চার দিক-আহা রে সেই কিশোরীবেলা by মৃত্যুঞ্জয় রায়

ঘটনাটি শুভ জন্মাষ্টমীর আগের দিনের। আমরা খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালার দিকে যাচ্ছিলাম। পথটা বেশ আঁকাবাঁকা আর উঁচু-নিচু। রাস্তার দুই পাশে রাবারবাগান, সবুজ পাহাড়ের ঢাল, জুম-জঙ্গল, আদিবাসীদের ঘরবাড়ি। রাস্তার কোল ঘেঁষে ঝোপ ধরে ফোটা সাদা কাশফুলগুলো যেন শরতের বিজয়বার্তা ঘোষণা করছে।


ঘাড় দুলিয়ে পড়ন্ত বিকেলে আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে। আমরা চলেছি এক অজানা দেশে, এক টিপরাপাড়ায়। টিপরারা রাস্তার পাশে ওই পাড়াটায় যাওয়ার জায়গাটাকে বলে পাঁচমাইল, পোশাকি নাম কামিনীপাড়া। খাগড়াছড়ি শহর থেকে হয়তো জায়গাটার দূরত্ব পাঁচ মাইল বলে ও রকম পরিচিতি পেয়েছে। ওখানেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। এরপর টিলায় ওঠার পালা। পাড়ার মুখে একটা বড় বটগাছ প্রবেশপথটাকে ছায়াময় করে রেখেছে। সে ছায়ায় ছাপরামতো দুটি চায়ের দোকান। নিচে পাকা রাস্তায় একটা চান্দের গাড়িতে (জিপগাড়ি) ঠেসে কলার কাঁদি বোঝাই করা হচ্ছে। রাস্তার ওপারে আরও উঁচু টিলা। সেখানে পুলিশক্যাম্প। রাস্তাটা ওখানে বাঁক খেয়ে চলে গেছে দীঘিনালা উপজেলায়। আমরা বটতলা পেরিয়ে একটা চওড়া রাস্তা দিয়ে খানিকটা হেঁটেই পাড়ায় পৌঁছে গেলাম। কামিনীপাড়া একটা টিপরা বা ত্রিপুরা আদিবাসী-অধ্যুষিত পাড়া। ৪৩ ঘর লোক থাকে সে পাড়ায়। সে পাড়ার পাড়াপ্রধান কার্বারি মনমোহন ত্রিপুরা আমাদের স্বাগত জানালেন।
পাশেই একটা বাড়িতে বসলাম। বাড়িতে প্রবেশের মুখেই দেখলাম একটা জঙ্গলের মধ্যে আগুন জ্বলছে। কাছে গিয়ে দেখলাম, তিন টিপরা মেয়ে একটা ছাগলের মাথা আগুনে ছেঁকছে। পুড়িয়ে খাবে। টিপরা জীবনযাত্রার ওটাই প্রথম দর্শন। একটা পাটি পেতে উঠানে বসেছি। খড়-বাঁশের কুঁড়েঘর। পাশে লাউয়ের মাচান। লাউগাছে ফুল ধরতে শুরু করেছে। উঠানের এক পাশে কয়েকটা মরা বাঁশের ডগায় লতিয়ে উঠে গেছে শসার মতো একধরনের গাছ, ওটার নাম মারফা। পেছনে কিছু ফলের গাছ। উঠানের পশ্চিম দিকে একটা আমলকীগাছ। আমলকীতে সারা গাছ ভরে আছে। আমলকী দেখতেই চোখ পড়ে গেল আমলকীর ডালের ফাঁকে। কে ওখানে? মিনতি ত্রিপুরা বললেন, ‘আমার মেয়ে। আপনারা আমাদের অতিথি। এখন তো থাইফং নেই, থাইচুকও শেষ। কী দিয়ে আপনাদের আপ্যায়ন করি? তবে থাইলি খেতে পারেন।’ শঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল। থাইলি কি তাহলে ছাগলের মাথা পোড়া? সঙ্গী রমণী ত্রিপুরাকে জিজ্ঞেস করতেই সে হেসে ফেলল। বলল, ‘না, ওসব কিছু না। টিপরারা কলাকে বলে থাইলি। আমকে বলে থাইচুক আর থাইফং হলো কাঁঠাল।’ বুঝলাম, গৃহকর্ত্রী আমাদের আমলকী দিয়ে আপ্যায়ন করবেন। দেখতে দেখতে কিশোরী আমলকী গাছের মগডালে উঠে পড়ল। থোকা থোকা আমলকী ছিঁড়ে একটা থলিতে ভরছে। শরতের আকাশের মতোই তার মুখজুড়ে উজ্জ্বল হাসির খেলা। এ রকম কিশোরীবেলা যে কতকাল দেখিনি! এত কষ্টকর দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের মধ্যেও ওরা এমন করে হাসতে পারে? কেউ বাড়িতে এলে এমন করে খুশি হয়? নিজেদের কথা ভেবে সত্যিই লজ্জা হলো।
উঠানে বসে আমরা একটু দূরের উঁচু পাহাড়ের জুম দেখছি। পাহাড়ের সবুজ ঢালগুলো এখন সোনা ছড়িয়ে হলুদ হতে শুরু করেছে। মিনতি বললেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই জুম কাটা শুরু হবে। কিশোরী ততক্ষণে আমলকীগাছ থেকে নেমে এসেছে। একটা থালায় করে সে আমাদের সামনে আমলকীগুলো নিয়ে এল। আর একজন নিয়ে এল এক গামলা পেয়ারা। আর একটা থালায় এল পাইন্যাগোটা ফল। ভাবলাম, ওই কষ্টের জীবনে ওগুলো বেচে তো কটা টাকা পেত ওরা। আমাদের খাইয়ে ওদের লাভ কী? মনের কথা মনেই চেপে গেলাম। এসব কথা বললে না জানি ওরা আবার খেপে যায়। কিশোরীকে বললাম, ‘স্কুলে পড়ো?’ মাথা কাত করল।
‘কোন ক্লাসে?’
‘সিক্সে।’ বলেই ছুট দিল। ওর সাথিরা এসে গেছে। পাশের বাড়ির উঠানে গিয়েই শুরু হয়ে গেল ছোটাছুটি। মাটিতে দাগ কেটে দে ছুট দে ছুট। চার-পাঁচজন কিশোরীর সে কী উল্লাস! খুব ছোটরা ওদের সে খেলা দেখে হাততালি দিয়ে আনন্দ করছে। হাসির যেন ফোয়ারা ছুটছে। কী খেলা জানি না। তবে সন্ধ্যা হওয়ার আগ পর্যন্ত সে খেলা চলতেই থাকল। শেয়াল যেমন মুরগি ধরে, তেমনি করে ওরাও ধরাধরি খেলা খেলতে লাগল। খেলার একপর্যায়ে সবাই মিলে গোল হয়ে দাঁড়াল। হাতের তালি বাজিয়ে সুর করে ছড়া কাটতে লাগল। ত্রিপুরা ভাষার কিছুই বুঝি না। অতএব, আমার বোঝার কোনো সাধ্য নেই। এরপর শুরু হলো কোরাস গান। সুরটা কী মিষ্টি আর নরম। সবাই এক সুরে গাইছে। শুনে মনটা ভরে গেল। রমণীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী গাইছে ওরা?’
‘ওটা আমরা চৈত্রসংক্রান্তির সময় গাই। ওরা সে গানটা গেয়েই হয়তো আনন্দ করছে।’
টিপরারা সনাতন ধর্মাবলম্বী। রমণী ত্রিপুরা জানাল, ত্রিপুরাদের মধ্যে ৫৬ গোত্র আছে। সবার ভাষাও নাকি হুবহু এক নয়। কার্বারি বললেন, ‘কাল আপনাদের আমন্ত্রণ রইল। কাল শুভ জন্মাষ্টমী। সবাই মিলে আমরা উৎসব করব। মন্দিরে পূজা দেব। দেখতে আসবেন।’ বিনয়ের সঙ্গেই সে আন্তরিক আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে হলো। ফিরে এলাম কিশোরীর সেই হাসিমুখের ছবিটা নিয়ে।

No comments

Powered by Blogger.