বিশ্ব নদী দিবস-নদীর ডাকে সাড়া দিতে হবে
বিশ্বে ষষ্ঠ এবং বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব নদী দিবস। ২০০৫ সাল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, সংগঠন ও গোষ্ঠীর উদ্যোগে দিনটি পালিত হয়ে আসছে। ওই বছর দিবসটি জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়।
এর আগ পর্যন্ত খ্যাতিমান ‘রিভার হিরো’ ও কানাডীয় নদী আন্দোলনের জনক মার্ক অ্যাঞ্জেলোর উদ্যোগে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে নদী দিবস পালিত হয়েছে। দিনটি পালনে এবার বাংলাদেশও শামিল হয়েছে। নদীবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ ‘রিভারাইন পিপল’-এর পক্ষ থেকে আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি। আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটির সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ও কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। বিশ্ব নদী দিবসের মূল ওয়েবসাইটেও স্থান পেয়েছে এ কর্মসূচি।
সন্দেহ নেই, নদীর প্রতি আমাদের সব সময়ই দায়িত্বশীল থাকা জরুরি। নদী যেমন নিরন্তর তার সিঞ্চনে ও সম্পদে আমাদের উপকার করে যাচ্ছে, তেমনি আমাদেরও উচিত মাস কিংবা মৌসুম ভেদে নদীর ব্যাপারে সচেতন থাকা। কিন্তু বহুমাত্রিক ব্যস্ততার এই যুগে নদীর প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করতে আলাদা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকারও করবে না। বাংলাদেশের জন্য তা আরও প্রাসঙ্গিক। কারণ, প্রাকৃতিকভাবে ‘নদীমাতৃক’ হলেও সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে আমরা নিজেদের নদীবৈরী জনগোষ্ঠী হিসেবে ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ দেশের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীগুলো আঞ্চলিক রাজনীতি এবং বহুজাতিক পুঁজির সর্বনাশা সম্প্রসারণেরও শিকার হয়েছে।
আমরা জানি, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা অববাহিকার প্রতিটি নদী কোনো না কোনোভাবে হিমালয়ের সঙ্গে যুক্ত। সেখানকার হিমবাহ ও বৃষ্টিপাতই এ দেশের শত শত নদীর চূড়ান্ত উৎস। সুউচ্চ ওই জলজ-রাজ্যে শুরু হয়েছে বাঁধের উৎপাত। ইন্টারন্যাশনাল রিভারসের একটি সমীক্ষায় আমরা দেখেছি, হিমালয় অঞ্চলে ৫৫২টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে আমাদের নদীর চূড়ান্ত সর্বনাশই হবে। রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের চোখরাঙানি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে একপর্যায়ে হিমালয়ের বরফ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হারে গলে যেতে পারে। এতে ভাটি অঞ্চল বাংলাদেশ প্রথম দিকে যেমন বন্যা ও নদীভাঙনে নাকাল হবে, পরের দিকে পড়বে পানিশূন্যতায়। সুদূর উজানে কেবল নয়, সীমান্ত ঘেঁষেও আমাদের ঘিরে ধরছে বাঁধের শেকল। পদ্মা, তিস্তা, ধরলা, মহানন্দা, গোমতী, মুহুরী, মনু, খোয়াই—কোনো নদীর আসন্ন উজানে বাঁধ নেই? সুরমা-কুশিয়ারার উজানে টিপাইমুখ-তোড়জোড় তো সর্বজনবিদিত। ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহারের দৈত্যকায় আয়োজনের কথাও বহুল শ্রুত। অস্বীকার করা যাবে না দেশের অভ্যন্তরের অপরিকল্পিত সেতু ও বাঁধের বিরূপ প্রভাবের কথাও।
শুধু কি বাঁধ? নদীতে নদীতে দখল-দূষণও কদর্য চেহারা নিয়েছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী-হালদা, সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা, নাটোরের নারদ, নেত্রকোনার মগড়া, বরিশালের কীর্তনখোলা, ফরিদপুরের কুমার, ময়মনসিংহের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা, বগুড়ার করতোয়া, যশোরের কপোতাক্ষ, খুলনার ময়ূরের মতো নগরসংলগ্ন নদ-নদীগুলো যেন অভিশপ্ত।
নদীর এ দুর্গতির জন্য কর্তৃপক্ষীয় অমনোযোগিতার পাশাপাশি নাগরিক অসচেতনতাও কম দায়ী নয়। আমরা যেভাবে সভ্যতা, কৃষি, যোগাযোগ, জীববৈচিত্র্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নদীর কাছে ঋণী, আর কোনো দেশ ততটা নয়। আবার নদীর প্রতি আমাদের ঔদাসীন্যেরও জুড়ি মেলা কঠিন। আশার কথা, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সাম্প্রতিক কালে নদীবিষয়ক সক্রিয়তা বেড়েছে। বেড়েছে গণমাধ্যমের মনোযোগও। এখন যদি নাগরিকেরা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়, মুমূর্ষু নদীগুলোকে স্বচ্ছতোয়া স্রোতস্বিনীতে রূপান্তর অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রেই বিশ্ব নদী দিবস ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্ব নদী দিবস ২০১০-এর জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিপাদ্য নেই। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল আলাদা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করতে পারবে। রিভারাইন পিপলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জন্য আমরা এই প্রতিপাদ্য তুলে ধরতে চাই—‘নদী আমাদের ডাকছে, সাড়া দিতে হবে’।
আমরা বিশ্বাস করি, নদী আমাদের ডাকছে; এখন সাড়া দিতে হবে। সাড়া নানাভাবে দেওয়া যায়। সচল নদী আমাদের অধিকার, ওই অধিকার নিশ্চিত করতে নদীর ডাকে সাড়া দিয়ে, নদীর জন্য কাজ করে যাওয়ার বিকল্প নেই। আজকের দিনে, সেপ্টেম্বরের শেষ রোববার, নদীর কল্যাণের জন্য প্রতীকী হলেও অন্তত কিছু কাজ আমরা করতে পারি। নদীবিষয়ক সাহিত্য, প্রবন্ধ লিখে কিংবা পড়ে, নদীবিষয়ক চলচ্চিত্র দেখে, নদীর ছবি তুলে কিংবা চিত্র এঁকে, নদীতে বেড়াতে গিয়ে, নদীর কথা আলোচনা করে দিনটি পালন করা যেতে পারে। অনুজ ও বিদ্যার্থীদের নদী রক্ষার শপথ করানো যেতে পারে। আজকে মা-বাবা তাঁর সন্তানকে নদী-সংবেদনশীল হিসেবে গড়ে তোলার শপথ নিতে পারেন। আর কিছু না হোক, প্রিয় নদীটির কথা ভেবে এ দিবস পালনের আহ্বান জানাই।
রিভারাইন পিপলের পক্ষে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকার স্টামফোর্ড, সিলেটের শাহজালাল ও রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে বিশ্ব নদী দিবসের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে; আগ্রহী ব্যক্তিরা সেখানে যোগ দিতে পারেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে রিভারাইন পিপলের ফেসবুক গ্রুপে (http://www.facebook.com/group.php?gid=33915816544)।
লেখকেরা: নদীবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রিভারাইন পিপলের সঙ্গে যুক্ত।
সন্দেহ নেই, নদীর প্রতি আমাদের সব সময়ই দায়িত্বশীল থাকা জরুরি। নদী যেমন নিরন্তর তার সিঞ্চনে ও সম্পদে আমাদের উপকার করে যাচ্ছে, তেমনি আমাদেরও উচিত মাস কিংবা মৌসুম ভেদে নদীর ব্যাপারে সচেতন থাকা। কিন্তু বহুমাত্রিক ব্যস্ততার এই যুগে নদীর প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করতে আলাদা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকারও করবে না। বাংলাদেশের জন্য তা আরও প্রাসঙ্গিক। কারণ, প্রাকৃতিকভাবে ‘নদীমাতৃক’ হলেও সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে আমরা নিজেদের নদীবৈরী জনগোষ্ঠী হিসেবে ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ দেশের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীগুলো আঞ্চলিক রাজনীতি এবং বহুজাতিক পুঁজির সর্বনাশা সম্প্রসারণেরও শিকার হয়েছে।
আমরা জানি, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা অববাহিকার প্রতিটি নদী কোনো না কোনোভাবে হিমালয়ের সঙ্গে যুক্ত। সেখানকার হিমবাহ ও বৃষ্টিপাতই এ দেশের শত শত নদীর চূড়ান্ত উৎস। সুউচ্চ ওই জলজ-রাজ্যে শুরু হয়েছে বাঁধের উৎপাত। ইন্টারন্যাশনাল রিভারসের একটি সমীক্ষায় আমরা দেখেছি, হিমালয় অঞ্চলে ৫৫২টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে আমাদের নদীর চূড়ান্ত সর্বনাশই হবে। রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের চোখরাঙানি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে একপর্যায়ে হিমালয়ের বরফ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হারে গলে যেতে পারে। এতে ভাটি অঞ্চল বাংলাদেশ প্রথম দিকে যেমন বন্যা ও নদীভাঙনে নাকাল হবে, পরের দিকে পড়বে পানিশূন্যতায়। সুদূর উজানে কেবল নয়, সীমান্ত ঘেঁষেও আমাদের ঘিরে ধরছে বাঁধের শেকল। পদ্মা, তিস্তা, ধরলা, মহানন্দা, গোমতী, মুহুরী, মনু, খোয়াই—কোনো নদীর আসন্ন উজানে বাঁধ নেই? সুরমা-কুশিয়ারার উজানে টিপাইমুখ-তোড়জোড় তো সর্বজনবিদিত। ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহারের দৈত্যকায় আয়োজনের কথাও বহুল শ্রুত। অস্বীকার করা যাবে না দেশের অভ্যন্তরের অপরিকল্পিত সেতু ও বাঁধের বিরূপ প্রভাবের কথাও।
শুধু কি বাঁধ? নদীতে নদীতে দখল-দূষণও কদর্য চেহারা নিয়েছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী-হালদা, সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা, নাটোরের নারদ, নেত্রকোনার মগড়া, বরিশালের কীর্তনখোলা, ফরিদপুরের কুমার, ময়মনসিংহের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা, বগুড়ার করতোয়া, যশোরের কপোতাক্ষ, খুলনার ময়ূরের মতো নগরসংলগ্ন নদ-নদীগুলো যেন অভিশপ্ত।
নদীর এ দুর্গতির জন্য কর্তৃপক্ষীয় অমনোযোগিতার পাশাপাশি নাগরিক অসচেতনতাও কম দায়ী নয়। আমরা যেভাবে সভ্যতা, কৃষি, যোগাযোগ, জীববৈচিত্র্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নদীর কাছে ঋণী, আর কোনো দেশ ততটা নয়। আবার নদীর প্রতি আমাদের ঔদাসীন্যেরও জুড়ি মেলা কঠিন। আশার কথা, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সাম্প্রতিক কালে নদীবিষয়ক সক্রিয়তা বেড়েছে। বেড়েছে গণমাধ্যমের মনোযোগও। এখন যদি নাগরিকেরা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়, মুমূর্ষু নদীগুলোকে স্বচ্ছতোয়া স্রোতস্বিনীতে রূপান্তর অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রেই বিশ্ব নদী দিবস ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্ব নদী দিবস ২০১০-এর জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিপাদ্য নেই। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল আলাদা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করতে পারবে। রিভারাইন পিপলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জন্য আমরা এই প্রতিপাদ্য তুলে ধরতে চাই—‘নদী আমাদের ডাকছে, সাড়া দিতে হবে’।
আমরা বিশ্বাস করি, নদী আমাদের ডাকছে; এখন সাড়া দিতে হবে। সাড়া নানাভাবে দেওয়া যায়। সচল নদী আমাদের অধিকার, ওই অধিকার নিশ্চিত করতে নদীর ডাকে সাড়া দিয়ে, নদীর জন্য কাজ করে যাওয়ার বিকল্প নেই। আজকের দিনে, সেপ্টেম্বরের শেষ রোববার, নদীর কল্যাণের জন্য প্রতীকী হলেও অন্তত কিছু কাজ আমরা করতে পারি। নদীবিষয়ক সাহিত্য, প্রবন্ধ লিখে কিংবা পড়ে, নদীবিষয়ক চলচ্চিত্র দেখে, নদীর ছবি তুলে কিংবা চিত্র এঁকে, নদীতে বেড়াতে গিয়ে, নদীর কথা আলোচনা করে দিনটি পালন করা যেতে পারে। অনুজ ও বিদ্যার্থীদের নদী রক্ষার শপথ করানো যেতে পারে। আজকে মা-বাবা তাঁর সন্তানকে নদী-সংবেদনশীল হিসেবে গড়ে তোলার শপথ নিতে পারেন। আর কিছু না হোক, প্রিয় নদীটির কথা ভেবে এ দিবস পালনের আহ্বান জানাই।
রিভারাইন পিপলের পক্ষে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকার স্টামফোর্ড, সিলেটের শাহজালাল ও রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে বিশ্ব নদী দিবসের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে; আগ্রহী ব্যক্তিরা সেখানে যোগ দিতে পারেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে রিভারাইন পিপলের ফেসবুক গ্রুপে (http://www.facebook.com/group.php?gid=33915816544)।
লেখকেরা: নদীবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রিভারাইন পিপলের সঙ্গে যুক্ত।
No comments