খোলা চোখে-নিষিদ্ধ গ্রন্থ সপ্তাহ by হাসান ফেরদৌস
প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আমেরিকায় নিষিদ্ধ গ্রন্থ সপ্তাহ উদ্যাপন করা হয়। আমেরিকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন এই উদ্যাপনের উদ্যোক্তা। ১৯৮২ সাল থেকে এই উদ্যাপন চলে আসছে। উদ্দেশ্য এ কথাটা বোঝানো যে বই নিষিদ্ধ করা মানে কারও না কারও নিজস্ব মত প্রকাশের অধিকার হরণ করা।
আজ যদি অন্যের সে অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, দুই দিন পরে আমার সে অধিকার যে অপহূত হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
আমেরিকা অত্যন্ত রক্ষণশীল দেশ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এরা জান দিতে প্রস্তুত, কিন্তু কোনো মত পছন্দ না হলে অন্যের গলা টিপে ধরতেও এরা বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না। এ দেশে ধর্ম ও নৈতিকতার অজুহাতে যত বই নিষিদ্ধ হয়েছে, এক কমিউনিস্ট দেশ ছাড়া তার তুলনা মেলা ভার। সাম্প্রতিক সময়ে রক্ষণশীল রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় বইয়ের ওপর আক্রমণ বেড়ে গেছে। শুধু বই নয়, ফিল্ম, গান, এমনকি চিত্রকলার ওপরও নানা রকম সেন্সরশিপ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আদর্শগত বা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, এমন যেকোনো কিছুই আক্রমণের শিকার হতে পারে। আক্রমণের এই তালিকায় যেমন ডারউইন ও তাঁর বিবর্তনবাদ রয়েছে, তেমনি রয়েছে কোনো কোনো ধর্মগ্রন্থ।
ধর্মের দোহাই দিয়ে বই নিষিদ্ধ করা ও তা পুড়িয়ে ফেলা নতুন কোনো ঘটনা নয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ধর্মের নামে বিতর্কিত কোনো কিছু চোখে পড়লে সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে সে বই নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনটা ক্ষতিকর, বই সম্পর্কে এমন সিদ্ধান্ত নেবে কে? একসময় বই নিষিদ্ধ করার কাজে নেতৃত্ব দিতেন ধর্মীয় নেতারা। ১৪৫৫ সালে গুটেনবার্গ আবিষ্কার করেন ছাপাখানা, তারপর থেকেই মুদ্রিত বইয়ের প্রকাশনা ও বিক্রি শুরু। যত দিন হাতে লেখা বই সীমিত সংখ্যায় বিলি হতো, কেউ তা নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামায়নি। কিন্তু ছাপা বই মানে সে বই যে কেউ সংগ্রহ করতে পারে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তা অনায়াসে পাঠিয়েও দেওয়া যায়। ক্যাথলিক চার্চের জন্য ব্যাপারটা উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। প্রথম আঘাতটা আসে মার্টিন লুথারের বিরুদ্ধে। এই জার্মান পাদরি ও ধর্মবিষয়ক তাত্ত্বিক, যাঁকে রিফরমেশন আন্দোলনের নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ভ্যাটিকানের ক্যাথলিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু করলে তাঁর বই নিষিদ্ধ করা হয়। পোপ তাঁকে ধর্মচ্যুত করেন এবং তাঁরই নির্দেশে ইতালির রাজা লুথারকে অপরাধী বলে ঘোষণা করেন। সেটা ১৫২১ সালের কথা। এরপর ১৫৬৪ সালে ভ্যাটিকান থেকে প্রকাশ করা হলো নিষিদ্ধ গ্রন্থের তালিকা—Index librorium prohibitorium. কোন বই পুনর্মুদ্রণ করা যাবে না, কোন বই বিলি করা যাবে না, কোন বই পড়লে তা পাপ বলে বিবেচিত হবে, তার লম্বা ফিরিস্তি। সেই থেকে শুরু। এরপর অসংখ্য বই নিষিদ্ধ হয়েছে, পোড়ানো হয়েছে, বইয়ের লেখককে জেলে ভরা হয়েছে, এমনকি হত্যাও করা হয়েছে। এখনো হচ্ছে।
কোনো কোনো বই যে সত্যি সত্যি ক্ষতিকর, সে কথায় ভুল নেই। এক ধর্মের বা গোত্রের মানুষকে অন্য ধর্ম বা গোত্রের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে যে বই লেখা, আমি মূলত সেসব বইয়ের কথাই বলছি। সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস সে রকম একটি বই। তা নিয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড হলো, তাতে মানুষ মারা গেছে—অধিকাংশই নিরীহ ও অরাজনৈতিক একাধিক দেশে। আবার এমন অনেক বই কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে, যা কোনো দল বা গোত্রের কাছে যেকোনো কারণেই হোক, না-পছন্দ হয়েছে। বইয়ের গুণাগুণ, তার বক্তব্যের যৌক্তিকতা, তাদের কাছে বিচার্য হয়নি। এ তালিকায় রয়েছে মার্ক টোয়েনের হাকলবেরি ফিন, ডি এইচ লরেনসের লেডি চ্যাটারলিস লাভার, বুদ্ধদেব বসুর রাত ভ’রে বৃষ্টি। এমনকি ফকনারের অব মেন অ্যান্ড মাউসও নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছিল। সামরিক একনায়কতন্ত্র এবং স্বেচ্ছাচারী ও কমিউনিস্ট দেশে বই নিষিদ্ধ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। চীনে ও সোভিয়েত ইউনিয়নে সরকারি লাইনের বাইরে আধ পা হাঁটলেও বই নিষিদ্ধ হতো, লেখককে জেলে পোরা হতো বা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হতো। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হয়েছে এমন লেখকের সংখ্যাও অসংখ্য।
বই মূলত নিষিদ্ধ করা হয় ভয় থেকে। বইয়ে যে নতুন সত্য আবিষ্কৃত হলো, প্রচলিত ধ্যান-ধারণার তা বিরোধী হলেই পিলে চমকে ওঠে যাজক মহাশয়ের, স্কুলপণ্ডিতের, পাড়ার মাতব্বরের, সরকারের মন্ত্রীর। ঠিক এ কারণেই চার্লস ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিস গ্রন্থটির ওপর সেন্সরের কুঠার নেমে এসেছিল। ব্রিটিশরাজের হাতে নজরুলের বই নিষিদ্ধ হয়েছিল একই কারণে। বই নিষিদ্ধ করে কি কোনো লাভ হয়? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় না, যেমন হয়নি অরিজিন অব স্পিসিস নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করে। বই নিষিদ্ধ করা মানে সে বইয়ে যে ‘আইডিয়ার’ কথা বলা হয়েছে, তাকে ঠেকানোর চেষ্টা। কিন্তু শুধু বই নিষিদ্ধ করে কোনো অর্থপূর্ণ ‘আইডিয়া’ নিষিদ্ধ করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে হিতে বিপরীত ঘটেছে। নিষিদ্ধ না হলে সে বইয়ের কথা হয়তো অনেকে জানতও না। নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাতে এমন কী গোপন কথা আছে, তা জানার জন্য সবাই তন্নতন্ন করে সে বই খোঁজা শুরু করে। এ কথাটা কাগজে-কলমে লিখে জানিয়েছিলেন মার্ক টোয়েন ১৯০২ সালে, ওমাহার পাবলিক লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ তাঁর হাকলবেরি ফিন উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করেছে এ কথা জানার পর। অভিযোগ ছিল, মার্ক টোয়েন যে ভাষায় লিখেছেন তা রুচিবিরুদ্ধ। কোমলমতি ছেলেমেয়েরা সে বই পড়লে তাদের নৈতিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে কথা জানতে পেরে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় পাঠানো এক টেলিগ্রামে মার্ক টোয়েন লিখলেন:
‘আমি এই ভেবে ভীত ও অশ্রুকাতর হয়ে পড়েছি যে (আপনাদের এই সিদ্ধান্তের ফলে) চারদিকে যে রকম প্রচার শুরু হয়েছে, তাতে বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে। যাঁদের এত দিন বিন্দুমাত্র পঙ্কিলতা স্পর্শ করেনি, তাঁদের কেউ কেউ এখন এই বই পড়া শুরু করেছেন। তাঁরা স্বভাবত জানতে চান, এমন কী আছে এই বইয়ে যে তাঁকে নিষিদ্ধ করা হলো। ফলে আগে যাঁরা এই বইয়ের নামও শোনেননি, এখন তাঁরা এই বই পড়তে আগ্রহী হবেন এবং ফলে তাঁদের নৈতিকতা সমূলে বিনষ্ট হবে। আমার এখন রুমাল নিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। আমার প্রকাশকেরা কিন্তু (আপনাদের এই সিদ্ধান্তে) মহা খুশি। আমার বই নিষিদ্ধ করার এই চক্রান্ত আসলে পুস্তক প্রকাশকদের। তাঁদের গুদামে আমার (অবিক্রীত) বই পড়ে থেকে জায়গা দখল করে ছিল, এখন এই হুজ্জতের ফলে সে মাল হু হু করে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। পুস্তক প্রকাশকেরা নিজের লাভের জন্য কী না করতে পারে, তা আপনারা ভাবতেও পারবেন না। আমি পারি, কারণ আমি নিজে একসময় পুস্তক প্রকাশক ছিলাম।’
হাকলবেরি ফিন নিষিদ্ধ হয়েছিল শুনে এখন আমরা হয়তো হো হো করে হাসি। এমন নির্ভেজাল কিশোর অ্যাডভেঞ্চার পড়ে গত ১০০ বছর সারা পৃথিবীর ছেলে-বুড়ো আনন্দ পেয়েছে। তাতে কারও নৈতিকতা কীটদষ্ট হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে কোনো কোনো বই বা সিনেমা আছে, যা সত্যি ক্ষতিকর। কয়েক বছর আগে আমেরিকায় ন্যাচারাল বর্ন কিলার্স নামে একটি ফিল্ম হয়েছিল। মহা রক্তারক্তি কাণ্ড সেই ফিল্মে। তা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে লুইজিয়ানায় এক লোক ঠান্ডা মাথায় একজনকে খুন করে। আদালতের রায়ে সে ফিল্মের পরিচালক-প্রযোজক দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। একই কাণ্ড হয়েছিল হিটম্যান নামের এক বই নিয়ে। সেখানেও বইয়ের লেখককে জরিমানা করা হয়েছিল অপরাধের সহযোগী হিসেবে। একই কথা বলা যায় পর্নোগ্রাফি নিয়ে। ক্ষতিকর এই বিবেচনা থেকে সব ধরনের পর্নোগ্রাফির ওপর নিষিদ্ধতা অনেক দেশেই চাপিয়ে দেওয়া হয়। নৈতিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই যুক্তিতে আজকাল ইন্টারনেটের ওপরও নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ হচ্ছে।
বই নিষিদ্ধ করার ব্যাপারটি আমেরিকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় পর্যায়ে গৃহীত হয়ে থাকে। স্কুল বোর্ড বা লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ ঠিক করতে পারে, তারা কোন বই কালো তালিকাভুক্ত করবে। রাজ্য সরকার বা আইন পরিষদ নিজেদের স্থানীয় দাবি মাথায় রেখেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ফলে দেখা যাবে, এক বই দেশের ৪৯টি রাজ্যে চালু, শুধু এক রাজ্যে নিষিদ্ধ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বই বাজেয়াপ্ত বা নিষিদ্ধ করার পেছনে কাজ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আমাদের দেশে বই নিষিদ্ধ করার কাজটি করে সরকার। এ নিয়ে কারও সঙ্গে সলাপরামর্শ করা, জনগণ কী ভাবে, তা হিসাবে নেওয়ার কোনো বালাই নেই।
কোন বই ভালো, কোন বই মন্দ, এই সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে কেন? ভালোমন্দ বিচারের ক্ষমতা কি দেশের মানুষের নিজেদের নেই? সরকার কি জনগণের মাথার ওপর বসে থাকা একজন অভিভাবক, তারা বলে না দেওয়া পর্যন্ত ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা দেশের নাগরিকদের হয় না? কোন কোন বই পড়লে বা ফিল্ম দেখলে কোমলমতি শিশুদের নৈতিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তর্কের খাতিরে সে যুক্তি না-হয় মানলাম, কিন্তু এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সরকার না নিয়ে যদি পিতা-মাতা নিজেরা নেন, সেটাই কি অধিক শোভন হয় না?
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার দেশের সব মসজিদ ও লাইব্রেরিতে মৌলবাদী ধর্মীয় নেতা মওদুদির সব গ্রন্থ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমরা জানি, মওদুদি অতি-উগ্র এক মৌলবাদী দর্শনের প্রচারক। তাঁর গ্রন্থ পাঠ মানুষের মনে জাতি-বিদ্বেষ জাগায়, তাদের হিংস্র করে। এ যুক্তিতে মওদুদির গ্রন্থের এই নিষিদ্ধকরণ বাংলাদেশে স্বাগত জানানো হয়েছে। মওদুদির বই নিষিদ্ধ করা হলো মানে, সে বই আর পাওয়া যাবে না, তেমন ভাবা অবাস্তব। ইন্টারনেটের যুগে বোতাম টিপলেই প্রায় যেকোনো বই হাতের নাগালে আনা যায়। বইয়ে থাকে আইডিয়া, সে আইডিয়া যদি ক্ষতিকর হয়, নিষিদ্ধ করার বদলে তা কেন ক্ষতিকর তার ব্যাখ্যা হিসেবে চাই পাল্টা আইডিয়া। সে পাল্টা আইডিয়া দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের নয়, দেশের বুদ্ধিজীবী মনস্বীজনের। বই নিষিদ্ধ হলে তাঁদের ভাবনার জগৎও সীমিত হয়ে আসে। সরকারের পছন্দ না হলে তাঁদের যেকোনো আইডিয়া নিষিদ্ধ হতে পারে, এই ভয় যদি একবার তাঁদের মন জুড়ে বসে, বুদ্ধিজীবী হয়ে পড়বেন ক্ষমতাশীল চক্রের বশংবদ, তাদের অনুগত প্রচারবিদ।
নিষিদ্ধ গ্রন্থ সপ্তাহে আমাদের দাবি হোক, সব ধরনের বই পাঠের জন্য উন্মুক্ত থাকুক। কোনো বই ভালো কি মন্দ, তার বিচার করব আমরা পাঠকেরা, সরকারের কোনো মন্ত্রী বা আমলা নন।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১০, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
আমেরিকা অত্যন্ত রক্ষণশীল দেশ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এরা জান দিতে প্রস্তুত, কিন্তু কোনো মত পছন্দ না হলে অন্যের গলা টিপে ধরতেও এরা বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না। এ দেশে ধর্ম ও নৈতিকতার অজুহাতে যত বই নিষিদ্ধ হয়েছে, এক কমিউনিস্ট দেশ ছাড়া তার তুলনা মেলা ভার। সাম্প্রতিক সময়ে রক্ষণশীল রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় বইয়ের ওপর আক্রমণ বেড়ে গেছে। শুধু বই নয়, ফিল্ম, গান, এমনকি চিত্রকলার ওপরও নানা রকম সেন্সরশিপ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আদর্শগত বা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, এমন যেকোনো কিছুই আক্রমণের শিকার হতে পারে। আক্রমণের এই তালিকায় যেমন ডারউইন ও তাঁর বিবর্তনবাদ রয়েছে, তেমনি রয়েছে কোনো কোনো ধর্মগ্রন্থ।
ধর্মের দোহাই দিয়ে বই নিষিদ্ধ করা ও তা পুড়িয়ে ফেলা নতুন কোনো ঘটনা নয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ধর্মের নামে বিতর্কিত কোনো কিছু চোখে পড়লে সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে সে বই নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনটা ক্ষতিকর, বই সম্পর্কে এমন সিদ্ধান্ত নেবে কে? একসময় বই নিষিদ্ধ করার কাজে নেতৃত্ব দিতেন ধর্মীয় নেতারা। ১৪৫৫ সালে গুটেনবার্গ আবিষ্কার করেন ছাপাখানা, তারপর থেকেই মুদ্রিত বইয়ের প্রকাশনা ও বিক্রি শুরু। যত দিন হাতে লেখা বই সীমিত সংখ্যায় বিলি হতো, কেউ তা নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামায়নি। কিন্তু ছাপা বই মানে সে বই যে কেউ সংগ্রহ করতে পারে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তা অনায়াসে পাঠিয়েও দেওয়া যায়। ক্যাথলিক চার্চের জন্য ব্যাপারটা উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। প্রথম আঘাতটা আসে মার্টিন লুথারের বিরুদ্ধে। এই জার্মান পাদরি ও ধর্মবিষয়ক তাত্ত্বিক, যাঁকে রিফরমেশন আন্দোলনের নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ভ্যাটিকানের ক্যাথলিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু করলে তাঁর বই নিষিদ্ধ করা হয়। পোপ তাঁকে ধর্মচ্যুত করেন এবং তাঁরই নির্দেশে ইতালির রাজা লুথারকে অপরাধী বলে ঘোষণা করেন। সেটা ১৫২১ সালের কথা। এরপর ১৫৬৪ সালে ভ্যাটিকান থেকে প্রকাশ করা হলো নিষিদ্ধ গ্রন্থের তালিকা—Index librorium prohibitorium. কোন বই পুনর্মুদ্রণ করা যাবে না, কোন বই বিলি করা যাবে না, কোন বই পড়লে তা পাপ বলে বিবেচিত হবে, তার লম্বা ফিরিস্তি। সেই থেকে শুরু। এরপর অসংখ্য বই নিষিদ্ধ হয়েছে, পোড়ানো হয়েছে, বইয়ের লেখককে জেলে ভরা হয়েছে, এমনকি হত্যাও করা হয়েছে। এখনো হচ্ছে।
কোনো কোনো বই যে সত্যি সত্যি ক্ষতিকর, সে কথায় ভুল নেই। এক ধর্মের বা গোত্রের মানুষকে অন্য ধর্ম বা গোত্রের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে যে বই লেখা, আমি মূলত সেসব বইয়ের কথাই বলছি। সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস সে রকম একটি বই। তা নিয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড হলো, তাতে মানুষ মারা গেছে—অধিকাংশই নিরীহ ও অরাজনৈতিক একাধিক দেশে। আবার এমন অনেক বই কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে, যা কোনো দল বা গোত্রের কাছে যেকোনো কারণেই হোক, না-পছন্দ হয়েছে। বইয়ের গুণাগুণ, তার বক্তব্যের যৌক্তিকতা, তাদের কাছে বিচার্য হয়নি। এ তালিকায় রয়েছে মার্ক টোয়েনের হাকলবেরি ফিন, ডি এইচ লরেনসের লেডি চ্যাটারলিস লাভার, বুদ্ধদেব বসুর রাত ভ’রে বৃষ্টি। এমনকি ফকনারের অব মেন অ্যান্ড মাউসও নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছিল। সামরিক একনায়কতন্ত্র এবং স্বেচ্ছাচারী ও কমিউনিস্ট দেশে বই নিষিদ্ধ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। চীনে ও সোভিয়েত ইউনিয়নে সরকারি লাইনের বাইরে আধ পা হাঁটলেও বই নিষিদ্ধ হতো, লেখককে জেলে পোরা হতো বা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হতো। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হয়েছে এমন লেখকের সংখ্যাও অসংখ্য।
বই মূলত নিষিদ্ধ করা হয় ভয় থেকে। বইয়ে যে নতুন সত্য আবিষ্কৃত হলো, প্রচলিত ধ্যান-ধারণার তা বিরোধী হলেই পিলে চমকে ওঠে যাজক মহাশয়ের, স্কুলপণ্ডিতের, পাড়ার মাতব্বরের, সরকারের মন্ত্রীর। ঠিক এ কারণেই চার্লস ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিস গ্রন্থটির ওপর সেন্সরের কুঠার নেমে এসেছিল। ব্রিটিশরাজের হাতে নজরুলের বই নিষিদ্ধ হয়েছিল একই কারণে। বই নিষিদ্ধ করে কি কোনো লাভ হয়? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় না, যেমন হয়নি অরিজিন অব স্পিসিস নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করে। বই নিষিদ্ধ করা মানে সে বইয়ে যে ‘আইডিয়ার’ কথা বলা হয়েছে, তাকে ঠেকানোর চেষ্টা। কিন্তু শুধু বই নিষিদ্ধ করে কোনো অর্থপূর্ণ ‘আইডিয়া’ নিষিদ্ধ করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে হিতে বিপরীত ঘটেছে। নিষিদ্ধ না হলে সে বইয়ের কথা হয়তো অনেকে জানতও না। নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাতে এমন কী গোপন কথা আছে, তা জানার জন্য সবাই তন্নতন্ন করে সে বই খোঁজা শুরু করে। এ কথাটা কাগজে-কলমে লিখে জানিয়েছিলেন মার্ক টোয়েন ১৯০২ সালে, ওমাহার পাবলিক লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ তাঁর হাকলবেরি ফিন উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করেছে এ কথা জানার পর। অভিযোগ ছিল, মার্ক টোয়েন যে ভাষায় লিখেছেন তা রুচিবিরুদ্ধ। কোমলমতি ছেলেমেয়েরা সে বই পড়লে তাদের নৈতিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে কথা জানতে পেরে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় পাঠানো এক টেলিগ্রামে মার্ক টোয়েন লিখলেন:
‘আমি এই ভেবে ভীত ও অশ্রুকাতর হয়ে পড়েছি যে (আপনাদের এই সিদ্ধান্তের ফলে) চারদিকে যে রকম প্রচার শুরু হয়েছে, তাতে বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে। যাঁদের এত দিন বিন্দুমাত্র পঙ্কিলতা স্পর্শ করেনি, তাঁদের কেউ কেউ এখন এই বই পড়া শুরু করেছেন। তাঁরা স্বভাবত জানতে চান, এমন কী আছে এই বইয়ে যে তাঁকে নিষিদ্ধ করা হলো। ফলে আগে যাঁরা এই বইয়ের নামও শোনেননি, এখন তাঁরা এই বই পড়তে আগ্রহী হবেন এবং ফলে তাঁদের নৈতিকতা সমূলে বিনষ্ট হবে। আমার এখন রুমাল নিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। আমার প্রকাশকেরা কিন্তু (আপনাদের এই সিদ্ধান্তে) মহা খুশি। আমার বই নিষিদ্ধ করার এই চক্রান্ত আসলে পুস্তক প্রকাশকদের। তাঁদের গুদামে আমার (অবিক্রীত) বই পড়ে থেকে জায়গা দখল করে ছিল, এখন এই হুজ্জতের ফলে সে মাল হু হু করে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। পুস্তক প্রকাশকেরা নিজের লাভের জন্য কী না করতে পারে, তা আপনারা ভাবতেও পারবেন না। আমি পারি, কারণ আমি নিজে একসময় পুস্তক প্রকাশক ছিলাম।’
হাকলবেরি ফিন নিষিদ্ধ হয়েছিল শুনে এখন আমরা হয়তো হো হো করে হাসি। এমন নির্ভেজাল কিশোর অ্যাডভেঞ্চার পড়ে গত ১০০ বছর সারা পৃথিবীর ছেলে-বুড়ো আনন্দ পেয়েছে। তাতে কারও নৈতিকতা কীটদষ্ট হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে কোনো কোনো বই বা সিনেমা আছে, যা সত্যি ক্ষতিকর। কয়েক বছর আগে আমেরিকায় ন্যাচারাল বর্ন কিলার্স নামে একটি ফিল্ম হয়েছিল। মহা রক্তারক্তি কাণ্ড সেই ফিল্মে। তা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে লুইজিয়ানায় এক লোক ঠান্ডা মাথায় একজনকে খুন করে। আদালতের রায়ে সে ফিল্মের পরিচালক-প্রযোজক দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। একই কাণ্ড হয়েছিল হিটম্যান নামের এক বই নিয়ে। সেখানেও বইয়ের লেখককে জরিমানা করা হয়েছিল অপরাধের সহযোগী হিসেবে। একই কথা বলা যায় পর্নোগ্রাফি নিয়ে। ক্ষতিকর এই বিবেচনা থেকে সব ধরনের পর্নোগ্রাফির ওপর নিষিদ্ধতা অনেক দেশেই চাপিয়ে দেওয়া হয়। নৈতিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই যুক্তিতে আজকাল ইন্টারনেটের ওপরও নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ হচ্ছে।
বই নিষিদ্ধ করার ব্যাপারটি আমেরিকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় পর্যায়ে গৃহীত হয়ে থাকে। স্কুল বোর্ড বা লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ ঠিক করতে পারে, তারা কোন বই কালো তালিকাভুক্ত করবে। রাজ্য সরকার বা আইন পরিষদ নিজেদের স্থানীয় দাবি মাথায় রেখেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ফলে দেখা যাবে, এক বই দেশের ৪৯টি রাজ্যে চালু, শুধু এক রাজ্যে নিষিদ্ধ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বই বাজেয়াপ্ত বা নিষিদ্ধ করার পেছনে কাজ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আমাদের দেশে বই নিষিদ্ধ করার কাজটি করে সরকার। এ নিয়ে কারও সঙ্গে সলাপরামর্শ করা, জনগণ কী ভাবে, তা হিসাবে নেওয়ার কোনো বালাই নেই।
কোন বই ভালো, কোন বই মন্দ, এই সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে কেন? ভালোমন্দ বিচারের ক্ষমতা কি দেশের মানুষের নিজেদের নেই? সরকার কি জনগণের মাথার ওপর বসে থাকা একজন অভিভাবক, তারা বলে না দেওয়া পর্যন্ত ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা দেশের নাগরিকদের হয় না? কোন কোন বই পড়লে বা ফিল্ম দেখলে কোমলমতি শিশুদের নৈতিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তর্কের খাতিরে সে যুক্তি না-হয় মানলাম, কিন্তু এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সরকার না নিয়ে যদি পিতা-মাতা নিজেরা নেন, সেটাই কি অধিক শোভন হয় না?
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার দেশের সব মসজিদ ও লাইব্রেরিতে মৌলবাদী ধর্মীয় নেতা মওদুদির সব গ্রন্থ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমরা জানি, মওদুদি অতি-উগ্র এক মৌলবাদী দর্শনের প্রচারক। তাঁর গ্রন্থ পাঠ মানুষের মনে জাতি-বিদ্বেষ জাগায়, তাদের হিংস্র করে। এ যুক্তিতে মওদুদির গ্রন্থের এই নিষিদ্ধকরণ বাংলাদেশে স্বাগত জানানো হয়েছে। মওদুদির বই নিষিদ্ধ করা হলো মানে, সে বই আর পাওয়া যাবে না, তেমন ভাবা অবাস্তব। ইন্টারনেটের যুগে বোতাম টিপলেই প্রায় যেকোনো বই হাতের নাগালে আনা যায়। বইয়ে থাকে আইডিয়া, সে আইডিয়া যদি ক্ষতিকর হয়, নিষিদ্ধ করার বদলে তা কেন ক্ষতিকর তার ব্যাখ্যা হিসেবে চাই পাল্টা আইডিয়া। সে পাল্টা আইডিয়া দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের নয়, দেশের বুদ্ধিজীবী মনস্বীজনের। বই নিষিদ্ধ হলে তাঁদের ভাবনার জগৎও সীমিত হয়ে আসে। সরকারের পছন্দ না হলে তাঁদের যেকোনো আইডিয়া নিষিদ্ধ হতে পারে, এই ভয় যদি একবার তাঁদের মন জুড়ে বসে, বুদ্ধিজীবী হয়ে পড়বেন ক্ষমতাশীল চক্রের বশংবদ, তাদের অনুগত প্রচারবিদ।
নিষিদ্ধ গ্রন্থ সপ্তাহে আমাদের দাবি হোক, সব ধরনের বই পাঠের জন্য উন্মুক্ত থাকুক। কোনো বই ভালো কি মন্দ, তার বিচার করব আমরা পাঠকেরা, সরকারের কোনো মন্ত্রী বা আমলা নন।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১০, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments