শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ উন্মুক্ত হলো-এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়

অযোধ্যার বাবরি মসজিদ-সংক্রান্ত মামলায় বৃহস্পতিবার ভারতের এলাহাবাদ হাইকোর্ট সেখানে মসজিদ ও মন্দির দুটিই থাকবে বলে রায় দিয়েছেন। বিরোধপূর্ণ জমির এক-তৃতীয়াংশ পাবে বাবরি মসজিদ, এক-তৃতীয়াংশ রামমন্দির এবং বাকি অংশ পাবে অযোধ্যাভিত্তিক হিন্দু সংগঠনগুলো।


তবে আদালত আগামী তিন মাস স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বলেছেন। রায়ের পর ভারতজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, তাকে ইতিবাচক বলেই আমরা ধারণা করি। বিজেপি ও সংঘ পরিবার রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। অন্যদিকে নয়াদিল্লির জামে মসজিদের ইমাম বলেছেন, ‘আমরা রায়ে খুশি হইনি।’ তবে দুই পক্ষের আইনজীবীই সুপ্রিম কোর্টে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন। কংগ্রেস, সিপিআই, সিপিআইএমসহ ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। রায়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ে সরকার যথেষ্ট সতর্ক ছিল। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের এই রায়কে অনেকে মন্দের ভালো হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁদের যুক্তি, এর মাধ্যমে বিরোধপূর্ণ স্থানে দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়েরই দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার কারও কারও মতে, এ রায়ে আইনের চেয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতা ও বিবেচনা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবি, রামের জন্মভূমি অযোধ্যায় মন্দিরের ওপর বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। অন্যদিকে মুসলমান সম্প্রদায়ের দাবি, ষোড়শ শতকে প্রতিষ্ঠিত বাবরি মসজিদের আগে সেখানে কোনো স্থাপনা ছিল না। এ নিয়ে বিবাদ দীর্ঘদিনের। ১৯৯২ সালে একদল উগ্রপন্থী হিন্দু বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিলে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয় এবং বহু মানুষ মারা যায়, যার অভিঘাত বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপরও পড়েছিল। সে কারণে বৃহস্পতিবারের রায় নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা ছিল।
শেষ পর্যন্ত রায়ের শান্তিপূর্ণ প্রতিক্রিয়া কেবল ভারত নয়, গোটা উপমহাদেশের মানুষকে আশ্বস্ত করেছে। আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় ও উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকারও সতর্ক ছিল। রাজনৈতিক দলগুলোও সংযত আচরণ করেছে। এতে আবারও প্রমাণিত হলো, শাসকগোষ্ঠীর মদদ না থাকলে কোনো দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটতে পারে না। হাইকোর্টের রায়ের পর রাস্তায় শক্তি প্রদর্শনের বদলে দুই পক্ষই সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার যে ঘোষণা দিয়েছে, তাতে আইনের শাসনের প্রতি তাদের আস্থাই প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৯২ সালে বিজেপি ও তার সহযোগীদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হলে অনেক প্রাণহানি ও জাতীয় সম্পদের ক্ষতি এড়ানো যেত। বিশাল ভারতের জনজীবনের সমস্যাও বিশাল। রাজনীতিকদের কর্তব্য সম্মিলিতভাবে সেসব সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে ধর্মীয় উপাসনালয়ের মালিকানা নিয়ে মারামারি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
বহু ধর্ম ও জাতির সমন্বয়ে গঠিত আধুনিক রাষ্ট্রে সব নাগরিকেরই সমান অধিকার আছে এবং ধর্ম বা জাতিগত সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে কারও প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। সেটি ভারতের জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি বাংলাদেশের বেলায়ও। নিকট প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের ঘটনাবলি আমাদের আলোড়িত না করে পারে না। সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুদৃঢ় হলে তার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া যেমন এখানে পড়বে, তেমনি সাম্প্রদায়িক হানাহানি হলে অভিঘাতও এড়ানো কঠিন হবে।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় হয়তো ঐতিহাসিক বিতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটাবে না, কিংবা উগ্রপন্থীদের হাতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ক্ষতচিহ্ন পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারবে না, কিন্তু সেখানে দুই সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.