গদ্যকার্টুন-গল্পগুলো অন্য লেখকদের কাছ থেকে শোনা by আনিসুল হক
গল্পটা বার্মা বা মিয়ানমারের। মিয়ানমারের একদল লেখক যাচ্ছেন রাজধানী থেকে দূরবর্তী এক শহরে। আলোচনা সভায় যোগ দিতে। ওই দেশে শিক্ষার হার বেশি নয়, মানুষ পড়তে পারে না, শিক্ষিতদের মধ্যেও খুব বেশি লোক বই পড়ে না। কাজেই লেখকেরা লেখার পাশাপাশি আরেকটা কাজ করেন। তাঁরা কথা বলেন, আলোচনা সভায় অংশ নেন।
আর জান্তা শাসনের অধীনে লেখার চেয়ে বলাটাই বেশি নিরাপদ, তাতে স্বাধীনতাও বেশি। এই লেখকেরা বেরিয়েছেন তেমনি একটা আলোচনা সভায় যোগ দেবেন বলে। তাঁদের কপাল খারাপ। পথে তাঁদের গাড়ি গেল নষ্ট হয়ে। তাঁরা গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। প্রচণ্ড গরম। তাঁরা পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। খোঁজখবর করে মেকানিক ডেকে আনা হয়েছে। গাড়ি মেরামত চলছে।
তাঁদের গাড়ির পাশে ভিড় করল গ্রামবাসী। তারা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কারা?’
‘আমরা লেখক।’
‘আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?’
‘আমরা যাচ্ছি কথা বলতে।’
‘আপনাদের গাড়ি সারতে কতক্ষণ লাগবে?’
‘চার-পাঁচ ঘণ্টা।’
‘খুব ভালো। আপনারা আমাদের উপাসনালয়ে আসুন। আমাদের গ্রামের লোকদের সামনে ততক্ষণ কথা বলুন।’
লেখকদের খুব সমাদর করে নিয়ে যাওয়া হলো বৌদ্ধমন্দিরে। মন্দিরের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলো, ‘সব গ্রামবাসী চলে আসো। শহর থেকে খুব সম্মানিত লোকেরা এসেছেন। তাঁরা কথা বলবেন।’
মন্দির ভরে গেল গ্রামবাসী-জনতায়। লেখকেরা গল্প বলতে শুরু করলেন। হাসির গল্প। কিন্তু কেউ হাসছে না।
‘কী ব্যাপার? সবাই এত গম্ভীর কেন?’
গ্রামের নেতা বললেন, ‘এরা মূর্খসুর্খ মানুষ। আর আপনারা শহরের শিক্ষিত লোক। এরা আপনাদের কথা ঠিকভাবে বুঝবে কি বুঝবে না আমাদের সন্দেহ আছে। কাজেই এদের বলে দেওয়া হয়েছে, কেউ যেন কোনো উচ্চবাচ্য না করে। যেন না হাসে।’
লেখকেরা বললেন, ‘তা কেন হবে। যখন হাসির কথা বলব, তখন তো হাসতে হবে।’
‘আচ্ছা। আমি সেটা দেখছি।’ স্থানীয় ভাষায় নেতা কিছু একটা বললেন। এরপর দেখা গেল, কৌতুক বলা হলে গ্রামবাসী হাসছে।
আসলে গ্রামের নেতা হাতে একটা কাঠি রেখেছেন। তিনি গ্রামবাসীকে বলেছেন, ‘যখন আমি কাঠিটা ওপরে তুলব, তখন হাসবে। আর যখন কাঠিটা মাটিতে থাকবে, তখন সবাই চুপচাপ শুনবে।’
এইবার এক লেখক খুব দুঃখের কাহিনি বলছেন, ‘আমার বন্ধু। সে মৃত্যুপথযাত্রী। আমাকে বলল, জল দাও। আমি জল এগিয়ে দিলাম। সেই জল পান করার আগেই তার মৃত্যু হলো।’
অমনি সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
ব্যাপার কী? নেতার পিঠ চুলকাচ্ছিল। তিনি মনের ভুলে কাঠিটা হাতে তুলে নিয়ে পিঠ চুলকাতে আরম্ভ করেছেন। এটাকেই হাসার ইশারা ভেবে গ্রামবাসী হাসতে শুরু করেছে।
এই গল্প শুনিয়েছেন যিনি, তাঁর নাম খিন মং নিও। তিনি বার্মার লেখক। আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন আরও অনেক লেখকের মতো লেখকদের আন্তর্জাতিক একটা আবাসিক কর্মশালায় অংশ নিতে।
তাঁর গল্প বলার অধিবেশন ছিল দিন দুই আগে। এই গল্প শোনালেন তিনি। অনুষ্ঠান শেষে আমি তাঁকে বললাম, ‘যাহ্! এটা তুমি বানিয়ে বলেছ। এটা পুরোনো কৌতুক।’ খিন বলেন, ‘না না, সত্য ঘটনা।’
খিন আবার রসায়নে পিএইচডি। বিলেতের ম্যানচেস্টার থেকে তিনি এই পিএইচডি করেছেন। বার্মায় তিনি লেখালেখি করেন, রেডিওতে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন, টেলিভিশনেও আলোচনায় অংশ নেন।
খিন তাঁর নিজের লেখা একটা গল্প পড়ে শোনালেন। সেই গল্পটা এই রকম:
দুটো মাটির ব্যাংক। তারা পাশাপাশি থাকে। একটার মালিক বড়লোক। আরেকটার মালিক তেমন বড়লোক নয়। বড়লোক মালিকের মাটির ব্যাংক বলে, ‘জানিস, আমার পেটের ভেতরে কী আছে? খুব দামি দামি মুদ্রা। এমনকি সোনার মুদ্রাও আছে।’
গরিব মালিকের ব্যাংক বলে, ‘ইশ, তোমার কী ভাগ্য! তোমার মালিক বড়লোক। সে প্রায়ই তোমার পেটে টাকা ভরে। পয়সা ভরে। আমি কী হতভাগা। আমার মালিক আমারটাতে পয়সা ভরতেই চায় না।’
দিন যায়। বড়লোকের ব্যাংকটা ভর্তি হয়ে যায়। তখন তার মালিক বলে, এটা তো ভরে গেছে। এখন এটাকে ভাঙতে হবে। মালিক মাটির ব্যাংকটাকে নিয়ে চলল ভাঙবে বলে।
বড়লোকের ব্যাংক বলে, ‘ভাই, আমি চললাম। আজকে আমার শেষ দিন। এখনই আমাকে ভেঙে ফেলা হবে।’
গরিবের ব্যাংক বলে, ‘দুঃখ কোরো না ভাই, আজ আর কাল। আমিও পূর্ণ হতে চলেছি। কিছুদিন পরে আমারও পরিণতি হবে তোমার মতোই।’
খিনের গল্পটা ইশপের উপদেশমূলক গল্পের মতো।
আমরা জানি, এই গল্পের উপদেশটা কী! আজ যাঁরা ভাবছেন তাঁদের খুব সুদিন যাচ্ছে, যাঁরা ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন, আর আমাদের কাঠি উঁচিয়ে বলছেন, হাসো, গভীর দুঃখের কথা শুনেও আমাদের যেন হাসতেই হবে, আমরা এমনি বোকাসোকা, তাদের জন্যও অপেক্ষা করছে করুণ পরিণতি। তাঁদেরও সুখের দিন শেষ হবে। এক মাঘে শীত যায় না। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস পুনরাবৃত্তিময়, আর এই শিক্ষাটা ইতিহাস থেকে কেউ গ্রহণ করে না।
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে এসেছেন কবি কিম সা-ইন। তাঁর কাছ থেকে শোনা হলো তাঁর লেখকজীবনের গল্প। ১৯৮০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়া ছিল সামরিক শাসনাধীন। কিমকে তিনবার কারাগারে যেতে হয়েছে, পালিয়ে থাকতে হয়েছে অনেক দিন, ওই সামরিক জান্তার শাসনামলে।
ফলে তিনি যখন লিখতে শুরু করেন, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁকে কবিতা লিখতে হয়েছে। ১৯৮৭ সালে ওই দেশে গণতন্ত্রের পথচলা শুরু হয়। কিম লিখেছেন, ‘তখন আমি আমার সাহিত্যিক উদ্যমের দিকনির্দেশনা হারিয়ে ফেলি। এখন কী লিখব? প্রাথমিক লক্ষ্য তো অর্জিত হয়েই গেছে।’ তিনি লিখেছেন, ‘নিজের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আমি আমার কবিতাকে এত দিন দূষিত করেছি, খুব বেশি করে নিজের মতবাদ প্রচার করে, ঘৃণা প্রচার করে। এ যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ না দেখে আমি দেখছি আমার শত্রুদের মুখ। আমি তো ওদের মতোই অন্যের ভালো জিনিসের প্রশংসা করতে পারিনি, আমি যদি ভালোবাসা আর সহানুভূতির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি, আমি কী করে নিজেকে একজন কবি বলি।’ তিনি বলছেন, ‘আমি চাই আমার কবিতা যেন বৃষ্টিতে ভেজা মানুষের পাশে গিয়ে একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতে পারে, এমন না যে একটা ছাতা আনাটাই সবচেয়ে জরুরি কাজ। যারা ঠান্ডা বৃষ্টিতে ভিজছে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে যেন আমার কবিতাও ভিজতে থাকে। তারপর যদি ছাতা ভাগাভাগি করা সম্ভব হয়, সে তো আরও ভালো কথা।’
কিমের এই কথাগুলো যেন আমাদেরও অনেকের মনের কথা। আমরা যারা পুরো আশির দশকে গণতন্ত্রের সংগ্রামে অংশ নিয়েছি, তাদের কাছে কবিতা আর মিছিল অভিন্ন হয়ে উঠেছিল। আমরা ওই সময়ে কবিতা থেকে মিছিলে আর মিছিল থেকে কবিতায় কীভাবে একাকারই না হয়ে গিয়েছিলাম! কিম বলছেন, ‘কিছুই যদি করতে না পারি, অন্তত এইটুকু যেন করতে পারি, আমার কবিতা যেন কাউকে আঘাত না করে।’
আমি কিমের দিকে তাকিয়ে সেই পুরোনো কথাটাই যেন উপলব্ধি করি—‘কবি তো তিনি, যিনি সমগ্র নিখিলের হয়ে দুঃখ পান।’
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
তাঁদের গাড়ির পাশে ভিড় করল গ্রামবাসী। তারা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কারা?’
‘আমরা লেখক।’
‘আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?’
‘আমরা যাচ্ছি কথা বলতে।’
‘আপনাদের গাড়ি সারতে কতক্ষণ লাগবে?’
‘চার-পাঁচ ঘণ্টা।’
‘খুব ভালো। আপনারা আমাদের উপাসনালয়ে আসুন। আমাদের গ্রামের লোকদের সামনে ততক্ষণ কথা বলুন।’
লেখকদের খুব সমাদর করে নিয়ে যাওয়া হলো বৌদ্ধমন্দিরে। মন্দিরের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলো, ‘সব গ্রামবাসী চলে আসো। শহর থেকে খুব সম্মানিত লোকেরা এসেছেন। তাঁরা কথা বলবেন।’
মন্দির ভরে গেল গ্রামবাসী-জনতায়। লেখকেরা গল্প বলতে শুরু করলেন। হাসির গল্প। কিন্তু কেউ হাসছে না।
‘কী ব্যাপার? সবাই এত গম্ভীর কেন?’
গ্রামের নেতা বললেন, ‘এরা মূর্খসুর্খ মানুষ। আর আপনারা শহরের শিক্ষিত লোক। এরা আপনাদের কথা ঠিকভাবে বুঝবে কি বুঝবে না আমাদের সন্দেহ আছে। কাজেই এদের বলে দেওয়া হয়েছে, কেউ যেন কোনো উচ্চবাচ্য না করে। যেন না হাসে।’
লেখকেরা বললেন, ‘তা কেন হবে। যখন হাসির কথা বলব, তখন তো হাসতে হবে।’
‘আচ্ছা। আমি সেটা দেখছি।’ স্থানীয় ভাষায় নেতা কিছু একটা বললেন। এরপর দেখা গেল, কৌতুক বলা হলে গ্রামবাসী হাসছে।
আসলে গ্রামের নেতা হাতে একটা কাঠি রেখেছেন। তিনি গ্রামবাসীকে বলেছেন, ‘যখন আমি কাঠিটা ওপরে তুলব, তখন হাসবে। আর যখন কাঠিটা মাটিতে থাকবে, তখন সবাই চুপচাপ শুনবে।’
এইবার এক লেখক খুব দুঃখের কাহিনি বলছেন, ‘আমার বন্ধু। সে মৃত্যুপথযাত্রী। আমাকে বলল, জল দাও। আমি জল এগিয়ে দিলাম। সেই জল পান করার আগেই তার মৃত্যু হলো।’
অমনি সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
ব্যাপার কী? নেতার পিঠ চুলকাচ্ছিল। তিনি মনের ভুলে কাঠিটা হাতে তুলে নিয়ে পিঠ চুলকাতে আরম্ভ করেছেন। এটাকেই হাসার ইশারা ভেবে গ্রামবাসী হাসতে শুরু করেছে।
এই গল্প শুনিয়েছেন যিনি, তাঁর নাম খিন মং নিও। তিনি বার্মার লেখক। আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন আরও অনেক লেখকের মতো লেখকদের আন্তর্জাতিক একটা আবাসিক কর্মশালায় অংশ নিতে।
তাঁর গল্প বলার অধিবেশন ছিল দিন দুই আগে। এই গল্প শোনালেন তিনি। অনুষ্ঠান শেষে আমি তাঁকে বললাম, ‘যাহ্! এটা তুমি বানিয়ে বলেছ। এটা পুরোনো কৌতুক।’ খিন বলেন, ‘না না, সত্য ঘটনা।’
খিন আবার রসায়নে পিএইচডি। বিলেতের ম্যানচেস্টার থেকে তিনি এই পিএইচডি করেছেন। বার্মায় তিনি লেখালেখি করেন, রেডিওতে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন, টেলিভিশনেও আলোচনায় অংশ নেন।
খিন তাঁর নিজের লেখা একটা গল্প পড়ে শোনালেন। সেই গল্পটা এই রকম:
দুটো মাটির ব্যাংক। তারা পাশাপাশি থাকে। একটার মালিক বড়লোক। আরেকটার মালিক তেমন বড়লোক নয়। বড়লোক মালিকের মাটির ব্যাংক বলে, ‘জানিস, আমার পেটের ভেতরে কী আছে? খুব দামি দামি মুদ্রা। এমনকি সোনার মুদ্রাও আছে।’
গরিব মালিকের ব্যাংক বলে, ‘ইশ, তোমার কী ভাগ্য! তোমার মালিক বড়লোক। সে প্রায়ই তোমার পেটে টাকা ভরে। পয়সা ভরে। আমি কী হতভাগা। আমার মালিক আমারটাতে পয়সা ভরতেই চায় না।’
দিন যায়। বড়লোকের ব্যাংকটা ভর্তি হয়ে যায়। তখন তার মালিক বলে, এটা তো ভরে গেছে। এখন এটাকে ভাঙতে হবে। মালিক মাটির ব্যাংকটাকে নিয়ে চলল ভাঙবে বলে।
বড়লোকের ব্যাংক বলে, ‘ভাই, আমি চললাম। আজকে আমার শেষ দিন। এখনই আমাকে ভেঙে ফেলা হবে।’
গরিবের ব্যাংক বলে, ‘দুঃখ কোরো না ভাই, আজ আর কাল। আমিও পূর্ণ হতে চলেছি। কিছুদিন পরে আমারও পরিণতি হবে তোমার মতোই।’
খিনের গল্পটা ইশপের উপদেশমূলক গল্পের মতো।
আমরা জানি, এই গল্পের উপদেশটা কী! আজ যাঁরা ভাবছেন তাঁদের খুব সুদিন যাচ্ছে, যাঁরা ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন, আর আমাদের কাঠি উঁচিয়ে বলছেন, হাসো, গভীর দুঃখের কথা শুনেও আমাদের যেন হাসতেই হবে, আমরা এমনি বোকাসোকা, তাদের জন্যও অপেক্ষা করছে করুণ পরিণতি। তাঁদেরও সুখের দিন শেষ হবে। এক মাঘে শীত যায় না। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস পুনরাবৃত্তিময়, আর এই শিক্ষাটা ইতিহাস থেকে কেউ গ্রহণ করে না।
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে এসেছেন কবি কিম সা-ইন। তাঁর কাছ থেকে শোনা হলো তাঁর লেখকজীবনের গল্প। ১৯৮০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়া ছিল সামরিক শাসনাধীন। কিমকে তিনবার কারাগারে যেতে হয়েছে, পালিয়ে থাকতে হয়েছে অনেক দিন, ওই সামরিক জান্তার শাসনামলে।
ফলে তিনি যখন লিখতে শুরু করেন, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁকে কবিতা লিখতে হয়েছে। ১৯৮৭ সালে ওই দেশে গণতন্ত্রের পথচলা শুরু হয়। কিম লিখেছেন, ‘তখন আমি আমার সাহিত্যিক উদ্যমের দিকনির্দেশনা হারিয়ে ফেলি। এখন কী লিখব? প্রাথমিক লক্ষ্য তো অর্জিত হয়েই গেছে।’ তিনি লিখেছেন, ‘নিজের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আমি আমার কবিতাকে এত দিন দূষিত করেছি, খুব বেশি করে নিজের মতবাদ প্রচার করে, ঘৃণা প্রচার করে। এ যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ না দেখে আমি দেখছি আমার শত্রুদের মুখ। আমি তো ওদের মতোই অন্যের ভালো জিনিসের প্রশংসা করতে পারিনি, আমি যদি ভালোবাসা আর সহানুভূতির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি, আমি কী করে নিজেকে একজন কবি বলি।’ তিনি বলছেন, ‘আমি চাই আমার কবিতা যেন বৃষ্টিতে ভেজা মানুষের পাশে গিয়ে একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতে পারে, এমন না যে একটা ছাতা আনাটাই সবচেয়ে জরুরি কাজ। যারা ঠান্ডা বৃষ্টিতে ভিজছে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে যেন আমার কবিতাও ভিজতে থাকে। তারপর যদি ছাতা ভাগাভাগি করা সম্ভব হয়, সে তো আরও ভালো কথা।’
কিমের এই কথাগুলো যেন আমাদেরও অনেকের মনের কথা। আমরা যারা পুরো আশির দশকে গণতন্ত্রের সংগ্রামে অংশ নিয়েছি, তাদের কাছে কবিতা আর মিছিল অভিন্ন হয়ে উঠেছিল। আমরা ওই সময়ে কবিতা থেকে মিছিলে আর মিছিল থেকে কবিতায় কীভাবে একাকারই না হয়ে গিয়েছিলাম! কিম বলছেন, ‘কিছুই যদি করতে না পারি, অন্তত এইটুকু যেন করতে পারি, আমার কবিতা যেন কাউকে আঘাত না করে।’
আমি কিমের দিকে তাকিয়ে সেই পুরোনো কথাটাই যেন উপলব্ধি করি—‘কবি তো তিনি, যিনি সমগ্র নিখিলের হয়ে দুঃখ পান।’
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments