অভিমত ভিন্নমত
কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের নথি ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাবেক সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন সাবেক উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলীর ‘সামরিক আদালতে বিচার/কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের সংরক্ষিত নথি’ শীর্ষক লেখাটি পড়লাম।
লেখার এক জায়গায় উল্লেখ আছে, ‘কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বাস্তবায়নের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই সময় কর্মরত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। সরকারের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল, ফাঁসির সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জেলে নির্ধারিত দিন ও সময়ে উপস্থিত থাকতে হবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এ নির্দেশ মৌখিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায় থেকে অবহিত করা হলে তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন, এ নির্দেশ আইনসম্মত নয়। জেল কোডের বিধান অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে উপস্থিত থাকার জন্য মনোনীত করবেন। টেলিফোনে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে বাদানুবাদ হওয়ার পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ বিষয়ে লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে দুটি প্রস্তাব করেন—এক. সামরিক ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির আদেশ ক্যান্টনমেন্টে করতে হবে। কারণ, জেল কোড অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক আদালতের আদেশই পালন করার কথা। দুই. যদি জেল কোডের সংশ্লিষ্ট বিধান সংশোধন করা হয়, তাহলেও এ জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিই যথেষ্ট হবে।’
সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যক্তিগত পরিচয় এ এম এম শওকত আলীর লেখাটির কোথাও উল্লেখ নেই। থাকলে এবং তদানীন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যদি আজও জীবিত থাকেন, তাহলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের একটি খোঁজ আমরা হয়তো পেতে পারতাম। কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের নথির খোঁজ পাওয়া তাই শওকত আলীর লেখার পরও অন্ধকারে ‘কালো বিড়াল’ খোঁজার মতো অবস্থায় রয়ে গেল।
প্রসঙ্গত, পাকিস্তান প্রশাসনের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা সম্ভবত সিনিয়র সেকশন অফিসারের সমপর্যায়ের ছিলেন। একজন সাবেক সিনিয়র সেকশন অফিসার সামরিক আইনের সময়ে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি নিয়ে আইনের বিষয়ে জেল কোড পর্যন্ত পরিবর্তনের সাহস রেখে লিখিত চিঠি চালাচালি করেছেন, বিষয়টি অবশ্যই চমকপ্রদ ও শিক্ষণীয়। তাঁর লেখার আরেক অংশে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রসচিবের কিছু বক্তব্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বক্তব্য থেকে দেখা যায়, মন্ত্রণালয় জেল কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছে।’
লেখাটির অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘...মামলার নথি জেলে কখনোই পাঠানো হয় না।’
নথি খোঁজা নিয়ে তাঁর লেখার এই মন্তব্য প্রমাণ করে, সামরিক শাসনের সময় ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণ’ সিনিয়র সেকশন অফিসার হিসেবে যা জানতেন, বর্তমানের স্বরাষ্ট্রসচিব এর ধারেকাছেও কিছু বুঝ করে পান না, যার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জেল কর্তৃপক্ষকে কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের নথির তথ্য দিতে বলা হচ্ছে। কী আশ্চর্য উন্নতি ঘটেছে বাংলাদেশ প্রশাসনের!
কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশ প্রদানকারী সামরিক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দার মারা গেছেন। তাঁর সেই ট্রাইব্যুনালে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন বলে জানা যায়। আরও জানা যায়, ওই দুজন ম্যাজিস্ট্রেট জীবিত আছেন। উদ্যোগ নিলে ওই দুজন সাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের নথির বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
জনান্তিকে বলা যায়, মহামান্য হাইকোর্ট কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের নথি তলব করেছেন বলে কোনো না কোনো সংবাদপত্রে এ নিয়ে কত না লেখা ছাপা হচ্ছে। এতে অনুসন্ধিৎসু পাঠকেরা হয়তো অনেক কিছুই জানতে পারছেন, বিশেষ করে সামরিক আইনের সময়ে বেসামরিক প্রশাসন ভেঙে পড়ার অনেক অজানা তথ্য সাধারণ মানুষ জানছে সংবাদপত্রের মাধ্যমে। এতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিধির বিস্তৃতি লক্ষণীয়। এমনকি আমাদের মতো মানুষও সামান্য বিষয়ে নিজে কিছু লিখতে পারছি, এটিও কম পাওয়া নয়।
মুহম্মদ জুলফিকার আলী
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী ও লেখক।
চট্টগ্রাম বিটিভির বেহাল দশা
বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান দেখে আশ্চর্য ও হতাশাগ্রস্ত হই। এক যুগেরও আগে সম্প্রচার শুরু করলেও এই কেন্দ্রটির অবস্থা খুব দুর্দশাগ্রস্ত। এখানে আকর্ষণীয় বিনোদন অথবা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান নেই। অধিবেশনের জন্য অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত যে সময় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে ইনডোর অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতেই কর্তৃপক্ষের হিমশিম খেতে হয়, আউটডোর অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সময় কোথায়?
প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিলে এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এর আমূল পরিবর্তন সাধনে সক্রিয় হলে তথা উপযুক্ত আর্থিক বরাদ্দ, পর্যাপ্ত ক্যামেরা ও অন্যান্য সরঞ্জাম, দক্ষ দল ও পর্যাপ্ত লোকবলের ব্যবস্থা করা হলে অবশ্যই চট্টগ্রাম কেন্দ্র বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান, প্রতিবেদন, প্রামাণ্যচিত্র ও নাটক নিয়মিত নির্মাণ ও সম্প্রচারের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে একটি আকর্ষণীয় চ্যানেলে পরিণত হতে পারে।
দেশব্যাপী সম্প্রচারে গেলে চট্টগ্রাম কেন্দ্র প্রচুর বিজ্ঞাপন পাবে। বাণিজ্যিকভাবে অনেক নাটক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান পাওয়া যাবে। বাণিজ্যনগর হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এই চ্যানেলের ভূমিকা হতে পারে অগ্রণী। কেন্দ্রটিকে রাজস্ব খাতে নিয়ে এই কেন্দ্রের অনুষ্ঠান দেশব্যাপী পূর্ণাঙ্গ সময়ে সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হোক।
হুমায়ুন কবির
মতিঝিল, ঢাকা।
শিক্ষায় ‘ই-বিপ্লব’ এবং আমাদের প্রস্তুতি
সম্প্রতি ভারতের হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ই-ইন্ডিয়া সম্মেলন ২০১০’। ভারতের এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ আইসিটি দক্ষযজ্ঞ। পাঁচটি ট্র্যাকে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো হচ্ছে ই-গভর্ন্যান্স, ডিজিটাল লার্নিং, ই-হেলথ, টেলিসেন্টার ফোরাম এবং ই-এগ্রিকালচার। ডিজিটাল লার্নিংয়ের আবার তিনটি সাব-ট্র্যাক স্কুল এডুকেশন, হায়ার এডুকেশন ও ভোকেশনাল ট্রেনিং অ্যান্ড স্কিল ডেভেলপমেন্ট। সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ডিজিটাল দশকের জন্য ভারতকে সামর্থ্যবান করা। ২০১১ থেকে ২০২০ সালকে ডিজিটাল দশক হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁরা এটিকে বলছেন রূপকল্প ২০২০। রূপকল্প কী, তার কিছুটা নমুনা পাওয়া গেল ভারতীয় আইটি-সচিব আর চন্দ্রশেখরের বক্তব্যে। ২০২০ সালের মধ্যে সব ভারতীয়কে মৌলিক অধিকার হিসেবে আইটি সাক্ষরতা প্রদান করা হবে। ভারতের তরুণ জনগোষ্ঠীকে আইসিটিতে প্রশিক্ষিত করে সারা দুনিয়ায় কাজ করার উপযোগী করে গড়ে তোলা ভারতের আইটি নীতিমালার একটি লক্ষ্য। স্বল্প সময়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ ও ব্রডব্যান্ড সংযোগসহ শক্তিশালী আইসিটি অবকাঠামো গড়ে তোলার এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে সেখানে। ভারত স্বপ্ন দেখে, ২০২০ সালে অবশিষ্ট বিশ্ব পেশাগতভাবে দক্ষ জনশক্তির জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল হবে এবং এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের সব প্রস্তুতি তারা নিচ্ছে।
এ আসরে যোগ দিতে এসেছে মিসর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারত মহাসাগরের অন্তর্গত দ্বীপরাজ্য আন্দামান ও নিকোবরের ‘ই’ আয়োজন সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সম্মেলনে প্রকাশিত তথ্যমতে, কেরালা ও অন্ধ্র প্রদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্রডব্যান্ড সংযোগ রয়েছে। শ্রীলঙ্কার আইসিটি নীতিমালার লক্ষ্য প্রবেশাধিকার, সমদর্শিতা ও উৎকর্ষ। ১৯৯৮ সালে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে আইসিটি শিক্ষায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষায় আইসিটির ব্যবহার সম্প্রসারণে কমিউনিটি সেন্টার ও টেলিসেন্টারগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগানো হয়েছে। এ কর্মকাণ্ডে পিপিপি সে দেশে একটি সফল গল্প। কেরালায় শতভাগ শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে ভর্তির সাফল্যগাথার পেছনেও রয়েছে পিপিপি। ‘রাষ্ট্রীয় সর্বশিক্ষা অভিযান’ কর্মসূচির পুরোধা ব্যক্তিত্ব ভারত সরকারের যুগ্ম সচিব সুভাষ সি খুন্তিয়া জানান, ২০০৪ সাল থেকে ভারতের বিদ্যালয়ে আইসিটির প্রচলন শুরু হয়েছে। অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আইসিটি ব্যবহার করে শ্রেণীকক্ষে যে আকষর্ণীয় ও আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, তার মাধ্যমে জেন্ডারবৈষম্য দূর করা, ঝরে পড়া রোধ এবং প্রবেশাধিকার বাড়ানো গেছে। বিজ্ঞানাগারের বিকল্প হিসেবে শ্রেণীকক্ষে আইসিটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে আইসিটির মাধ্যমে পর্যাপ্ত সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে।
সম্মেলনে প্রতিবেশী দেশগুলোর আয়োজন দেখে মনে মনে নিজেদের সঙ্গে একটা তুলনা করার চেষ্টা করেছি। মাধ্যমিক স্তরে আমাদের অর্ধেকেরও বেশি বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎসংযোগ নেই। বিদ্যুৎ-সংযোগসম্পন্ন অনেক বিদ্যালয়ে আবার কম্পিউটার নেই। অনেক বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে কম্পিউটার সরবরাহ করা হলেও উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ বা শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাবে তা আর ব্যবহারযোগ্য নেই। এক হিসাবে দেখা গেছে, আমাদের প্রায় তিন হাজার বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাব রয়েছে। কিন্তু এতে প্রবেশাধিকার রয়েছে নবম-দশম শ্রেণীর শুধু কম্পিউটার বিষয়ের শিক্ষার্থীদের।
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল সম্প্রতি এক হাজার ৮০০ বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক হাজার ৪০০ বিদ্যালয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া দুটি করে ল্যাপটপ বিতরণ করেছে। সামর্থ্যবান শহরকেন্দ্রিক কিছু বিদ্যালয় নিজস্ব উদ্যোগে কম্পিউটার সংগ্রহ করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন (টিকিউআই) প্রকল্পের ১৭টি মোবাইল আইসিটি ল্যাব শিক্ষার্থীদের মধ্যে আইসিটি জনপ্রিয়করণের লক্ষ্যে বিদ্যালয় পর্যায়ে আইসিটি প্রদর্শনীর আয়োজন করছে।
সম্প্রতি স্বল্পব্যয়ে শ্রেণীকক্ষে আইসিটির সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তা হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই অন্তত একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন। এই ক্লাসরুমে অতিরিক্ত উপকরণ হিসেবে থাকবে একটি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, একটি ল্যাপটপ ও স্পিকার বা সাউন্ডবক্স। এতে শিক্ষকেরা নিজেদের তৈরি আইসিটি উপকরণ ব্যবহার করে অত্যন্ত আনন্দদায়ক ও কার্যকরভাবে শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এতে বিমূর্ত বিষয়গুলো শিক্ষার্থীরা সহজে বুঝবে, মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। সব শিক্ষার্থীর মনোযোগ আকর্ষণ করা যাবে, শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষা নিশ্চিত হবে, শিক্ষার্থীরা পারিপার্শ্বিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান লাভ করবে এবং শিক্ষার্থীদের শিখন স্থায়ী হবে। অন্যদিকে শিক্ষকেরা আইসিটি ব্যবহারে উৎসাহিত হবেন। তাঁদের ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে। নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী কন্টেন্ট তৈরি ও ক্লাসরুমে ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষকেরা আত্মবিশ্বাসী হবেন। আইসিটি শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন সহজ ও যথাযথভাবে করতে সহায়ক হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনাও এতে আধুনিক, মানসম্মত ও ব্যয়সাশ্রয়ী হয়।
ই-ইন্ডিয়া কনফারেন্সের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, শিক্ষায় আইসিটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। এ অবস্থা নিরসনে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমরা এসব দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি। সময়ের দাবি মেটাতে আগামী তিন বছরে মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি প্রচলনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। পিপিপির সম্ভাবনাকে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়। ইনসেনটিভ দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আইসিটি ব্যবহারে উৎসাহিত করা যেতে পারে। সোলার প্যানেল বা ট্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ-সমস্যার বিকল্প সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটি সামনে আসবে, তা হচ্ছে আইসিটি ব্যবহারে শিক্ষকের সামর্থ্য। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এটুআই ও টিকিউআই প্রকল্পের যৌথ উদ্যোগে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যা ২০১১ সাল পর্যন্ত চলবে। ২০১২ সাল থেকে প্রস্তাবিত টিকিউআই-২ প্রকল্পে আইসিটিতে নিবিড় শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
আমাদের নতুন প্রজন্মকে একুশ শতকের উপযোগী দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য কার্যকর শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে আইসিটির ব্যাপক সুযোগও আমাদের কাজে লাগাতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য উপযুক্ত সে শিখন পরিবেশটি গড়ে তুলতে প্রয়োজন দূরদর্শী পরিকল্পনা, সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, শিক্ষক, প্রশিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রশাসক, নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রয়াস।
মো. নজরুল ইসলাম
সরকারের যুগ্ম সচিব এবং টিকিউআই প্রকল্পের পরিচালক।
উচ্চশিক্ষায় বিত্তবানের বাড়তি সুযোগ
‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতি বৈষম্য’ শিরোনামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের একটি যৌথ লেখা ১৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোয়। সেখানে লেখকেরা বলেছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের সুযোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে না। ফলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইরের কোনো শিক্ষার্থীর ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকে না। লেখকেরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে স্নাতক পাস করে মেধাবী শিক্ষার্থীরা যদি পরীক্ষা দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতকোত্তর কোর্সগুলোতে ভর্তির সুযোগ পেতে চান, তাহলে আপত্তি কোথায়? যৌক্তিক প্রশ্ন। কিন্তু স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়েও শিক্ষা লাভ করতে চান এবং এটাই স্বাভাবিক। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আসনসংখ্যা তো বেশি নয় যে বাইরের শিক্ষার্থীদের ধারণ করা যাবে।
একটা সমাধান হতে পারে, তাঁদের প্রস্তাব অনুযায়ী কিছু আসন মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা। এটা করতে হলে বর্তমানে যাঁরা স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হচ্ছেন, তাঁদের আসন ছাঁটাই করতে হবে। সাধারণত যাঁরা ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছেন, তাঁরাই সেখানে ভর্তি হন। তাঁরা কিন্তু পরীক্ষিত মেধাবী, তাঁরা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কাজেই তাঁদের থেকে একটি আসনও ছাঁটাই করা যায় না। দ্বিতীয় সমাধান হতে পারে কিছু আসন বাড়ানো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা বাড়ানো সহজ নয়; কারণ একজন শিক্ষার্থীর পেছনে প্রজাতন্ত্রের ব্যয় হয় অনেক অর্থ। এ বাবদ বাড়তি অর্থ পাওয়া সহজ নয়। লেখকদের প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আসন বাড়ানো যায়। কিন্তু আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রধান যোগ্যতা হবে মেধা। কারও বাবার টাকা থাকতে পারে, কিন্তু সেটা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তির যোগ্যতা হতে পারে না। আমরা যদি আরও কিছু আসন বাড়াতে পারি, তা-ও হবে পরীক্ষিত মেধাবীদের জন্য।
লেখকেরা আইবিএর উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও ভর্তির প্রধান যোগ্যতা মেধা, টাকা নয়। আইবিএর ভর্তি পরীক্ষা অত্যন্ত কঠিন। হ্যাঁ, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা এখানে লাগে। এখানে অনেকে চাকরি জোগাড় করে তারপর এমবিএ করছেন। বরং আইবিএতে বেশি টাকার প্রয়োজন না হলেই ভালো হতো, তাহলে দরিদ্র মেধাবীদের পড়ার খরচ জোগানোর জন্য চাকরি করতে হতো না; বরং সম্পূর্ণ সময় ও শ্রম তাঁরা পড়াশোনার কাজেই ব্যয় করতে পারতেন।
লেখকেরা শিক্ষানীতির ১০ নম্বর অনুচ্ছেদ উল্লেখ করেছেন: ‘উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে হবে। সরকারি অনুদান ছাড়া এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যয় নির্বাহের জন্য শিক্ষার্থীদের বেতন ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যক্তিগত অনুদান সংগ্রহের চেষ্টা চালাতে হবে।’ উচ্চশিক্ষার বেসরকারি খাত-সংক্রান্ত ধারণার প্রভাবে এ কথাগুলো শিক্ষানীতিতে সংযোজিত হয়েছে বলে ধারণা করি এবং এর বিরোধিতা করি। কারণ এভাবে ধীরে ধীরে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছেলেমেয়েরা আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন না। সামর্থ্যবান পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েরা হবেন ব্যবস্থাপক, বড় কর্তা; আর দরিদ্র পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েরা হবেন কেরানি! না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। অর্থবিত্তের জোরে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ বিত্তহীন মেধাবীদের উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগের পথে যেন প্রতিবন্ধক না হয়। জাতীয় পর্যায়ে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষালাভের সুযোগ হবে ধনী-নির্ধন সব মেধাবীর জন্য সমান। বিত্তবানদের জন্য তো বেসরকারি খাত রয়েছেই, কেউ তো সেখানে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে না। তাই আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিত্তের জোরে শিক্ষা লাভের সুযোগের দাবিকে সমর্থন করব না, প্রতিবাদ করে যাব।
মো. মঈনউল হক, সরকারি কর্মকর্তা, ঢাকা।
mainul_haque@ieee.org
ক্ষুদ্রঋণ: নতুন করে ভাবুন
বাংলাদেশ ক্ষুদ্রঋণের জন্মভূমি হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্ভাবিত গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম দারিদ্র্য বিমোচনে একটি আদর্শ মডেল হিসেবে এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুসৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি অনেক ছোট-বড় সংস্থার মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
কিন্তু নিবিড় তদারকির অভাব, ক্ষুদ্রঋণ দানকারী সংস্থাগুলোর অতিবাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততার অভাব, অদক্ষতা আর অবহেলার কারণে আমাদের দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মূল আবেদন, প্রাসঙ্গিকতা ও উপযোগিতা ইতিমধ্যে অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম এখন তেমন দৃশ্যমান কল্যাণ বয়ে আনতে পারছে না বা দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কার্যকর হতে পারছে না। বরং এটা অনেকটা অতীতের গ্রামীণ সুদখোর মহাজনদের দাদন ব্যবসার আদলে পরিচালিত হচ্ছে। দাদনের টাকা নিয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহক কী কাজে ব্যয় করছেন, তা নিয়ে মহাজনদের মাথাব্যথা থাকে না; তাঁদের দৃষ্টি থাকে মুনাফা করার দিকে; কত বেশি টাকা সুদে-আসলে আদায় করা যায় সেই দিকে। এই সুযোগে তাঁরা দাদনগ্রহীতার বন্ধকি সম্পত্তিটুকু গ্রাস করার কৌশল করতেও দ্বিধান্বিত হন না। অবশ্য ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে ঋণদানকারী সংস্থা মহাজনদের মতো ঋণগ্রহীতার সম্পত্তি বন্ধক রাখে না এবং সুদের হিসাবের ক্ষেত্রে সরল সুদ নির্ণয়ের পদ্ধতি অনুসরণ করে। কোনো কোনো সংস্থা সুদকে সুদ না বলে সার্ভিস চার্জ বলে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে নিয়োজিত কর্মীদের বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় পরিচালনা ব্যয় বিতরণ করা ঋণের ওপর ধার্যকৃত সুদ/সার্ভিস চার্জের ওপর নির্ভরশীল। ফলে এটি একটি লাভজনক আর্থিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। বেশিসংখ্যক মানুষকে ঋণের আওতায় নিয়ে বেশি পরিমাণে ঋণ বিতরণ করা এবং সুদ আদায়ের মাধ্যমে সংস্থার তহবিল বাগানোই এখন এই কর্মসূচির মূল প্রবণতা।
ক্ষুদ্রঋণ-ব্যবস্থার মূল চেতনা দারিদ্র্য বিমোচন। দরিদ্র মানুষ, যাঁরা পুঁজির অভাবে কোনো রকম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারেন না, তাঁদের পুঁজি জোগানো এই কর্মসূচির লক্ষ্য, যেন তাঁরা সেই পুঁজির সদ্ব্যবহার করে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে আসতে পারেন। অর্থাৎ তাঁরা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার সদস্য হয়ে নিজেদের চাহিদা ও প্রয়োজনমতো ঋণ নেবেন এবং তা আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে খাটিয়ে লাভবান হয়ে ঋণ পরিশোধ করবেন—এভাবে তাঁদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে, দারিদ্র্য হ্রাস পাবে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। কিন্তু এখন ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে এ ধারা প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে।
বর্তমানে প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সংস্থার বার্ষিক মোট ঋণ বিতরণের পরিমাণ এবং আদায়ের হারকে সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যথাযথ তদারকির অভাব, আন্তসংস্থার সমন্বয়হীনতা ইত্যাদি কারণে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে এখন ব্যাপক অনিয়ম ঘটছে। ফলে দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হচ্ছে। একই ব্যক্তি এক সঙ্গে একাধিক সংস্থা থেকে বেশি বেশি পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে একসময় তা পরিশোধে সক্ষমতা হারাচ্ছে এবং দ্রুত ঋণভারে জর্জরিত ও দিশেহারা হয়ে পড়ছে। অবশেষে নিরুপায় হয়ে পরিবারসহ গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের স্রোত বাড়ছে; তারা দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্র থেকে বেরোতে পারছে না। ফলে বিগত প্রায় তিন দশকব্যাপী আমাদের দেশে ক্ষুদ্রঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ঘটলেও দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের শতকরা হারের ক্ষেত্রে তেমন কোনো তারতম্য ঘটেনি। তাই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের বর্তমান সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটিবিচ্যুতি খতিয়ে দেখে এসব দূর করে দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর হয়—এমন কার্যক্রম হাতে নেওয়ার লক্ষ্যে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। সুষ্ঠু ভূমিনীতি ও কৃষিনীতি গ্রহণ এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে বেশিসংখ্যক গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান তথা স্বাবলম্বীকরণ সম্ভব।
শহীদুল আযম, সাবেক কর্মকর্তা
বিআরডিবি, মিরপুর, ঢাকা।
সংশোধনী
গতকাল সৈয়দ আবুল মকসুদের উপসম্পাদকীয়র প্রথম কলামের সপ্তম অনুচ্ছেদে ‘আসন থেকে উঠে দাঁড়াননি’র স্থলে ‘আসন থেকে উঠে দাঁড়ান’ এবং দ্বিতীয় কলামের অষ্টম অনুচ্ছেদে ‘দেশ এক অবৈধ গ্রাম্যতার দিকে’র স্থলে ‘দেশ এক সর্বৈব গ্রাম্যতার দিকে’ পড়তে হবে। অনিচ্ছাকৃত এ ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত। —বি. স.
সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যক্তিগত পরিচয় এ এম এম শওকত আলীর লেখাটির কোথাও উল্লেখ নেই। থাকলে এবং তদানীন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যদি আজও জীবিত থাকেন, তাহলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের একটি খোঁজ আমরা হয়তো পেতে পারতাম। কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের নথির খোঁজ পাওয়া তাই শওকত আলীর লেখার পরও অন্ধকারে ‘কালো বিড়াল’ খোঁজার মতো অবস্থায় রয়ে গেল।
প্রসঙ্গত, পাকিস্তান প্রশাসনের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা সম্ভবত সিনিয়র সেকশন অফিসারের সমপর্যায়ের ছিলেন। একজন সাবেক সিনিয়র সেকশন অফিসার সামরিক আইনের সময়ে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি নিয়ে আইনের বিষয়ে জেল কোড পর্যন্ত পরিবর্তনের সাহস রেখে লিখিত চিঠি চালাচালি করেছেন, বিষয়টি অবশ্যই চমকপ্রদ ও শিক্ষণীয়। তাঁর লেখার আরেক অংশে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রসচিবের কিছু বক্তব্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বক্তব্য থেকে দেখা যায়, মন্ত্রণালয় জেল কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছে।’
লেখাটির অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘...মামলার নথি জেলে কখনোই পাঠানো হয় না।’
নথি খোঁজা নিয়ে তাঁর লেখার এই মন্তব্য প্রমাণ করে, সামরিক শাসনের সময় ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণ’ সিনিয়র সেকশন অফিসার হিসেবে যা জানতেন, বর্তমানের স্বরাষ্ট্রসচিব এর ধারেকাছেও কিছু বুঝ করে পান না, যার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জেল কর্তৃপক্ষকে কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের নথির তথ্য দিতে বলা হচ্ছে। কী আশ্চর্য উন্নতি ঘটেছে বাংলাদেশ প্রশাসনের!
কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশ প্রদানকারী সামরিক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দার মারা গেছেন। তাঁর সেই ট্রাইব্যুনালে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন বলে জানা যায়। আরও জানা যায়, ওই দুজন ম্যাজিস্ট্রেট জীবিত আছেন। উদ্যোগ নিলে ওই দুজন সাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের নথির বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
জনান্তিকে বলা যায়, মহামান্য হাইকোর্ট কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের নথি তলব করেছেন বলে কোনো না কোনো সংবাদপত্রে এ নিয়ে কত না লেখা ছাপা হচ্ছে। এতে অনুসন্ধিৎসু পাঠকেরা হয়তো অনেক কিছুই জানতে পারছেন, বিশেষ করে সামরিক আইনের সময়ে বেসামরিক প্রশাসন ভেঙে পড়ার অনেক অজানা তথ্য সাধারণ মানুষ জানছে সংবাদপত্রের মাধ্যমে। এতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিধির বিস্তৃতি লক্ষণীয়। এমনকি আমাদের মতো মানুষও সামান্য বিষয়ে নিজে কিছু লিখতে পারছি, এটিও কম পাওয়া নয়।
মুহম্মদ জুলফিকার আলী
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী ও লেখক।
চট্টগ্রাম বিটিভির বেহাল দশা
বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান দেখে আশ্চর্য ও হতাশাগ্রস্ত হই। এক যুগেরও আগে সম্প্রচার শুরু করলেও এই কেন্দ্রটির অবস্থা খুব দুর্দশাগ্রস্ত। এখানে আকর্ষণীয় বিনোদন অথবা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান নেই। অধিবেশনের জন্য অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত যে সময় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে ইনডোর অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতেই কর্তৃপক্ষের হিমশিম খেতে হয়, আউটডোর অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সময় কোথায়?
প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিলে এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এর আমূল পরিবর্তন সাধনে সক্রিয় হলে তথা উপযুক্ত আর্থিক বরাদ্দ, পর্যাপ্ত ক্যামেরা ও অন্যান্য সরঞ্জাম, দক্ষ দল ও পর্যাপ্ত লোকবলের ব্যবস্থা করা হলে অবশ্যই চট্টগ্রাম কেন্দ্র বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান, প্রতিবেদন, প্রামাণ্যচিত্র ও নাটক নিয়মিত নির্মাণ ও সম্প্রচারের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে একটি আকর্ষণীয় চ্যানেলে পরিণত হতে পারে।
দেশব্যাপী সম্প্রচারে গেলে চট্টগ্রাম কেন্দ্র প্রচুর বিজ্ঞাপন পাবে। বাণিজ্যিকভাবে অনেক নাটক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান পাওয়া যাবে। বাণিজ্যনগর হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এই চ্যানেলের ভূমিকা হতে পারে অগ্রণী। কেন্দ্রটিকে রাজস্ব খাতে নিয়ে এই কেন্দ্রের অনুষ্ঠান দেশব্যাপী পূর্ণাঙ্গ সময়ে সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হোক।
হুমায়ুন কবির
মতিঝিল, ঢাকা।
শিক্ষায় ‘ই-বিপ্লব’ এবং আমাদের প্রস্তুতি
সম্প্রতি ভারতের হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ই-ইন্ডিয়া সম্মেলন ২০১০’। ভারতের এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ আইসিটি দক্ষযজ্ঞ। পাঁচটি ট্র্যাকে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো হচ্ছে ই-গভর্ন্যান্স, ডিজিটাল লার্নিং, ই-হেলথ, টেলিসেন্টার ফোরাম এবং ই-এগ্রিকালচার। ডিজিটাল লার্নিংয়ের আবার তিনটি সাব-ট্র্যাক স্কুল এডুকেশন, হায়ার এডুকেশন ও ভোকেশনাল ট্রেনিং অ্যান্ড স্কিল ডেভেলপমেন্ট। সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ডিজিটাল দশকের জন্য ভারতকে সামর্থ্যবান করা। ২০১১ থেকে ২০২০ সালকে ডিজিটাল দশক হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁরা এটিকে বলছেন রূপকল্প ২০২০। রূপকল্প কী, তার কিছুটা নমুনা পাওয়া গেল ভারতীয় আইটি-সচিব আর চন্দ্রশেখরের বক্তব্যে। ২০২০ সালের মধ্যে সব ভারতীয়কে মৌলিক অধিকার হিসেবে আইটি সাক্ষরতা প্রদান করা হবে। ভারতের তরুণ জনগোষ্ঠীকে আইসিটিতে প্রশিক্ষিত করে সারা দুনিয়ায় কাজ করার উপযোগী করে গড়ে তোলা ভারতের আইটি নীতিমালার একটি লক্ষ্য। স্বল্প সময়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ ও ব্রডব্যান্ড সংযোগসহ শক্তিশালী আইসিটি অবকাঠামো গড়ে তোলার এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে সেখানে। ভারত স্বপ্ন দেখে, ২০২০ সালে অবশিষ্ট বিশ্ব পেশাগতভাবে দক্ষ জনশক্তির জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল হবে এবং এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের সব প্রস্তুতি তারা নিচ্ছে।
এ আসরে যোগ দিতে এসেছে মিসর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারত মহাসাগরের অন্তর্গত দ্বীপরাজ্য আন্দামান ও নিকোবরের ‘ই’ আয়োজন সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সম্মেলনে প্রকাশিত তথ্যমতে, কেরালা ও অন্ধ্র প্রদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্রডব্যান্ড সংযোগ রয়েছে। শ্রীলঙ্কার আইসিটি নীতিমালার লক্ষ্য প্রবেশাধিকার, সমদর্শিতা ও উৎকর্ষ। ১৯৯৮ সালে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে আইসিটি শিক্ষায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষায় আইসিটির ব্যবহার সম্প্রসারণে কমিউনিটি সেন্টার ও টেলিসেন্টারগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগানো হয়েছে। এ কর্মকাণ্ডে পিপিপি সে দেশে একটি সফল গল্প। কেরালায় শতভাগ শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে ভর্তির সাফল্যগাথার পেছনেও রয়েছে পিপিপি। ‘রাষ্ট্রীয় সর্বশিক্ষা অভিযান’ কর্মসূচির পুরোধা ব্যক্তিত্ব ভারত সরকারের যুগ্ম সচিব সুভাষ সি খুন্তিয়া জানান, ২০০৪ সাল থেকে ভারতের বিদ্যালয়ে আইসিটির প্রচলন শুরু হয়েছে। অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আইসিটি ব্যবহার করে শ্রেণীকক্ষে যে আকষর্ণীয় ও আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, তার মাধ্যমে জেন্ডারবৈষম্য দূর করা, ঝরে পড়া রোধ এবং প্রবেশাধিকার বাড়ানো গেছে। বিজ্ঞানাগারের বিকল্প হিসেবে শ্রেণীকক্ষে আইসিটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে আইসিটির মাধ্যমে পর্যাপ্ত সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে।
সম্মেলনে প্রতিবেশী দেশগুলোর আয়োজন দেখে মনে মনে নিজেদের সঙ্গে একটা তুলনা করার চেষ্টা করেছি। মাধ্যমিক স্তরে আমাদের অর্ধেকেরও বেশি বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎসংযোগ নেই। বিদ্যুৎ-সংযোগসম্পন্ন অনেক বিদ্যালয়ে আবার কম্পিউটার নেই। অনেক বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে কম্পিউটার সরবরাহ করা হলেও উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ বা শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাবে তা আর ব্যবহারযোগ্য নেই। এক হিসাবে দেখা গেছে, আমাদের প্রায় তিন হাজার বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাব রয়েছে। কিন্তু এতে প্রবেশাধিকার রয়েছে নবম-দশম শ্রেণীর শুধু কম্পিউটার বিষয়ের শিক্ষার্থীদের।
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল সম্প্রতি এক হাজার ৮০০ বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক হাজার ৪০০ বিদ্যালয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া দুটি করে ল্যাপটপ বিতরণ করেছে। সামর্থ্যবান শহরকেন্দ্রিক কিছু বিদ্যালয় নিজস্ব উদ্যোগে কম্পিউটার সংগ্রহ করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন (টিকিউআই) প্রকল্পের ১৭টি মোবাইল আইসিটি ল্যাব শিক্ষার্থীদের মধ্যে আইসিটি জনপ্রিয়করণের লক্ষ্যে বিদ্যালয় পর্যায়ে আইসিটি প্রদর্শনীর আয়োজন করছে।
সম্প্রতি স্বল্পব্যয়ে শ্রেণীকক্ষে আইসিটির সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তা হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই অন্তত একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন। এই ক্লাসরুমে অতিরিক্ত উপকরণ হিসেবে থাকবে একটি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, একটি ল্যাপটপ ও স্পিকার বা সাউন্ডবক্স। এতে শিক্ষকেরা নিজেদের তৈরি আইসিটি উপকরণ ব্যবহার করে অত্যন্ত আনন্দদায়ক ও কার্যকরভাবে শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এতে বিমূর্ত বিষয়গুলো শিক্ষার্থীরা সহজে বুঝবে, মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। সব শিক্ষার্থীর মনোযোগ আকর্ষণ করা যাবে, শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষা নিশ্চিত হবে, শিক্ষার্থীরা পারিপার্শ্বিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান লাভ করবে এবং শিক্ষার্থীদের শিখন স্থায়ী হবে। অন্যদিকে শিক্ষকেরা আইসিটি ব্যবহারে উৎসাহিত হবেন। তাঁদের ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে। নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী কন্টেন্ট তৈরি ও ক্লাসরুমে ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষকেরা আত্মবিশ্বাসী হবেন। আইসিটি শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন সহজ ও যথাযথভাবে করতে সহায়ক হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনাও এতে আধুনিক, মানসম্মত ও ব্যয়সাশ্রয়ী হয়।
ই-ইন্ডিয়া কনফারেন্সের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, শিক্ষায় আইসিটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। এ অবস্থা নিরসনে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমরা এসব দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি। সময়ের দাবি মেটাতে আগামী তিন বছরে মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি প্রচলনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। পিপিপির সম্ভাবনাকে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়। ইনসেনটিভ দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আইসিটি ব্যবহারে উৎসাহিত করা যেতে পারে। সোলার প্যানেল বা ট্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ-সমস্যার বিকল্প সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটি সামনে আসবে, তা হচ্ছে আইসিটি ব্যবহারে শিক্ষকের সামর্থ্য। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এটুআই ও টিকিউআই প্রকল্পের যৌথ উদ্যোগে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যা ২০১১ সাল পর্যন্ত চলবে। ২০১২ সাল থেকে প্রস্তাবিত টিকিউআই-২ প্রকল্পে আইসিটিতে নিবিড় শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
আমাদের নতুন প্রজন্মকে একুশ শতকের উপযোগী দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য কার্যকর শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে আইসিটির ব্যাপক সুযোগও আমাদের কাজে লাগাতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য উপযুক্ত সে শিখন পরিবেশটি গড়ে তুলতে প্রয়োজন দূরদর্শী পরিকল্পনা, সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, শিক্ষক, প্রশিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রশাসক, নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রয়াস।
মো. নজরুল ইসলাম
সরকারের যুগ্ম সচিব এবং টিকিউআই প্রকল্পের পরিচালক।
উচ্চশিক্ষায় বিত্তবানের বাড়তি সুযোগ
‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতি বৈষম্য’ শিরোনামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের একটি যৌথ লেখা ১৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোয়। সেখানে লেখকেরা বলেছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের সুযোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে না। ফলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইরের কোনো শিক্ষার্থীর ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকে না। লেখকেরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে স্নাতক পাস করে মেধাবী শিক্ষার্থীরা যদি পরীক্ষা দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতকোত্তর কোর্সগুলোতে ভর্তির সুযোগ পেতে চান, তাহলে আপত্তি কোথায়? যৌক্তিক প্রশ্ন। কিন্তু স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়েও শিক্ষা লাভ করতে চান এবং এটাই স্বাভাবিক। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আসনসংখ্যা তো বেশি নয় যে বাইরের শিক্ষার্থীদের ধারণ করা যাবে।
একটা সমাধান হতে পারে, তাঁদের প্রস্তাব অনুযায়ী কিছু আসন মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা। এটা করতে হলে বর্তমানে যাঁরা স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হচ্ছেন, তাঁদের আসন ছাঁটাই করতে হবে। সাধারণত যাঁরা ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছেন, তাঁরাই সেখানে ভর্তি হন। তাঁরা কিন্তু পরীক্ষিত মেধাবী, তাঁরা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কাজেই তাঁদের থেকে একটি আসনও ছাঁটাই করা যায় না। দ্বিতীয় সমাধান হতে পারে কিছু আসন বাড়ানো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা বাড়ানো সহজ নয়; কারণ একজন শিক্ষার্থীর পেছনে প্রজাতন্ত্রের ব্যয় হয় অনেক অর্থ। এ বাবদ বাড়তি অর্থ পাওয়া সহজ নয়। লেখকদের প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আসন বাড়ানো যায়। কিন্তু আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রধান যোগ্যতা হবে মেধা। কারও বাবার টাকা থাকতে পারে, কিন্তু সেটা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তির যোগ্যতা হতে পারে না। আমরা যদি আরও কিছু আসন বাড়াতে পারি, তা-ও হবে পরীক্ষিত মেধাবীদের জন্য।
লেখকেরা আইবিএর উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও ভর্তির প্রধান যোগ্যতা মেধা, টাকা নয়। আইবিএর ভর্তি পরীক্ষা অত্যন্ত কঠিন। হ্যাঁ, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা এখানে লাগে। এখানে অনেকে চাকরি জোগাড় করে তারপর এমবিএ করছেন। বরং আইবিএতে বেশি টাকার প্রয়োজন না হলেই ভালো হতো, তাহলে দরিদ্র মেধাবীদের পড়ার খরচ জোগানোর জন্য চাকরি করতে হতো না; বরং সম্পূর্ণ সময় ও শ্রম তাঁরা পড়াশোনার কাজেই ব্যয় করতে পারতেন।
লেখকেরা শিক্ষানীতির ১০ নম্বর অনুচ্ছেদ উল্লেখ করেছেন: ‘উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে হবে। সরকারি অনুদান ছাড়া এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যয় নির্বাহের জন্য শিক্ষার্থীদের বেতন ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যক্তিগত অনুদান সংগ্রহের চেষ্টা চালাতে হবে।’ উচ্চশিক্ষার বেসরকারি খাত-সংক্রান্ত ধারণার প্রভাবে এ কথাগুলো শিক্ষানীতিতে সংযোজিত হয়েছে বলে ধারণা করি এবং এর বিরোধিতা করি। কারণ এভাবে ধীরে ধীরে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছেলেমেয়েরা আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন না। সামর্থ্যবান পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েরা হবেন ব্যবস্থাপক, বড় কর্তা; আর দরিদ্র পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েরা হবেন কেরানি! না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। অর্থবিত্তের জোরে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ বিত্তহীন মেধাবীদের উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগের পথে যেন প্রতিবন্ধক না হয়। জাতীয় পর্যায়ে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষালাভের সুযোগ হবে ধনী-নির্ধন সব মেধাবীর জন্য সমান। বিত্তবানদের জন্য তো বেসরকারি খাত রয়েছেই, কেউ তো সেখানে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে না। তাই আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিত্তের জোরে শিক্ষা লাভের সুযোগের দাবিকে সমর্থন করব না, প্রতিবাদ করে যাব।
মো. মঈনউল হক, সরকারি কর্মকর্তা, ঢাকা।
mainul_haque@ieee.org
ক্ষুদ্রঋণ: নতুন করে ভাবুন
বাংলাদেশ ক্ষুদ্রঋণের জন্মভূমি হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্ভাবিত গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম দারিদ্র্য বিমোচনে একটি আদর্শ মডেল হিসেবে এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুসৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি অনেক ছোট-বড় সংস্থার মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
কিন্তু নিবিড় তদারকির অভাব, ক্ষুদ্রঋণ দানকারী সংস্থাগুলোর অতিবাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততার অভাব, অদক্ষতা আর অবহেলার কারণে আমাদের দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মূল আবেদন, প্রাসঙ্গিকতা ও উপযোগিতা ইতিমধ্যে অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম এখন তেমন দৃশ্যমান কল্যাণ বয়ে আনতে পারছে না বা দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কার্যকর হতে পারছে না। বরং এটা অনেকটা অতীতের গ্রামীণ সুদখোর মহাজনদের দাদন ব্যবসার আদলে পরিচালিত হচ্ছে। দাদনের টাকা নিয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহক কী কাজে ব্যয় করছেন, তা নিয়ে মহাজনদের মাথাব্যথা থাকে না; তাঁদের দৃষ্টি থাকে মুনাফা করার দিকে; কত বেশি টাকা সুদে-আসলে আদায় করা যায় সেই দিকে। এই সুযোগে তাঁরা দাদনগ্রহীতার বন্ধকি সম্পত্তিটুকু গ্রাস করার কৌশল করতেও দ্বিধান্বিত হন না। অবশ্য ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে ঋণদানকারী সংস্থা মহাজনদের মতো ঋণগ্রহীতার সম্পত্তি বন্ধক রাখে না এবং সুদের হিসাবের ক্ষেত্রে সরল সুদ নির্ণয়ের পদ্ধতি অনুসরণ করে। কোনো কোনো সংস্থা সুদকে সুদ না বলে সার্ভিস চার্জ বলে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে নিয়োজিত কর্মীদের বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় পরিচালনা ব্যয় বিতরণ করা ঋণের ওপর ধার্যকৃত সুদ/সার্ভিস চার্জের ওপর নির্ভরশীল। ফলে এটি একটি লাভজনক আর্থিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। বেশিসংখ্যক মানুষকে ঋণের আওতায় নিয়ে বেশি পরিমাণে ঋণ বিতরণ করা এবং সুদ আদায়ের মাধ্যমে সংস্থার তহবিল বাগানোই এখন এই কর্মসূচির মূল প্রবণতা।
ক্ষুদ্রঋণ-ব্যবস্থার মূল চেতনা দারিদ্র্য বিমোচন। দরিদ্র মানুষ, যাঁরা পুঁজির অভাবে কোনো রকম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারেন না, তাঁদের পুঁজি জোগানো এই কর্মসূচির লক্ষ্য, যেন তাঁরা সেই পুঁজির সদ্ব্যবহার করে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে আসতে পারেন। অর্থাৎ তাঁরা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার সদস্য হয়ে নিজেদের চাহিদা ও প্রয়োজনমতো ঋণ নেবেন এবং তা আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে খাটিয়ে লাভবান হয়ে ঋণ পরিশোধ করবেন—এভাবে তাঁদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে, দারিদ্র্য হ্রাস পাবে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। কিন্তু এখন ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে এ ধারা প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে।
বর্তমানে প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সংস্থার বার্ষিক মোট ঋণ বিতরণের পরিমাণ এবং আদায়ের হারকে সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যথাযথ তদারকির অভাব, আন্তসংস্থার সমন্বয়হীনতা ইত্যাদি কারণে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে এখন ব্যাপক অনিয়ম ঘটছে। ফলে দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হচ্ছে। একই ব্যক্তি এক সঙ্গে একাধিক সংস্থা থেকে বেশি বেশি পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে একসময় তা পরিশোধে সক্ষমতা হারাচ্ছে এবং দ্রুত ঋণভারে জর্জরিত ও দিশেহারা হয়ে পড়ছে। অবশেষে নিরুপায় হয়ে পরিবারসহ গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের স্রোত বাড়ছে; তারা দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্র থেকে বেরোতে পারছে না। ফলে বিগত প্রায় তিন দশকব্যাপী আমাদের দেশে ক্ষুদ্রঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ঘটলেও দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের শতকরা হারের ক্ষেত্রে তেমন কোনো তারতম্য ঘটেনি। তাই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের বর্তমান সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটিবিচ্যুতি খতিয়ে দেখে এসব দূর করে দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর হয়—এমন কার্যক্রম হাতে নেওয়ার লক্ষ্যে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। সুষ্ঠু ভূমিনীতি ও কৃষিনীতি গ্রহণ এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে বেশিসংখ্যক গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান তথা স্বাবলম্বীকরণ সম্ভব।
শহীদুল আযম, সাবেক কর্মকর্তা
বিআরডিবি, মিরপুর, ঢাকা।
সংশোধনী
গতকাল সৈয়দ আবুল মকসুদের উপসম্পাদকীয়র প্রথম কলামের সপ্তম অনুচ্ছেদে ‘আসন থেকে উঠে দাঁড়াননি’র স্থলে ‘আসন থেকে উঠে দাঁড়ান’ এবং দ্বিতীয় কলামের অষ্টম অনুচ্ছেদে ‘দেশ এক অবৈধ গ্রাম্যতার দিকে’র স্থলে ‘দেশ এক সর্বৈব গ্রাম্যতার দিকে’ পড়তে হবে। অনিচ্ছাকৃত এ ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত। —বি. স.
No comments