চিরকুট-বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয় by শাহাদুজ্জামান
এ মাসে ২০১০ সালের বিশ্বের সেরা ২০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ঘোষণা করেছে ‘টাইম ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং’ কর্তৃপক্ষ। নানা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রতিবছর এই সংস্থাটি পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করে থাকে।
লক্ষ করলাম, জ্ঞান বিতরণ এবং নতুন জ্ঞান উৎপাদন—এ দুটিকেই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ বলে বিবেচনা করছে। কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দুটি কাজের মান কেমন, তা নির্ধারণ করার জন্য নানা গাণিতিক হিসাব কষেছে তারা। মোট ১৩টি বিষয়ের ওপর বিভিন্ন অনুপাতে পয়েন্ট দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, গবেষণার পরিমাণ, পিএইচডি ছাত্রের সংখ্যা, আন্তর্জাতিক ছাত্রের সংখ্যা ইত্যাদি। তবে পয়েন্ট গণনায় সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে গবেষণাকে। গবেষণার বিষয়টি কয়েকটি স্তরে পরিমাপ করেছে তারা। একটি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা প্রকল্পে কী পরিমাণ অর্থ সংগ্রহে সক্ষম হয়েছে, সেখানকার শিক্ষকেরা সারা বছর আন্তর্জাতিক জার্নালে কয়টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন এবং সেসব প্রকাশনার কয়টি অন্য গবেষকদের দ্বারা উদ্ধৃত হয়েছে, সেগুলোর ভিত্তিতে পয়েন্ট দিয়েছে তারা। তারা বলছে, পৃথিবী যত জটিল হয়ে উঠছে, সম্পদ হিসেবে জ্ঞানের গুরুত্ব তত বাড়ছে। এই বিশেষ সম্পদটি উৎপাদনের প্রধান কারখানা হিসেবে এখনো বিবেচনা করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই। স্বভাবতই কৌতূহলী ছিলাম, কোন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শীর্ষ তালিকায় রয়েছে তা জানার জন্য। শুরুতে বলে নেওয়া ভালো, এই ২০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও নেই।
তালিকার শীর্ষ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ই আমেরিকার। প্রথম হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, দ্বিতীয় ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, তৃতীয় ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, চতুর্থ স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং পঞ্চম প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি। ষষ্ঠ স্থানে যৌথভাবে আছে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি। এশিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্থান পেয়েছে চীনের ঐতিহ্যবাহী ইউনিভার্সিটি অব হংকং, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনের নেতা সান ইয়াৎ সেন থেকে শুরু করে বহু বিশিষ্টজন লেখাপড়া করেছেন। অবশ্য এশিয়ার প্রথম হলেও চূড়ান্ত তালিকায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ২১তম। এশিয়ার শীর্ষ পাঁচে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জাপানের ইউনিভার্সিটি অব টোকিও, তৃতীয় স্থানে দক্ষিণ কোরিয়ার পোহাং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, চতুর্থ স্থানে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং পঞ্চম চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি। চূড়ান্ত তালিকায় এদের অবস্থান ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে।
ভাবছিলাম, তালিকাটি কত দীর্ঘ হলে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যুক্ত হতে পারত—৫০০, ১০০০? নাকি তাও নয়? সংস্থাটি জানিয়েছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধের মোট সংখ্যা বছরে যদি ৫০টির কম হয়, তবে তারা সেই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে প্রতিযোগিতার তালিকায়ই রাখেনি। আশঙ্কা করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুরু থেকেই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে কি না। পৃথিবীর সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করা এবং আন্তর্জাতিক একাডেমিক পত্রিকায় গবেষণা নিবন্ধ লেখা শিক্ষকদের অবশ্যকর্তব্যের একটি অংশ। এভাবেই তাঁরা নিজেদের জ্ঞানকে সমসাময়িক রাখেন এবং তাঁদের নিজস্ব জ্ঞানকাণ্ডে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিকা রাখেন। গবেষণা নিবন্ধ লেখা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি তো দূরের কথা, কোনো কোনো দেশে চাকরিচ্যুতির ব্যাপারও ঘটে। অথচ আমাদের দেশে গবেষণার সঙ্গে কোনো সংস্রব ছাড়াই এবং আন্তর্জাতিক পত্রিকায় একটি নিবন্ধ না লিখেও অধ্যাপক পর্যন্ত হওয়া সম্ভব; কিংবা নিজেদের বিভাগীয় পত্রিকায় দু-একটি নিবন্ধ ছাপিয়ে প্রকাশনার প্রয়োজনীয় কোটা পূরণ করে পদোন্নতি নেওয়া সম্ভব, কখনো ছাত্রদের করা গবেষণায় কর্তৃত্বের বলে নিজের নামটি যুক্ত করে প্রকাশনার সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব। বলা বাহুল্য, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই কিছু শিক্ষক রয়েছেন, যাঁরা নিয়মিত আন্তর্জাতিক মানের পত্রিকায় নিজেদের গবেষণাপত্র ছাপাচ্ছেন, কিন্তু সেটি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েরই মূল প্রবণতা নয়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ইত্যাদি বলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যতই আত্মতৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন, এটি মেনে নেওয়া ভালো যে বিশ্বমানের ধারেকাছে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশে নেই।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, সাধারণভাবে আমাদের দেশে একটি জ্ঞানবিমুখতা লক্ষ করি। কোনো কিছুকে গভীরভাবে নিংড়ে বুঝবার আগ্রহকে বরং নিরুৎসাহিতই করা হয়। বন্ধুমহলে যে তরুণটি একটু বিশ্লেষণপ্রবণ, তাকে ‘আঁতেল’ তকমা দিয়ে দলচ্যুত করা হয়; রাজনৈতিক দলে যে তরুণটি গলাবাজির বদলে কোনো রাজনৈতিক তাত্ত্বিক প্রশ্ন তোলে, তাকে ‘বেশি বোঝে’ বিধায় একঘরে করা হয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই উপরিতলের কিছু তথ্য আর হালকা ও ঝাপসা জ্ঞানের ভিত্তিতে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা। আমাদের চারপাশে এখন তথ্যের জোয়ার, কিন্তু তথ্য তো জ্ঞান নয়, প্রয়োজন তথ্য বিশ্লেষণ, যা সম্ভব কেবল গবেষণার মধ্য দিয়ে। ইউরোপের নানা দেশে দেখি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, করপোরেট সংস্থা, এমনকি প্রতিটি রাজনৈতিক দলের রয়েছে গবেষণা সেল। বিলেতে দেখি, গবেষক দলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই প্রধান সরকারি সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করা হয়।
দ্রুত অপস্রিয়মাণ সময়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য, সময়কে বদলানোর জন্য প্রয়োজন সময়কে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করা। সেটি সম্ভব অবিরাম গবেষণার মধ্য দিয়ে পুরোনো জ্ঞানকে যাচাই আর নতুন জ্ঞানের জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই জ্ঞানচর্চায় নেতৃত্ব দিতে পারত। সে লক্ষণ তো দেখি না। আর জ্ঞানবিমুখতা যদি একটি জাতিগত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়, তবে সে জাতি যে সব ক্ষেত্রেই লেজেগোবরে অবস্থায় থাকবে, সে আর আশ্চর্যের কী?
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
তালিকার শীর্ষ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ই আমেরিকার। প্রথম হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, দ্বিতীয় ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, তৃতীয় ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, চতুর্থ স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং পঞ্চম প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি। ষষ্ঠ স্থানে যৌথভাবে আছে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি। এশিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্থান পেয়েছে চীনের ঐতিহ্যবাহী ইউনিভার্সিটি অব হংকং, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনের নেতা সান ইয়াৎ সেন থেকে শুরু করে বহু বিশিষ্টজন লেখাপড়া করেছেন। অবশ্য এশিয়ার প্রথম হলেও চূড়ান্ত তালিকায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ২১তম। এশিয়ার শীর্ষ পাঁচে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জাপানের ইউনিভার্সিটি অব টোকিও, তৃতীয় স্থানে দক্ষিণ কোরিয়ার পোহাং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, চতুর্থ স্থানে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং পঞ্চম চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি। চূড়ান্ত তালিকায় এদের অবস্থান ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে।
ভাবছিলাম, তালিকাটি কত দীর্ঘ হলে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যুক্ত হতে পারত—৫০০, ১০০০? নাকি তাও নয়? সংস্থাটি জানিয়েছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধের মোট সংখ্যা বছরে যদি ৫০টির কম হয়, তবে তারা সেই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে প্রতিযোগিতার তালিকায়ই রাখেনি। আশঙ্কা করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুরু থেকেই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে কি না। পৃথিবীর সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করা এবং আন্তর্জাতিক একাডেমিক পত্রিকায় গবেষণা নিবন্ধ লেখা শিক্ষকদের অবশ্যকর্তব্যের একটি অংশ। এভাবেই তাঁরা নিজেদের জ্ঞানকে সমসাময়িক রাখেন এবং তাঁদের নিজস্ব জ্ঞানকাণ্ডে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিকা রাখেন। গবেষণা নিবন্ধ লেখা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি তো দূরের কথা, কোনো কোনো দেশে চাকরিচ্যুতির ব্যাপারও ঘটে। অথচ আমাদের দেশে গবেষণার সঙ্গে কোনো সংস্রব ছাড়াই এবং আন্তর্জাতিক পত্রিকায় একটি নিবন্ধ না লিখেও অধ্যাপক পর্যন্ত হওয়া সম্ভব; কিংবা নিজেদের বিভাগীয় পত্রিকায় দু-একটি নিবন্ধ ছাপিয়ে প্রকাশনার প্রয়োজনীয় কোটা পূরণ করে পদোন্নতি নেওয়া সম্ভব, কখনো ছাত্রদের করা গবেষণায় কর্তৃত্বের বলে নিজের নামটি যুক্ত করে প্রকাশনার সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব। বলা বাহুল্য, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই কিছু শিক্ষক রয়েছেন, যাঁরা নিয়মিত আন্তর্জাতিক মানের পত্রিকায় নিজেদের গবেষণাপত্র ছাপাচ্ছেন, কিন্তু সেটি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েরই মূল প্রবণতা নয়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ইত্যাদি বলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যতই আত্মতৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন, এটি মেনে নেওয়া ভালো যে বিশ্বমানের ধারেকাছে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশে নেই।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, সাধারণভাবে আমাদের দেশে একটি জ্ঞানবিমুখতা লক্ষ করি। কোনো কিছুকে গভীরভাবে নিংড়ে বুঝবার আগ্রহকে বরং নিরুৎসাহিতই করা হয়। বন্ধুমহলে যে তরুণটি একটু বিশ্লেষণপ্রবণ, তাকে ‘আঁতেল’ তকমা দিয়ে দলচ্যুত করা হয়; রাজনৈতিক দলে যে তরুণটি গলাবাজির বদলে কোনো রাজনৈতিক তাত্ত্বিক প্রশ্ন তোলে, তাকে ‘বেশি বোঝে’ বিধায় একঘরে করা হয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই উপরিতলের কিছু তথ্য আর হালকা ও ঝাপসা জ্ঞানের ভিত্তিতে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা। আমাদের চারপাশে এখন তথ্যের জোয়ার, কিন্তু তথ্য তো জ্ঞান নয়, প্রয়োজন তথ্য বিশ্লেষণ, যা সম্ভব কেবল গবেষণার মধ্য দিয়ে। ইউরোপের নানা দেশে দেখি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, করপোরেট সংস্থা, এমনকি প্রতিটি রাজনৈতিক দলের রয়েছে গবেষণা সেল। বিলেতে দেখি, গবেষক দলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই প্রধান সরকারি সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করা হয়।
দ্রুত অপস্রিয়মাণ সময়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য, সময়কে বদলানোর জন্য প্রয়োজন সময়কে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করা। সেটি সম্ভব অবিরাম গবেষণার মধ্য দিয়ে পুরোনো জ্ঞানকে যাচাই আর নতুন জ্ঞানের জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই জ্ঞানচর্চায় নেতৃত্ব দিতে পারত। সে লক্ষণ তো দেখি না। আর জ্ঞানবিমুখতা যদি একটি জাতিগত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়, তবে সে জাতি যে সব ক্ষেত্রেই লেজেগোবরে অবস্থায় থাকবে, সে আর আশ্চর্যের কী?
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments