পুলিশ ও জনগণের অধিকার by এ এম এম শওকত আলী
জনগণের মৌলিক অধিকারের বিষয়ে সংবিধানে স্বীকৃত রয়েছে। এসব অধিকার রক্ষার জন্য পুলিশ বাহিনীকে আইনের দ্বারা যথেষ্ট ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। অতীতসহ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য বেআইনি কর্মকাণ্ডে মৌলিক অধিকার এখন হুমকির মুখে।
এ নিয়ে সরকারি নীতিনির্ধারকদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই বলে মনে হয়। এক কিশোরীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা কিছু পুলিশ সদস্য করেছে। এ নিয়ে মিডিয়ায় যথেষ্ট সংবাদসহ প্রতিবাদও জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের উক্তি নিতান্তই হাস্যকর ও দুঃখজনক। একজন সাংবাদিককে উপদেশ বা পরামর্শ দিয়েছেন সংবাদ সংগ্রহের সময় পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার জন্য। এর বিপরীতে পাবলিক প্রতিক্রিয়াও যথেষ্ট হয়েছে। এক. কিছু সংবাদপত্রে কার্টুনও ছাপানো হয়েছে। দুই. একজন খ্যাতনামা আইনজীবী এহেন উক্তির জন্য সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারককে জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেছেন।
সাংবাদিকরা কেন নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করবেন? সাধারণত এ ধরনের যুক্তি কি পুলিশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? পুলিশ তো জনসেবক। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করাই তো তাদের কাজ। অতীতে পুলিশের কিছু বেআইনি কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যায় বলা হতো, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা যখন কিছু দিন পর পরই ঘটছে তখনো কি বলা যাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা? গত কয়েক দিনের ঘটনার বিষয়ে এ বাক্য উচ্চারিত না হলেও বলা হয়েছে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানের কথা। অথচ পুলিশ বিধিমালায় বলা আছে, পুলিশ ও জনগণের পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়। এখন বোধ হয় বিধিমালায় বর্ণিত নীতির কোনো প্রয়োজন নেই। তা হলে সরকারিভাবে ঘোষণা দিলেই তো ভালো হয়। সবাই জানতে পারবে। প্রয়োজনে হাইকোর্টের দারস্থ হবে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার জন্য।
গত কয়েক দিনে কর্তব্যরত সাংবাদিকরা একাধিকবার পুলিশের কিছু সদস্যের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছেন। সর্বশেষ ঘটনায় এক কিশোরীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়। সাংবাদিকসহ কিছু আইনজীবী এর প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশ লাঠিপেটা করে। কিশোরীসহ তার মা-বাবাকে থানায় নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক তাদের তাঁর জিম্মায় থানা থেকে নিয়ে আসেন। সংশ্লিষ্ট অন্য একজন সরকারি নীতিনির্ধারকের উক্তি আরো দুঃখজনক- কিছু পুলিশ অন্যায় আচরণ করলেও পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো। তাঁর উক্তিতে আরো ছিল- সাংবাদিকদের এ সার্টিফিকেট দিতে হবে। সার্টিফিকেটের প্রশ্ন কেন আসবে? মুখ্য বিষয় হলো, পুলিশের অপরাধমূলক আচরণের জন্য প্রতিকার। কেন তারা এ আচরণ করবে। অবশ্য তাঁর উক্তিতে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে, বিষয়টি তদন্তাধীন। বিভাগীয় তদন্ত নিয়মমাফিক অবশ্যই হতে হবে। তবে অপরাধমূলক আচরণের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ফৌজদারি মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেন হবে না? এ বিষয়ে একটি বাংলা দৈনিক কিছু তথ্য দিয়েছে। অনেক চেষ্টার পর গভীর রাতে আক্রান্ত কিশোরীর মায়ের প্রদত্ত এফআইআর থানা গ্রহণ করেছে। গত শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লিখিত বক্তব্যের বিপরীতধর্মী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যদের আচরণ দুঃখজনক।
অতীতে এ ধরনের কিছু ঘটনায় শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার নির্দেশ দেন। এ সত্ত্বেও কেন থামছে না পুলিশের অপরাধমূলক আচরণ? বিশ্লেষকরা এর ব্যাখ্যা অতীতেও দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন। এর পরও কোনো ক্ষমতাসীন দলই এ বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অনেকে ভবিষ্যতেও করবে না মর্মে মত প্রকাশ করেছেন। প্রতিকারের উৎস দুটি। এক. বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীক্ষ্ন নজরদারি এবং দুই. হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ। এ দুটোর কোনোটিই অত প্রয়োজন ছিল না, যদি রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ এ বিষয়ে সচেতন হতো। এ কারণে বিশ্লেষকরা যথার্থই বলেছেন, পুলিশের রাজনীতিকায়ন এ বিষয়ে একটি বড় বাধা। এ বিষয়টির বিশ্লেষণ দিতে গিয়ে ৩০ মে তারিখ এক টক শোতে ১৮ দলীয় জোটের এক সংসদ সদস্যের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর বক্তব্যে অনেক কিছুর সঙ্গে ছিল দুটি বিষয়। এক. শুধু রাজধানী শহরেই নয়, গ্রামাঞ্চলেও এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এ নিয়ে কেউ কথা বলে না এবং দুই. পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের মনোভাব জানে। জানে বলেই তারা মনে করে, অন্যায় বা অপরাধমূলক আচরণের জন্য তাদের কোনো শাস্তি হবে না। বলা যায়, এটাই হলো বৃহত্তর ক্ষেত্র বা আঙ্গিক (Larger picture)। টক শোতে উপস্থিত আইন বিষয়ে দক্ষ একজন সাংবাদিকও মোটামুটি একই সুরে কথা বলেছেন।
অতীতে ও সাম্প্রতিককালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ পুলিশের অপরাধমূলক আচরণের প্রবণতা সর্ম্পকে যেসব বিশ্লেষণ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচিত হয়নি বলে বলা যায়। অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই দিকনির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। অতীতে মাঠ প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ডেপুটি কমিশনার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ পুলিশের কর্মকাণ্ডসংক্রান্ত কিছু ক্ষমতাও পুলিশ বিধিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দেওয়া হয়েছিল। তবে এর জন্য জেলা পুলিশের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক বিষয়ে তাঁকে কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। বর্তমানে তিনি আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে নির্বাহী আদেশবলে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। এ বিষয়ে দুর্বলতা অনেক। কারণ, বিদ্যমান বিধিমালার কোনো প্রয়োগ নেই। হয়তো অনেকে জানেনই না। বিধিমালাটির শিরোনাম, 'বাংলাদেশ পুলিশ বিধিমালা।' ১৯৪১ সালে প্রথম এটি প্রকাশ করা হয়। এর মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেসি ও পুলিশের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ বিধিমালার কোনো মৌলিক সংস্কার আজ পর্যন্ত হয়নি। যা হয়েছে, তা পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের সামরিক শাসনের সময়। এতে ভারসাম্য অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন যুক্তি দেখানো যায় যে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর এর কোনো প্রয়োজন নেই। এ যুক্তিও দেখানো যায় যে এ ধরনের মতাদর্শের কারণেই এত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। এ মত আগ্রহ্য করলেও বলা সম্ভব যে বিদ্যমান বিধিমালা অনুসৃত না হওয়ার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে প্রাথমিক জবাবদিহিতাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াও কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সব সিদ্ধান্তই এখন হবে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে। জেলা প্রশাসনের কাজ এখন মন্ত্রণালয়ে। ফলে দৈনন্দিন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এখন মন্ত্রণালয়ে হয়। মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন। এ দুটি কাজ মন্ত্রণালয় করতে অক্ষম। কারণ, ছোটখাটো কাজে বড় ব্যস্ততা।
উল্লিখিত টক শোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পুলিশ সংস্কার সমীক্ষা বাস্তবায়নের কথাও বলা হয়। আসলে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট একটি কারিগরি প্রকল্পের আওতায় এ সমীক্ষা প্রণীত হয়। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এর একটি সুপারিশ ছিল স্থায়ী পুলিশ কমিশন গঠন করা। উদ্দেশ্য পদোন্নতি ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল এসব বিষয়ে রাজনৈতিক প্রভাব যাতে না কাজ করে। বৈদেশিক সাহায্য দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। কাজেই যুক্তরাজ্যের পুলিশের আদলেই প্রধান প্রধান সুপারিশ প্রণীত হয়, যা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এখনো নেই। বিষয়টি সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণে আবদ্ধ। মূল উদ্দেশ্য হবে সার্বিকভাবে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিজ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। এটা করা না হলে সুশাসন আসবে না।
এ বিষয়টি যতটা না আইন ও বিধির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরশীল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে জনস্বার্থকেই অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। সাম্প্রতিককালে ডিবি পুলিশের বিষয়ে কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে একাধিক ঘটনা ঘটেছে। দুটি গুম হওয়া ঘটনার বিষয়ে। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার বিষয় এখনো অজানা। প্রকাশিত সংবাদমতে, ইলিয়াস আলীর বাসায় গিয়েছিল ডিবি পুলিশের পরিচয়ে কিছু ব্যক্তি। অন্য ঘটনাটি একটু ভিন্নতর। তবে এ ক্ষেত্রেও কিছু ব্যক্তি ডিবি পুলিশ পরিচয়ে রাতে এক বাসায় গিয়েছিল। প্রথম ঘটনাটি ডিবি পুলিশ অস্বীকার করেছে। অথচ এ বিষয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কী করা উচিত তা প্রকাশ্যে বলা হয়নি। প্রচলিত আইন অনুযায়ী যেকোনো বাড়িতে পুলিশ পরিচয়ে প্রবেশ করতে হলে আদালতের সার্চ ওয়ারেন্ট প্রয়োজন। এ কথা কেন পুলিশের তরফ থেকে বলা হয় না যে সার্চ ওয়ারেন্ট দেখাতে না পারলে কেউ যেন দরজা না খুলে পুলিশকে জানায়। তাৎক্ষণিকভাবে, বাড়ি সার্চের সময় অন্তত দুজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা আইনে রয়েছে। এটা কি সব সময় মানা হয়? পক্ষান্তরে সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া কারো বাড়িতে পুলিশের যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এমনটি কেন ঘটবে? এটাও কি অতি উৎসাহের পরিচয় বহন করে না? কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যের বেআইনি আচরণ বন্ধ করতে হলে যেকোনো ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদেরও বেআইনিভাবে অতি উৎসাহব্যঞ্জক আচরণ বন্ধ করতে হবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
সাংবাদিকরা কেন নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করবেন? সাধারণত এ ধরনের যুক্তি কি পুলিশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? পুলিশ তো জনসেবক। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করাই তো তাদের কাজ। অতীতে পুলিশের কিছু বেআইনি কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যায় বলা হতো, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা যখন কিছু দিন পর পরই ঘটছে তখনো কি বলা যাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা? গত কয়েক দিনের ঘটনার বিষয়ে এ বাক্য উচ্চারিত না হলেও বলা হয়েছে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানের কথা। অথচ পুলিশ বিধিমালায় বলা আছে, পুলিশ ও জনগণের পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়। এখন বোধ হয় বিধিমালায় বর্ণিত নীতির কোনো প্রয়োজন নেই। তা হলে সরকারিভাবে ঘোষণা দিলেই তো ভালো হয়। সবাই জানতে পারবে। প্রয়োজনে হাইকোর্টের দারস্থ হবে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার জন্য।
গত কয়েক দিনে কর্তব্যরত সাংবাদিকরা একাধিকবার পুলিশের কিছু সদস্যের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছেন। সর্বশেষ ঘটনায় এক কিশোরীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়। সাংবাদিকসহ কিছু আইনজীবী এর প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশ লাঠিপেটা করে। কিশোরীসহ তার মা-বাবাকে থানায় নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক তাদের তাঁর জিম্মায় থানা থেকে নিয়ে আসেন। সংশ্লিষ্ট অন্য একজন সরকারি নীতিনির্ধারকের উক্তি আরো দুঃখজনক- কিছু পুলিশ অন্যায় আচরণ করলেও পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো। তাঁর উক্তিতে আরো ছিল- সাংবাদিকদের এ সার্টিফিকেট দিতে হবে। সার্টিফিকেটের প্রশ্ন কেন আসবে? মুখ্য বিষয় হলো, পুলিশের অপরাধমূলক আচরণের জন্য প্রতিকার। কেন তারা এ আচরণ করবে। অবশ্য তাঁর উক্তিতে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে, বিষয়টি তদন্তাধীন। বিভাগীয় তদন্ত নিয়মমাফিক অবশ্যই হতে হবে। তবে অপরাধমূলক আচরণের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ফৌজদারি মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেন হবে না? এ বিষয়ে একটি বাংলা দৈনিক কিছু তথ্য দিয়েছে। অনেক চেষ্টার পর গভীর রাতে আক্রান্ত কিশোরীর মায়ের প্রদত্ত এফআইআর থানা গ্রহণ করেছে। গত শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লিখিত বক্তব্যের বিপরীতধর্মী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যদের আচরণ দুঃখজনক।
অতীতে এ ধরনের কিছু ঘটনায় শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার নির্দেশ দেন। এ সত্ত্বেও কেন থামছে না পুলিশের অপরাধমূলক আচরণ? বিশ্লেষকরা এর ব্যাখ্যা অতীতেও দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন। এর পরও কোনো ক্ষমতাসীন দলই এ বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অনেকে ভবিষ্যতেও করবে না মর্মে মত প্রকাশ করেছেন। প্রতিকারের উৎস দুটি। এক. বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীক্ষ্ন নজরদারি এবং দুই. হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ। এ দুটোর কোনোটিই অত প্রয়োজন ছিল না, যদি রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ এ বিষয়ে সচেতন হতো। এ কারণে বিশ্লেষকরা যথার্থই বলেছেন, পুলিশের রাজনীতিকায়ন এ বিষয়ে একটি বড় বাধা। এ বিষয়টির বিশ্লেষণ দিতে গিয়ে ৩০ মে তারিখ এক টক শোতে ১৮ দলীয় জোটের এক সংসদ সদস্যের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর বক্তব্যে অনেক কিছুর সঙ্গে ছিল দুটি বিষয়। এক. শুধু রাজধানী শহরেই নয়, গ্রামাঞ্চলেও এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এ নিয়ে কেউ কথা বলে না এবং দুই. পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের মনোভাব জানে। জানে বলেই তারা মনে করে, অন্যায় বা অপরাধমূলক আচরণের জন্য তাদের কোনো শাস্তি হবে না। বলা যায়, এটাই হলো বৃহত্তর ক্ষেত্র বা আঙ্গিক (Larger picture)। টক শোতে উপস্থিত আইন বিষয়ে দক্ষ একজন সাংবাদিকও মোটামুটি একই সুরে কথা বলেছেন।
অতীতে ও সাম্প্রতিককালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ পুলিশের অপরাধমূলক আচরণের প্রবণতা সর্ম্পকে যেসব বিশ্লেষণ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচিত হয়নি বলে বলা যায়। অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই দিকনির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। অতীতে মাঠ প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ডেপুটি কমিশনার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ পুলিশের কর্মকাণ্ডসংক্রান্ত কিছু ক্ষমতাও পুলিশ বিধিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দেওয়া হয়েছিল। তবে এর জন্য জেলা পুলিশের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক বিষয়ে তাঁকে কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। বর্তমানে তিনি আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে নির্বাহী আদেশবলে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। এ বিষয়ে দুর্বলতা অনেক। কারণ, বিদ্যমান বিধিমালার কোনো প্রয়োগ নেই। হয়তো অনেকে জানেনই না। বিধিমালাটির শিরোনাম, 'বাংলাদেশ পুলিশ বিধিমালা।' ১৯৪১ সালে প্রথম এটি প্রকাশ করা হয়। এর মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেসি ও পুলিশের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ বিধিমালার কোনো মৌলিক সংস্কার আজ পর্যন্ত হয়নি। যা হয়েছে, তা পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের সামরিক শাসনের সময়। এতে ভারসাম্য অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন যুক্তি দেখানো যায় যে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর এর কোনো প্রয়োজন নেই। এ যুক্তিও দেখানো যায় যে এ ধরনের মতাদর্শের কারণেই এত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। এ মত আগ্রহ্য করলেও বলা সম্ভব যে বিদ্যমান বিধিমালা অনুসৃত না হওয়ার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে প্রাথমিক জবাবদিহিতাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াও কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সব সিদ্ধান্তই এখন হবে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে। জেলা প্রশাসনের কাজ এখন মন্ত্রণালয়ে। ফলে দৈনন্দিন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এখন মন্ত্রণালয়ে হয়। মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন। এ দুটি কাজ মন্ত্রণালয় করতে অক্ষম। কারণ, ছোটখাটো কাজে বড় ব্যস্ততা।
উল্লিখিত টক শোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পুলিশ সংস্কার সমীক্ষা বাস্তবায়নের কথাও বলা হয়। আসলে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট একটি কারিগরি প্রকল্পের আওতায় এ সমীক্ষা প্রণীত হয়। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এর একটি সুপারিশ ছিল স্থায়ী পুলিশ কমিশন গঠন করা। উদ্দেশ্য পদোন্নতি ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল এসব বিষয়ে রাজনৈতিক প্রভাব যাতে না কাজ করে। বৈদেশিক সাহায্য দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। কাজেই যুক্তরাজ্যের পুলিশের আদলেই প্রধান প্রধান সুপারিশ প্রণীত হয়, যা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এখনো নেই। বিষয়টি সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণে আবদ্ধ। মূল উদ্দেশ্য হবে সার্বিকভাবে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিজ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। এটা করা না হলে সুশাসন আসবে না।
এ বিষয়টি যতটা না আইন ও বিধির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরশীল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে জনস্বার্থকেই অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। সাম্প্রতিককালে ডিবি পুলিশের বিষয়ে কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে একাধিক ঘটনা ঘটেছে। দুটি গুম হওয়া ঘটনার বিষয়ে। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার বিষয় এখনো অজানা। প্রকাশিত সংবাদমতে, ইলিয়াস আলীর বাসায় গিয়েছিল ডিবি পুলিশের পরিচয়ে কিছু ব্যক্তি। অন্য ঘটনাটি একটু ভিন্নতর। তবে এ ক্ষেত্রেও কিছু ব্যক্তি ডিবি পুলিশ পরিচয়ে রাতে এক বাসায় গিয়েছিল। প্রথম ঘটনাটি ডিবি পুলিশ অস্বীকার করেছে। অথচ এ বিষয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কী করা উচিত তা প্রকাশ্যে বলা হয়নি। প্রচলিত আইন অনুযায়ী যেকোনো বাড়িতে পুলিশ পরিচয়ে প্রবেশ করতে হলে আদালতের সার্চ ওয়ারেন্ট প্রয়োজন। এ কথা কেন পুলিশের তরফ থেকে বলা হয় না যে সার্চ ওয়ারেন্ট দেখাতে না পারলে কেউ যেন দরজা না খুলে পুলিশকে জানায়। তাৎক্ষণিকভাবে, বাড়ি সার্চের সময় অন্তত দুজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা আইনে রয়েছে। এটা কি সব সময় মানা হয়? পক্ষান্তরে সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া কারো বাড়িতে পুলিশের যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এমনটি কেন ঘটবে? এটাও কি অতি উৎসাহের পরিচয় বহন করে না? কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যের বেআইনি আচরণ বন্ধ করতে হলে যেকোনো ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদেরও বেআইনিভাবে অতি উৎসাহব্যঞ্জক আচরণ বন্ধ করতে হবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
No comments