বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-এখনো শুকায়নি আইলার ক্ষত by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
২০০৯ সালের ২৫ মে উপকূলীয় কয়েকটি এলাকায় পড়েছিল আইলার ভয়াবহ থাবা। এখনো সেসব অঞ্চলের মানুষকে সেই ত্রাস তাড়া করে। বৃহত্তর খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় ভয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
প্রায় ২০০ মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি দুই লাখ ৪৩ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছিল। প্রায় ৯৭ হাজার একর জমির উঠতি আমন ফসল পুরোপুরি বিনষ্ট হয়। অর্ধলক্ষাধিক গবাদিপশু মারা যায়। পাশাপাশি পানিবন্দি হয়ে পড়ে কয়েক লাখ মানুষ। আইলার প্রত্যক্ষ ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও এর দীর্ঘমেয়াদি ভয়ংকর প্রভাব গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনে এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং তা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেটে গেলেও এ দেশে আক্রান্ত মানুষের দুর্ভোগ কাটে না। আইলাদুর্গত জনপদের চিত্র এ সাক্ষ্যই বহন করছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এই বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ প্রকৃতির ভয়াবহ রুদ্ররোষ মোকাবিলা করেই চলেছে। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তারা প্রত্যক্ষ শিকার। এর বিরূপ ধাক্কা জাতীয় অর্থনীতিতেও পড়ে। উপকূলীয় অঞ্চলের জনজীবনে নোনা পানির আগ্রাসী থাবা গ্রামীণ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইলায় ঘরবাড়ি ও পেশা হারিয়ে উপদ্রুত এলাকার কয়েক লাখ বাস্তুহারা মানুষ বিপন্ন-বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল এবং তিন বছর পরও উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। এর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর আঘাত হানে। সিডরের আঘাতে প্রায় গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলেও তৎকালীন সরকারের তাৎক্ষণিক কিছু দূরদর্শী পদক্ষেপের কারণে বছরখানেকের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বড় একটা অংশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলেও আইলার পর তিন বছর ইতিমধ্যে কেটে গেছে; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়ানোর অবকাশ পায়নি। আইলার পর সরকার তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল বটে; কিন্তু বিপন্ন মানুষ এর সুফল পায়নি। দেশি-বিদেশি সাহায্য-সহায়তার যথাযথ ব্যবহার নিয়ে যেমন বিস্তর প্রশ্ন আছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়াই যায়নি। তিন বছর আগেও যাদের নিজস্ব জমিতে বাড়িঘর ছিল, এখন তারা বেড়িবাঁধের ওপর চরম ঝুঁকিপূর্ণ জীবন যাপন করছে। আবার অনেক বেড়িবাঁধ তখন বিনষ্ট হলেও সেগুলোরও যথাযথ সংস্কার হয়নি। গ্রামীণ অবকাঠামো পুনঃসংস্কার কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। দীর্ঘদিন পরও আইলাদুর্গতদের স্বাভাবিক জীবনে কেন ফিরিয়ে দেওয়া যায়নি- এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলে না। মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে এমন উপেক্ষা মেনে নেওয়া যায় না। যেসব ফলদ ও বনজ বৃক্ষ ধ্বংস হয়ে গেছে, সেসব শূন্যস্থানও পূরণ হয়নি। অনেক স্থানেই নেই সেই সবুজ বেষ্টনীও, যে বেষ্টনীকে উপকূলীয় মানুষের জীবন রক্ষায় প্রাচীর বলা যায়। অভিযোগ আছে, সবুজ বেস্টনিতেও ক্ষমতাবানদের থাবা পড়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, জনবসতির প্রমাণস্বরূপ খুপরিঘর ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অর্ধমৃত কিছু তাল ও খেজুরগাছ ছাড়া মাইলের পর মাইল আইলা-বিধ্বস্ত রূপ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। খাদ্য, সুপেয় পানি, বাসস্থানসহ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর দাবি যেন রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কেউ শুনতে পান না। বিস্ময়কর হলো, প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত গৃহনির্মাণ বাবদ মঞ্জুর করা অর্থ দুই বছরেও হাতে পায়নি তালিকাভুক্ত বাস্তুহারা মানুষ!
এখনো পানিবন্দি আছে অনেক মানুষ আইলাদুর্গত এলাকায়। কৃষি ধ্বংস হয়ে গেছে নোনা পানির আগ্রাসনে। ফলে দরিদ্রদের তালিকা দীর্ঘ হয়েছে, অতিদরিদ্রের সংখ্যাও ক্রমে বাড়ছে। মানুষের মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে। বর্তমানে অনেক স্থানেই সরকারি ত্রাণ সহায়তা বন্ধ রয়েছে। মানুষের কাছে নেই কাজের সন্ধানও। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে সেসব এলাকার মানুষ। বর্ষা মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। এমনিতেই আইলা-দুর্গত অঞ্চলে রয়েছে পানির চাপ এবং সংগত কারণেই এখন তা আরো বাড়বে। এরই মধ্যে সতর্কবার্তা শোনা গেছে, দ্রুতই আবার আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। দুর্বল বেড়িবাঁধগুলো পানির চাপে যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। বিপন্ন মানুষজনের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ বাড়ছে। গত তিন বছরে আইলা-বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসনের অর্থ নিয়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও লুটপাটের সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত হলেও এখন পর্যন্ত প্রতিকারমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুর্গতরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অধিকতর খারাপ অবস্থায় আছে, মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। এ দেশে বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানুষের কল্যাণে অঙ্গীকার আর প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিক বাণী শোনানোর যে রেওয়াজ গড়ে উঠেছে, এ ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু মানুষের জীবন নিয়ে এমন সব ঘটনা কোন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে, কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হওয়া উচিত- এ প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আইলা-বিধ্বস্তরা যে তিমিরে ছিল, এখনো প্রায় সে তিমিরেই রয়ে গেছে। ফলে তীব্র মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলোর কোনো কোনো স্থানে মেরামতের নামে যা হয়েছে, অভিযোগ আছে, তাতেও যেন সম্পন্ন হয়েছে লুটপাটেরই এক মহাযজ্ঞ। মানুষের জীবনকে যারা এতটা তুচ্ছ ভেবেছে এবং বিপন্নদের কল্যাণে বরাদ্দে যারা থাবা বসিয়েছে, তারা কি অচেনা?
মানুষ প্রকৃতির বৈরী আচরণের পর এখন পর্যন্ত বেঁচে ও টিকে আছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের প্রাণান্ত চেষ্টায়। কিন্তু তাদের চেষ্টার ক্ষেত্রও তো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। সিডর ও আইলা বিশাল এলাকা নিয়ে পরিব্যাপ্ত ছিল। আমাদের সবারই জানা, এ দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া, অঙ্গীকার করা কিংবা আশ্বাসের পর মানুষকে বাঁচিয়ে তোলার তৎপরতা রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতি অত্যন্ত দুঃখজনক। শুভবুদ্ধিসম্পন্নদের এখনো প্রত্যাশা, সরকার বাস্তবতা আমলে নিয়ে বিপন্ন-বিপর্যস্তদের কল্যাণে প্রকৃত অর্থেই পদক্ষেপ নেবে এবং তাদের জীবনযুদ্ধে সহযাত্রী হয়ে দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে। প্রতিশ্রুত বিদেশি সাহায্যপ্রাপ্তির ব্যাপারে নতুন করে প্রচেষ্টা চালানো দরকার আর সময়ক্ষেপণ না করে। সময় বয়ে গেছে অনেক, আর যেন তা না হয়, সেটিই এখন জরুরি বিষয়। বিপন্ন-বিপর্যস্তরা আর পারছে না- এই সত্যের মধ্যে তো কোনো ফাঁক নেই। মনে রাখা দরকার, সব কিছুর শেষ আছে, কিন্তু মানুষের অধিকারের কোনো শেষ নেই। আইলা কিংবা যেকোনো দুর্যোগের মর্মন্তুদ শিকার যারা, তারা এই রাষ্ট্রের বাসিন্দা। তাদের মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো থেকে তারা যেন বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র পরিচালকদের দায়- এটি দায়িত্বশীলরা ভুলে না গেলেই মঙ্গল।
লেখক : সাংবাদিক
প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এই বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ প্রকৃতির ভয়াবহ রুদ্ররোষ মোকাবিলা করেই চলেছে। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তারা প্রত্যক্ষ শিকার। এর বিরূপ ধাক্কা জাতীয় অর্থনীতিতেও পড়ে। উপকূলীয় অঞ্চলের জনজীবনে নোনা পানির আগ্রাসী থাবা গ্রামীণ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইলায় ঘরবাড়ি ও পেশা হারিয়ে উপদ্রুত এলাকার কয়েক লাখ বাস্তুহারা মানুষ বিপন্ন-বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল এবং তিন বছর পরও উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। এর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর আঘাত হানে। সিডরের আঘাতে প্রায় গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলেও তৎকালীন সরকারের তাৎক্ষণিক কিছু দূরদর্শী পদক্ষেপের কারণে বছরখানেকের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বড় একটা অংশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলেও আইলার পর তিন বছর ইতিমধ্যে কেটে গেছে; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়ানোর অবকাশ পায়নি। আইলার পর সরকার তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল বটে; কিন্তু বিপন্ন মানুষ এর সুফল পায়নি। দেশি-বিদেশি সাহায্য-সহায়তার যথাযথ ব্যবহার নিয়ে যেমন বিস্তর প্রশ্ন আছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়াই যায়নি। তিন বছর আগেও যাদের নিজস্ব জমিতে বাড়িঘর ছিল, এখন তারা বেড়িবাঁধের ওপর চরম ঝুঁকিপূর্ণ জীবন যাপন করছে। আবার অনেক বেড়িবাঁধ তখন বিনষ্ট হলেও সেগুলোরও যথাযথ সংস্কার হয়নি। গ্রামীণ অবকাঠামো পুনঃসংস্কার কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। দীর্ঘদিন পরও আইলাদুর্গতদের স্বাভাবিক জীবনে কেন ফিরিয়ে দেওয়া যায়নি- এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলে না। মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে এমন উপেক্ষা মেনে নেওয়া যায় না। যেসব ফলদ ও বনজ বৃক্ষ ধ্বংস হয়ে গেছে, সেসব শূন্যস্থানও পূরণ হয়নি। অনেক স্থানেই নেই সেই সবুজ বেষ্টনীও, যে বেষ্টনীকে উপকূলীয় মানুষের জীবন রক্ষায় প্রাচীর বলা যায়। অভিযোগ আছে, সবুজ বেস্টনিতেও ক্ষমতাবানদের থাবা পড়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, জনবসতির প্রমাণস্বরূপ খুপরিঘর ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অর্ধমৃত কিছু তাল ও খেজুরগাছ ছাড়া মাইলের পর মাইল আইলা-বিধ্বস্ত রূপ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। খাদ্য, সুপেয় পানি, বাসস্থানসহ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর দাবি যেন রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কেউ শুনতে পান না। বিস্ময়কর হলো, প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত গৃহনির্মাণ বাবদ মঞ্জুর করা অর্থ দুই বছরেও হাতে পায়নি তালিকাভুক্ত বাস্তুহারা মানুষ!
এখনো পানিবন্দি আছে অনেক মানুষ আইলাদুর্গত এলাকায়। কৃষি ধ্বংস হয়ে গেছে নোনা পানির আগ্রাসনে। ফলে দরিদ্রদের তালিকা দীর্ঘ হয়েছে, অতিদরিদ্রের সংখ্যাও ক্রমে বাড়ছে। মানুষের মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে। বর্তমানে অনেক স্থানেই সরকারি ত্রাণ সহায়তা বন্ধ রয়েছে। মানুষের কাছে নেই কাজের সন্ধানও। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে সেসব এলাকার মানুষ। বর্ষা মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। এমনিতেই আইলা-দুর্গত অঞ্চলে রয়েছে পানির চাপ এবং সংগত কারণেই এখন তা আরো বাড়বে। এরই মধ্যে সতর্কবার্তা শোনা গেছে, দ্রুতই আবার আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। দুর্বল বেড়িবাঁধগুলো পানির চাপে যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। বিপন্ন মানুষজনের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ বাড়ছে। গত তিন বছরে আইলা-বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসনের অর্থ নিয়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও লুটপাটের সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত হলেও এখন পর্যন্ত প্রতিকারমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুর্গতরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অধিকতর খারাপ অবস্থায় আছে, মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। এ দেশে বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানুষের কল্যাণে অঙ্গীকার আর প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিক বাণী শোনানোর যে রেওয়াজ গড়ে উঠেছে, এ ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু মানুষের জীবন নিয়ে এমন সব ঘটনা কোন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে, কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হওয়া উচিত- এ প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আইলা-বিধ্বস্তরা যে তিমিরে ছিল, এখনো প্রায় সে তিমিরেই রয়ে গেছে। ফলে তীব্র মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলোর কোনো কোনো স্থানে মেরামতের নামে যা হয়েছে, অভিযোগ আছে, তাতেও যেন সম্পন্ন হয়েছে লুটপাটেরই এক মহাযজ্ঞ। মানুষের জীবনকে যারা এতটা তুচ্ছ ভেবেছে এবং বিপন্নদের কল্যাণে বরাদ্দে যারা থাবা বসিয়েছে, তারা কি অচেনা?
মানুষ প্রকৃতির বৈরী আচরণের পর এখন পর্যন্ত বেঁচে ও টিকে আছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের প্রাণান্ত চেষ্টায়। কিন্তু তাদের চেষ্টার ক্ষেত্রও তো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। সিডর ও আইলা বিশাল এলাকা নিয়ে পরিব্যাপ্ত ছিল। আমাদের সবারই জানা, এ দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া, অঙ্গীকার করা কিংবা আশ্বাসের পর মানুষকে বাঁচিয়ে তোলার তৎপরতা রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতি অত্যন্ত দুঃখজনক। শুভবুদ্ধিসম্পন্নদের এখনো প্রত্যাশা, সরকার বাস্তবতা আমলে নিয়ে বিপন্ন-বিপর্যস্তদের কল্যাণে প্রকৃত অর্থেই পদক্ষেপ নেবে এবং তাদের জীবনযুদ্ধে সহযাত্রী হয়ে দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে। প্রতিশ্রুত বিদেশি সাহায্যপ্রাপ্তির ব্যাপারে নতুন করে প্রচেষ্টা চালানো দরকার আর সময়ক্ষেপণ না করে। সময় বয়ে গেছে অনেক, আর যেন তা না হয়, সেটিই এখন জরুরি বিষয়। বিপন্ন-বিপর্যস্তরা আর পারছে না- এই সত্যের মধ্যে তো কোনো ফাঁক নেই। মনে রাখা দরকার, সব কিছুর শেষ আছে, কিন্তু মানুষের অধিকারের কোনো শেষ নেই। আইলা কিংবা যেকোনো দুর্যোগের মর্মন্তুদ শিকার যারা, তারা এই রাষ্ট্রের বাসিন্দা। তাদের মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো থেকে তারা যেন বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র পরিচালকদের দায়- এটি দায়িত্বশীলরা ভুলে না গেলেই মঙ্গল।
লেখক : সাংবাদিক
No comments