে দিনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি কাউন্টারের ব্যবস্থাপক এ তথ্য স্বীকার করেন। কাউন্টারে বসে পরিবহন ব্যবসা চালানোর জন্য এ টাকাকে দৈনিক ভাড়া বা খরচ হিসেবে দেখেন তাঁরা। টার্মিনালে কাউন্টার রয়েছে ২১৪টি। প্রতিটি কাউন্টার থেকে দিনে ৩০০ টাকা করে তোলা হলেও অন্তত ৬৪ হাজার ২০০ টাকা আদায় করা হয়। কয়েকজন বাস মালিক জানান, একটি বাস নামাতে গেলে মালিক সমিতিকে ৭০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।
সিটি বাস থেকে দিনে ৩৫০ টাকা : গাবতলী লিংক, ৭ নম্বর, ৮ নম্বরসহ ঢাকা শহরের মধ্যে চলাচলকারী মিনিবাসগুলো টার্মিনালের বাইরে থেকেই ছেড়ে যাচ্ছে। কয়েকজন চালক জানান, গাবতলী, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন পয়েন্টে সমিতির নামে দিনে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। গাবতলী থেকে বাস ছাড়তে গেলে 'ওয়ে বিল' নামে ১৫০ টাকা দিতে হয় আগেই। মালিক সমিতির নামে ১০০ টাকা, পার্কিংয়ের নামে ৪০ টাকা ও শ্রমিক সংগঠনের নামে ১২০ টাকা ওঠানো হয়। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি ও গাবতলী মিনিবাস মালিক সমিতির নামে এসব টাকা আদায় করা হয়। ৭ নম্বর রুটের বাসচালক (ঢাকা মেট্রো জ ১১-২৬৮৮) মোয়াজ্জেম মোল্লা বলেন, 'গাবতলী থেইকা বাস ছাড়ার আগেই দেড় শ ট্যাকা দিতে হয়।'
পুলিশের নামে মাসিক চাঁদা : গাবতলী টার্মিনালের একটি কাউন্টারের কর্মী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিটি কাউন্টার থেকেই পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ আলাদাভাবে মাসিক চাঁদা আদায় করে। পরিবহনের বাসের সংখ্যানুযায়ী কাউন্টারে চাঁদার হার নির্ধারণ করা হয়। দূরপাল্লার প্রতিটি বাসের জন্য প্রতিমাসে ৩০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।
নিয়ন্ত্রণ চলছে সিন্ডিকেটে : বাস মালিক ও চালকদের কাছ থেকে জানা গেছে, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে গাবতলী টার্মিনালের নিয়ন্ত্রক বদলে যায়। তবে চাঁদাবাজির সিন্ডিকেটের ধরন অনেকটাই অভিন্ন থাকে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মফিজুল হক বেবু টার্মিনালের প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সহসভাপতি। সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার মফিজুল হক বেবু জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁর নিজস্ব লোক জসিম উদ্দিনকে ডিসিসির রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। টার্মিনাল থেকে ২০ থেকে ৩০ জনের শ্রমিক নেতার একটি সিন্ডিকেট কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দোকান ও পরিবহনের চাঁদাবাজি তাদের হাতে। এর মধ্যে আতিক ও আব্বাসের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ, সালাম গ্রুপ, মহিউদ্দিন গ্রুপ, শরিফ গ্রুপ, আকতার গ্রুপ, সোবহান গ্রুপ, বাদল গ্রুপ অন্যতম।
গাবতলী টার্মিনালের দায়িত্বে নিয়োজিত সিটি করপোরেশনের সহকারী ব্যবস্থাপক জোসন আলী বলেন, 'পার্কিংয়ের নামে এক টাকাও বেশি রাখা হয় না। তারা সংগঠনকে কিছু চাঁদা দেয়। আদায়কারী বেশি আদায় করে এমন অভিযোগ পাইনি।' টার্মিনালে অতিরিক্ত দোকান ও ফুটপাতে দোকান বসিয়ে চাঁদা আদায় এবং সিটি করপোরেশনের যোগসাজশের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'অনেক পরিবহন কর্তৃপক্ষ অন্যের কাছে কাউন্টার ভাড়া দেয়। এখানে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার হার প্রতি স্কয়ার ফিট ১৫ টাকা। বেশি আদায়ের অভিযোগ পাইনি।'
বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, 'আমাদের সংগঠনের জন্য নিজস্ব লোক দিয়ে ট্রিপ প্রতি ৩০ টাকা করে কালেকশন করা হয়।'
ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্বাস উদ্দিন বলেন, 'এখানে কোনো চাঁদাবাজি নেই। সরকারের নির্ধারিত ২০ টাকা নেওয়া হয় গাড়িপ্রতি।'
মফিজুল হক বেবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, একসময় টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন তিনি আর সেখানে ব্যবসা করেন না। টার্মিনালে চাঁদাবাজি নেই বলে দাবি করলেও বেবু বলেন, 'সবাই তো আর ধোয়া তুলসী পাতা না। নির্ধারিত টাকার বাইরে কিছু টাকা আদায় হয়। অবৈধ কিছু দোকানও আছে। এগুলা নিয়া ডিসিসি ও পুলিশ বেনিফিট নেয়।'
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জসিম উদ্দিন বলেন, 'পার্কিংয়ের জন্য বেশি টাকা আদায় করা হয় না। অবৈধ দোকান বসানোর অভিযোগও ঠিক না। সংগঠনের চাঁদা আলাদা বিষয়।'
এদিকে গাবতলী টার্মিনালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আবু রায়হান বলেন, 'টার্মিনাল থেকে কোনো প্রকার টাকা আদায়ের অভিযোগ ভিত্তিহীন।'
পুলিশের মিরপুর জোনের উপকমিশনার ইমতিয়াজ আহম্মেদ বলেন, 'পুলিশ সদস্যদের টাকা ওঠানোর বিষয়ে কোনো অভিযোগ শুনিনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

No comments

Powered by Blogger.