বিশেষ সাক্ষাৎকার-রাজনৈতিক নেতৃত্ব পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে রেখেই কাজ করতে চান by এএসএম শাহজাহান
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) এএসএম শাহজাহানের জন্ম ১৯৪১ সালে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার পাদিপাড়া গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স শেষে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করেছিলেন পেশাগত জীবন।
চৌমুহনী কলেজ ও রাজশাহী সরকারি কলেজে স্বল্প সময়ের শিক্ষকতা শেষে তিনি যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পুলিশ সার্ভিসে যোগ দিয়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন শেষে আইজি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৯২ সালে। চার বছর এই পদে দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৯৬ সালে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন। অবসর নেন ১৯৯৯ সালে। এরপর ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। বর্তমানে ইউএনডিপির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো পুলিশ জনগণের বন্ধু—এই ধারণা ও বোধ জনগণের মধ্যে কম। আবার ভাবমূর্তির সংকট পুলিশের মধ্যে খুব বড় হয়ে দেখা দেয়। এই সংকট কাটছে না কেন?
এএসএম শাহজাহান আসল বিষয়টি হচ্ছে ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা। ঔপনিবেশিক আমলের ভাবমূর্তি আমাদের পুলিশ এখনো বহন করে চলেছে। গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের পুলিশে পরিবর্তন হয়নি। তখন পুলিশ গঠিত হয়েছিল শাসকদের স্বার্থে। এখনো পুলিশকে শাসকদের স্বার্থেই ব্যবহার করা হচ্ছে। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আমরা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এসেছি। কিন্তু বলা যায়, আমরা সেই ১৮৬১ মডেলের গাড়ি চালাচ্ছি। রয়ে গেছে সেই পুরোনো আইন ও বিধিমালা। সেই আইন দিয়ে পুলিশ চললে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। শাসকদের স্বার্থের পরিবর্তে জনস্বার্থে পুলিশকে ব্যবহারের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি।
প্রথম আলো ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নানা পর্যায় পার হয়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম হয়েছে। এত রূপান্তর ঘটল, কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলো না কেন?
এএসএম শাহজাহান মূল কারণ হচ্ছে, আইনের পরিবর্তন না হওয়া। যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাঁরা এই পরিবর্তনটা চাননি। স্বাধীনতার পর থেকে এই সময় পর্যন্ত আমরা অনেক ধরনের সরকার দেখলাম। সব সরকার একইভাবে কাজ করেছে। পুলিশকে জনগণের স্বার্থে ব্যবহারের পরিবর্তে ঔপনিবেশিক আমলের মতো নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের বিষয়টি টিকিয়ে রাখাকে তারা জরুরি মনে করেছে। অন্য ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলেও এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন শাসকগোষ্ঠী চায়নি। পুলিশের সংস্কারে সুপারিশ ও প্রস্তাব কম হয়নি, কিন্তু সব সরকার বিষয়টি কম বেশি একইভাবে উপেক্ষা করে গেছে।
প্রথম আলো পুলিশে সংস্কারের ক্ষেত্রে ঠিক কারা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন বা দাঁড়াচ্ছেন?
এএসএম শাহজাহান সংস্কার হলে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাঁরাই সংস্কার চান না। প্রথমেই বলা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব। পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মুখ্য অস্ত্র কী? বদলি, পদোন্নতি, ওএসডি, সাময়িক বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান—এসব। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এর মধ্য দিয়ে পুলিশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ করাতে চান। দীর্ঘদিন এসবের চর্চা হতে হতে এখন বলা যায়, পুলিশের সংস্কার হলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন, এমনকি পুলিশের যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাঁরা সংস্কারের বিরোধী। বর্তমান সমাজে পুলিশের যে মূল দায়িত্ব জনজীবনে নিরাপত্তার বোধ উন্নত করা, তা থেকে আমাদের পুলিশ অনেক দূরে। এখানে পুলিশ মূলত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির স্বার্থরক্ষার কাজ করে যাচ্ছে, আর এর উপজাত হিসেবে রাষ্ট্রীয় বা জনস্বার্থের কাজে ব্যবহূত হচ্ছে।
প্রথম আলো আপনি সামগ্রিকভাবে পুলিশের সংস্কারের কথা বলছেন। কিন্তু পুলিশ বর্তমানে যেভাবে চলছে, তার ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়নে নানা উদ্যোগ তো বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়।
এএসএম শাহজাহান আসলে গাড়ি মেরামত বা চালক পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গাড়িটিকে আপনি কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চান, সেটাই বড় কথা। আপনি যদি মূল বিষয়টি ঠিক করে নেন যে জনজীবনে নিরাপত্তা বোধের ধারণা উন্নত করাই হবে পুলিশের আসল কাজ, তবে সে অনুযায়ী পুলিশকে পরিচালনা করা যাবে। সবকিছুর ওপর দরকার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তবে জনগণের সচেতনতার বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো জনগণ এ ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে?
এএসএম শাহজাহান জনগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের আইন ও ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন নয়। পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে জনগণের অজ্ঞতা ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকে। আইন পুলিশকে কতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে আর জনগণকে কতটুকু অধিকার দিয়েছে—এই বিষয়গুলো জানা থাকলে অনেক ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করে পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব।
প্রথম আলো পুলিশের বিরুদ্ধে জনগণকে হয়রানি করা এবং নানা অপরাধ ও অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়, কিন্তু এর যথাযথ বিহিত পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?
এএসএম শাহজাহান দেখুন, আগেই বলেছি, যে আইন ও আইনের ধারাবাহিকতায় পুলিশ চলছে, তা পুরোনো। আধুনিক ধ্যান-ধারণার অনেক কিছুর সঙ্গেই সংগতিপূর্ণ নয়। আমাদের এই পুলিশ যখন গঠিত হয়, তখন মানবাধিকারের ধারণা বলে কিছু ছিল না। তাই আইনের সংস্কার না হলে উল্লেখযোগ্য কিছু করা কঠিন। পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে তা তদন্ত করে পুলিশ। পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের তদন্ত অনেকটা নিজের মাঠে খেলার মতো। অনেক ক্ষেত্রেই এর নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির আওতায় খসড়া অধ্যাদেশ প্রণয়ন কমিটি যে বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ, ২০০৭ (খসড়া) তৈরি করেছে, সেখানে পুলিশের অভিযোগ বিবেচনার জন্য ‘পুলিশ অভিযোগ কর্তৃপক্ষ’-এর কথা বলা আছে। সেখানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অথবা জাতীয় পর্যায়ে অবস্থান ও খ্যাতিসম্পন্ন একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি পুলিশ অভিযোগ কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশে ন্যায়পালও নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
প্রথম আলো পুলিশ অধ্যাদেশের এই খসড়া প্রণয়ন কমিটিতে আপনি ছিলেন। পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে খসড়ায় কী কী প্রস্তাব রয়েছে?
এএসএম শাহজাহান খসড়ায় জাতীয় পুলিশ কমিশনের কথা বলা আছে। এই কমিশন পুলিশপ্রধান নিয়োগের জন্য অতিরিক্ত আইজিপির নিম্নপদস্থ নয় এমন পাঁচজন কর্মকর্তার মধ্য থেকে তিনজনের নাম সুপারিশ করবে। এটি বাস্তবায়ন করা গেলে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় যখন তখন পুলিশপ্রধান নিয়োগ বা সরানোর সুযোগ নিয়ন্ত্রণ করা যেত। পুলিশ বিভাগ যেভাবে চলে আসছে, তা অনেকটা মন্ত্রী ও রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে চলছে। বর্তমান ব্যবস্থায় পুলিশের কাজের ওপর অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের সুযোগ রয়েছে।
প্রথম আলো এসপিদের জেলা প্রশাসকের অধীনে রাখার বিষয়টি নিয়েও মতভেদ রয়েছে। এ নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এএসএম শাহজাহান আসলে এসপিদের জেলা প্রশাসকদের অধীনে রাখার বিষয়টিও ঔপনিবেশিক আমলের একটি বিধি। সে সময় সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় জেলা প্রশাসন পুলিশকে ব্যবহার করত। বর্তমানে সেই পরিস্থিতি নেই। এখন অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে এসপিকে তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য জবাবদিহি করাই সমীচীন।
প্রথম আলো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ কোনো মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত নিশ্চিত করতে কী কী দিকে বাড়তি নজর থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
এএসএম শাহজাহান এ ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তার পেশাগত ও আইনি দক্ষতার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় কারিগরি সমর্থনের বিষয়টি খুবই জরুরি। কারিগরি দিকের মধ্যে রয়েছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের বিষয়টি নিশ্চিত করা। লাই ডিটেক্টর বা এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের কক্ষ বা জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি ভিডিও করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তদন্তকারী কর্মকর্তার ওপর অবাঞ্ছিত প্রভাব পড়ে এমন কিছু করা থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিরত থাকতে হবে। অনেক সময় তদন্ত চলাকালে মন্ত্রী বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এমন মন্তব্য শোনা যায়, যা সুষ্ঠু তদন্ত-প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ ধরনের মন্তব্য পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে। তদন্তের ব্যাপারে যেকোনো মন্তব্য করার আগে সতর্ক থাকতে হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তা অন্যায়ভাবে প্রভাবিত হতে পারেন, বা ভয়ে ভয়ে তদন্ত পরিচালনা করতে হয় এমন কোনো অবস্থা সৃষ্টি হলে তদন্তের মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
প্রথম আলো আমরা দেখি, সন্দেহভাজন অনেককে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার করে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হয়। আদালতে তাঁদের কেউ কেউ পরে নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারেন। গ্রেপ্তার করে কাউকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা কতটুকু সমর্থনযোগ্য?
এএসএম শাহজাহান আদালতে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বিবেচনা করা ঠিক নয়। তদন্ত-প্রক্রিয়ায়ও কাউকে অযথা হয়রানি করা যাবে না। আমি মনে করি, ঘটনা ঘটার সময় তাৎক্ষণিক কিছু ঘটতে পারে। গণমাধ্যম সেখানে উপস্থিত ও কর্মতৎপর থাকতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রে এমনটি করা ঠিক নয়। আমরা যদি কোনো সন্দেহভাজন অপরাধীকে গণমাধ্যমে হাজির করি, তবে অপরাধীকে শনাক্ত করার তদন্ত অথবা টি আই প্যারেড মূল্য হারিয়ে ফেলবে।
প্রথম আলো পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে। এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যে বিভাগীয় তদন্ত হয়, তাতে তা প্রমাণ করা কঠিন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক নানা দিক বিবেচনায় কিছু ঘটনা জনগণের মনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবেই বিবেচিত হয়। এ ধরনের ঘটনার ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
এএসএম শাহজাহান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত আছে এমন দেশে বিচার না করে কাউকে হত্যা করার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, এ ধরনের মৃত্যুকে খুন হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। যে ঘটনাগুলো ঘটে, সেগুলোকে সাধারণত ‘এনকাউন্টার’ বা ‘ক্রসফায়ার’—এ ধরনের নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আইনের দৃষ্টিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু ঘটনাগুলো বিশ্বাসযোগ্য কি না, সেটাই প্রশ্ন। প্রথমত, যাকে গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়েছে, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এ জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এর পরও যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে এবং ঘটনার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তবে সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের মৃত্যুর ক্ষেত্রে যথাযথ পোস্টমর্টেম ও সুরতহালের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছে, তা জানা সহজ হয়। আমি মনে করি, এ ধরনের ঘটনার পোস্টমর্টেম ও সুরতহালের ভিডিও হওয়া উচিত। আমি যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে চাই, তা হলো মানসিকতা। পুলিশের মনোভাব এমন হতে হবে, যাতে তাদের হাতে কখনো কাউকে আইনবহির্ভূতভাবে মারা পড়তে না হয়। যাঁরা পুলিশকে পরিচালনা করেন, সেই রাজনৈতিক শক্তিরও একই মানসিকতা থাকতে হবে। ধৈর্য ধারণ করার শক্তি হচ্ছে পুলিশের বড় শক্তি। বিক্ষোভ দমনে অনেক সময় আমরা পুলিশকে যথেষ্ট মারমুখী দেখি। ক্ষমতার প্রয়োগ জরুরি হলে আইনানুগভাবে ন্যূনতম ক্ষমতা প্রয়োগ করা উচিত।
প্রথম আলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব। এখন এলিট বাহিনী হিসেবে র্যাব বেশি সক্রিয়। র্যাবের মূল কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা মূলত সামরিক বাহিনী থেকে আসা। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ-প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সে বিবেচনায় র্যাবের ভূমিকা এবং এতে পুলিশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন কি?
এএসএম শাহজাহান এলিট বাহিনী থাকতেই পারে। পুলিশ কাজ করছে, র্যাবও কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে যদি প্রতিযোগিতার মনোভাব থাকে, তবে তা খুবই ইতিবাচক। এতে পুলিশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে পারে এমন কোনো বিষয় নেই। এটা ঠিক যে পুলিশের প্রশিক্ষণ-প্রক্রিয়া ও র্যাবের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও ক্রমবর্ধমান অপরাধের যে ধারা, তাতে অনেক ক্ষেত্রে সামরিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মাঝে জেএমবির জঙ্গি তৎপরতা দেশকে যে বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল, সেই চক্রের বিরুদ্ধে র্যাব প্রশংসনীয় সফলতা দেখিয়েছে। এ ধরনের সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য ভালো।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
এএসএম শাহজাহান ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো পুলিশ জনগণের বন্ধু—এই ধারণা ও বোধ জনগণের মধ্যে কম। আবার ভাবমূর্তির সংকট পুলিশের মধ্যে খুব বড় হয়ে দেখা দেয়। এই সংকট কাটছে না কেন?
এএসএম শাহজাহান আসল বিষয়টি হচ্ছে ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা। ঔপনিবেশিক আমলের ভাবমূর্তি আমাদের পুলিশ এখনো বহন করে চলেছে। গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের পুলিশে পরিবর্তন হয়নি। তখন পুলিশ গঠিত হয়েছিল শাসকদের স্বার্থে। এখনো পুলিশকে শাসকদের স্বার্থেই ব্যবহার করা হচ্ছে। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আমরা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এসেছি। কিন্তু বলা যায়, আমরা সেই ১৮৬১ মডেলের গাড়ি চালাচ্ছি। রয়ে গেছে সেই পুরোনো আইন ও বিধিমালা। সেই আইন দিয়ে পুলিশ চললে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। শাসকদের স্বার্থের পরিবর্তে জনস্বার্থে পুলিশকে ব্যবহারের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি।
প্রথম আলো ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নানা পর্যায় পার হয়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম হয়েছে। এত রূপান্তর ঘটল, কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলো না কেন?
এএসএম শাহজাহান মূল কারণ হচ্ছে, আইনের পরিবর্তন না হওয়া। যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাঁরা এই পরিবর্তনটা চাননি। স্বাধীনতার পর থেকে এই সময় পর্যন্ত আমরা অনেক ধরনের সরকার দেখলাম। সব সরকার একইভাবে কাজ করেছে। পুলিশকে জনগণের স্বার্থে ব্যবহারের পরিবর্তে ঔপনিবেশিক আমলের মতো নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের বিষয়টি টিকিয়ে রাখাকে তারা জরুরি মনে করেছে। অন্য ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলেও এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন শাসকগোষ্ঠী চায়নি। পুলিশের সংস্কারে সুপারিশ ও প্রস্তাব কম হয়নি, কিন্তু সব সরকার বিষয়টি কম বেশি একইভাবে উপেক্ষা করে গেছে।
প্রথম আলো পুলিশে সংস্কারের ক্ষেত্রে ঠিক কারা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন বা দাঁড়াচ্ছেন?
এএসএম শাহজাহান সংস্কার হলে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাঁরাই সংস্কার চান না। প্রথমেই বলা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব। পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মুখ্য অস্ত্র কী? বদলি, পদোন্নতি, ওএসডি, সাময়িক বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান—এসব। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এর মধ্য দিয়ে পুলিশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ করাতে চান। দীর্ঘদিন এসবের চর্চা হতে হতে এখন বলা যায়, পুলিশের সংস্কার হলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন, এমনকি পুলিশের যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাঁরা সংস্কারের বিরোধী। বর্তমান সমাজে পুলিশের যে মূল দায়িত্ব জনজীবনে নিরাপত্তার বোধ উন্নত করা, তা থেকে আমাদের পুলিশ অনেক দূরে। এখানে পুলিশ মূলত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির স্বার্থরক্ষার কাজ করে যাচ্ছে, আর এর উপজাত হিসেবে রাষ্ট্রীয় বা জনস্বার্থের কাজে ব্যবহূত হচ্ছে।
প্রথম আলো আপনি সামগ্রিকভাবে পুলিশের সংস্কারের কথা বলছেন। কিন্তু পুলিশ বর্তমানে যেভাবে চলছে, তার ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়নে নানা উদ্যোগ তো বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়।
এএসএম শাহজাহান আসলে গাড়ি মেরামত বা চালক পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গাড়িটিকে আপনি কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চান, সেটাই বড় কথা। আপনি যদি মূল বিষয়টি ঠিক করে নেন যে জনজীবনে নিরাপত্তা বোধের ধারণা উন্নত করাই হবে পুলিশের আসল কাজ, তবে সে অনুযায়ী পুলিশকে পরিচালনা করা যাবে। সবকিছুর ওপর দরকার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তবে জনগণের সচেতনতার বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো জনগণ এ ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে?
এএসএম শাহজাহান জনগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের আইন ও ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন নয়। পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে জনগণের অজ্ঞতা ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকে। আইন পুলিশকে কতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে আর জনগণকে কতটুকু অধিকার দিয়েছে—এই বিষয়গুলো জানা থাকলে অনেক ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করে পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব।
প্রথম আলো পুলিশের বিরুদ্ধে জনগণকে হয়রানি করা এবং নানা অপরাধ ও অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়, কিন্তু এর যথাযথ বিহিত পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?
এএসএম শাহজাহান দেখুন, আগেই বলেছি, যে আইন ও আইনের ধারাবাহিকতায় পুলিশ চলছে, তা পুরোনো। আধুনিক ধ্যান-ধারণার অনেক কিছুর সঙ্গেই সংগতিপূর্ণ নয়। আমাদের এই পুলিশ যখন গঠিত হয়, তখন মানবাধিকারের ধারণা বলে কিছু ছিল না। তাই আইনের সংস্কার না হলে উল্লেখযোগ্য কিছু করা কঠিন। পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে তা তদন্ত করে পুলিশ। পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের তদন্ত অনেকটা নিজের মাঠে খেলার মতো। অনেক ক্ষেত্রেই এর নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির আওতায় খসড়া অধ্যাদেশ প্রণয়ন কমিটি যে বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ, ২০০৭ (খসড়া) তৈরি করেছে, সেখানে পুলিশের অভিযোগ বিবেচনার জন্য ‘পুলিশ অভিযোগ কর্তৃপক্ষ’-এর কথা বলা আছে। সেখানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অথবা জাতীয় পর্যায়ে অবস্থান ও খ্যাতিসম্পন্ন একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি পুলিশ অভিযোগ কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশে ন্যায়পালও নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
প্রথম আলো পুলিশ অধ্যাদেশের এই খসড়া প্রণয়ন কমিটিতে আপনি ছিলেন। পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে খসড়ায় কী কী প্রস্তাব রয়েছে?
এএসএম শাহজাহান খসড়ায় জাতীয় পুলিশ কমিশনের কথা বলা আছে। এই কমিশন পুলিশপ্রধান নিয়োগের জন্য অতিরিক্ত আইজিপির নিম্নপদস্থ নয় এমন পাঁচজন কর্মকর্তার মধ্য থেকে তিনজনের নাম সুপারিশ করবে। এটি বাস্তবায়ন করা গেলে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় যখন তখন পুলিশপ্রধান নিয়োগ বা সরানোর সুযোগ নিয়ন্ত্রণ করা যেত। পুলিশ বিভাগ যেভাবে চলে আসছে, তা অনেকটা মন্ত্রী ও রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে চলছে। বর্তমান ব্যবস্থায় পুলিশের কাজের ওপর অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের সুযোগ রয়েছে।
প্রথম আলো এসপিদের জেলা প্রশাসকের অধীনে রাখার বিষয়টি নিয়েও মতভেদ রয়েছে। এ নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এএসএম শাহজাহান আসলে এসপিদের জেলা প্রশাসকদের অধীনে রাখার বিষয়টিও ঔপনিবেশিক আমলের একটি বিধি। সে সময় সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় জেলা প্রশাসন পুলিশকে ব্যবহার করত। বর্তমানে সেই পরিস্থিতি নেই। এখন অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে এসপিকে তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য জবাবদিহি করাই সমীচীন।
প্রথম আলো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ কোনো মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত নিশ্চিত করতে কী কী দিকে বাড়তি নজর থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
এএসএম শাহজাহান এ ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তার পেশাগত ও আইনি দক্ষতার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় কারিগরি সমর্থনের বিষয়টি খুবই জরুরি। কারিগরি দিকের মধ্যে রয়েছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের বিষয়টি নিশ্চিত করা। লাই ডিটেক্টর বা এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের কক্ষ বা জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি ভিডিও করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তদন্তকারী কর্মকর্তার ওপর অবাঞ্ছিত প্রভাব পড়ে এমন কিছু করা থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিরত থাকতে হবে। অনেক সময় তদন্ত চলাকালে মন্ত্রী বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এমন মন্তব্য শোনা যায়, যা সুষ্ঠু তদন্ত-প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ ধরনের মন্তব্য পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে। তদন্তের ব্যাপারে যেকোনো মন্তব্য করার আগে সতর্ক থাকতে হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তা অন্যায়ভাবে প্রভাবিত হতে পারেন, বা ভয়ে ভয়ে তদন্ত পরিচালনা করতে হয় এমন কোনো অবস্থা সৃষ্টি হলে তদন্তের মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
প্রথম আলো আমরা দেখি, সন্দেহভাজন অনেককে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার করে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হয়। আদালতে তাঁদের কেউ কেউ পরে নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারেন। গ্রেপ্তার করে কাউকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা কতটুকু সমর্থনযোগ্য?
এএসএম শাহজাহান আদালতে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বিবেচনা করা ঠিক নয়। তদন্ত-প্রক্রিয়ায়ও কাউকে অযথা হয়রানি করা যাবে না। আমি মনে করি, ঘটনা ঘটার সময় তাৎক্ষণিক কিছু ঘটতে পারে। গণমাধ্যম সেখানে উপস্থিত ও কর্মতৎপর থাকতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রে এমনটি করা ঠিক নয়। আমরা যদি কোনো সন্দেহভাজন অপরাধীকে গণমাধ্যমে হাজির করি, তবে অপরাধীকে শনাক্ত করার তদন্ত অথবা টি আই প্যারেড মূল্য হারিয়ে ফেলবে।
প্রথম আলো পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে। এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যে বিভাগীয় তদন্ত হয়, তাতে তা প্রমাণ করা কঠিন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক নানা দিক বিবেচনায় কিছু ঘটনা জনগণের মনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবেই বিবেচিত হয়। এ ধরনের ঘটনার ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
এএসএম শাহজাহান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত আছে এমন দেশে বিচার না করে কাউকে হত্যা করার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, এ ধরনের মৃত্যুকে খুন হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। যে ঘটনাগুলো ঘটে, সেগুলোকে সাধারণত ‘এনকাউন্টার’ বা ‘ক্রসফায়ার’—এ ধরনের নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আইনের দৃষ্টিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু ঘটনাগুলো বিশ্বাসযোগ্য কি না, সেটাই প্রশ্ন। প্রথমত, যাকে গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়েছে, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এ জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এর পরও যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে এবং ঘটনার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তবে সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের মৃত্যুর ক্ষেত্রে যথাযথ পোস্টমর্টেম ও সুরতহালের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছে, তা জানা সহজ হয়। আমি মনে করি, এ ধরনের ঘটনার পোস্টমর্টেম ও সুরতহালের ভিডিও হওয়া উচিত। আমি যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে চাই, তা হলো মানসিকতা। পুলিশের মনোভাব এমন হতে হবে, যাতে তাদের হাতে কখনো কাউকে আইনবহির্ভূতভাবে মারা পড়তে না হয়। যাঁরা পুলিশকে পরিচালনা করেন, সেই রাজনৈতিক শক্তিরও একই মানসিকতা থাকতে হবে। ধৈর্য ধারণ করার শক্তি হচ্ছে পুলিশের বড় শক্তি। বিক্ষোভ দমনে অনেক সময় আমরা পুলিশকে যথেষ্ট মারমুখী দেখি। ক্ষমতার প্রয়োগ জরুরি হলে আইনানুগভাবে ন্যূনতম ক্ষমতা প্রয়োগ করা উচিত।
প্রথম আলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব। এখন এলিট বাহিনী হিসেবে র্যাব বেশি সক্রিয়। র্যাবের মূল কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা মূলত সামরিক বাহিনী থেকে আসা। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ-প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সে বিবেচনায় র্যাবের ভূমিকা এবং এতে পুলিশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন কি?
এএসএম শাহজাহান এলিট বাহিনী থাকতেই পারে। পুলিশ কাজ করছে, র্যাবও কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে যদি প্রতিযোগিতার মনোভাব থাকে, তবে তা খুবই ইতিবাচক। এতে পুলিশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে পারে এমন কোনো বিষয় নেই। এটা ঠিক যে পুলিশের প্রশিক্ষণ-প্রক্রিয়া ও র্যাবের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও ক্রমবর্ধমান অপরাধের যে ধারা, তাতে অনেক ক্ষেত্রে সামরিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মাঝে জেএমবির জঙ্গি তৎপরতা দেশকে যে বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল, সেই চক্রের বিরুদ্ধে র্যাব প্রশংসনীয় সফলতা দেখিয়েছে। এ ধরনের সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য ভালো।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
এএসএম শাহজাহান ধন্যবাদ।
No comments