চারদিক-হার মানে না মধ্যরাতের অশ্বারোহী by মালেকা বেগম
‘নিবিড় পর্যবেক্ষণে ফয়েজ আহমেদ’ খবরটি (মানবজমিন, ২৫.৯.১০) দেশের অগণিত নারী-পুরুষ-শিশুর জন্য উদ্বেগজনক। সারা জীবন তিনি পর্যবেক্ষণ করে গেছেন দেশ-বিদেশের নানা খবর, পরিস্থিতি, ব্যক্তিত্বদের ভালো-মন্দ। আজ তাঁকে থাকতে হচ্ছে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে! দেশের যেকোনো প্রগতির আন্দোলনে শরিক হয়েছেন রাজপথে,
নেতৃত্ব দিয়েছেন সাংস্কৃতিক-প্রতিবাদ-আনন্দের আন্দোলনে, কলম ধরেছেন হাজার-হাজারবার খবরাদি লেখার জন্য, গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসংবলিত বই প্রকাশিত হয়েছে; শিশুতোষ ছড়া, মধ্যরাতের অশ্বারোহী হয়ে আমাদের সমাজ-দেশ-জনসাধারণকে সচেতন করেছেন, সজাগ রেখেছেন।
আমি জানি, বাংলাদেশের ও বিদেশের বহু ব্যক্তির মনে তাঁর স্থান বিশেষিত হয়ে আছে। আমার আশৈশব স্মৃতিতে ফয়েজ ভাই বড় ভাইয়ের স্থান করে নিয়েছেন। ওয়ারীপাড়ায় লারমিনি স্ট্রিটে আমরা ১৯৫৩ থেকে স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করি। ১২ ভাইবোনকে নিয়ে মা-বাবার আর্থিক-পারিবারিক-সামাজিক-ব্যতিব্যস্ততা, উদ্বেগ নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু ওই সময় ওয়ারীপাড়ার সাংস্কৃতিক-শিক্ষাগত সামাজিক পরিবেশ ছিল আনন্দময়, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন। সেই কারণে এবং বাসার ভেতরে আমরা মা-বাবার কাছ থেকে সুন্দর শিক্ষণীয় পরিবেশ পেয়ে খুবই উৎফুল্ল থাকতাম। পাড়ার র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে বাস করতেন স্বনামখ্যাত চিকিৎসক মন্মথনাথ নন্দী ও স্বনামখ্যাত শিক্ষক শান্তি নন্দী এবং তাঁদের দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়েরা ইন্দিরা-মন্দিরা ছিল আমাদের তিন বোনের বন্ধু। সেই বাড়িটি ছিল ঢাকার সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের ও ঢাকার সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্রস্বরূপ। আমার বয়স তখন ১০ বছর। সেই সময়ই ফয়েজ ভাইকে প্রথম দেখি এবং ক্রমেই বুঝতে পারি, তিনি ওই পরিবারেরই একজন সদস্যরূপে সব সাংস্কৃতিক চর্চার পরিচালক। তখন তারুণ্যে ভরপুর ফয়েজ ভাই ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সাংস্কৃতিক এবং রবীন্দ্র, অতুল প্রসাদ, নজরুল, ভাওয়াইয়া ও স্বদেশি গানের চর্চাশীল শিল্পী ও তাঁদের পরিবারের সবার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনকারী হিসেবে সক্রীয় ভূমিকা রাখতেন। ছুটির দিনগুলোতে সকাল থেকেই একে একে চলে আসতেন জাহেদুর রহিম, ফাহমিদা খাতুনসহ অনেকেই। বিশেষ করে রবীন্দ্রশতবর্ষ উদ্যাপনের প্রস্তুতি পর্বে এই বিশেষ বাড়িতে সারা দিন গানের রিহার্সেল হতো। ছোট বয়সের আরও বহু স্মৃতিতে ফয়েজ ভাইয়ের কর্মস্ফূর্তি ও শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক নন্দীর বাড়িতে আনন্দঘন পরিবেশের বহু ঘটনা, বহু গানের সুর, বহু নৃত্যের নূপুর ধ্বনি বেজে চলেছে আজও। এদের সঙ্গে থেকে থেকে সুরপ্রীতি, রবীন্দ্রচর্চার সাধনাপ্রীতি আমাদের অনেকের মনে চর্চিত হয়েছে। ফয়েজ ভাই সবাইকে একত্র করেই চলতেন—শ্রদ্ধেয় কাজী মোতাহার হোসেনের কন্যাদের, শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের পুত্র-কন্যাদের, কবি সুফিয়া কামাল, কবি জসীমউদ্দীন প্রমুখের উপস্থিতি, শিল্পী কামরুল হাসানসহ আরও বহু জনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে লারমিনি স্ট্রিটের ব্রাহ্মসমাজের মধ্যমণি শ্রদ্ধেয় মানিক ঘোষের উপস্থিতি। আজ ফয়েজ ভাইয়ের কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে। বলধা গার্ডেনের পুকুরঘাটে শারদ উৎসব, রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা নৃত্যনাট্য এ সবই ছিল সে সময়ের সামরিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জস্বরূপ।
ফয়েজ ভাইকে পেয়েছি সাংবাদিকতায় পারদর্শী লেখক, পর্যবেক্ষক, ক্ষুরধার কলমসেবীরূপে। ফয়েজ ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে আমার নিজের কথা বলা হয়ে যাচ্ছে—পাঠক ক্ষমা করবেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন থেকে শিক্ষার্থীদের মিছিল বেরিয়েছিল গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে। নবীন কর্মী হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নের আহ্বানে সেই মিছিলে ছিলাম। হঠাৎ দেখি, পুলিশ আর আমি প্রায় মুখোমুখি। সামনে ও পেছন থেকে সাবধানী পাকাপোক্ত ছাত্র নেতারা সবাই সঁটকে পড়েছিলেন। হঠাৎ আমাকে হ্যাঁচকা টানে ফয়েজ আহমেদ টেনে নিয়ে চললেন। রাস্তার পাশে বড় ড্রেন ছিল। সেখানে আমরা পচা পানিতে মাথা ডুবিয়ে বসেছিলাম। ফয়েজ ভাই আমাকে বকলেন এই বলে যে এত বোকার মতো পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়ালাম কেন? সাংবাদিক, লেখক, আন্দোলক, সঞ্চালক প্রতিভাবান ফয়েজ ভাইয়ের সহযোগিতা পাননি এ দেশে এমন খুব কম প্রগতিবাদীই আছেন।
আমাদের নারী আন্দোলনের একজন বড় শুভানুধ্যায়ী তিনি। ১৯৮৫ সালে নারী নির্যাতনবিরোধী ঐক্যবদ্ধ কমিটিতে আমরা নারী-পুরুষের সমন্বয় ঘটাতে পেরেছিলাম। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ছিল উদ্যোক্তা সংগঠন। সুফিয়া কামাল ছিলেন সংগঠনের সভানেত্রী। আহ্বায়ক ছিলেন ফয়েজ আহমেদ। অফিস ছিল রোকেয়া রহমান পরিচালিত ‘সপ্তগ্রামে’। জেলায় জেলায়, ঢাকা শহরের নানা জায়গায় আমরা সভা করেছি তাঁকে আহ্বায়ক করে। সেই সময় একদিকে নারী দশকের আন্দোলন অন্যদিকে নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বোপরি সামরিক সরকারের নানা দমননীতি—সব কিছুর প্রতিরোধে ফয়েজ ভাইয়ের ভূমিকা স্মরণীয় থাকবে ইতিহাসে।
ফয়েজ ভাই ও হামিদা হোসেনসহ বহু জনের আহ্বানে দ্রুত আমরা বহু নারী-পুরুষ প্রগতিবাদীরা প্রেসক্লাবে স্বল্প সময়ের সভা করেছিলাম ভারতে বাবরি মসজিদসংক্রান্ত দাঙ্গার পাল্টাপাল্টি দাঙ্গা বাংলাদেশে যেন না হয়, তার জন্য। এলাকায় এলাকায় মিষ্টির দোকান লুট করতে ব্যস্ত ছিল সামরিক নেতা এরশাদের বাহিনী। আমরা দলে দলে নিজ নিজ দায়িত্বে এলাকায় এলাকায় শান্তির আহ্বানে কাজ করেছিলাম।
ফয়েজ ভাই শিল্পাঙ্গনে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন ফয়েজ ভাই। তাঁর অবদান কেউ ভুলবে না। আমরা তাঁর সুস্বাস্থ্য
কামনা করি।
আমি জানি, বাংলাদেশের ও বিদেশের বহু ব্যক্তির মনে তাঁর স্থান বিশেষিত হয়ে আছে। আমার আশৈশব স্মৃতিতে ফয়েজ ভাই বড় ভাইয়ের স্থান করে নিয়েছেন। ওয়ারীপাড়ায় লারমিনি স্ট্রিটে আমরা ১৯৫৩ থেকে স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করি। ১২ ভাইবোনকে নিয়ে মা-বাবার আর্থিক-পারিবারিক-সামাজিক-ব্যতিব্যস্ততা, উদ্বেগ নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু ওই সময় ওয়ারীপাড়ার সাংস্কৃতিক-শিক্ষাগত সামাজিক পরিবেশ ছিল আনন্দময়, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন। সেই কারণে এবং বাসার ভেতরে আমরা মা-বাবার কাছ থেকে সুন্দর শিক্ষণীয় পরিবেশ পেয়ে খুবই উৎফুল্ল থাকতাম। পাড়ার র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে বাস করতেন স্বনামখ্যাত চিকিৎসক মন্মথনাথ নন্দী ও স্বনামখ্যাত শিক্ষক শান্তি নন্দী এবং তাঁদের দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়েরা ইন্দিরা-মন্দিরা ছিল আমাদের তিন বোনের বন্ধু। সেই বাড়িটি ছিল ঢাকার সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের ও ঢাকার সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্রস্বরূপ। আমার বয়স তখন ১০ বছর। সেই সময়ই ফয়েজ ভাইকে প্রথম দেখি এবং ক্রমেই বুঝতে পারি, তিনি ওই পরিবারেরই একজন সদস্যরূপে সব সাংস্কৃতিক চর্চার পরিচালক। তখন তারুণ্যে ভরপুর ফয়েজ ভাই ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সাংস্কৃতিক এবং রবীন্দ্র, অতুল প্রসাদ, নজরুল, ভাওয়াইয়া ও স্বদেশি গানের চর্চাশীল শিল্পী ও তাঁদের পরিবারের সবার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনকারী হিসেবে সক্রীয় ভূমিকা রাখতেন। ছুটির দিনগুলোতে সকাল থেকেই একে একে চলে আসতেন জাহেদুর রহিম, ফাহমিদা খাতুনসহ অনেকেই। বিশেষ করে রবীন্দ্রশতবর্ষ উদ্যাপনের প্রস্তুতি পর্বে এই বিশেষ বাড়িতে সারা দিন গানের রিহার্সেল হতো। ছোট বয়সের আরও বহু স্মৃতিতে ফয়েজ ভাইয়ের কর্মস্ফূর্তি ও শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক নন্দীর বাড়িতে আনন্দঘন পরিবেশের বহু ঘটনা, বহু গানের সুর, বহু নৃত্যের নূপুর ধ্বনি বেজে চলেছে আজও। এদের সঙ্গে থেকে থেকে সুরপ্রীতি, রবীন্দ্রচর্চার সাধনাপ্রীতি আমাদের অনেকের মনে চর্চিত হয়েছে। ফয়েজ ভাই সবাইকে একত্র করেই চলতেন—শ্রদ্ধেয় কাজী মোতাহার হোসেনের কন্যাদের, শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের পুত্র-কন্যাদের, কবি সুফিয়া কামাল, কবি জসীমউদ্দীন প্রমুখের উপস্থিতি, শিল্পী কামরুল হাসানসহ আরও বহু জনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে লারমিনি স্ট্রিটের ব্রাহ্মসমাজের মধ্যমণি শ্রদ্ধেয় মানিক ঘোষের উপস্থিতি। আজ ফয়েজ ভাইয়ের কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে। বলধা গার্ডেনের পুকুরঘাটে শারদ উৎসব, রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা নৃত্যনাট্য এ সবই ছিল সে সময়ের সামরিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জস্বরূপ।
ফয়েজ ভাইকে পেয়েছি সাংবাদিকতায় পারদর্শী লেখক, পর্যবেক্ষক, ক্ষুরধার কলমসেবীরূপে। ফয়েজ ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে আমার নিজের কথা বলা হয়ে যাচ্ছে—পাঠক ক্ষমা করবেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন থেকে শিক্ষার্থীদের মিছিল বেরিয়েছিল গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে। নবীন কর্মী হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নের আহ্বানে সেই মিছিলে ছিলাম। হঠাৎ দেখি, পুলিশ আর আমি প্রায় মুখোমুখি। সামনে ও পেছন থেকে সাবধানী পাকাপোক্ত ছাত্র নেতারা সবাই সঁটকে পড়েছিলেন। হঠাৎ আমাকে হ্যাঁচকা টানে ফয়েজ আহমেদ টেনে নিয়ে চললেন। রাস্তার পাশে বড় ড্রেন ছিল। সেখানে আমরা পচা পানিতে মাথা ডুবিয়ে বসেছিলাম। ফয়েজ ভাই আমাকে বকলেন এই বলে যে এত বোকার মতো পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়ালাম কেন? সাংবাদিক, লেখক, আন্দোলক, সঞ্চালক প্রতিভাবান ফয়েজ ভাইয়ের সহযোগিতা পাননি এ দেশে এমন খুব কম প্রগতিবাদীই আছেন।
আমাদের নারী আন্দোলনের একজন বড় শুভানুধ্যায়ী তিনি। ১৯৮৫ সালে নারী নির্যাতনবিরোধী ঐক্যবদ্ধ কমিটিতে আমরা নারী-পুরুষের সমন্বয় ঘটাতে পেরেছিলাম। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ছিল উদ্যোক্তা সংগঠন। সুফিয়া কামাল ছিলেন সংগঠনের সভানেত্রী। আহ্বায়ক ছিলেন ফয়েজ আহমেদ। অফিস ছিল রোকেয়া রহমান পরিচালিত ‘সপ্তগ্রামে’। জেলায় জেলায়, ঢাকা শহরের নানা জায়গায় আমরা সভা করেছি তাঁকে আহ্বায়ক করে। সেই সময় একদিকে নারী দশকের আন্দোলন অন্যদিকে নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বোপরি সামরিক সরকারের নানা দমননীতি—সব কিছুর প্রতিরোধে ফয়েজ ভাইয়ের ভূমিকা স্মরণীয় থাকবে ইতিহাসে।
ফয়েজ ভাই ও হামিদা হোসেনসহ বহু জনের আহ্বানে দ্রুত আমরা বহু নারী-পুরুষ প্রগতিবাদীরা প্রেসক্লাবে স্বল্প সময়ের সভা করেছিলাম ভারতে বাবরি মসজিদসংক্রান্ত দাঙ্গার পাল্টাপাল্টি দাঙ্গা বাংলাদেশে যেন না হয়, তার জন্য। এলাকায় এলাকায় মিষ্টির দোকান লুট করতে ব্যস্ত ছিল সামরিক নেতা এরশাদের বাহিনী। আমরা দলে দলে নিজ নিজ দায়িত্বে এলাকায় এলাকায় শান্তির আহ্বানে কাজ করেছিলাম।
ফয়েজ ভাই শিল্পাঙ্গনে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন ফয়েজ ভাই। তাঁর অবদান কেউ ভুলবে না। আমরা তাঁর সুস্বাস্থ্য
কামনা করি।
No comments