গ্যাস বিক্রি-আরও একটি সর্বনাশা চুক্তির বোঝা by আনু মুহাম্মদ

২৬ সেপ্টেম্বর কেয়ার্ন এনার্জি ও (মার্কিন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনিখ্যাত) হেলিবার্টনকে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমতির চুক্তি স্বাক্ষর করেছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। চুক্তিতে বর্ণিত তৃতীয় পক্ষ যে কেউ হতে পারে। কোম্পানি এখন যে কারও কাছে তাদের নির্ধারিত অর্থাৎ উচ্চতর দামে গ্যাস বিক্রি করতে পারবে।


এরই মধ্যে যেসব আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জানা গেছে, তাদের মধ্যে বিদেশি কোম্পানি কাফকো ও কোরীয় ইপিজেড অন্যতম।
আর্থিক জোরের কারণে রপ্তানিমুখী এসব কোম্পানি উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনতে সক্ষম হবে। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য সার উৎপাদনকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসহ বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি খাতের অন্যান্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তা করতে সক্ষম হবে না। গ্যাসের উচ্চমূল্যের কারণে পিছিয়ে পড়ে তারা এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এভাবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হারাবে দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। আর যদি তাদের বর্ধিত মূল্যে গ্যাস কিনতেই হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানের এই অংশের উৎপাদন খরচ অন্ততপক্ষে পাঁচ গুণ বাড়বে। উৎপাদন খরচের এই বৃদ্ধিতে অর্থনীতির সব খাতই হয়ে পড়বে অনেক ব্যয়বহুল। দ্রব্যমূল্য বাড়বে, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। আমদানিকৃত পণ্যের সঙ্গে দেশীয় পণ্যের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা গুরুতরভাবে সংকুচিত হবে। এই চুক্তি হওয়ার ফলে এখন গ্যাস খাতে সক্রিয় অন্যান্য কোম্পানিও অবধারিতভাবে একই সুযোগ চাইবে। এই চুক্তি তাই জ্বালানি খাতে আরাও বড় ধরনের নিরাপত্তাহীনতা এবং সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার পথ তৈরি করল।
বাংলাদেশের স্থলভাগ ও অগভীর সমুদ্রের গ্যাস-সম্পদের ওপর প্রধান কর্তৃত্ব এখন কেয়ার্ন এনার্জি, শেভরন ও শেলসহ কয়েকটি মার্কিন ও ইউরোপীয় কোম্পানির হাতে। ১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় স্বাক্ষরিত বিভিন্ন উৎপাদন বণ্টন চুক্তির মধ্য দিয়ে তাদের এই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কোম্পানিগুলো একসময় বাংলাদেশ থেকে গ্যাস রপ্তানির জোর চেষ্টাও করেছিল। জনগণের প্রতিরোধ ও তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর ও কয়লা রক্ষা জাতীয় কমিটির বিরোধিতার কারণে তা এখন পর্যন্ত হতে পারেনি। পরিকল্পনা ছিল প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট করে প্রায় ২০ বছরে মোট ৩ দশমিক ৫ টিসিএফ গ্যাস রপ্তানি করার। সেটা তারা করতে পারলে দেশের গ্যাস ও বিদ্যুতের বর্তমান সংকট আরও কয়েক গুণ বাড়ত, বর্তমানের সিএনজির সুবিধাও পাওয়া সম্ভব হতো না।
রপ্তানি করতে সক্ষম না হলেও ক্ষতিকর চুক্তির মাধ্যমে গ্যাস ব্লকগুলোর ওপর বিদেশিদের কর্তৃত্বের কারণে প্রতিবছরই বাংলাদেশকে দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। যেখানে বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস ৫০ টাকায় কিনলেও তা ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভজনক হতে পারে, সেখানে বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে আমাদের গ্যাস কিনতে হচ্ছে কর ও অন্যান্য ফিসহ গড়পড়তা ৩০০ টাকায়। সেটি আবার কিনতে হয় বিদেশি মুদ্রায়। এর ফলে প্রতিবছর একদিকে ভর্তুকি বাবদ আর্থিক ঘাটতি তৈরি হয়, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়ে। এ অবস্থা অনিবার্য ছিল না, এই খাত পরিচালনার জন্য জাতীয় সক্ষমতা আমাদের ছিল। পুঁজির সংকটের কথা বলে এসব কোম্পানিকে আনা হলেও এদের সঙ্গে চুক্তির কারণে এখন প্রয়োজনীয় পুুঁজির ১০ গুণ গচ্চা দিতে হচ্ছে।
এখন আবার তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমতি দেওয়া হলো। এরপর প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম (আন্তর্জাতিক বাজারদর এবং কাতার থেকে গ্যাস আমদানির দর-কষাকষি বিবেচনা করে বলা যায়) ৭০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এই চুক্তির ফলে গ্যাস বাজারের অন্য যেকোনো পণ্যের মতো একটি পণ্যে পরিণত হলো। বাজারের কোনো কোনো পণ্যের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকলে কীভাবে সিন্ডিকেট-তৎপরতার মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়, সেই অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। এত দিন গ্যাসের বেলায় এ রকম হওয়ার সুযোগ ছিল না। কেননা, এত দিন পেট্রোবাংলা নির্দিষ্ট দামে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনে তা নির্দিষ্ট মূল্যে সরকারি-বেসরকারি শিল্প-কৃষি-বিদ্যুৎ ও গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরবরাহ করেছে। কিন্তু এই চুক্তির ফলে গ্যাসের সরবরাহ এখন সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে বিদেশি কোম্পানির দ্বারা। দাম নির্ধারণের ক্ষমতাও কেন্দ্রীভূত থাকবে তাদের এবং বাজারের অন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে।
হাতিয়া মগনামা এলাকায় গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনায় অধিক ব্যয়ের কথা বলে কেয়ার্ন এনার্জি এই চুক্তির পক্ষে বেশ কিছুদিন ধরে তৎপর ছিল। কিন্তু তাদের হিসাবের ওপর আস্থা রাখার আগে তাদের হিসাব নিয়ে অতীত রেকর্ড দেখার দায়িত্ব তো সরকারেরই ছিল। এর আগে কেয়ার্ন এনার্জি সাঙ্গু গ্যাসফিল্ড পরিচালনা করত। সাঙ্গুক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলার ব্যয়ের প্রাক্কলন ব্যয় চুক্তি হওয়ার সময়ের চেয়ে তারা এসব কথা বলেই দফায় দফায় পাঁচ গুণেরও বেশি ব্যয় বাড়িয়ে দেখিয়েছে। এই বেশি ব্যয় দেখানোয় উৎপাদন অংশীদারি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, সাঙ্গু গ্যাসফিল্ডের গ্যাসের ওপর বাংলাদেশের অংশীদারি অনেক কমে যায় এবং অধিকতর অংশ তাদের ঠিক করা দামেই কিনতে হয়। অন্যদের তুলনায় এত বর্ধিত ব্যয় কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত করা যায়নি, সে কারণে এই ব্যয়ের হিসাব নিয়ে পেট্রোবাংলা থেকেও একাধিকবার আপত্তি উত্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু অজানা (বা বোধগম্য) কারণে কেয়ার্নের বর্ধিত বাজেটই শেষ পর্যন্ত বহাল থাকে।
এ ছাড়া সাঙ্গু গ্যাসফিল্ডের মজুদ নিয়েও কেয়ার্ন এনার্জি সরকারকে ভুল তথ্য দিয়েছিল। গ্যাসের মজুদ অনেক বেশি দেখিয়ে তারা দ্রুত হারে গ্যাস উঠিয়েছে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই গ্যাস শেষ হয়ে যায় এবং গ্যাসক্ষেত্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ এই গ্যাসের মজুদের ভরসায়ই চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ব্যয়ের হিসাব ও মজুদ সম্পর্কে এ রকম ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য কেয়ার্ন এনার্জির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল এবং জাতীয় স্বার্থে সেটাই করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটা না করে কেয়ার্ন এনার্জিকে গ্যাস-সম্পদই শুধু নয়, সামগ্রিক জ্বালানি-অর্থনীতির ওপর পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেওয়া হলো।
এর মধ্য দিয়ে আর্থিক জোর কম, কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হলো। ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলের গ্যাসের সংকট সমাধানে এটাই মোক্ষম উপায়’ বলে ধারণা প্রচার করা হলেও এ অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে আরও বেশি। কেয়ার্ন এনার্জি হুমকি দিয়েছিল, তাদের কথা না শুনলে তারা চলে যাবে। এটা খুবই সহজ সমাধান ছিল এবং সরকার এই হুমকি গ্রহণ করেই দেশের গ্যাস-সম্পদের ওপর দেশের কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনতে পারত। কিন্তু সরকার সেই পথ নেয়নি, মন্ত্রণালয় এই হুমকিকেই যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে।
সামগ্রিকভাবে জ্বালানি নিরাপত্তা ও বিদ্যুতের সংকট সমাধানের পথে এখন তাই প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ওপর দেশি কমিশনভোগী ও বিদেশি কোম্পানির রাহুর গ্রাস। সে কারণে জ্বালানি খাত নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত ও চুক্তির প্রক্রিয়ায় তাদের সেই ভৌতিক ক্ষমতার প্রয়োগ আমরা দেখছি। সংসদে এখন পর্যন্ত উৎপাদন বণ্টন চুক্তি, গ্যাসক্ষেত্র ইজারা, জ্বালানিনীতি, কয়লানীতি ইত্যাদি জাতীয় গুরুত্বপূূর্ণ বিষয়ে কোনো ধরনের আলোচনা হয়নি। মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের জন্য যথাক্রমে শেভরন ও নাইকোর কাছ থেকে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়টিও সংসদে ওঠানো হয়নি। সংসদে উত্থাপিত জাতীয় কমিটি প্রস্তাবিত ‘খনিজ সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধকরণ আইন’ এখনো ফেলে রাখা হয়েছে। এমনকি এসব বিষয়ে জনগণকে জানিয়ে তাদের সম্মতি নেওয়ার কোনো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করা হয়নি।
সম্প্রতি জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের কৃতিত্বে একদিকে আশার একটি খবর আমরা পেয়েছি। তা হলো, নেত্রকোনা অঞ্চলে বর্তমান প্রমাণিত জাতীয় মজুদের প্রায় ৬০ শতাংশ অতিরিক্ত গ্যাসের মজুদের (চার থেকে সাড়ে চার টিসিএফ) সন্ধান লাভ। এই পরিমাণ গ্যাসের মজুদ যদি জাতীয় সংস্থার কর্তৃত্বে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের মাধ্যমে দেশের শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নতির জন্য ব্যবহূত হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে গ্যাস বা বিদ্যুতের আর কোনো সংকট হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সরকার যেভাবে গ্যাসক্ষেত্রসহ সব জ্বালানিসম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়াকেই প্রধান করণীয় বলে নির্ধারণ করেছে, যেভাবে আবার পুঁজির অভাবের কথা বলে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে দেনদরবার করা হচ্ছে, সেখানে এই নতুন সম্ভাবনাও বিদেশি দখলদারির কারণে বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে। মার্কিন কোম্পানি কনকো-ফিলিপস এখন স্থলভাগ ও সমুদ্রের গ্যাসক্ষেত্রের ইজারা পাওয়ার চেষ্টারত। তারা এরই মধ্যে এই গ্যাসক্ষেত্রের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে এবং বিদ্যুৎ-সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য জ্বালানিসম্পদের ওপর শতভাগ জাতীয় মালিকানা নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্য জাতীয় সংস্থাসহ জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ, খনিজ সম্পদ রপ্তানি ও উন্মুক্ত খনিপদ্ধতি নিষিদ্ধ করা এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে বিদেশি কোম্পানির রাহুমুক্ত করা অপরিহার্য। এটা যেকোনো দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক সরকারের প্রধান জরুরি কর্তব্য। এ থেকে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে তা বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্বালানি ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে। কিন্তু ঘটছে সেটাই।
একই দিন অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বর সংসদে সরকারের পক্ষ থেকে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) বিল ২০১০’ উত্থাপন করা হয়েছে। এই বিল অনুযায়ী জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অর্থাৎ ‘এ আইনের অধীনকৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ যেখানে জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা আর গোপন চুক্তি ও সমঝোতার দুষ্ট চক্র থেকে বের করা দরকার, সেখানে এই মন্ত্রণালয়কে সব আইনি বাধ্যবাধকতার ঊর্ধ্বে স্থাপন করে দুর্নীতি আর জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতাকে প্রশ্নাতীত করার ক্ষেত্রে সরকারের এই আগ্রহ সর্বনাশা নানা উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন কেবল আরও জোরালোই করে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ। সভাপতি, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.