আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষ-সহিংসতার পথ না ছাড়লে কারখানা বন্ধের হুমকি
আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে তৈরি পোশাক শিল্পে বিশৃঙ্খলা বন্ধে সরকারি উদ্যোগের মধ্যেই শ্রমিকদের অসন্তোষ চতুর্থ দিনে গড়াল। সহিংসতার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে গত বুধবার ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান স্থানীয় সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু গতকাল
বৃহস্পতিবার সকালে শিল্পাঞ্চলের নরসিংহপুরে হা-মীম গ্রুপের কারখানায় শ্রমিক ও মালিকপক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে মালিকদের রাজি করানোর আশ্বাস দেন।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পোশাক শিল্প মালিকরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, আগামী রবিবারের মধ্যে চলমান সহিংসতা বন্ধ না হলে পরদিন সোমবার থেকে আশুলিয়ায় সব পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই মুহূর্তে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো সম্ভব নয় জানিয়ে তাঁরা পরে অন্য এলাকায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সেখানেও একই পন্থা অবলম্বন করা হবে বলে ঘোষণা দেন। তাঁরা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
গতকাল হা-মীম গ্রুপের কারখানায় যখন বৈঠক চলছিল তখনই অন্যান্য কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক বিক্ষোভ শুরু করে। তারা সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত পাঁচ ঘণ্টা আশুলিয়ার আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়ক অবরুদ্ধ করে রাখে। গতকালও শিল্পাঞ্চলের প্রায় ৩০০ কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে মহাসড়কে জড়ো হয়। বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকরা মহাসড়কে যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করায় পুলিশের সঙ্গে তাদের অন্তত ২০টি পয়েন্টে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। এতে শতাধিক শ্রমিক আহত হয়। ভাঙচুর করা হয়েছে অর্ধশতাধিক যানবাহন।
পুলিশ, শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে গতকাল শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলো খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও শ্রমিকরা সকালে কাজে যোগ দেয়নি। সকাল ৮টার দিকে নরসিংহপুরে হা-মীম গ্রুপের কারখানায় শ্রমিক, মালিক এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। আধা ঘণ্টা পর অন্যান্য কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক জামগড়া এলাকায় মহাসড়কে জড়ো হয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এরপর তারা জামগড়া থেকে বাইপাইল মোড় ও জিরাব পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার সড়কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে টায়ার ও কাঠ জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। একদল শ্রমিক জামগড়ায় 'ড্রেস আপ' নামের একটি পোশাক কারখানা থেকে আসবাবপত্র বের করে সড়কে এনে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়।
বিক্ষোভকারীরা আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়ক ও নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কে অর্ধশতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা একপর্যায়ে জামগড়া এলাকায় যমুনা ব্যাংকের একটি এটিএম বুথ ভাঙচুর করে। পুলিশ সকালে বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ওপর রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের তাণ্ডবের মুখে তারা তেমন সফলকাম হয়নি।
গণমাধ্যমের কর্মীদেরও সহ্য করতে পারছে না শ্রমিকরা। সকালের দিকে তারা মাছরাঙা টেলিভিশনের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে তারা গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কে। বিক্ষোভকারীরা ওই সড়কে এবি ব্যাংক শাখার সামনে কাঠের গুঁড়ি জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দিলে পুলিশের সঙ্গে তাদের আরেক দফা সংঘর্ষ হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, একই সময় আশুলিয়ার জামগড়া ও নরসিংহপুর এলাকার শারমিন গ্রুপ, এনভয় ফ্যাশন, এমডিজে, নূরজাহান, ডেকু, অনন্ত, অন্বেষা, সেতারা গ্রুপ, উইন্ডি গ্রুপ, জনরনসহ বিভিন্ন কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক মিছিলসহ হা-মীম গ্রুপের কারখানার সামনে উপস্থিত হয়।
ওই সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু কারখানার ভেতরে হা-মীম গ্রুপের শ্রমিক ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভরত শ্রমিকরা ওই কারখানার শ্রমিকদের মন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময় না করে মিছিলে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানায়। সে সময় বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত শ্রমিকরা নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কের আশপাশের বেশ কিছু দোকান ও ১৪-১৫টি যানবাহন ভাঙচুর করে। সে সময় পুলিশ লাঠিপেটা করে ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। পুলিশের পাশাপাশি পরিবহন শ্রমিকরাও লাঠিসোঁটা নিয়ে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ধাওয়া দেয়। ঘটনার সময় পুলিশ নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। ঘণ্টাখানেক পরে আবার যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
দুপুর ১২টার পর আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়ক ও নবীনগর-কালিয়াকৈর সড়কের নিয়ন্ত্রণ আবারও বিক্ষোভকারীদের হাতে চলে যায়। সড়কের জামগড়া ও ইউনিক পয়েন্টে স্যুয়ারেজের বড় বড় পাইপ জড়ো করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। সে সময় পুলিশ-শ্রমিক ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, শ্রমিক ছাড়াও বেশ কিছু লোককে বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা গেছে। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। তবে সে সময় বহু পুলিশ সদস্যকে বিভিন্ন দোকানে বসে অলস সময় কাটাতে দেখেছে তারা।
শিল্পপুলিশ আশুলিয়া জোনের পরিদর্শক মোকলেসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, হা-মীম গ্রুপের কারখানায় মালিক-শ্রমিক পক্ষের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর বৈঠক শেষ হয় দুপুর দেড়টার দিকে। বৈঠক শেষে তাঁর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তখন পুলিশ পাহারায় কিছু ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়কে চলাচল শুরু করে। এরপর আড়াইটার দিকে ওই মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অসন্তোষের কারণে গত সোমবার থেকে চার দিন ধরে বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ রয়েছে। এ চার দিনই আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ পর্যন্ত চার শতাধিক শ্রমিক, পুলিশ ও পথচারী আহত হয়েছে।
আশুলিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মনোয়ার হোসেন বলেন, গত চার দিনে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে সহিংস ঘটনার ব্যাপারে থানায় কোনো মামলা হয়নি। কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি। এলাকার পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে। যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
হা-মীম গ্রুপের কারখানায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বৈঠক : গত চার দিন কারখানা বন্ধ থাকলেও উপস্থিত দেখিয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ ও জুলাইয়ের ৭ তারিখের মধ্যে বেতন-ভাতা সমন্বয় করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। গতকাল আশুলিয়ার নরসিংহপুরে হা-মীম গ্রুপের কারখানায় মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে তিনি এ আশ্বাস দেন।
প্রতিমন্ত্রী টুকু বলেন, সাধারণত পোশাক শ্রমিকদের বেতন-ভাতা সমন্বয় করা হয় নভেম্বর মাসে। তবে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে- আগামী জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা সমন্বয় করা হবে। তিনি বলেন, চার দিনের সংঘর্ষে যেসব শ্রমিক আহত হয়েছেন, মালিকপক্ষ তাঁদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, শুধু হা-মীম গ্রুপের শ্রমিকদের বেতন বাড়ালেই হবে না। আশুলিয়ায় প্রায় সাড়ে তিন শ পোশাক কারখানা আছে। বেতন বাড়াতে হলে সব কারখানার শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে হবে। এ জন্য মালিক, শ্রমিক, বিজিএমইএ, পুলিশসহ সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ ও স্থানীয় সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ উপস্থিত ছিলেন।
মালিকদের হুঁশিয়ারি : উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সদস্যরা জরুরি মতবিনিময় সভা করেন। বিজিএমইএ কার্যালয়ের মিলনায়তনে বিকেল সাড়ে ৩টায় সভা শুরু হয়। রাত ৮টায় সভা শেষে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, রবিবারের মধ্যে যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, কারখানা ঠিকমতো না চলে ও উৎপাদন ব্যাহত হয় তবে পরদিন আশুলিয়ার সব কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে। শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় এটা করতে বাধ্য হবেন মালিকরা।
সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআই সভাপতি এ কে আজাদ, বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, বিকেএমইএ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেমসহ এ খাতের অন্য উদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পোশাক শিল্প মালিকরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, আগামী রবিবারের মধ্যে চলমান সহিংসতা বন্ধ না হলে পরদিন সোমবার থেকে আশুলিয়ায় সব পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই মুহূর্তে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো সম্ভব নয় জানিয়ে তাঁরা পরে অন্য এলাকায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সেখানেও একই পন্থা অবলম্বন করা হবে বলে ঘোষণা দেন। তাঁরা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
গতকাল হা-মীম গ্রুপের কারখানায় যখন বৈঠক চলছিল তখনই অন্যান্য কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক বিক্ষোভ শুরু করে। তারা সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত পাঁচ ঘণ্টা আশুলিয়ার আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়ক অবরুদ্ধ করে রাখে। গতকালও শিল্পাঞ্চলের প্রায় ৩০০ কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে মহাসড়কে জড়ো হয়। বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকরা মহাসড়কে যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করায় পুলিশের সঙ্গে তাদের অন্তত ২০টি পয়েন্টে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। এতে শতাধিক শ্রমিক আহত হয়। ভাঙচুর করা হয়েছে অর্ধশতাধিক যানবাহন।
পুলিশ, শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে গতকাল শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলো খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও শ্রমিকরা সকালে কাজে যোগ দেয়নি। সকাল ৮টার দিকে নরসিংহপুরে হা-মীম গ্রুপের কারখানায় শ্রমিক, মালিক এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। আধা ঘণ্টা পর অন্যান্য কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক জামগড়া এলাকায় মহাসড়কে জড়ো হয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এরপর তারা জামগড়া থেকে বাইপাইল মোড় ও জিরাব পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার সড়কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে টায়ার ও কাঠ জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। একদল শ্রমিক জামগড়ায় 'ড্রেস আপ' নামের একটি পোশাক কারখানা থেকে আসবাবপত্র বের করে সড়কে এনে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়।
বিক্ষোভকারীরা আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়ক ও নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কে অর্ধশতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা একপর্যায়ে জামগড়া এলাকায় যমুনা ব্যাংকের একটি এটিএম বুথ ভাঙচুর করে। পুলিশ সকালে বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ওপর রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের তাণ্ডবের মুখে তারা তেমন সফলকাম হয়নি।
গণমাধ্যমের কর্মীদেরও সহ্য করতে পারছে না শ্রমিকরা। সকালের দিকে তারা মাছরাঙা টেলিভিশনের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে তারা গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কে। বিক্ষোভকারীরা ওই সড়কে এবি ব্যাংক শাখার সামনে কাঠের গুঁড়ি জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দিলে পুলিশের সঙ্গে তাদের আরেক দফা সংঘর্ষ হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, একই সময় আশুলিয়ার জামগড়া ও নরসিংহপুর এলাকার শারমিন গ্রুপ, এনভয় ফ্যাশন, এমডিজে, নূরজাহান, ডেকু, অনন্ত, অন্বেষা, সেতারা গ্রুপ, উইন্ডি গ্রুপ, জনরনসহ বিভিন্ন কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক মিছিলসহ হা-মীম গ্রুপের কারখানার সামনে উপস্থিত হয়।
ওই সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু কারখানার ভেতরে হা-মীম গ্রুপের শ্রমিক ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভরত শ্রমিকরা ওই কারখানার শ্রমিকদের মন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময় না করে মিছিলে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানায়। সে সময় বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত শ্রমিকরা নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কের আশপাশের বেশ কিছু দোকান ও ১৪-১৫টি যানবাহন ভাঙচুর করে। সে সময় পুলিশ লাঠিপেটা করে ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। পুলিশের পাশাপাশি পরিবহন শ্রমিকরাও লাঠিসোঁটা নিয়ে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ধাওয়া দেয়। ঘটনার সময় পুলিশ নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। ঘণ্টাখানেক পরে আবার যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
দুপুর ১২টার পর আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়ক ও নবীনগর-কালিয়াকৈর সড়কের নিয়ন্ত্রণ আবারও বিক্ষোভকারীদের হাতে চলে যায়। সড়কের জামগড়া ও ইউনিক পয়েন্টে স্যুয়ারেজের বড় বড় পাইপ জড়ো করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। সে সময় পুলিশ-শ্রমিক ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, শ্রমিক ছাড়াও বেশ কিছু লোককে বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা গেছে। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। তবে সে সময় বহু পুলিশ সদস্যকে বিভিন্ন দোকানে বসে অলস সময় কাটাতে দেখেছে তারা।
শিল্পপুলিশ আশুলিয়া জোনের পরিদর্শক মোকলেসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, হা-মীম গ্রুপের কারখানায় মালিক-শ্রমিক পক্ষের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর বৈঠক শেষ হয় দুপুর দেড়টার দিকে। বৈঠক শেষে তাঁর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তখন পুলিশ পাহারায় কিছু ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়কে চলাচল শুরু করে। এরপর আড়াইটার দিকে ওই মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অসন্তোষের কারণে গত সোমবার থেকে চার দিন ধরে বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ রয়েছে। এ চার দিনই আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ পর্যন্ত চার শতাধিক শ্রমিক, পুলিশ ও পথচারী আহত হয়েছে।
আশুলিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মনোয়ার হোসেন বলেন, গত চার দিনে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে সহিংস ঘটনার ব্যাপারে থানায় কোনো মামলা হয়নি। কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি। এলাকার পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে। যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
হা-মীম গ্রুপের কারখানায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বৈঠক : গত চার দিন কারখানা বন্ধ থাকলেও উপস্থিত দেখিয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ ও জুলাইয়ের ৭ তারিখের মধ্যে বেতন-ভাতা সমন্বয় করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। গতকাল আশুলিয়ার নরসিংহপুরে হা-মীম গ্রুপের কারখানায় মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে তিনি এ আশ্বাস দেন।
প্রতিমন্ত্রী টুকু বলেন, সাধারণত পোশাক শ্রমিকদের বেতন-ভাতা সমন্বয় করা হয় নভেম্বর মাসে। তবে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে- আগামী জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা সমন্বয় করা হবে। তিনি বলেন, চার দিনের সংঘর্ষে যেসব শ্রমিক আহত হয়েছেন, মালিকপক্ষ তাঁদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, শুধু হা-মীম গ্রুপের শ্রমিকদের বেতন বাড়ালেই হবে না। আশুলিয়ায় প্রায় সাড়ে তিন শ পোশাক কারখানা আছে। বেতন বাড়াতে হলে সব কারখানার শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে হবে। এ জন্য মালিক, শ্রমিক, বিজিএমইএ, পুলিশসহ সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ ও স্থানীয় সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ উপস্থিত ছিলেন।
মালিকদের হুঁশিয়ারি : উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সদস্যরা জরুরি মতবিনিময় সভা করেন। বিজিএমইএ কার্যালয়ের মিলনায়তনে বিকেল সাড়ে ৩টায় সভা শুরু হয়। রাত ৮টায় সভা শেষে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, রবিবারের মধ্যে যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, কারখানা ঠিকমতো না চলে ও উৎপাদন ব্যাহত হয় তবে পরদিন আশুলিয়ার সব কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে। শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় এটা করতে বাধ্য হবেন মালিকরা।
সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআই সভাপতি এ কে আজাদ, বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, বিকেএমইএ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেমসহ এ খাতের অন্য উদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন।
No comments