সরকারের জন্য অশনিসংকেত

সবেমাত্র গরম পড়তে শুরু করেছে। একই সঙ্গে দেশে শুরু হয়েছে বোরো আবাদ। এরই মধ্যে লোডশেডিং বা ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার সেই পুরনো চেহারা অনেকটাই ফিরে এসেছে। যদিও সরকার বলছে, জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে প্রায় এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি চোখে পড়ে না।


শহরে বা গ্রামে কিংবা রাজধানী ঢাকাকেও এলাকাভেদে প্রতিদিন গড়ে চার থেকে আট ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে। সামনের মাসগুলোতে সংকট বাড়বে ছাড়া কমবে না। নতুন এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে, তা আমরা অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু আমাদের মেয়াদোত্তীর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যে এখন আর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েও চলতে পারছে না, বর্তমানে ১২টি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। রাউজান বিদ্যুৎকেন্দ্রে বয়লার বিস্ফোরণের কারণে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে যেটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে, প্রায় সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেও গেছে। তাই মোট উৎপাদনে খুব বেশি তারতম্য হচ্ছে না। অথচ প্রতিদিনই বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। আমাদের সমস্যা হয়েছে, এক দশকের বেশি সময় ধরে নতুন কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়নি। বর্তমান সরকারের দুই বছরের অধিক সময়ে কিছু ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এগুলো দিয়ে বর্তমান বিদ্যুৎ সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। খুলনায় ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের যে বিদু্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনের কথা চলছে, সে ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত চুক্তি করা যায়নি। বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিও চূড়ান্ত হয়নি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অগ্রগতিও তথৈবচ। ফলে যা হওয়ার তা-ই হবে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না এবং সরকারকে চরম জনরোষ মোকাবিলা করতে হবে।
দেশে মোট বিদ্যুতের চাহিদা সাত হাজার মেগাওয়াটের মতো। তার বিপরীতে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট। এই চাহিদা মেটাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। তা ছাড়া ছোট ছোট কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও অনেক বেশি পড়ে। বিদ্যুতের অভাবে শুধু যে জনজীবনে দুর্ভোগ হচ্ছে তা-ই নয়, কৃষি এবং শিল্পোৎপাদনও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের আরেকটি বড় ব্যর্থতা হলো বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমাতে না পারা। একই সঙ্গে সরকারকে বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষমতা যাতে যথাসম্ভব ধরে রাখা যায়, তার ওপরও নজর রাখতে হবে। সেখানে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। অথচ তার পরও বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সংকট রয়েছে। কাজেই গ্যাসের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে হবে। আর তা করা না গেলে কয়লা, পরমাণু বা বিকল্প শক্তিসমূহের ওপর নির্ভরশীল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে। গ্রামাঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত আছে, 'ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল দেবার গোঁসাই।' বিদ্যুতের চরম ঘাটতিতে জনজীবন অতিষ্ঠ, অথচ সরকার এরই মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। খরচ বেড়েছে, কাজেই দাম বাড়বে_এই যুক্তি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আগে ঠিকমতো বিদ্যুৎ দেওয়ার ব্যবস্থা করুন, তারপর দাম বাড়ান। সরকারের অগ্রাধিকারের খাতায় খাদ্যনিরাপত্তার পরই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিল বিদ্যুৎ খাত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের ধীরগতি দেশবাসীকে হতাশ করছে। আর এই হতাশাকে পুঁজি করে বিপক্ষ শক্তিই ফায়দা লুটবে। আর সরকারের ভাবমূর্তি দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

No comments

Powered by Blogger.