আঞ্চলিক রাজনীতি: বগুড়া-গত খুনের পরে, পরের খুনের আগে by ফারুক ওয়াসিফ

গত বিএনপি জোট সরকারের আমলে যেসব জেলা শহর ‘টাউন’ থেকে সিটিতে প্রমোশন পেয়েছে, বগুড়া তাদের মধ্যে তারকাসম। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে শতকোটি টাকার ওপরে ব্যয় হয়েছে। সড়ক ও তার দুই পাশের বাহার বেড়েছে। সড়কদ্বীপ, সোডিয়াম বাতি, মনোরম পার্ক, সবুজ বৃক্ষরাজি মিলিয়ে চোখের আরাম হয়।


এসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শহরবাসীর একাংশের আয়ও অনেক বেড়েছে। নতুন গাড়ি এসেছে অনেক, ঢাকার মতো চমৎকার স্থাপত্যের বাড়ি বেড়েছে। সব মিলিয়ে বগুড়া যেন এক সুখী ও সচ্ছল শহরের মডেল।
কিন্তু ফুলবাগানে সাপের মতো এই সুখী জীবনযাত্রার তলায় রক্তের দাগ, অস্ত্রের ঝনঝনানি, মাদকের তুমুল ছড়াছড়ি। বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ডের নিচে, নতুন রং করা দেয়ালের গায়ে চলতে চলতে চোখে পড়বেই দুই ধরনের পোস্টার। কোনো পোস্টারে টকটকে অক্ষরে অমুকের খুনের বিচারের দাবি; কোনো পোস্টারে তমুকের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ যে মিথ্যা, সেই দাবি। পোস্টারগুলোয় তরুণের রক্তমাখা বীভৎস দেহ আর অভিযুক্ত খুনির টকটকে রঙিন প্রতিকৃতি যেন দেয়ালের গায়ে মৃত আর জীবিতের পুরোনো হানাহানিরই ধারাবাহিকতা। ওদিকে পুরোনো খুনের জায়গা নেয় নতুন খুন, নতুন পোস্টার পড়ে। শহরের মানুষ আবার চঞ্চল হয়। অনেক সময় সিনেমার পোস্টারকে খুনের সচিত্র বিবরণ মনে হয়, আবার খুন হওয়া যুবকের রক্তাক্ত ছবিকে মনে হয় নতুন কোনো মারমার-কাটকাট সিনেমার পোস্টার। শহরবাসীর মধ্যে ভয় বাড়ে। এ রকম অবস্থায়ই সান্ধ্য আড্ডায় কাউকে বলতে শোনা যায়, ‘আজ দিন তো গেল, কাল কে খুন হবে?’
খুন তো বাংলাদেশে হরহামেশাই হয়, এ আবার নতুন কি! নতুন এটাই—খুনের শিকার আর খুনের দায়ে অভিযুক্তদের সবারই বয়স, শ্রেণী আর দল এক। সবাই ক্ষমতাসীন দলের উঠতি তরুণ নেতা-কর্মী। কেউ ছাত্রনেতা, কেউ শ্রমিকনেতা, কেউ থানা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। ক্ষমতাসীন দলের তরুণ কর্মীদের মধ্যে খুনোখুনির হিড়িক কিসের ইঙ্গিত? কিসে তৈরি হলো এই ক্রমিক খুনের বাস্তবতা?
গত আমলে তারেক জিয়ার উন্নয়নযজ্ঞের সময় বগুড়ায় এত রাজনৈতিক কোন্দল ও খুনোখুনি ছিল না। সে সময় জেলাজুড়ে অজস্র উন্নয়নযজ্ঞে বিপুল সরকারি টাকা ঢালা হয় এবং তা ঠিকাদারিসহ নানা চ্যানেলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বাটোয়ারার ব্যবস্থাও দাঁড়িয়ে যায়। ক্ষমতার সুফল নিয়ে কামড়াকামড়িও তাতে কমে। যে রিকশায় চড়ত, সে মোটরসাইকেল কেনে; যে মোটরসাইকেলে চড়ত, সে গাড়ি কেনে। অনেকেই সুরম্য অট্টালিকা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যায়। এবং দিন বদলায়। তাদেরটা তাদেরই থাকলেও আগের ‘খাই খাই’ দঙ্গলের জায়গায় আসে নতুন এক দঙ্গল। এদিকে সরকারি অর্থের সেই ঢল প্রায় বন্ধ। নতুন সোনার ছেলেরা তবে কী খাবে? তারা তখন চারপাশে তাকায় এবং পদ, ব্যবসাসহ যে যা পারে, তা অধিকার করে বসে।
রাজনৈতিক ক্ষমতার বরাতে দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের যে তরিকা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সবকিছু ভেঙেচুরে বিত্তবৈভব অর্জনের যে ধারা রাজনীতির ময়দানে কায়েম হয়েছে, বাজার-অর্থনীতির সুবাদে কাঁচা টাকার যে ঢল বাজারকে ধুইয়ে দিচ্ছে, পণ্যের যে নেশা ছেলে-বুড়ো সবার মনে-মজ্জায় ঢুকে গেছে, কার সাধ্য আছে তার বাইরে মুখ গোমড়া করে বসে থাকে? ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নয়ন, নির্মাণ, জমি বিক্রি, পরিবহনব্যবসা থেকে শুরু করে যেখানেই টাকা বা সম্পদ লেনদেনের বিষয় আছে, সেখানেই রাজনীতির হেজিপেজিরা হাজির। এসব খুনোখুনি ও দলীয় কোন্দলের অদৃশ্য সুতা ধরে এগোলে তাই পাওয়া যাবে কোনো না কোনো নেতা, পাতিনেতা, সাংসদ ও গডফাদারকে। সমাজ-অর্থনীতির হেন কোনো স্থান নেই, যেখানে তাদের জাল ছড়ানো নেই। তলার দিকের ক্যাডার ও কর্মীদের বন্দুকযুদ্ধ, খুনোখুনি এদের ইন্ধন ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব হওয়ার কথা নয়। এদের দাপটেই পুলিশ ও প্রশাসন অকার্যকর হয়ে যায়, কিংবা সানন্দে নিজেদের ভাগ পেয়ে খুশি থাকে। পরিস্থিতি কতটা নাজুক, তা বোঝা যায় সরকারি কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে পাবনায় স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীদের সশস্ত্র তাণ্ডব ও প্রহারের ঘটনায়। এদিকে বগুড়ায় প্রশাসন এতটাই নিস্তেজ যে এ রকম তাণ্ডবের প্রয়োজন পড়ে না। দলীয় পদের মগডালে বসে থাকা ব্যক্তিরা ক্ষমতার ছুমন্তর দিয়ে তাদের অবশ করে রাখতে পারছেন।
প্রথম আলোর গত ২৩ তারিখের প্রতিবেদন বলছে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ও বালুর ব্যবসা, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজির ভাগই এসব রক্তপাতের কারণ। অভিযোগ এই, সম্প্রতি শ্রমিক লীগের দুই নেতা-কর্মীর খুনের পেছনেও যে নতুন চালু হওয়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে দৈনিক ওঠানো বখরার কর্তৃত্ব নিয়ে কোন্দল। কিছুদিন পরপরই শহর বা শহরতলিতে দুই গ্রুপের মধ্যে টানা বন্দুকযুদ্ধও ঘটতে দেখা যায়। এসবে ব্যবহূত হচ্ছে ১৭ থেকে ২০ বছর বয়সী কিশোর-তরুণেরা। এই বয়সী তরুণদের মধ্যে নানা কারণে অপরাধপ্রবণতা বেশি। এ বয়সেই ‘বড়দের মতো’ কিছু করার আগ্রহ দানা বাঁধে। ওপর থেকে নেতারা আর হিন্দি ছবির সুপার-ডুপার অ্যাকশন হিরোরা তাদের সেই প্ররোচনা জুগিয়ে যান। এভাবেই তারা হয়ে ওঠে ‘মরদ’। ১৮ বছর বয়সের দারুণ দুঃসাহসে একসময়কার তরুণেরা দেশোদ্ধারে নামত, বা প্রেমের আবেগে কাতর হতো, এখন তাদের অনেকেই হয় বখরাবাজ মাস্তান আর তরুণীদের জ্বালাতনকারী বখাটে। এরাই নাকি আমাদের ভবিষ্যৎ জাতীয় নেতৃত্ব?
বগুড়ার এই বালু ব্যবসায়ী, পাতি শ্রমিকনেতা, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীদের অনেকেরই উত্থান সমাজের তলার শ্রেণীগুলো থেকে। বিত্ত ও ক্ষমতার যে লালসা রাজনৈতিক অ্যানথ্রাক্স মহামারির মতো ছড়িয়েছে, তা সমাজের অনেকের মধ্যেই ঈর্ষা ও হিংসার জন্ম দিচ্ছে। রাজনীতিই তাদের কাছে দ্রুত বড়লোক হওয়ার শর্টকাট উপায়। বাজার-অর্থনীতির ভোগের হাতছানি তাদের মধ্যে পোশাক, ইলেকট্রনিক উপকরণ, গাড়ি-বাড়ি তথা বিলাসের চুম্বক তাদের টানছে। ওপরের লোক হতে চায় একচেটিয়া, মাঝের লোক উঠতে চায় ওপরে, আর তলার তরুণদের কাজ হচ্ছে এদের লেজুড় হয়ে কোলে ঝোল টানা।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সুবাদে বাংলাদেশে এখন তরুণেরাই একক বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। ঢাকা থেকে মফস্বল শহরের সবখানেই ২০-৩০ বছর বয়সীদের আনাগোনা। উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে রাজনৈতিক দলের ক্যাডারবৃত্তিই এদের একটা অংশের বিকল্প কর্মসংস্থান। পারিবারিক বা সামাজিক নৈতিকতায় এসব আর নিন্দনীয় নয়। নিন্দা যা কিছু, তা খবরের কাগজের সংবাদ বা কলামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা জানে, একবার বড়লোক হয়ে গেলে ‘স্ট্যাটাস’ বা সম্মান আপসে আপ নিউটনের আপেলের মতো হাতে এসে পড়বে।
বিএনপির আমলে তারেক জিয়া ‘উন্নয়নের রাজনীতি’ ও ‘তৃণমূল গণতন্ত্রের’ নামে বগুড়াকে আদর্শ রাজনৈতিক মডেল হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত দুর্নীতির আদর্শে বগুড়ার তারুণ্যকে তিনি অনেকটা প্রভাবিতও করেছেন। বর্তমান আওয়ামী লীগের আমলে তারই ধারাবাহিকতা। সরকারদলীয় কাঠামো ও কমিটিগুলো অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের মানবমেশিন। নব্বইয়ের দশক থেকে জেলা ও মফস্বলগুলোতে রাজনীতি ও সমাজের যে দুর্বৃত্তকরণ অবাধে চলেছিল, তার ফল এখন পেকে টসটসে। আগের খুনটির পরে এবং পরের খুনের আগে আমাদের ভাবতে হবে সমৃদ্ধি, লুটপাট আর মাফিয়াতন্ত্রের মিশেলে গণতন্ত্রের কী হাল হয়?
জেলা পর্যায়ে সাংসদ ও জেলা কমিটির নেতারা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বশীলতার চর্চা হওয়ার কথা। সংসদের মতো স্থানীয় কমিটিগুলোকেও হতে হয় নির্বাচিত ও জবাবদিহিমূলক। কিন্তু দেখা যায়, অনেক জেলা শহরের মতো বগুড়াতেও এ ধরনের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বের বালাই নেই। স্বার্থের ভিত্তিতে জোট বাঁধা বিভিন্ন গোষ্ঠীই যখন পিরামিডের মতো শীর্ষে একজন বা দুজন আঞ্চলিক অধীশ্বরের অধীনে কাজ করে, তখন কাকে বলব দল, কাকে বলব রাজনীতি, আর কাকে বলব গণতন্ত্র?
বলা হয়, পুলিশ আর সমাজতাত্ত্বিকের মধ্যে পার্থক্য হলো, যার হাত দিয়ে অপরাধ হয়েছে, পুলিশ কেবল তাকেই খোঁজে; আর সমাজতাত্ত্বিক দায়ী ব্যক্তিটি ছাড়া সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি সবকিছুকেই দোষী করেন। আমাদের তাকাতে হবে দুখানেই। বগুড়ায় ২১ মাসে ২০ খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র ১১ জন। পোস্টারে যাদের নাম আসে না, খুনের দৃশ্যে যারা অদৃশ্য থাকে, তাদের দিকে চোখ তুলে তাকানো বারণ। তাদের ক্ষমতা তেজস্ক্রিয়, তাকালেই চোখ পুড়ে যেতে পারে। রাজনীতির নীতিনির্ধারকদের অনেকেরই নজর যার যার নাগের ডগা থেকে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত। গণতন্ত্রের উদর কি এতই বড় যে সেখানে সব অন্যায়ই এঁটে যায়? গণতন্ত্র কি তাহলে রূপকথার সেই পেলিক্যান পাখি, যে নিজের বুকের রক্ত খেয়েই বাঁচে?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.