স্মরণ-পুঁথির জন্য জীবনপাত by আবদুর রাজ্জাক
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ ও সাহিত্যের ঐতিহ্য অন্বেষণের ক্ষেত্রে এক বিরল ব্যক্তিত্ব। উচ্চশিক্ষা বলতে যা বোঝায়, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের তা ছিল না। ঐশ্বর্যের মধ্যে তিনি লালিত-পালিত হননি—জীবনকাল অতিবাহিত হয়েছে দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটনে।
যত দিন যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বিনির্মাণে তাঁর কাজের গুরুত্ব ক্রমে স্বীকৃতি পাচ্ছে। আজ তাঁর ৫৭তম মৃত্যুবার্ষিকী।
উপমহাদেশের বরেণ্য পুঁথিগবেষক ১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাতৃজঠরে থাকতেই আবদুল করিম পিতৃহীন হন। তাঁর চাচা আছিরুদ্দীনের স্নেহে লালিত-পালিত হন তিনি। স্থানীয় সুচক্রদণ্ডী বঙ্গ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় তাঁর। ১৮৯৩ সালে তিনি স্থানীয় পটিয়া ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। উচ্চশিক্ষার অর্জনের জন্য তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। এফএ (বর্তমান এইচএসসি) পরীক্ষা দেওয়ার আগেই শারীরিক অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে তাঁকে পড়ালেখা ছেড়ে দিতে হয়। তবে এর মধ্যেই সংস্কৃত ভাষায় তিনি পাণ্ডিত্য অর্জনে সক্ষম হন।
সাহিত্যবিশারদের কর্মজীবনের সূচনা শিক্ষকতা দিয়ে। তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল এবং পরে সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। সরকারি চাকরির মোহেই তিনি শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চট্টগ্রাম জজ কোর্টে কেরানির পদে চাকরি করেন। তখন কমিশনারের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছিলেন কবি নবীনচন্দ্র সেন। নবীন সেন আবদুল করিমের লোকসাহিত্যপ্রীতি ও তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার খবর জানতেন। সে কারণে তিনি আবদুল করিমকে স্নেহ করতেন। আবদুল করিম স্থানীয় জ্যোতি পত্রিকায় এক বিজ্ঞপ্তি ছাপালেন, ‘যাঁরা আমাদের হাতের লেখা পুঁথি সংগ্রহ করে দেবেন, তাঁদের বিনা মূল্যে এক বছর জ্যোতি পত্রিকা দেওয়া হবে।’
তাঁর বিশ্বাস ছিল, প্রাচীন পুঁথিগুলো সংগৃহীত ও উপযুক্তভাবে সংরক্ষিত না হলে প্রাচীন সাহিত্যের বিপুল ভান্ডার লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যাবে, হারিয়ে যাবে ঐতিহ্যের মূল্যবান উপকরণ। তাই শারীরিক-সাংসারিক কষ্ট স্বীকার করে, বহু লাঞ্ছনা ও অপমান সহ্য করে পুঁথি সংগ্রহ করেছেন তিনি।
ছোটকালে তাঁর বাড়িতে অনেকবার পুঁথির আসর বসেছে। পুঁথির প্রতি তাঁর একটা আগ্রহ তৈরি হয়। প্রথম যে পাণ্ডুলিপিটির সন্ধান পান তিনি, সৌভাগ্যক্রমে সেই পুঁথি ছিল আলাওলের পদ্মাবতী। তখন তিনি আনোয়ারা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ওখানে এক চাষির ঘরে তিনি পুঁথিটি পান। এই পুঁথির আবিষ্কার তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, নতুন পুঁথি আবিষ্কারের নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। সাহিত্যের গবেষণায় তিনি সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাঁর কাজের ফলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নতুন করে লেখার প্রয়োজন পড়ে।
তাঁর সংগৃহীত পুঁথির সংখ্যা আড়াই হাজারেরও অধিক বলে জানা যায়। এর মধ্যে মুসলিম কবি রচিত পুঁথির সংখ্যা এক হাজার দুই শয়ের ওপরে বলে অনুমান করা হয়। পুঁথি সংগ্রহ করেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। পুঁথি তিনি সম্পাদনা করেছেন, পুঁথির পরিচিতি লিখেছেন এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিরন্তর লিখে গেছেন। তিনি প্রায় ৬০০ মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেন, যার প্রধান বিষয় ছিল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। সে সময়কার প্রধান প্রধান পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। সাধনা, কোহিনুর, নবনূর, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, এডুকেশন গেজেটের মতো উন্নত পত্রিকায় তাঁর রচনা ছাপা হতো। একাধিক পত্রিকার তিনি সম্পাদক ছিলেন। তিনি তাঁর বিপুল সংগ্রহ থেকে প্রায় ৬০০ পুঁথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন। আরও ৪৫০টি পুঁথি তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে অধ্যাপক আহমদ শরীফ দান করেন বরেন্দ্র মিউজিয়ামে।
শুধু সংখ্যা দিয়ে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সংগ্রহের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যাবে না। এই সংগ্রহের ফলেই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বহু অপরিজ্ঞাত কবি, অজ্ঞাতপূর্ব কাব্য ও অপরিচিত তথ্যের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি। শাহ্ মুহাম্মদ সগীর, জয়নুদ্দীন, সৈয়দ সুলতান, দৌলত উজীর বাহারাম খান, মুহাম্মদ কবীর, শাবিরিদ খান, শেখ চাঁদ, মুহাম্মদ খান, আলী রাজা প্রভৃতি কবির কথা তাঁর মাধ্যমে জানা গেছে। শ্রীধরের বিদ্যাসুন্দর কিংবা ভবানী , গোপীচন্দের পাঁচালী তাঁরই সংগৃহীত।
আজীবন সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ চট্টগ্রামের সুধীসমাজ তাঁকে ‘সাহিত্যবিশারদ’ এবং নদীয়ার পণ্ডিতসমাজ তাঁকে ‘সাহিত্যসাগর’ উপাধি দেন। সাহিত্যবিশারদ প্রথম সংগ্রাহক, যিনি অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কবিদের রচিত পুঁথি সংগ্রহ করেছেন। তদানীন্তন ব্রিটিশ-শাসিত পূর্ববাংলায় সাহিত্যবিশারদ একমাত্র সাহিত্যব্যক্তিত্ব, যিনি মধ্যযুগের রচিত বাংলা সাহিত্যের পুঁথি সংগ্রহে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর অবদানের কথা উল্লেখ করে আহমদ শরীফ বলেন, তাঁর সংগৃহীত পুঁথিই আজ সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুসলমানদের মুখ রক্ষা করেছে। দীর্ঘদিন তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এ কর্মীপুরুষ ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মারা যান।
উপমহাদেশের বরেণ্য পুঁথিগবেষক ১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাতৃজঠরে থাকতেই আবদুল করিম পিতৃহীন হন। তাঁর চাচা আছিরুদ্দীনের স্নেহে লালিত-পালিত হন তিনি। স্থানীয় সুচক্রদণ্ডী বঙ্গ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় তাঁর। ১৮৯৩ সালে তিনি স্থানীয় পটিয়া ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। উচ্চশিক্ষার অর্জনের জন্য তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। এফএ (বর্তমান এইচএসসি) পরীক্ষা দেওয়ার আগেই শারীরিক অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে তাঁকে পড়ালেখা ছেড়ে দিতে হয়। তবে এর মধ্যেই সংস্কৃত ভাষায় তিনি পাণ্ডিত্য অর্জনে সক্ষম হন।
সাহিত্যবিশারদের কর্মজীবনের সূচনা শিক্ষকতা দিয়ে। তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল এবং পরে সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। সরকারি চাকরির মোহেই তিনি শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চট্টগ্রাম জজ কোর্টে কেরানির পদে চাকরি করেন। তখন কমিশনারের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছিলেন কবি নবীনচন্দ্র সেন। নবীন সেন আবদুল করিমের লোকসাহিত্যপ্রীতি ও তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার খবর জানতেন। সে কারণে তিনি আবদুল করিমকে স্নেহ করতেন। আবদুল করিম স্থানীয় জ্যোতি পত্রিকায় এক বিজ্ঞপ্তি ছাপালেন, ‘যাঁরা আমাদের হাতের লেখা পুঁথি সংগ্রহ করে দেবেন, তাঁদের বিনা মূল্যে এক বছর জ্যোতি পত্রিকা দেওয়া হবে।’
তাঁর বিশ্বাস ছিল, প্রাচীন পুঁথিগুলো সংগৃহীত ও উপযুক্তভাবে সংরক্ষিত না হলে প্রাচীন সাহিত্যের বিপুল ভান্ডার লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যাবে, হারিয়ে যাবে ঐতিহ্যের মূল্যবান উপকরণ। তাই শারীরিক-সাংসারিক কষ্ট স্বীকার করে, বহু লাঞ্ছনা ও অপমান সহ্য করে পুঁথি সংগ্রহ করেছেন তিনি।
ছোটকালে তাঁর বাড়িতে অনেকবার পুঁথির আসর বসেছে। পুঁথির প্রতি তাঁর একটা আগ্রহ তৈরি হয়। প্রথম যে পাণ্ডুলিপিটির সন্ধান পান তিনি, সৌভাগ্যক্রমে সেই পুঁথি ছিল আলাওলের পদ্মাবতী। তখন তিনি আনোয়ারা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ওখানে এক চাষির ঘরে তিনি পুঁথিটি পান। এই পুঁথির আবিষ্কার তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, নতুন পুঁথি আবিষ্কারের নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। সাহিত্যের গবেষণায় তিনি সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাঁর কাজের ফলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নতুন করে লেখার প্রয়োজন পড়ে।
তাঁর সংগৃহীত পুঁথির সংখ্যা আড়াই হাজারেরও অধিক বলে জানা যায়। এর মধ্যে মুসলিম কবি রচিত পুঁথির সংখ্যা এক হাজার দুই শয়ের ওপরে বলে অনুমান করা হয়। পুঁথি সংগ্রহ করেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। পুঁথি তিনি সম্পাদনা করেছেন, পুঁথির পরিচিতি লিখেছেন এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিরন্তর লিখে গেছেন। তিনি প্রায় ৬০০ মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেন, যার প্রধান বিষয় ছিল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। সে সময়কার প্রধান প্রধান পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। সাধনা, কোহিনুর, নবনূর, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, এডুকেশন গেজেটের মতো উন্নত পত্রিকায় তাঁর রচনা ছাপা হতো। একাধিক পত্রিকার তিনি সম্পাদক ছিলেন। তিনি তাঁর বিপুল সংগ্রহ থেকে প্রায় ৬০০ পুঁথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন। আরও ৪৫০টি পুঁথি তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে অধ্যাপক আহমদ শরীফ দান করেন বরেন্দ্র মিউজিয়ামে।
শুধু সংখ্যা দিয়ে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সংগ্রহের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যাবে না। এই সংগ্রহের ফলেই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বহু অপরিজ্ঞাত কবি, অজ্ঞাতপূর্ব কাব্য ও অপরিচিত তথ্যের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি। শাহ্ মুহাম্মদ সগীর, জয়নুদ্দীন, সৈয়দ সুলতান, দৌলত উজীর বাহারাম খান, মুহাম্মদ কবীর, শাবিরিদ খান, শেখ চাঁদ, মুহাম্মদ খান, আলী রাজা প্রভৃতি কবির কথা তাঁর মাধ্যমে জানা গেছে। শ্রীধরের বিদ্যাসুন্দর কিংবা ভবানী , গোপীচন্দের পাঁচালী তাঁরই সংগৃহীত।
আজীবন সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ চট্টগ্রামের সুধীসমাজ তাঁকে ‘সাহিত্যবিশারদ’ এবং নদীয়ার পণ্ডিতসমাজ তাঁকে ‘সাহিত্যসাগর’ উপাধি দেন। সাহিত্যবিশারদ প্রথম সংগ্রাহক, যিনি অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কবিদের রচিত পুঁথি সংগ্রহ করেছেন। তদানীন্তন ব্রিটিশ-শাসিত পূর্ববাংলায় সাহিত্যবিশারদ একমাত্র সাহিত্যব্যক্তিত্ব, যিনি মধ্যযুগের রচিত বাংলা সাহিত্যের পুঁথি সংগ্রহে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর অবদানের কথা উল্লেখ করে আহমদ শরীফ বলেন, তাঁর সংগৃহীত পুঁথিই আজ সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুসলমানদের মুখ রক্ষা করেছে। দীর্ঘদিন তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এ কর্মীপুরুষ ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মারা যান।
No comments