ইউরোপের চিঠি-মার্কিন-সৌদি অস্ত্র চুক্তি: আরেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতি? by পিটার কাস্টার্স
পরিকল্পিত মার্কিন-সৌদি অস্ত্র চুক্তির নানা দিক এখনই সাধারণ্যে আলোচিত হওয়া জরুরি। কেননা এই চুক্তির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, বিপুল তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবের কাছে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির নতুন চুক্তি অনুমোদন করার দ্বারপ্রান্তে মার্কিন কংগ্রেস। চুক্তিটি হবে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের।
অস্ত্র সরবরাহ চলবে ১০ বছর ধরে। সম্ভাব্য এ চুক্তিকে এরই মধ্যে ইতিহাসের অন্যতম বড় অস্ত্র চুক্তি হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।
চুক্তির প্রধান দিক হলো, এতে সৌদি আরবে ৮৫টি এফ-১৫ যুদ্ধবিমান পাঠানো এবং অতীতে পাঠানো এ ধরনের ৭০টি যুদ্ধবিমানকে উন্নীতকরণের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সামরিক বিমান হিসেবে এফ-১৫ মডেলটি অপেক্ষাকৃত পুরোনো, কিন্তু আকাশযুদ্ধে প্রতিপক্ষের ক্ষতিসাধনের উপায় হিসেবে অত্যন্ত কার্যকর বলে পরিচিত। এর প্রস্তুতকারক বোয়িং করপোরেশন পেন্টাগনে অস্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। তা ছাড়া এটি বিশ্বায়িত অস্ত্রশিল্পের অন্যতম করপোরেশন। এ চুক্তি নিশ্চয়ই বোয়িং, ইউনাইটেড টেকনোলজিস এবং অন্য সুবিধাভোগীদের অনুপ্রাণিত করবে। কংগ্রেসকে প্রভাবিত করতে তারা লবি করে যাচ্ছিল। মধ্যপ্রাচ্যে গত ৩০ বছরে কয়েকটি যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। অত্যন্ত সংঘাতমুখর এ অঞ্চলে এই চুক্তির ফল কেমন করে মূল্যায়ন করা যায়? অতীতে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এখানে বহুবার অস্ত্র রপ্তানি করেছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এই চুক্তিকে কীভাবে যাচাই করা যায়?
সর্বাগ্রে বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র ইসরায়েল মার্কিন-সৌদি চুক্তির ব্যাপারে কোনো আপত্তি না জানিয়ে বরং ‘সবুজ সংকেত’ পাঠিয়েছে। পরিকল্পিত চুক্তি নিয়ে উত্তেজনা প্রশমন করে এর পথ মসৃণ করতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাকের ওয়াশিংটন সফর জরুরি হয়ে পড়েছিল বলে মনে হয়। ইসরায়েলের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে এ চুক্তি সাংঘর্ষিক হতে পারে—ইসরায়েলের এমন আশঙ্কা দূর করা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রাপ্ত ব্যাখ্যাটি হলো, ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান জানিয়েছে, এফ-১৫ যুদ্ধবিমানগুলোয় সেন্সর ও এমন প্রযুক্তি থাকবে, যা একই ধরনের ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে ব্যবহূত হওয়া প্রতিহত করবে। অন্যদিকে সৌদি আরবের কাছে এফ-১৫ বিক্রির সমান্তরালে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের কাছে বিক্রি করবে সর্বাধুনিক সামরিক যুদ্ধবিমান মার্টিন লকউডস এফ-৩৫। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভাব্য সব প্রতিপক্ষের চেয়ে আকাশপথে ইসরায়েলের আধিপত্য জারি থাকা নিশ্চিত হবে। ওয়াশিংটনের ওপর ইসরায়েল লবির প্রভাব কত ব্যাপক, তা মার্কিন-সৌদি চুক্তির এই ত্রিমুখী কূটনীতি থেকে আবারও দেখা যাচ্ছে। ফলে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের বিক্রি বাড়বে, যা মার্কিন অস্ত্র প্রস্তুতকারক এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার (জেএসএফ) নামের সমধিক পরিচিত এ যুদ্ধবিমানটি বিক্রির কৌশল থেকে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন সরকার সামরিক খাতের সঙ্গে তার সম্পর্ককে কেমন করে মার্কিন অর্থনীতির সার্বিক বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করছে।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোকপাত করার আগে দেখা যাক, মার্কিন-সৌদি অস্ত্র চুক্তি কীভাবে একটি পরম্পরার অংশ। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ওয়াশিংটন এ বিষয়ে নীতি প্রণয়ন করা শুরু করে। অশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্য তেল উৎপাদক রাষ্ট্রগুলো ১৯৭৩ সালে তেলসংকট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্কিন সরকারি কর্মকর্তারা একটি নতুন লেনদেনের কৌশল প্রণয়ন করেন। তেল উৎপাদক রাষ্ট্রগুলোর চাপ প্রতিহত করাকে অব্যাহত রাখার বদলে তখন থেকেই মার্কিন সরকার নতুন কৌশল নেয়। চেষ্টা চালাতে থাকে, মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর আয় বৃদ্ধি থেকে কীভাবে সুবিধা আদায় করে নিতে পারে। বিশেষত, সৌদি আরব ও ইরানকে(!) যুক্তরাষ্ট্র পরামর্শ দিয়েছিল তাদের বাড়তি আর্থিক সম্পদের বড় একটি অংশ পশ্চিমা অস্ত্র ক্রয়ে ব্যয় করার জন্য। এমন লেনদেন-ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্বশীল একটি চুক্তি হলো আল ইয়ামামাহ চুক্তি। ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরব এই বিনিময় চুক্তি অনুসরণ করেছে। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাজ্য অস্ত্র সরবরাহ করেছে সৌদি আরবকে। অশোধিত তেলের বিনিময়ে সরাসরি অস্ত্র দিয়েছে। বর্তমান মার্কিন-সৌদি চুক্তি আকারের দিক থেকে আল ইয়ামামাহ চুক্তির সমকক্ষ, যদিও বর্তমান চুক্তিটি বিনিময় চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু সৌদি সরকার অস্ত্র কিনতে তেলসম্পদের আয় থেকেই যে অর্থসংস্থান করবে, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
অবশ্য এ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত অতীতের এক নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সেই নীতিটি ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে ক্লিনটন প্রশাসন তৈরি করে। সেই সময় মার্কিন ব্যবসায়ী চক্রকে উদ্দীপিত করার প্রাথমিক শক্তি হিসেবে মার্কিন সরকার যেন আবারও সামরিক অর্থায়নের ওপর নির্ভর করতে পারে, সে জন্য পেন্টাগন নতুন ভাবনার বিকাশ ঘটায়। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য সামরিক ব্যয়ের ওপর প্রাথমিক নির্ভরতার ফলে আবারও অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হতে পারে, এ আশঙ্কা থেকে ক্লিনটন সরকার নতুন পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয়। তাত্ত্বিক দিক থেকে একে ‘সামরিক কেইনসবাদ’ বলে অভিহিত করা হয়। শুধু সামরিক বাজেট বাড়িয়ে যাতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টার পরিবর্তে মার্কিন সরকার অস্ত্র রপ্তানির ওপর আরও বেশি নির্ভর করে, সেই লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়। অস্ত্র রপ্তানির শীর্ষে ছিল জেএসএফ। নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ থেকে নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশকজুড়ে জেএসএফ ও অন্যান্য অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমত ইউরোপীয় দেশগুলোকে টার্গেট করেছিল। আর পরের সারিতে ছিল চীন ও ভারতের মতো এশিয়ার উদীয়মান শক্তি। তবে এখন মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র রপ্তানি মার্কিন অর্থনীতিতে বাড়তি উদ্দীপনা এনে দেবে, এমন আশা করা হচ্ছে। আরেকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, মার্কিন-সৌদি চুক্তির সমান্তরালে ইরাকি সামরিক বাহিনীর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি। সাম্প্রতিক খবর হলো, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মতো ইরাকও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য অস্ত্র কিনতে রাজি হয়েছে। সব মিলিয়ে এসব যুদ্ধাস্ত্রের মূল্য পড়বে ১৬ বিলিয়ন ডলার।
প্রশ্ন হলো, মধ্যপ্রাচ্যের ‘স্থিতিশীলতা’র প্রশ্নে এমন সব সমান্তরাল অস্ত্র বিক্রির কী প্রভাব পড়বে? যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কিন-সৌদি চুক্তির প্রধান লক্ষ্য স্থিতিশীলতা। সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে এই মাল্টিবিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনাকে সহজেই বিরাট ক্ষতি হিসেবে গণ্য করা যায়। এ ক্ষতি মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের ক্ষতি। তারা বিদেশি অস্ত্র কেনার জন্য অত্যন্ত চাপের মধ্যে আছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ব্যাপারে সংশয়ী হওয়ার মতো অনেক যুক্তি আছে। আবার ইতিহাসের দিকে তাকালে এ চুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণও পাওয়া যায়।
মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল অস্ত্র রপ্তানির পরিণতিতেই গত শতকের আশির দশকের পর তিনটি উপসাগরীয় যুদ্ধ বেধেছে—এ কথা বলা ঠিক হবে না। কেননা, তেলসম্পদ নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের বাসনাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। মার্কিন সরকারের এক বিবৃতি সেটিকে নিশ্চিত করে। তবে কোনো সন্দেহ নেই, সেসব নৃশংস যুদ্ধের পেছনে অন্যতম উপাদান ছিল অস্ত্র রপ্তানি। ১৯৯১ সালের দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের উদ্দেশ্য বাহ্যত কুয়েতকে স্বাধীন করা হলেও বিশ্বগণমাধ্যমের মতে, এ যুদ্ধ ব্যবহূত হয়েছিল প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্রের কার্যকারিতা প্রদর্শনের জন্য। প্যাট্রিয়ট নিক্ষেপণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাছ থেকে এ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে প্রলুব্ধ করেছে। আশির দশকের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরান ও ইরাকের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী পরিখাযুদ্ধ চলে। যুদ্ধরত দুই দেশের কাছেই পশ্চিমাদের অস্ত্র বিক্রির ফলে যুদ্ধের উত্তাপও বাড়ে। তাই অভ্যন্তরীণ ও ‘বহিস্থ’ সামরিক কেইনসবাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পুরোপুরি নির্ভরতার বাস্তবতায় অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক আগ্রহ আছে—মধ্যপ্রাচ্যের পর্যবেক্ষকদের এমন সন্দেহ কি অমূলক হবে? এবার যদি সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ না-ও বাধে, তবু মার্কিন স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা কি জরুরি নয়?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
পিটার কাস্টার্স: প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।
চুক্তির প্রধান দিক হলো, এতে সৌদি আরবে ৮৫টি এফ-১৫ যুদ্ধবিমান পাঠানো এবং অতীতে পাঠানো এ ধরনের ৭০টি যুদ্ধবিমানকে উন্নীতকরণের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সামরিক বিমান হিসেবে এফ-১৫ মডেলটি অপেক্ষাকৃত পুরোনো, কিন্তু আকাশযুদ্ধে প্রতিপক্ষের ক্ষতিসাধনের উপায় হিসেবে অত্যন্ত কার্যকর বলে পরিচিত। এর প্রস্তুতকারক বোয়িং করপোরেশন পেন্টাগনে অস্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। তা ছাড়া এটি বিশ্বায়িত অস্ত্রশিল্পের অন্যতম করপোরেশন। এ চুক্তি নিশ্চয়ই বোয়িং, ইউনাইটেড টেকনোলজিস এবং অন্য সুবিধাভোগীদের অনুপ্রাণিত করবে। কংগ্রেসকে প্রভাবিত করতে তারা লবি করে যাচ্ছিল। মধ্যপ্রাচ্যে গত ৩০ বছরে কয়েকটি যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। অত্যন্ত সংঘাতমুখর এ অঞ্চলে এই চুক্তির ফল কেমন করে মূল্যায়ন করা যায়? অতীতে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এখানে বহুবার অস্ত্র রপ্তানি করেছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এই চুক্তিকে কীভাবে যাচাই করা যায়?
সর্বাগ্রে বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র ইসরায়েল মার্কিন-সৌদি চুক্তির ব্যাপারে কোনো আপত্তি না জানিয়ে বরং ‘সবুজ সংকেত’ পাঠিয়েছে। পরিকল্পিত চুক্তি নিয়ে উত্তেজনা প্রশমন করে এর পথ মসৃণ করতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাকের ওয়াশিংটন সফর জরুরি হয়ে পড়েছিল বলে মনে হয়। ইসরায়েলের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে এ চুক্তি সাংঘর্ষিক হতে পারে—ইসরায়েলের এমন আশঙ্কা দূর করা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রাপ্ত ব্যাখ্যাটি হলো, ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান জানিয়েছে, এফ-১৫ যুদ্ধবিমানগুলোয় সেন্সর ও এমন প্রযুক্তি থাকবে, যা একই ধরনের ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে ব্যবহূত হওয়া প্রতিহত করবে। অন্যদিকে সৌদি আরবের কাছে এফ-১৫ বিক্রির সমান্তরালে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের কাছে বিক্রি করবে সর্বাধুনিক সামরিক যুদ্ধবিমান মার্টিন লকউডস এফ-৩৫। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভাব্য সব প্রতিপক্ষের চেয়ে আকাশপথে ইসরায়েলের আধিপত্য জারি থাকা নিশ্চিত হবে। ওয়াশিংটনের ওপর ইসরায়েল লবির প্রভাব কত ব্যাপক, তা মার্কিন-সৌদি চুক্তির এই ত্রিমুখী কূটনীতি থেকে আবারও দেখা যাচ্ছে। ফলে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের বিক্রি বাড়বে, যা মার্কিন অস্ত্র প্রস্তুতকারক এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার (জেএসএফ) নামের সমধিক পরিচিত এ যুদ্ধবিমানটি বিক্রির কৌশল থেকে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন সরকার সামরিক খাতের সঙ্গে তার সম্পর্ককে কেমন করে মার্কিন অর্থনীতির সার্বিক বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করছে।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোকপাত করার আগে দেখা যাক, মার্কিন-সৌদি অস্ত্র চুক্তি কীভাবে একটি পরম্পরার অংশ। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ওয়াশিংটন এ বিষয়ে নীতি প্রণয়ন করা শুরু করে। অশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্য তেল উৎপাদক রাষ্ট্রগুলো ১৯৭৩ সালে তেলসংকট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্কিন সরকারি কর্মকর্তারা একটি নতুন লেনদেনের কৌশল প্রণয়ন করেন। তেল উৎপাদক রাষ্ট্রগুলোর চাপ প্রতিহত করাকে অব্যাহত রাখার বদলে তখন থেকেই মার্কিন সরকার নতুন কৌশল নেয়। চেষ্টা চালাতে থাকে, মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর আয় বৃদ্ধি থেকে কীভাবে সুবিধা আদায় করে নিতে পারে। বিশেষত, সৌদি আরব ও ইরানকে(!) যুক্তরাষ্ট্র পরামর্শ দিয়েছিল তাদের বাড়তি আর্থিক সম্পদের বড় একটি অংশ পশ্চিমা অস্ত্র ক্রয়ে ব্যয় করার জন্য। এমন লেনদেন-ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্বশীল একটি চুক্তি হলো আল ইয়ামামাহ চুক্তি। ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরব এই বিনিময় চুক্তি অনুসরণ করেছে। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাজ্য অস্ত্র সরবরাহ করেছে সৌদি আরবকে। অশোধিত তেলের বিনিময়ে সরাসরি অস্ত্র দিয়েছে। বর্তমান মার্কিন-সৌদি চুক্তি আকারের দিক থেকে আল ইয়ামামাহ চুক্তির সমকক্ষ, যদিও বর্তমান চুক্তিটি বিনিময় চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু সৌদি সরকার অস্ত্র কিনতে তেলসম্পদের আয় থেকেই যে অর্থসংস্থান করবে, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
অবশ্য এ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত অতীতের এক নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সেই নীতিটি ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে ক্লিনটন প্রশাসন তৈরি করে। সেই সময় মার্কিন ব্যবসায়ী চক্রকে উদ্দীপিত করার প্রাথমিক শক্তি হিসেবে মার্কিন সরকার যেন আবারও সামরিক অর্থায়নের ওপর নির্ভর করতে পারে, সে জন্য পেন্টাগন নতুন ভাবনার বিকাশ ঘটায়। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য সামরিক ব্যয়ের ওপর প্রাথমিক নির্ভরতার ফলে আবারও অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হতে পারে, এ আশঙ্কা থেকে ক্লিনটন সরকার নতুন পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয়। তাত্ত্বিক দিক থেকে একে ‘সামরিক কেইনসবাদ’ বলে অভিহিত করা হয়। শুধু সামরিক বাজেট বাড়িয়ে যাতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টার পরিবর্তে মার্কিন সরকার অস্ত্র রপ্তানির ওপর আরও বেশি নির্ভর করে, সেই লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়। অস্ত্র রপ্তানির শীর্ষে ছিল জেএসএফ। নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ থেকে নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশকজুড়ে জেএসএফ ও অন্যান্য অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমত ইউরোপীয় দেশগুলোকে টার্গেট করেছিল। আর পরের সারিতে ছিল চীন ও ভারতের মতো এশিয়ার উদীয়মান শক্তি। তবে এখন মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র রপ্তানি মার্কিন অর্থনীতিতে বাড়তি উদ্দীপনা এনে দেবে, এমন আশা করা হচ্ছে। আরেকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, মার্কিন-সৌদি চুক্তির সমান্তরালে ইরাকি সামরিক বাহিনীর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি। সাম্প্রতিক খবর হলো, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মতো ইরাকও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য অস্ত্র কিনতে রাজি হয়েছে। সব মিলিয়ে এসব যুদ্ধাস্ত্রের মূল্য পড়বে ১৬ বিলিয়ন ডলার।
প্রশ্ন হলো, মধ্যপ্রাচ্যের ‘স্থিতিশীলতা’র প্রশ্নে এমন সব সমান্তরাল অস্ত্র বিক্রির কী প্রভাব পড়বে? যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কিন-সৌদি চুক্তির প্রধান লক্ষ্য স্থিতিশীলতা। সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে এই মাল্টিবিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনাকে সহজেই বিরাট ক্ষতি হিসেবে গণ্য করা যায়। এ ক্ষতি মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের ক্ষতি। তারা বিদেশি অস্ত্র কেনার জন্য অত্যন্ত চাপের মধ্যে আছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ব্যাপারে সংশয়ী হওয়ার মতো অনেক যুক্তি আছে। আবার ইতিহাসের দিকে তাকালে এ চুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণও পাওয়া যায়।
মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল অস্ত্র রপ্তানির পরিণতিতেই গত শতকের আশির দশকের পর তিনটি উপসাগরীয় যুদ্ধ বেধেছে—এ কথা বলা ঠিক হবে না। কেননা, তেলসম্পদ নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের বাসনাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। মার্কিন সরকারের এক বিবৃতি সেটিকে নিশ্চিত করে। তবে কোনো সন্দেহ নেই, সেসব নৃশংস যুদ্ধের পেছনে অন্যতম উপাদান ছিল অস্ত্র রপ্তানি। ১৯৯১ সালের দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের উদ্দেশ্য বাহ্যত কুয়েতকে স্বাধীন করা হলেও বিশ্বগণমাধ্যমের মতে, এ যুদ্ধ ব্যবহূত হয়েছিল প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্রের কার্যকারিতা প্রদর্শনের জন্য। প্যাট্রিয়ট নিক্ষেপণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাছ থেকে এ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে প্রলুব্ধ করেছে। আশির দশকের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরান ও ইরাকের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী পরিখাযুদ্ধ চলে। যুদ্ধরত দুই দেশের কাছেই পশ্চিমাদের অস্ত্র বিক্রির ফলে যুদ্ধের উত্তাপও বাড়ে। তাই অভ্যন্তরীণ ও ‘বহিস্থ’ সামরিক কেইনসবাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পুরোপুরি নির্ভরতার বাস্তবতায় অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক আগ্রহ আছে—মধ্যপ্রাচ্যের পর্যবেক্ষকদের এমন সন্দেহ কি অমূলক হবে? এবার যদি সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ না-ও বাধে, তবু মার্কিন স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা কি জরুরি নয়?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
পিটার কাস্টার্স: প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।
No comments