কণ্ঠস্বর-দুর্নীতি-রাজনীতি, রাজনীতি-দুর্নীতি by রাহাত খান
টু-জি স্পেকট্রাম দুর্নীতি দিয়ে শুরু করেছিলাম। ভারতের সাবেক টেলিকমমন্ত্রী রাজা এবং এমপি কানিমোঝি এই সমুদ্রচুরির মতো ভয়াবহ চুরির দায়ে অভিযুক্ত। বর্তমানে তাদের দিন কাটছে জেলে। দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টা কীভাবে দুর্নীতির হাতে মার খায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই টু-জি কেলেঙ্কারি।
আমাদের মতো দরিদ্র দেশেও পুকুরচুরি এমনকি সমুদ্রচুরিও হয়। হাজার কোটি ডলার পাচার হয়ে চলে যায়
দেশের বাইরে
বোন তিহার (ভারত) জেলে আটক আছেন। বোনকে দেখতে দিলি্ল পেঁৗছেছেন এমকে স্টালিন। তামিলনাড়ূর ডিএমকে নেতা এম করুণানিধির পুত্র তিনি।
এই কিছুদিন আগেও করুণানিধি ছিলেন তামিলনাড়ূর মুখ্যমন্ত্রী। সিংহ-পুরুষ। তবে কিছুদিন আগে তামিলনাড়ূর রাজ্য নির্বাচনে গোহারা হেরেছেন এডিএমকে নেতা, তামিলনাড়ূর কিংবদন্তি অভিনেতা, পরে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া প্রয়াত রামচন্দ্রনের স্ত্রী, সাবেক অভিনেত্রী, বর্তমানে দাপুটে রাজনীতিবিদ জয়ললিতার কাছে। সিংহ-পুরুষের সিংহ গর্জন এখন বিড়ালের মিউমিউতে পরিণত হয়েছে।
করুণানিধির ডিএমকে পার্টি এখনও ভারতের ক্ষমতাসীন ইউপিএ কোয়ালিশনে আছে। তবে টু-জি স্পেকট্রাম দুর্নীতির কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো অনুকম্পা পাচ্ছেন না। অনুকম্পা পাওয়া তো দূরে থাকুক, দিলি্ল সরকারই করুণানিধির ডিএমকে দলের দাপুটে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজাকে আগে মন্ত্রিত্ব থেকে বরখাস্ত করেছে, পরে দুর্নীতির নাটগুরু হিসেবে জেলে পুরেছে।
টু-জি স্পেকট্রাম বিশাল মাপের এক দুর্নীতি। অভিযোগ আছে, টেলিকমমন্ত্রী হিসেবে রাজা ঘুষের বিনিময়ে লোকজনকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। যেমন-তেমন দুর্নীতি নয়, প্রায় এক লাখ ৩৩ হাজার কোটি ডলারের দুর্নীতি। অনুসন্ধানী রিপোর্টারের কল্যাণে বিশাল এই দুর্নীতির খবর সংবাদপত্রে চাউর হতে বেশি সময় লাগেনি। ভারতজুড়ে এই দুর্নীতি এবং কংগ্রেসদলীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নিস্পৃহতা-নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। মন্ত্রী টি কে রাজা (নামের প্রথমাংশ ঠিক নাও হতে পারে) খুব স্মার্ট, খুব করিতকর্মা লোক। বিরোধী দল, কোয়ালিশন সরকারের অন্যান্য দল ও জনগণের ক্ষোভের বিপক্ষে সোজা জানিয়ে দিলেন, দুর্নীতির সঙ্গে তিনি আদৌ জড়িত নন। দিলি্লর বিভিন্ন লবি মহলে বুক চিতিয়ে বেড়াতে লাগলেন। উঠেপড়ে লাগলেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে।
শেষ রক্ষা অবশ্য তার হয়নি। ভারতীয় গোয়েন্দাদের কয়েকটি তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে তার মন্ত্রিত্ব গেল এবং পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে যেতে হলো রাজাকে। রাজাকে জেলে পোরার কিছুদিন পর গোয়েন্দা তদন্তের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হলো কানিমোঝিকে। ডিএমকে দলের অন্যতম সম্পাদক তিনি। ডিএমকে প্রধান করুণানিধির মেয়ে।
শোনা যায় কানিমোঝি নাকি তিহার জেলে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর হতাশায় ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু করার কিছু নেই। উচ্চ আদালতে করা তার জামিনের আবেদন তিন-তিনবার অগ্রাহ্য হয়েছে। বাড়িতে কানিমোঝির দশ বছরের ছেলে আদিত্য রয়েছে। তার জন্য কান্নাকাটি করেন কানিমোঝি। কিন্তু তামিলনাড়ূর এমপি কানিমোঝির কান্নাই শুধু সার। টু-জি স্পেকট্রাম ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার দায়ে তাকে জেলে পোরা হয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতেও রাজনীতি ও প্রশাসনে দুর্নীতি বড় একটা কম হয় না। তবে প্রায় সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের মতো দুর্নীতি এর আগে ভারতে কখনও ঘটেনি। জনগণের কল্পনার বাইরে ছিল এ রকম বিশাল মাপের দুর্নীতি।
এই দুর্নীতির বিচার নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো টালবাহানা করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। কংগ্রেস কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারে, যদি এর মধ্যে কোনো অঘটন না ঘটে, আরও তিন বছর। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে টু-জি স্পেকট্রামসহ স্পর্শকাতর দুর্নীতিগুলোর বিচার সম্পন্ন করতে হবে। যেমন-তেমনভাবে নয়, বিচারে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা শতকরা একশ' ভাগ নিশ্চিত করে। নইলে আগামী নির্বাচনে কংগ্রেসের অবস্থা হয়ে দাঁড়াবে শোচনীয়।
দুর্নীতি কি রাজনীতির অপরিহার্য অঙ্গ? অথবা কথাটা ঘুরিয়ে বলা যায়, রাজনীতি ও দুর্নীতি কি প্রায় সমার্থক? জানি প্রত্যেক রাজনীতিবিদই, অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও নিজেকে ধোয়া তুলসী পাতা মনে করেন। রাজনীতিবিদদের মধ্যে দুর্নীতির ব্যাপারে এ রকম দু'একজন ধোয়া তুলসী পাতা থাকলেও থাকতে পারেন। সবকিছুতে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তো থাকেই। তবে নিজেদের এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে কিছুমাত্র দ্বিধা না করে বলাই যায়, কিছু ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত বাদ দিলে দুনিয়ার সর্বত্র রাজনীতি ও দুর্নীতি, কিংবা বলা যায় দুর্নীতি ও রাজনীতি যেন শরীর জোড়া লেগে যাওয়া একই দেহের দুটি মাথা। দুই ভাই।
জাপানের এক প্রধানমন্ত্রী, এখন পর্যন্ত যাকে দেশের সবচেয়ে সফল, সবচেয়ে করিতকর্মা প্রধানমন্ত্রী বলে মনে করা হয়, কয়েক কোটি ইয়েন উৎকোচ নেওয়ার অপরাধে তার প্রধানমন্ত্রিত্ব তো যায়ই, পরে তাকে প্রায় আমৃত্যু জেলে কাটাতে হয়েছে। ভারতের ইন্দিরাতনয় রাজীব গান্ধী ছিলেন চমৎকার মানুষ। আধুনিক ভারতের রূপকার গণ্য করা হয় তাকেই। সেই রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় অভিযোগ উঠেছিল, অস্ত্র কেনার এক ডিলে ইতালির একটি অস্ত্র তৈরিকারী কোম্পানির কাছ থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলারের উৎকোচ গ্রহণ করেছেন রাজীব। এই অভিযোগ সত্য না মিথ্যা, তা কোর্টে সাব্যস্ত হওয়ার আগেই নির্বাচনী প্রচারে বিরোধী বিজেপি এবং অন্যান্য দল ভারতজুড়ে ছড়িয়ে দেয় একটি স্লোগান : গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়। এই একটা স্লোগানেই নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়। ক্ষমতায় যায় সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি। পরে অবশ্য কোর্টে রাজীব গান্ধীর নির্দোষিতা প্রমাণ হয়। পরে দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন তিনি। তবে জনগণ যে তাদের বহুমুখী অভিজ্ঞতার আলোকে রাজনীতিতে দুর্নীতিকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে মনে করে, এটা এরই প্রমাণ।
দেশ-বিদেশের এ রকম বহু দুর্নীতির দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়, যা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমন রাজনীতির কথা বলা যায়, যে রাজনীতির লক্ষ্যই ক্ষমতার অপব্যবহার করে যতটা পারা যায় অর্থ উপার্জন করা। বিশেষত দুর্নীতি তাকে বা তাদেরই বেশি আশ্রয় করে যার বা যাদের হাতে থাকে অপরিমেয় ক্ষমতা, যারা থাকে পার্লামেন্ট ও আদালতের ঊধর্ে্ব। মার্কোস, সুহার্তো, আইয়ুব খান, মধ্যপ্রাচ্যের মোবারক, বেন আলি, সালেহ, গাদ্দাফি, বাশার, সৌদি আরবের প্রিন্স থেকে শুরু করে স্বয়ং বাদশা, দক্ষিণ আমেরিকার একনায়কবৃন্দ, বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও অন্যান্য বিলুপ্ত কিংবা বিলুপ্তপ্রায় কমিউনিস্ট দেশের পলিটব্যুরোর সদস্যবৃন্দ_ এরা সবাই দুর্নীতি ও রাজনীতি যে ভাই ভাই, তা নিজেদের জীবদ্দশায় ভালোভাবে প্রমাণ করেছেন। ৩২ বছর একটানা দেশ শাসনে মিসরের 'তুলনাহীন' সৎ নেতার মানিব্যাগে আছে মাত্র ১২ বিলিয়ন ডলার। তিউনিসিয়ার বেন আলি জনগণের তাড়া খেয়ে সৌদি আরবে ভেগেছেন মাত্র পাঁচ বিলিয়ন ডলার এবং ছালাভর্তি তিরিশ মণ সোনা নিয়ে। ৪২ বছর দেশ শাসন করা মুয়াম্মার গাদ্দাফি যে কত শত বিলিয়ন ডলারের মালিক তা বোধকরি তিনি নিজেই জানেন না। শুধু স্বৈরশাসকের দেশে নয়, দুর্নীতি ছেয়ে আছে কমবেশি গণতান্ত্রিক বলে বিবেচিত বহু দেশেও। এ রকম একটি দেশের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে ভরাডুবি হবে বুঝে ৮০টি বড় বড় বাক্স বোঝাই করে 'ওমরাহ' পালন করতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। কী ছিল সেসব ট্যাঙ্কে? নিশ্চয়ই শুধু কাপড়-জাপা, গামছা-তোয়ালে দিয়ে বোঝাই ছিল না ট্যাঙ্কগুলো!
বৃহৎ-গরিব নির্বিশেষে, গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট দেশ নির্বিশেষে দুর্নীতির সঙ্গে চমৎকার দোস্তি পাতিয়েছে রাজনীতি। অথবা বলা যায়, ব্যতিক্রম বাদে রাজনীতি মানেই যেন দুর্নীতির সঙ্গে গলাগলি সম্পর্ক থাকা। এসব কথা অপ্রিয়। তবে সত্য কথন।
বলতে হয়, বাংলাদেশের মতো শুধু বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ নন, বেশিরভাগ উচ্চ ও মধ্যস্তরের আমলাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমণ্ডির উল্লেখযোগ্য অংশের বাড়ির মালিক এই আমলারা। তাদের কেউ ছিলেন বন বিভাগে, কেউ কাস্টমসে, কেউ পুলিশে, কেউ সরকারি করপোরেশনের চেয়ারম্যান বা এমডি, কেউ গোয়েন্দা বিভাগে। কিন্তু আমলাদের দিকে কারও চোখ যায় না। কারণ তাদের ওই সব বাড়ি তো করেছেন তাদের শ্বশুরকুলের লোকেরা, অথবা গিফট হিসেবে পেয়েছেন। কেউ কেউ বাড়ি করেছেন বাড়ির সম্পত্তি (থাক বা না থাক) বেচে। এক পয়সা ঘুষ খেলে রাজনীতিবিদদের দোষ হয় এক হাজার টাকার। আর এক হাজার টাকা নয়ছয় করলে আমলাদের দোষ হয় এক পয়সার।
অবশ্য সত্যের খাতিরে বলতে হয়, আমলাদের সত্যিকারের ক্ষমতা ও দাপট ছিল পাকিস্তান আমলে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের কিছুটা জবাবদিহিতা রয়েছে, যে কারণে ছোটখাটো ঘুষ-দুর্নীতি যে হয় না তা নয়। দুর্নীতি বলতে গেলে আমলাতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পেঁৗছে গেছে। তবে একেবারে যাকে বলে পুকুরচুরি, 'পাক জমানায়' যেগুলো প্রায়ই হতো, সে ধরনের দুর্নীতি ঘটার সুযোগ-অবকাশ এখন অনেকটা কম। অবশ্য মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদদের সহায়তা পেলে বঙ্গভবনটাও কয়েক কোটি টাকায় বেচে দেওয়া সম্ভব।
টু-জি স্পেকট্রাম দুর্নীতি দিয়ে শুরু করেছিলাম। ভারতের সাবেক টেলিকমমন্ত্রী রাজা এবং এমপি কানিমোঝি এই সমুদ্রচুরির মতো ভয়াবহ চুরির দায়ে অভিযুক্ত। বর্তমানে তাদের দিন কাটছে জেলে। দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টা কীভাবে দুর্নীতির হাতে মার খায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই টু-জি কেলেঙ্কারি। আমাদের মতো দরিদ্র দেশেও পুকুরচুরি এমনকি সমুদ্রচুরিও হয়। হাজার কোটি ডলার পাচার হয়ে চলে যায় দেশের বাইরে। জমা হয় গিয়ে হয়তো সুইস কিংবা সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে। চোরাচালান যাতে নির্বিঘ্নে হয় সেসবের তদারক করতে ছোটেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী কিংবা স্বয়ং অর্থমন্ত্রী। চোরে চোরে যদি মাসতুতো ভাই হয়, তাহলে কার সাধ্য দুর্নীতি রোধ করে, চোরাচালান আটকায়!
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
দেশের বাইরে
বোন তিহার (ভারত) জেলে আটক আছেন। বোনকে দেখতে দিলি্ল পেঁৗছেছেন এমকে স্টালিন। তামিলনাড়ূর ডিএমকে নেতা এম করুণানিধির পুত্র তিনি।
এই কিছুদিন আগেও করুণানিধি ছিলেন তামিলনাড়ূর মুখ্যমন্ত্রী। সিংহ-পুরুষ। তবে কিছুদিন আগে তামিলনাড়ূর রাজ্য নির্বাচনে গোহারা হেরেছেন এডিএমকে নেতা, তামিলনাড়ূর কিংবদন্তি অভিনেতা, পরে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া প্রয়াত রামচন্দ্রনের স্ত্রী, সাবেক অভিনেত্রী, বর্তমানে দাপুটে রাজনীতিবিদ জয়ললিতার কাছে। সিংহ-পুরুষের সিংহ গর্জন এখন বিড়ালের মিউমিউতে পরিণত হয়েছে।
করুণানিধির ডিএমকে পার্টি এখনও ভারতের ক্ষমতাসীন ইউপিএ কোয়ালিশনে আছে। তবে টু-জি স্পেকট্রাম দুর্নীতির কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো অনুকম্পা পাচ্ছেন না। অনুকম্পা পাওয়া তো দূরে থাকুক, দিলি্ল সরকারই করুণানিধির ডিএমকে দলের দাপুটে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজাকে আগে মন্ত্রিত্ব থেকে বরখাস্ত করেছে, পরে দুর্নীতির নাটগুরু হিসেবে জেলে পুরেছে।
টু-জি স্পেকট্রাম বিশাল মাপের এক দুর্নীতি। অভিযোগ আছে, টেলিকমমন্ত্রী হিসেবে রাজা ঘুষের বিনিময়ে লোকজনকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। যেমন-তেমন দুর্নীতি নয়, প্রায় এক লাখ ৩৩ হাজার কোটি ডলারের দুর্নীতি। অনুসন্ধানী রিপোর্টারের কল্যাণে বিশাল এই দুর্নীতির খবর সংবাদপত্রে চাউর হতে বেশি সময় লাগেনি। ভারতজুড়ে এই দুর্নীতি এবং কংগ্রেসদলীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নিস্পৃহতা-নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। মন্ত্রী টি কে রাজা (নামের প্রথমাংশ ঠিক নাও হতে পারে) খুব স্মার্ট, খুব করিতকর্মা লোক। বিরোধী দল, কোয়ালিশন সরকারের অন্যান্য দল ও জনগণের ক্ষোভের বিপক্ষে সোজা জানিয়ে দিলেন, দুর্নীতির সঙ্গে তিনি আদৌ জড়িত নন। দিলি্লর বিভিন্ন লবি মহলে বুক চিতিয়ে বেড়াতে লাগলেন। উঠেপড়ে লাগলেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে।
শেষ রক্ষা অবশ্য তার হয়নি। ভারতীয় গোয়েন্দাদের কয়েকটি তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে তার মন্ত্রিত্ব গেল এবং পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে যেতে হলো রাজাকে। রাজাকে জেলে পোরার কিছুদিন পর গোয়েন্দা তদন্তের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হলো কানিমোঝিকে। ডিএমকে দলের অন্যতম সম্পাদক তিনি। ডিএমকে প্রধান করুণানিধির মেয়ে।
শোনা যায় কানিমোঝি নাকি তিহার জেলে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর হতাশায় ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু করার কিছু নেই। উচ্চ আদালতে করা তার জামিনের আবেদন তিন-তিনবার অগ্রাহ্য হয়েছে। বাড়িতে কানিমোঝির দশ বছরের ছেলে আদিত্য রয়েছে। তার জন্য কান্নাকাটি করেন কানিমোঝি। কিন্তু তামিলনাড়ূর এমপি কানিমোঝির কান্নাই শুধু সার। টু-জি স্পেকট্রাম ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার দায়ে তাকে জেলে পোরা হয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতেও রাজনীতি ও প্রশাসনে দুর্নীতি বড় একটা কম হয় না। তবে প্রায় সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের মতো দুর্নীতি এর আগে ভারতে কখনও ঘটেনি। জনগণের কল্পনার বাইরে ছিল এ রকম বিশাল মাপের দুর্নীতি।
এই দুর্নীতির বিচার নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো টালবাহানা করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। কংগ্রেস কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারে, যদি এর মধ্যে কোনো অঘটন না ঘটে, আরও তিন বছর। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে টু-জি স্পেকট্রামসহ স্পর্শকাতর দুর্নীতিগুলোর বিচার সম্পন্ন করতে হবে। যেমন-তেমনভাবে নয়, বিচারে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা শতকরা একশ' ভাগ নিশ্চিত করে। নইলে আগামী নির্বাচনে কংগ্রেসের অবস্থা হয়ে দাঁড়াবে শোচনীয়।
দুর্নীতি কি রাজনীতির অপরিহার্য অঙ্গ? অথবা কথাটা ঘুরিয়ে বলা যায়, রাজনীতি ও দুর্নীতি কি প্রায় সমার্থক? জানি প্রত্যেক রাজনীতিবিদই, অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও নিজেকে ধোয়া তুলসী পাতা মনে করেন। রাজনীতিবিদদের মধ্যে দুর্নীতির ব্যাপারে এ রকম দু'একজন ধোয়া তুলসী পাতা থাকলেও থাকতে পারেন। সবকিছুতে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তো থাকেই। তবে নিজেদের এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে কিছুমাত্র দ্বিধা না করে বলাই যায়, কিছু ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত বাদ দিলে দুনিয়ার সর্বত্র রাজনীতি ও দুর্নীতি, কিংবা বলা যায় দুর্নীতি ও রাজনীতি যেন শরীর জোড়া লেগে যাওয়া একই দেহের দুটি মাথা। দুই ভাই।
জাপানের এক প্রধানমন্ত্রী, এখন পর্যন্ত যাকে দেশের সবচেয়ে সফল, সবচেয়ে করিতকর্মা প্রধানমন্ত্রী বলে মনে করা হয়, কয়েক কোটি ইয়েন উৎকোচ নেওয়ার অপরাধে তার প্রধানমন্ত্রিত্ব তো যায়ই, পরে তাকে প্রায় আমৃত্যু জেলে কাটাতে হয়েছে। ভারতের ইন্দিরাতনয় রাজীব গান্ধী ছিলেন চমৎকার মানুষ। আধুনিক ভারতের রূপকার গণ্য করা হয় তাকেই। সেই রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় অভিযোগ উঠেছিল, অস্ত্র কেনার এক ডিলে ইতালির একটি অস্ত্র তৈরিকারী কোম্পানির কাছ থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলারের উৎকোচ গ্রহণ করেছেন রাজীব। এই অভিযোগ সত্য না মিথ্যা, তা কোর্টে সাব্যস্ত হওয়ার আগেই নির্বাচনী প্রচারে বিরোধী বিজেপি এবং অন্যান্য দল ভারতজুড়ে ছড়িয়ে দেয় একটি স্লোগান : গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়। এই একটা স্লোগানেই নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়। ক্ষমতায় যায় সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি। পরে অবশ্য কোর্টে রাজীব গান্ধীর নির্দোষিতা প্রমাণ হয়। পরে দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন তিনি। তবে জনগণ যে তাদের বহুমুখী অভিজ্ঞতার আলোকে রাজনীতিতে দুর্নীতিকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে মনে করে, এটা এরই প্রমাণ।
দেশ-বিদেশের এ রকম বহু দুর্নীতির দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়, যা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমন রাজনীতির কথা বলা যায়, যে রাজনীতির লক্ষ্যই ক্ষমতার অপব্যবহার করে যতটা পারা যায় অর্থ উপার্জন করা। বিশেষত দুর্নীতি তাকে বা তাদেরই বেশি আশ্রয় করে যার বা যাদের হাতে থাকে অপরিমেয় ক্ষমতা, যারা থাকে পার্লামেন্ট ও আদালতের ঊধর্ে্ব। মার্কোস, সুহার্তো, আইয়ুব খান, মধ্যপ্রাচ্যের মোবারক, বেন আলি, সালেহ, গাদ্দাফি, বাশার, সৌদি আরবের প্রিন্স থেকে শুরু করে স্বয়ং বাদশা, দক্ষিণ আমেরিকার একনায়কবৃন্দ, বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও অন্যান্য বিলুপ্ত কিংবা বিলুপ্তপ্রায় কমিউনিস্ট দেশের পলিটব্যুরোর সদস্যবৃন্দ_ এরা সবাই দুর্নীতি ও রাজনীতি যে ভাই ভাই, তা নিজেদের জীবদ্দশায় ভালোভাবে প্রমাণ করেছেন। ৩২ বছর একটানা দেশ শাসনে মিসরের 'তুলনাহীন' সৎ নেতার মানিব্যাগে আছে মাত্র ১২ বিলিয়ন ডলার। তিউনিসিয়ার বেন আলি জনগণের তাড়া খেয়ে সৌদি আরবে ভেগেছেন মাত্র পাঁচ বিলিয়ন ডলার এবং ছালাভর্তি তিরিশ মণ সোনা নিয়ে। ৪২ বছর দেশ শাসন করা মুয়াম্মার গাদ্দাফি যে কত শত বিলিয়ন ডলারের মালিক তা বোধকরি তিনি নিজেই জানেন না। শুধু স্বৈরশাসকের দেশে নয়, দুর্নীতি ছেয়ে আছে কমবেশি গণতান্ত্রিক বলে বিবেচিত বহু দেশেও। এ রকম একটি দেশের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে ভরাডুবি হবে বুঝে ৮০টি বড় বড় বাক্স বোঝাই করে 'ওমরাহ' পালন করতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। কী ছিল সেসব ট্যাঙ্কে? নিশ্চয়ই শুধু কাপড়-জাপা, গামছা-তোয়ালে দিয়ে বোঝাই ছিল না ট্যাঙ্কগুলো!
বৃহৎ-গরিব নির্বিশেষে, গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট দেশ নির্বিশেষে দুর্নীতির সঙ্গে চমৎকার দোস্তি পাতিয়েছে রাজনীতি। অথবা বলা যায়, ব্যতিক্রম বাদে রাজনীতি মানেই যেন দুর্নীতির সঙ্গে গলাগলি সম্পর্ক থাকা। এসব কথা অপ্রিয়। তবে সত্য কথন।
বলতে হয়, বাংলাদেশের মতো শুধু বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ নন, বেশিরভাগ উচ্চ ও মধ্যস্তরের আমলাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমণ্ডির উল্লেখযোগ্য অংশের বাড়ির মালিক এই আমলারা। তাদের কেউ ছিলেন বন বিভাগে, কেউ কাস্টমসে, কেউ পুলিশে, কেউ সরকারি করপোরেশনের চেয়ারম্যান বা এমডি, কেউ গোয়েন্দা বিভাগে। কিন্তু আমলাদের দিকে কারও চোখ যায় না। কারণ তাদের ওই সব বাড়ি তো করেছেন তাদের শ্বশুরকুলের লোকেরা, অথবা গিফট হিসেবে পেয়েছেন। কেউ কেউ বাড়ি করেছেন বাড়ির সম্পত্তি (থাক বা না থাক) বেচে। এক পয়সা ঘুষ খেলে রাজনীতিবিদদের দোষ হয় এক হাজার টাকার। আর এক হাজার টাকা নয়ছয় করলে আমলাদের দোষ হয় এক পয়সার।
অবশ্য সত্যের খাতিরে বলতে হয়, আমলাদের সত্যিকারের ক্ষমতা ও দাপট ছিল পাকিস্তান আমলে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের কিছুটা জবাবদিহিতা রয়েছে, যে কারণে ছোটখাটো ঘুষ-দুর্নীতি যে হয় না তা নয়। দুর্নীতি বলতে গেলে আমলাতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পেঁৗছে গেছে। তবে একেবারে যাকে বলে পুকুরচুরি, 'পাক জমানায়' যেগুলো প্রায়ই হতো, সে ধরনের দুর্নীতি ঘটার সুযোগ-অবকাশ এখন অনেকটা কম। অবশ্য মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদদের সহায়তা পেলে বঙ্গভবনটাও কয়েক কোটি টাকায় বেচে দেওয়া সম্ভব।
টু-জি স্পেকট্রাম দুর্নীতি দিয়ে শুরু করেছিলাম। ভারতের সাবেক টেলিকমমন্ত্রী রাজা এবং এমপি কানিমোঝি এই সমুদ্রচুরির মতো ভয়াবহ চুরির দায়ে অভিযুক্ত। বর্তমানে তাদের দিন কাটছে জেলে। দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টা কীভাবে দুর্নীতির হাতে মার খায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই টু-জি কেলেঙ্কারি। আমাদের মতো দরিদ্র দেশেও পুকুরচুরি এমনকি সমুদ্রচুরিও হয়। হাজার কোটি ডলার পাচার হয়ে চলে যায় দেশের বাইরে। জমা হয় গিয়ে হয়তো সুইস কিংবা সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে। চোরাচালান যাতে নির্বিঘ্নে হয় সেসবের তদারক করতে ছোটেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী কিংবা স্বয়ং অর্থমন্ত্রী। চোরে চোরে যদি মাসতুতো ভাই হয়, তাহলে কার সাধ্য দুর্নীতি রোধ করে, চোরাচালান আটকায়!
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments