বইপত্র-ভাবনার দরজায় by মেহেদি হাসান

বিচিত্রবিধ বিচার বিবেচনা—যতীন সরকার \ প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর \ প্রকাশক: ভূমিকা \ প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১২ \ মূল্য: ৩৩০ টাকা যে নজরুলকে একসময় প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিরা ‘কাফের’, ‘বিধর্মী’ আখ্যায়িত করে ফতোয়া দিয়েছিলেন, তাঁরাই আবার ঘটনাচক্রে তাঁকে খাঁটি মুসলমান কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন।


নজরুলের জীবদ্দশায় যখন তাঁর বিরুদ্ধে এহেন অভিযোগ ওঠে, তখন তিনি নিজে বলেছিলেন, ‘যাঁরা মনে করেন আমি ইসলামের বিরুদ্ধবাদী বা তাঁর সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছি, তাঁরা অনর্থক এ ভুল করেন। ইসলামের নামে যেসব কুসংস্কার, মিথ্যা আবর্জনা স্তূপীকৃত হয়ে উঠেছে, তাকে ইসলাম বলে না মানা কি ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযান?’ কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহ করেছিলেন সব ধরনের অন্যায়-অত্যাচার আর ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। সমকালে তাঁকে নিয়ে নানা বিপরীতমুখী কথা উঠলেও একসময় তাঁর প্রকৃত স্বরূপ হয়ে ওঠে সাম্যবাদী ও বিদ্রোহী। বাংলা ভাষার যে গীতলতা, সাংগীতিকতা, নজরুলের আবির্ভাবের পূর্বে সেটাকেই তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু নজরুল তাঁর রচনার মাধ্যমে এই ভাষার অগ্নিমূর্তির রূপটি বের করে আনেন। বস্তুত, বিদ্রোহী কবিতাটি রচিত হওয়ার আগে বাংলা ভাষার এ রকম তেজস্বী ভঙ্গি কল্পনাতীত ছিল। শান্তশিষ্ট গ্রাম্য বালিকার মতোই ছিল তার চলন। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জীবন ও সাহিত্যকে পৃথকভাবে দেখেননি। সাহিত্যচর্চা ছিল তাঁর যাপনেরই অনুষঙ্গ। শক্তিমান প্রাবন্ধিক যতীন সরকার নজরুলের জীবন ও সাহিত্যকে চিহ্নিত করেছেন একজন অনুসন্ধানী বিশ্লেষকের চোখ দিয়ে। কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে লেখা বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে এই বিচিত্রবিধ বিচার বিবেচনা বইয়ের। নজরুল সম্পর্কে নির্মোহ মূল্যায়নের জন্য প্রবন্ধগুলো গুরুত্বপূর্ণ। যতীন সরকারের প্রবন্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর সহজবোধ্যতা, যে কারণে সব শ্রেণীর পাঠকই তাঁর লেখা থেকে লাভবান হতে পারেন। বিচিত্রবিধ বিচার বিবেচনা বইয়ে নানা বিষয়ে মোট ২৬টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে চমৎকার দুটো প্রবন্ধ রয়েছে প্রথমেই। লেখক সেখানে দেখান প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কীভাবে এই সম্পর্ককে রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় জাহির করে। অবশ্য তাদের সেই হাস্যকর প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত টেকে না। বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীকে নিয়ে নাতিদীর্ঘ রচনাটিও বেশ তথ্যপূর্ণ ও চমকপ্রদ। ময়মনসিংহের এই জনপ্রিয় কবির অনেক অজানা গল্প লেখক আমাদের সামনে তুলে ধরেন। চন্দ্রাবতী ময়মনসিংহের পূর্বভাগে এমন পরিচিত ছিলেন যে তাঁকে সর্বসাধারণের প্রাণের কবি বলা হতো। অথচ তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের মানুষ অনেক দিন পর্যন্ত এই কবির কোনো খোঁজখবরই রাখতেন না। ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মধ্যবিত্তের আত্মসমালোচনা’ প্রবন্ধে লেখক স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানাবিধ ধারণা ও উপলব্ধি তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কার্যকলাপ, বিভিন্ন সময়ে তাদের ভূমিকা এবং এসবের সমান্তরালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সক্রিয়তার রূপরেখাটি চিহ্নিত করেছেন তিনি। ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধই মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামের প্রবন্ধটি সংক্ষিপ্তাকারের হলেও এর বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সারা পৃথিবীতে শান্তিকামী মানুষের আসল শত্রুমিত্র যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, লেখক তারই স্বরূপটি উন্মোচন করেছেন এখানে। ‘কম্যুনিস্ট থেকে রিয়ালিস্ট’ প্রবন্ধে এ দেশের কমিউনিস্টদের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করেছেন লেখক। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং কাজের ফারাক, সেই সঙ্গে প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধিতে তাদের ব্যর্থতা আলোচিত হয়েছে এখানে। লেখক দেখান একটি গণতান্ত্রিক শক্তি কীভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর স্বৈরাচারী শক্তিতে পাল্টে যায়। তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাসের বিশ্লেষণ এবং তার নিষিদ্ধ হওয়ার বাস্তবতা নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি আমাদের নানামুখী চিন্তার জায়গাটা প্রসারিত করে, একই ঘটনা পৃথকভাবে ভাবতে উৎসাহিত করে। রাষ্ট্র কর্তৃক একজন লেখকের ওপর আরোপিত সেন্সরের বিষয়টি কতটা যৌক্তিক এবং লেখকের প্রকৃত স্বাধীনতা কেমন হওয়া উচিত, তারই একটি দিকনির্দেশনা এ লেখাটি। তবে সব ক্ষেত্রেই যতীন সরকারের বিশ্লেষণী ভঙ্গি, অনুসন্ধানী দৃষ্টি ও যৌক্তিক শৃঙ্খলা পাঠকের চিন্তাকে উসকে দেয়। ভাষাভঙ্গির সহজতার কারণে জটিলতম বিষয়ও উপভোগ্য করে তোলেন এই শক্তিমান প্রাবন্ধিক।

No comments

Powered by Blogger.