চার দিক-তিনি বৃদ্ধ হলেন... by শাশ্বতী বিপ্লব
মহাখালীর সিগন্যালে গাড়ি থামামাত্র একদল ভিক্ষুক গাড়িটিকে ঘিরে ধরল। নীলা তাকিয়ে দেখল—১০ বছরের একটি মেয়ে, হাতে একটি কাপড়। সে গাড়ি মোছা শুরু করেছে, একজন কম বয়সী মায়ের কোলে একটি বছরখানেক বয়সী শিশু আর তিনজন বৃদ্ধ, যাঁদের একজন নতুন, নীলা আগে দেখেনি।
অফিস থেকে ফিরতিপথে ট্রাফিক সিগন্যালের বেশির ভাগ ভিক্ষুককেই নীলা চেনে। প্রতিদিন দেখে দেখে মুখ চেনা হয়ে গেছে। কিন্তু নীলা খেয়াল করেছে, কিছুদিন পরপরই একটি-দুটি নতুন মুখ এদের সঙ্গে যোগ হয় এবং এর বেশির ভাগই প্রবীণ। নীলা ঢাকায় বড় হয়েছে, কিন্তু এর আগে এত প্রবীণ ভিক্ষুক দেখেছে কি না মনে করতে পারে না। সেদিন নীলার এক সহকর্মী বলছিল, বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্য কমছে না বাড়ছে, বুঝতে চাইলে বেশি গবেষণা করার দরকার নেই, ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে ভিক্ষুকের সংখ্যা খেয়াল করলেই তা বোঝা যাবে এবং প্রতিনিয়ত কারা এই দলে যুক্ত হচ্ছে তাও বোঝা যাবে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য নিয়ে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও অনেক হইচই চলছে। শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জনের জন্য জাতিসংঘ বাংলাদেশকে পুরস্কৃত করেছে। উন্নত দেশগুলো থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেলে অন্যান্য লক্ষ্য সঠিক সময়ের মধ্যে অর্জনের দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। নীলা এই নতুন প্রবীণ ভিক্ষুকের দিকে তাকিয়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অবস্থান নিয়ে ভাবতে থাকে।
নীলা খেয়াল করে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে একটি ওল্ড এইজ ব্লাইন্ড বা বার্ধক্য এবং এর অসহায়ত্ব ১৮৯ জন বিশ্বনেতার মনোযোগ কাড়তে ব্যর্থ হয়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অগ্রগতি পরিমাপের জন্য যে লক্ষ্য ও সূচকগুলো ঠিক করা হয়েছে, এর কোনোটিতেই সুনির্দিষ্টভাবে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে বিবেচনা করা হয়নি। যার ফলে অধিকাংশ উন্নয়ন নীতিমালা এবং কর্মসূচিতেই শিশু, তরুণ ও কর্মক্ষম দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। বার্ধক্যে মানুষের যে বিশেষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং নিবিড় তত্ত্ব্বাবধানের প্রয়োজন রয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষিত হয়েছে। বিগত ১০ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু পিছিয়ে পড়েছেন প্রবীণেরা। সবচেয়ে দরিদ্র ও অসহায়দের মধ্যে তাঁরা অবস্থান করছেন। মানুষের জন্মহার কমেছে, বেড়েছে আয়ু। তাই পৃথিবীব্যাপী ৬০+ বয়সী মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৫১ সালে যেভাবে ৬০+ বয়সী জনসংখ্যা ছিল ১.৯ মিলিয়ন (জনসংখ্যার ৪.৪%), ২০০৭ সালে সেটা ৯.৪ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে (৬.৬ শতাংশ)। ২০২৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১৪.৬ মিলিয়নে (নয় শতাংশ) পৌঁছাবে বলে মনে করছেন জনসংখ্যা বিশ্লেষকেরা। ২০০৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে যাঁর বয়স ৬০ বছর, তিনি আরও ১৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি দিন বাঁচবেন।
বার্ধক্যের সমস্যা বহুমাত্রিক। সার্বিকভাবে আমাদের আর্থসামাজিক ও পরিবার-কাঠামোকে পর্যালোচনা করলে প্রবীণদের অসহায়ত্বের মাত্রা বোঝা যায়। বাংলাদেশের পরিবার-কাঠামো ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবারের ধারণা এখন আর জনপ্রিয় নয়। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের ভূমিকা এবং তাঁদের প্রতি বিশেষ মর্যাদা প্রদর্শনের ঐতিহ্য ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে, প্রবীণেরা ততই নিঃসঙ্গ ও অসহায় হয়ে পড়ছেন। নিয়মিত আয়ের উৎস না থাকা, সঠিক ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার অভাব, পরিবারের ভেতরে গুরুত্ব কমে যাওয়া এবং সর্বোপরি নিঃসঙ্গতা বার্ধক্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তের মধ্যে এই দৃশ্যপটের খুব একটা ব্যতিক্রম চোখে পড়ে না।
মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘার মতো অকালবন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙনের মতো বিবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে মানুষ আজ শহরমুখো। বাস্তুভিটা হারানো এই বিপুল অভিবাসী মানুষের মিছিলে প্রবীণদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। গাছপালা, নদী-নালার চিরচেনা নিজের বসত ছেড়ে ইট-পাথরের এই নগরে সর্বস্ব হারানো এই প্রবীণেরা কীভাবে বেঁচে আছেন, তার খোঁজ কি আমরা কেউ নিয়েছি?
এখনো প্রায় ৫৬ মিলিয়ন মানুষ (প্রায় ৪০ শতাংশ) দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যার মধ্যে ৩৫ মিলিয়ন নিম্নদারিদ্র্যসীমার নিচে বা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। আমরা যদি অগ্রজ প্রজন্মের দারিদ্র্য দূর করতে না পারি, তবে তার পরবর্তী প্রজন্মও দরিদ্র থেকে যাবে। চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তাদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে উদ্যোগ না নিলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে যেসব সামাজিক বিনিয়োগ করা হয়, তার সুফল তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া কখনোই সম্ভব হবে না।
আমাদের সমাজে তীব্র জেন্ডার-বৈষম্য থাকার কারণে প্রবীণ নারীদের অবস্থা আরও বেশি শোচনীয়। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, বাংলাদেশে ৯১ শতাংশ প্রবীণ নারী বিধবা বা পরিত্যক্তা, যেখানে প্রবীণ পুরুষদের মধ্যে এর পরিমাণ মাত্র নয় শতাংশ। একটি বৈষম্যভিত্তিক সমাজে একজন মানুষ যখন একাধারে নারী, বিধবা, দরিদ্র ও প্রবীণ, তখন তার দারিদ্র্য ও অসহায়ত্বের মাত্রা সহজেই অনুুমেয়।
আজ ১ অক্টোবর, আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে নীলার কাছে মনে হয় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অর্জনগুলো বয়স, লিঙ্গ, জাতিসত্তা এবং প্রতিবন্ধীদের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা জরুরি। আর তা হলেই বোঝা যাবে, আজ যারা সত্যিকার অর্থেই পিছিয়ে আছে, যারা দারিদ্র্যের মধ্যেও দরিদ্র, তাদের হ্রাসের ক্ষেত্রে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য কতটুকু কার্যকরভাবে অর্জিত হয়েছে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য নিয়ে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও অনেক হইচই চলছে। শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জনের জন্য জাতিসংঘ বাংলাদেশকে পুরস্কৃত করেছে। উন্নত দেশগুলো থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেলে অন্যান্য লক্ষ্য সঠিক সময়ের মধ্যে অর্জনের দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। নীলা এই নতুন প্রবীণ ভিক্ষুকের দিকে তাকিয়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অবস্থান নিয়ে ভাবতে থাকে।
নীলা খেয়াল করে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে একটি ওল্ড এইজ ব্লাইন্ড বা বার্ধক্য এবং এর অসহায়ত্ব ১৮৯ জন বিশ্বনেতার মনোযোগ কাড়তে ব্যর্থ হয়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অগ্রগতি পরিমাপের জন্য যে লক্ষ্য ও সূচকগুলো ঠিক করা হয়েছে, এর কোনোটিতেই সুনির্দিষ্টভাবে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে বিবেচনা করা হয়নি। যার ফলে অধিকাংশ উন্নয়ন নীতিমালা এবং কর্মসূচিতেই শিশু, তরুণ ও কর্মক্ষম দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। বার্ধক্যে মানুষের যে বিশেষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং নিবিড় তত্ত্ব্বাবধানের প্রয়োজন রয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষিত হয়েছে। বিগত ১০ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু পিছিয়ে পড়েছেন প্রবীণেরা। সবচেয়ে দরিদ্র ও অসহায়দের মধ্যে তাঁরা অবস্থান করছেন। মানুষের জন্মহার কমেছে, বেড়েছে আয়ু। তাই পৃথিবীব্যাপী ৬০+ বয়সী মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৫১ সালে যেভাবে ৬০+ বয়সী জনসংখ্যা ছিল ১.৯ মিলিয়ন (জনসংখ্যার ৪.৪%), ২০০৭ সালে সেটা ৯.৪ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে (৬.৬ শতাংশ)। ২০২৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১৪.৬ মিলিয়নে (নয় শতাংশ) পৌঁছাবে বলে মনে করছেন জনসংখ্যা বিশ্লেষকেরা। ২০০৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে যাঁর বয়স ৬০ বছর, তিনি আরও ১৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি দিন বাঁচবেন।
বার্ধক্যের সমস্যা বহুমাত্রিক। সার্বিকভাবে আমাদের আর্থসামাজিক ও পরিবার-কাঠামোকে পর্যালোচনা করলে প্রবীণদের অসহায়ত্বের মাত্রা বোঝা যায়। বাংলাদেশের পরিবার-কাঠামো ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবারের ধারণা এখন আর জনপ্রিয় নয়। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের ভূমিকা এবং তাঁদের প্রতি বিশেষ মর্যাদা প্রদর্শনের ঐতিহ্য ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে, প্রবীণেরা ততই নিঃসঙ্গ ও অসহায় হয়ে পড়ছেন। নিয়মিত আয়ের উৎস না থাকা, সঠিক ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার অভাব, পরিবারের ভেতরে গুরুত্ব কমে যাওয়া এবং সর্বোপরি নিঃসঙ্গতা বার্ধক্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তের মধ্যে এই দৃশ্যপটের খুব একটা ব্যতিক্রম চোখে পড়ে না।
মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘার মতো অকালবন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙনের মতো বিবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে মানুষ আজ শহরমুখো। বাস্তুভিটা হারানো এই বিপুল অভিবাসী মানুষের মিছিলে প্রবীণদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। গাছপালা, নদী-নালার চিরচেনা নিজের বসত ছেড়ে ইট-পাথরের এই নগরে সর্বস্ব হারানো এই প্রবীণেরা কীভাবে বেঁচে আছেন, তার খোঁজ কি আমরা কেউ নিয়েছি?
এখনো প্রায় ৫৬ মিলিয়ন মানুষ (প্রায় ৪০ শতাংশ) দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যার মধ্যে ৩৫ মিলিয়ন নিম্নদারিদ্র্যসীমার নিচে বা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। আমরা যদি অগ্রজ প্রজন্মের দারিদ্র্য দূর করতে না পারি, তবে তার পরবর্তী প্রজন্মও দরিদ্র থেকে যাবে। চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তাদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে উদ্যোগ না নিলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে যেসব সামাজিক বিনিয়োগ করা হয়, তার সুফল তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া কখনোই সম্ভব হবে না।
আমাদের সমাজে তীব্র জেন্ডার-বৈষম্য থাকার কারণে প্রবীণ নারীদের অবস্থা আরও বেশি শোচনীয়। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, বাংলাদেশে ৯১ শতাংশ প্রবীণ নারী বিধবা বা পরিত্যক্তা, যেখানে প্রবীণ পুরুষদের মধ্যে এর পরিমাণ মাত্র নয় শতাংশ। একটি বৈষম্যভিত্তিক সমাজে একজন মানুষ যখন একাধারে নারী, বিধবা, দরিদ্র ও প্রবীণ, তখন তার দারিদ্র্য ও অসহায়ত্বের মাত্রা সহজেই অনুুমেয়।
আজ ১ অক্টোবর, আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে নীলার কাছে মনে হয় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অর্জনগুলো বয়স, লিঙ্গ, জাতিসত্তা এবং প্রতিবন্ধীদের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা জরুরি। আর তা হলেই বোঝা যাবে, আজ যারা সত্যিকার অর্থেই পিছিয়ে আছে, যারা দারিদ্র্যের মধ্যেও দরিদ্র, তাদের হ্রাসের ক্ষেত্রে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য কতটুকু কার্যকরভাবে অর্জিত হয়েছে।
No comments