গন্তব্য ঢাকা-বড়লোক হওয়ার সাধ নেই by শর্মিলা সিনড্রেলা
গ্রামের কাছ দিয়ে বয়ে চলেছে তিতাস নদী। মাথার ওপর স্নিগ্ধ আকাশ। পায়ের নিচে সবুজ ঘাসের নরম পরশ। মন মাতানো এক জগৎ যেন। কিন্তু ছেলেটি বেশ দাপুটে স্বভাবের। দিনরাত বাঁদরামি করে, পড়াশোনায় মনোযোগ নেই। বাবা-মা চিন্তিত কী করা যায় ভেবে।
ছেলেকে পড়াশোনার জগতে ফিরিয়ে আনার জন্য পাঠিয়ে দিলেন ঢাকা শহরে মামার বাসায়। সেই শেষ হলো গ্রামের মুক্ত পরিবেশে ছেলেটির দাপিয়ে বেড়ানোর উত্তাল আনন্দ।
সেই ছেলেটিই আজকের ৫০ বছরের মো. সিরাজুল হক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের কুড়িঘর গ্রামে তাঁর বাড়ি। গ্রাম ছেড়েছেন আজ ৩৬ বছর হলো, ১৯৭৪ সালে। কিন্তু গ্রামের স্মৃতি আজও অমলিন তাঁর হূদয়ে। ‘শহরে থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তা ঠিক; তবে গ্রামকে এখনো ভুলে যাইনি। কিন্তু অনেক কম সময় গ্রামে থেকেছি তো, তাই গ্রাম নিয়ে খুব বেশি কথা মনে নাই।’
গ্রাম কি কেউ ভুলতে পারে? তাও আবার নিজের গ্রামকে? সেখানে যত কম সময়ই থাকা হোক না কেন। নিজের শেকড় তো কেউ ভুলতে পারে না। সিরাজুল হকও তাঁর বাইরে নন। এখন তিনি ঢাকায়। মিরপুরের দিকে যেতে শেওড়াপাড়া ওভারব্রিজের ১০০ মিটার আগেই ডাব, জাম্বুরা, কলা ইত্যাদি ফল নিয়ে বসেন তিনি।
নিজের গ্রামীণজীবনের কথা বলতে গিয়ে সিরাজুল হক বলেন, ‘যখন আমি বাড়িতে ছিলাম, তখন খুব দুষ্টু ছিলাম। বাবা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার পড়াশোনা ভালো লাগত না। খুব স্কুল ফাঁকি দিতাম। আমাদের গ্রামে তখন মিষ্টি আলু, মসুর ডাল—এসব চাষ হতো। স্কুলে যাবার নাম করে বই-খাতা নিয়ে বের হতাম। তারপর আলুখেতের ঝোপে বই লুকিয়ে পালিয়ে যেতাম খেলতে। আর স্কুলে যেতাম না। এভাবে প্রতিদিনই স্কুল ফাঁকি দিতাম। তখন তো খুব মজা পেতাম, কিন্তু এখন খুব কষ্ট হয়। মনে হয়, ভুল করেছি। জীবনে তো সবকিছুই ভুল করলাম। পড়াশোনাটা করলে এখন অনেক কিছু করার সুযোগ পেতাম।’
সিরাজুল হক ঢাকায় এসে ওঠেন মামার বাসায়। উদ্দেশ্য ছিল পড়াশোনা। কিন্তু এখানেও স্বপ্নটা মিছে হলো। কী আর করার থাকে? অবশেষে সিরাজুল হক একটা কাজ শুরু করলেন। বেকারির ব্যবসা, কিন্তু ক্ষতি হলো ব্যবসায়। এভাবে কয়েকবার ক্ষতি হওয়ার পর বাদ দিলেন সেই ব্যবসা। শুরু করলেন ফলের ব্যবসা। বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন তিনি। অবশেষে এসে স্থায়ী হয়েছেন শেওড়াপাড়ায়। ‘বিয়ে করেছি ১৯৮৮ সালের বন্যার পরে। তখন মোহাম্মদপুরে থাকতাম। বউয়ের নাম আকলিমা আক্তার। আকলিমাও তখন মোহাম্মদপুরে থাকত। ওদের দেশের বাড়ি ঝিনাইদহে। আকলিমা বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট। দেখলে বলবেন ও আমার দ্বিতীয় বউ!’ বললেন সিরাজুল হক।
সিরাজুল হক বলেন, ‘আমরা তিন ভাই ও দুই বোন। আমি সবার ছোট। বোনদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি আর আমার মেজো ভাই থাকি ঢাকায়। গ্রামে থাকে কেবল আমার বড় ভাই ও তাঁর পরিবার। মা-বাবা তো মারা গেছেন। তাই আর গ্রামে বেশি যাওয়া হয় না। গ্রামে আমার যেটুকু জমি আছে, সেটুকু ভাই দেখাশোনা করেন। বছরে একবার কেবল কোরবানির ঈদে বাড়ি যাই।’
নিজের বাল্যবন্ধুদের সম্পর্কে সিরাজুল হক বলেন, ‘ছোটতে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। আমরা সবাই একসাথে নদীতে মাছ ধরতাম, সাঁতার কাটতাম। এখন তো সেই বন্ধুদের কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। খুরশিদ আলম, সানাউল্লাহ ওরা তো এখন বড় উকিল। ওরা ঢাকায় আছে। কিন্তু ওদের সাথে দেখা হয় খুব কম। ওরাও তো অনেক ব্যস্ত মানুষ। কাজেকামে ব্যস্ত থাকে। ওদের সাথে খুব আগের মতো দিন কাটাতে ইচ্ছে করে। কে জানে, কবে আবার একসাথে হব!’
‘আজ অনেক দিন হলো ঢাকায় এসেছি। যানজটের জ্বালায় মাথাব্যথা করে। এত গ্যাঞ্জাম (গোলমাল), তবু অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন গ্রামে গিয়ে বেশি দিন থাকতে পারি না। ওখানে হাতের নাগালে কোনো কিছু পাই না। কিন্তু তার পরও গ্রাম ভালো লাগে। সেখানে শান্ত পরিবেশ, স্বচ্ছ বাতাস অনেক ভালো লাগে। গ্রামে হয়তো একবারে আর যাওয়া হবে না। তার পরও দেখি, ভাগ্যে কী আছে। এক ছেলে ও এক মেয়ে আমাদের। মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা মাদ্রাসায় পড়ে। ওকে হাফেজ বানাতে চাই। জানি না, শেষে কী হবে।’ নিজের ভবিষ্যতের ইচ্ছা এভাবেই বলছিলেন সিরাজুল হক।
ব্যবসা নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? জানতে চাইলে সিরাজুল হক বলেন, ‘না, আর বেশি কিছু চাই না। এই ব্যবসাটা যেমন করছি, এমনই করতে চাই। আর বড়লোক হতে চাই না। বহুত হইছি, আর না। এখন এভাবে কাজ করে ডাইল-ভাত খেতে পারলেই হয়।’ ভাবতে ভালোই লাগছিল পৃথিবীতে এমন মানুষও আছেন, যাঁরা বেশি অর্থের স্বপ্ন দেখেন না।
সেই ছেলেটিই আজকের ৫০ বছরের মো. সিরাজুল হক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের কুড়িঘর গ্রামে তাঁর বাড়ি। গ্রাম ছেড়েছেন আজ ৩৬ বছর হলো, ১৯৭৪ সালে। কিন্তু গ্রামের স্মৃতি আজও অমলিন তাঁর হূদয়ে। ‘শহরে থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তা ঠিক; তবে গ্রামকে এখনো ভুলে যাইনি। কিন্তু অনেক কম সময় গ্রামে থেকেছি তো, তাই গ্রাম নিয়ে খুব বেশি কথা মনে নাই।’
গ্রাম কি কেউ ভুলতে পারে? তাও আবার নিজের গ্রামকে? সেখানে যত কম সময়ই থাকা হোক না কেন। নিজের শেকড় তো কেউ ভুলতে পারে না। সিরাজুল হকও তাঁর বাইরে নন। এখন তিনি ঢাকায়। মিরপুরের দিকে যেতে শেওড়াপাড়া ওভারব্রিজের ১০০ মিটার আগেই ডাব, জাম্বুরা, কলা ইত্যাদি ফল নিয়ে বসেন তিনি।
নিজের গ্রামীণজীবনের কথা বলতে গিয়ে সিরাজুল হক বলেন, ‘যখন আমি বাড়িতে ছিলাম, তখন খুব দুষ্টু ছিলাম। বাবা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার পড়াশোনা ভালো লাগত না। খুব স্কুল ফাঁকি দিতাম। আমাদের গ্রামে তখন মিষ্টি আলু, মসুর ডাল—এসব চাষ হতো। স্কুলে যাবার নাম করে বই-খাতা নিয়ে বের হতাম। তারপর আলুখেতের ঝোপে বই লুকিয়ে পালিয়ে যেতাম খেলতে। আর স্কুলে যেতাম না। এভাবে প্রতিদিনই স্কুল ফাঁকি দিতাম। তখন তো খুব মজা পেতাম, কিন্তু এখন খুব কষ্ট হয়। মনে হয়, ভুল করেছি। জীবনে তো সবকিছুই ভুল করলাম। পড়াশোনাটা করলে এখন অনেক কিছু করার সুযোগ পেতাম।’
সিরাজুল হক ঢাকায় এসে ওঠেন মামার বাসায়। উদ্দেশ্য ছিল পড়াশোনা। কিন্তু এখানেও স্বপ্নটা মিছে হলো। কী আর করার থাকে? অবশেষে সিরাজুল হক একটা কাজ শুরু করলেন। বেকারির ব্যবসা, কিন্তু ক্ষতি হলো ব্যবসায়। এভাবে কয়েকবার ক্ষতি হওয়ার পর বাদ দিলেন সেই ব্যবসা। শুরু করলেন ফলের ব্যবসা। বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন তিনি। অবশেষে এসে স্থায়ী হয়েছেন শেওড়াপাড়ায়। ‘বিয়ে করেছি ১৯৮৮ সালের বন্যার পরে। তখন মোহাম্মদপুরে থাকতাম। বউয়ের নাম আকলিমা আক্তার। আকলিমাও তখন মোহাম্মদপুরে থাকত। ওদের দেশের বাড়ি ঝিনাইদহে। আকলিমা বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট। দেখলে বলবেন ও আমার দ্বিতীয় বউ!’ বললেন সিরাজুল হক।
সিরাজুল হক বলেন, ‘আমরা তিন ভাই ও দুই বোন। আমি সবার ছোট। বোনদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি আর আমার মেজো ভাই থাকি ঢাকায়। গ্রামে থাকে কেবল আমার বড় ভাই ও তাঁর পরিবার। মা-বাবা তো মারা গেছেন। তাই আর গ্রামে বেশি যাওয়া হয় না। গ্রামে আমার যেটুকু জমি আছে, সেটুকু ভাই দেখাশোনা করেন। বছরে একবার কেবল কোরবানির ঈদে বাড়ি যাই।’
নিজের বাল্যবন্ধুদের সম্পর্কে সিরাজুল হক বলেন, ‘ছোটতে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। আমরা সবাই একসাথে নদীতে মাছ ধরতাম, সাঁতার কাটতাম। এখন তো সেই বন্ধুদের কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। খুরশিদ আলম, সানাউল্লাহ ওরা তো এখন বড় উকিল। ওরা ঢাকায় আছে। কিন্তু ওদের সাথে দেখা হয় খুব কম। ওরাও তো অনেক ব্যস্ত মানুষ। কাজেকামে ব্যস্ত থাকে। ওদের সাথে খুব আগের মতো দিন কাটাতে ইচ্ছে করে। কে জানে, কবে আবার একসাথে হব!’
‘আজ অনেক দিন হলো ঢাকায় এসেছি। যানজটের জ্বালায় মাথাব্যথা করে। এত গ্যাঞ্জাম (গোলমাল), তবু অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন গ্রামে গিয়ে বেশি দিন থাকতে পারি না। ওখানে হাতের নাগালে কোনো কিছু পাই না। কিন্তু তার পরও গ্রাম ভালো লাগে। সেখানে শান্ত পরিবেশ, স্বচ্ছ বাতাস অনেক ভালো লাগে। গ্রামে হয়তো একবারে আর যাওয়া হবে না। তার পরও দেখি, ভাগ্যে কী আছে। এক ছেলে ও এক মেয়ে আমাদের। মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা মাদ্রাসায় পড়ে। ওকে হাফেজ বানাতে চাই। জানি না, শেষে কী হবে।’ নিজের ভবিষ্যতের ইচ্ছা এভাবেই বলছিলেন সিরাজুল হক।
ব্যবসা নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? জানতে চাইলে সিরাজুল হক বলেন, ‘না, আর বেশি কিছু চাই না। এই ব্যবসাটা যেমন করছি, এমনই করতে চাই। আর বড়লোক হতে চাই না। বহুত হইছি, আর না। এখন এভাবে কাজ করে ডাইল-ভাত খেতে পারলেই হয়।’ ভাবতে ভালোই লাগছিল পৃথিবীতে এমন মানুষও আছেন, যাঁরা বেশি অর্থের স্বপ্ন দেখেন না।
No comments